জিঞ্জির
কাজী নজরুল ইসলাম


                    নওরোজ

রূপেরে সওদা কে করিবি তোরা আয় রে আয়,
        নওরোজের         এই মেলায়!
            ডামাডোল আজি চাঁদের হাট
            লুট হল রূপ হল লোপাট!
        খুলে ফেলে লাজ শরম-টাট
                    রূপসিরা সব রূপ বিলায়
        বিনি-কিম্মতে হাসি-ইঙ্গিতে হেলাফেলায়
                নওরোজের     এই মেলায়!

শাজাদা উজির নওয়াব-জাদারা – রূপকুমার
       এই মেলার           খরিদ-দার!
            নও-জোয়ানীর জহুরি ঢের
            খুঁজিছে বিপণি জহরতের,
            জহরত নিতে – টেড়া আঁখের
                        জহর কিনিছে নির্বিকার!
        বাহানা করিয়া ছোঁয় গো পিরান জাহানারার
                    নওরোজের         রূপকুমার!

ফিরি করে ফেরে শা-জাদি বিবি ও বেগম সাব
        চাঁদ-মুখের         নাই নেকাব?
                শূন্য দোকানে পসারিনি
                কে জানে কী করে বিকি-কিনি!
                চুড়ি-কঙ্কণে রিনিঠিনি
                        কাঁদিছে কোমল কড়ি রেখাব।
        অধরে অধরে দর-কষাকষি–নাই হিসাব!
                হেম-কপোল   লাল গোলাব।

হেরেম-বাঁদিরা দেরেম ফেলিয়া মাগিছে দিল,
        নওরোজের         নও-মফিল!
            সাহেব গোলাম, খুনি আশেক,
            বিবি বাঁদি, –সব আজিকে এক!
            চোখে চোখে পেশ দাখিলা চেক
                    দিলে দিলে মিল এক সামিল।
বে-পরওয়া আজ বিলায় বাগিচা ফুল-তবিল!
                    নওরোজের    নও-মফিল!

ঠোঁটে ঠোঁটে আজ মিঠি শরবত ঢাল উপুড়,
            রণ-ঝনায়         পায় নূপুর।
                কিসমিস-ছেঁচা আজ অধর,
                আজিকে আলাপ ‘মোখতসর’!
                কার পায়ে পড়ে কার চাদর,
                        কাহারে জড়ায় কার কেয়ূর,
        প্রলাপ বকে গো কলাপ মেলিয়া মন-ময়ূর,
                        আজ দিলের নাই সবুর।

আঁখির নিক্তি করিছে ওজন প্রেম দেদার
        ভার কাহারা             অশ্রু-হার।
            চোখে চোখে আজ চেনাচেনি,
            বিনি মূলে আজ কেনাকেনি,
            নিকাশ করিয়া লেনাদেনি
                        ‘ফাজিল কিছুতে কমে না আর!
        পানের বদলে মুন্না মাগিছে পান্না-হার!
                        দিল সবার ‘বে-কারার!  

সাধ করে আজ বরবাদ করে দিল সবাই
        নিমখুন কেউ         কেউ জবাই!
                লিকপিক করে ক্ষীণ কাঁকাল,
                পেশোয়াজ কাঁপে টালমাটাল,
                গুরু ঊরু-ভারে তনু নাকাল,
                            টলমল আঁখি জল-বোঝাই!
        হাফিজ উমর শিরাজ পালায়ে লেখে ‘রুবাই’!
                            নিমখুন কেউ কেউ জবাই!

শিরী লায়লিরে খোঁজ ফরহাদ খোঁজে কায়েস
        নওরোজের         এই সে দেশ!
                ঢুড়েঁ ফেরে হেথা যুবা সেলিম
                নূরজাহানের দূর সাকিম,
                আরংজিব আজ হইয়া ঝিম
                        হিয়ায় হিয়ায় চাহে আয়েস!
        তখ‍‍ত-তাউস কোহিনূর কারও নাই খায়েশ,
                        নওরোজের এই সে দেশ!  

গুলে-বকৌলি ঊর্বশীর এ চাঁদনি-চক,
        চাও হেথায়         রূপ নিছক।
            শারাব সাকি ও রঙে রূপে
            আতর লোবান ধুনা ধূপে
            সয়লাব সব যাক ডুবে,
                    আঁখি-তারা হোক নিষ্পলক।
চাঁদো মুখে আঁকো কালো কলঙ্ক তিল-তিলক।
                    চাও হেথায় রূপ নিছক!

হাসিস-নেশায় ঝিম মেরে আছে আজ সকল
        লাল পানির         রংমহল।
            চাঁদ-বাজারে এ নওরোজের
            দোকান বসেছে মোমতাজের
            সওদা করিতে এসেছে ফের
                        শাজাহান হেথা রূপ-পাগল।
        হেরিতেছে কবি সুদূরের ছবি ভবিষ্যতের তাজমহল–
                        নওরোজের স্বপ্ন-ফল!

কৃষ্ণনগর,
১৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৪