মরুভাস্কর
খোর্মা খেজুরে মরু-কানন
ফলবতী হলুদ-রং
কাজী নজরুল ইসলাম
প্রথম সর্গ
অবতরণিকা
জেগে ওঠ তুই রে ভোরের পাখি নিশি-প্রভাতের কবি!
লোহিত সাগরে সিনান করিয়া উদিল আরব-রবি
ওরে ওঠ তুই, নূতন করিয়া বেঁধে তোল তোর বীণ!
ঘন আঁধারের মিনারে ফুকারে আজান মুয়াজ্জিন ।
কাঁপিয়া উঠিল সে ডাকের ঘোরে গ্রহ, রবি, শশী, ব্যোম,
ঐ শোন শোন 'সালাতের’ ধ্বনি ‘খায়রুমমিনান্নৌম !’
রবি-শশী-গ্রহ-তারা ঝলমল গগনাঙ্গনতলে
সাগর ঊর্মি-মঞ্জীর পায়ে ধরা নেচে নেচে চলে।
তটিনী-মেখলা নটিনি ধরার নাচের ঘূর্ণি লাগে
গগনে গগনে পাবকে পবনে শস্যে কুসুম-বাগে।
সে আজান শুনি থমকি দাঁড়ায় বিশ্ব-নাচের সভা,
নিখিল-মর্ম ছাপিয়া উঠিল অরুণ জ্যোতির জবা।
দিগ্দিগন্ত ভরিয়া উঠিল জাগর পাখির গানে,
ভূলোক দ্যুলোক প্লাবিয়া গেল রেআকুল আলোর বানে!
আরব ছাপিয়া উঠিল আবার ব্যোমপথে ‘দীন’‘দীন’,
কাবার মিনারে আবার আসিল নবীন মুয়াজ্জিন!
ওরে ওঠ তোরা, পশ্চিমে ওই লোহিত সাগর জল
রঙে রঙে হল লোহিততর রে লালে-লাল ঝলমল।
রঙ্গে ভঙ্গে কোটি তরঙ্গে ইরানি দরিয়া ছুটে,
পূর্ব-সীমায়,– সালাম জানায় আরব-চরণে লুটে।
দখিনে ভারত-সাগরে বাজিছে শঙ্খ, আরতি ধ্বনি,
উদিল আরবে নূতন সূর্য–মানব-মুকুট-মণি।
উত্তরে চির-উদাসিনী মরু, বালুকা-উত্তরীয়
উড়ায়ে নাচিয়া নাচিয়া গাহিছে– ‘জাগো রে, অমৃত পিয়ো!’
লু হাওয়া বাজায় সারেঙ্গি বীণ খেজুর পাতার তারে,
বালুর আবির ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে স্বর্গে গগন-পারে।
খুশিতে বেদানা-ডালিম ডাঁসায়ে ফাটিয়া পড়িছে ভুঁয়ে,
ঝরে রসধারা নারঙ্গি শেউ আপেল আঙুর চুঁয়ে।
আরবি ঘোড়ারা রাশ নাহি মানে আশমানে যাবে উঠি,
মরুর তরণি উটেরা আজিকে সোজা পিঠে চলে ছুটি।
বয়ে যায় ঢল ধরে নাকো জল আজি ‘জমজম’ কূপে,
‘সাহারা’ আজিকে উথলিয়া ওঠে অতীত সাগর রূপে
পুরাতন রবি উঠিল না আর সেদিন লজ্জা পেয়ে,
নবীন রবির আলোকে সেদিন বিশ্ব উঠিল ছেয়ে।
চক্ষে সুরমা বক্ষে ‘খোর্মা’ বেদুইন কিশোরীরা
বিনি কিম্মতে বিলাল সেদিন অধর চিনির শিরা!
‘ঈদ’ উৎসব আসিল রে যেন দুর্ভিক্ষের দিনে,
যত ‘দুশমনি’ ছিল যথা নিল ‘দোসতি’ আসিয়া জিনে।
নহে আরবের, নহে এশিয়ার,– বিশ্বে সে একদিন,
ধূলির ধরার জ্যোতিতে হল গো বেহেশ্ত জ্যোতিহীন!
ধরার পঙ্কে ফুটিল গো আজ কোটিদল কোকনদ,
গুঞ্জরি ওঠে বিশ্ব-মধুপ– ‘আসিল মোহাম্মদ!’
*
*
*
অভিনব নাম শুনিল রে
ধরা সেদিন – ‘মোহাম্মদ!’
এতদিন পরে এল ধরার
‘প্রশংসিত ও প্রেমাস্পদ!’
চাহিয়া রহিল সবিস্ময়
ইহুদি আর ইশাই সব,
আসিল কি ফিরে এতদিনে
সেই মসিহ্ মহামানব?
‘তওরাত’'ইঞ্জিল’ ভরি
শুনিল যাঁর আগমনি,
‘ইশা’ ‘মুসা’ আর ‘দাউদ’ যাঁর
শুনেছিল পা-র ধ্বনি,
সেই সুন্দর দুলাল আজ
আসিল কি নীরব পায়?
যেমন নীরবে আসে তপন
পূর্ণ চাঁদ পুব-সীমায়।
এমনই করিয়া ওঠে রবি
ওঠে রে চাঁদ, ধরা তখন
এমনই করিয়া ঘুমায়ে রয়
রবি শশী হেরে স্বপন।
আলোকে আলোকে ছায় দিশি
নব অরুণ ভাঙে রে ঘুম,
তন্দ্রালু সব আঁখি-পাতায়
বন্ধুপ্রায় বুলায় চুম।
তেমনই মহিমা সেই বিভায়
আসিল আজ আলোর দূত,
ঝরনার সুরে পাখিরা গায়,
আতর গায় বয় মারুত।
শুষ্ক সাহারা এত সে যুগ
হেরেছে রে যার স্বপন,
বেহেশ্ত হতে নামিল ওই
সেই সুধার প্রস্রবণ।
মরুর শিয়রে বাজে রে ওই
জলধারার মেঘ-মৃদং!
শোনেনি বিশ্ব কভু যে নাম –
‘মোহাম্মদ’ শুনে সে আজ
সেই সে নাম অবিশ্রাম
একী মধুর, একী আওয়াজ!
আঁধার বিশ্বে যবে প্রথম
হইল রে সূর্যোদয়
চেয়েছিল বুঝি সকল লোক
এই সে রূপ সবিস্ময়!
এমনই করিয়া নবারুণের
করিল কি নামকরণ,
সে আলোক-শিশু এমনই রে
হরি আঁধার হরিল মন!
এমনই সুখে রে সেই সেদিন
বিহগ সব গাহিল গান,
শাখায় প্রথম ফুটিল ফুল,
হল নিখিল শ্যামায়মান।
গুলে গুলে শাড়ি গুলবাহার
পরি সেদিন ধরণি মা
আঁধার সূতিকাবাস ত্যজি
হেরে প্রথম দিক্সীমা।
ফুলবন লুটি, খোশখবর
দিয়ে বেড়ায় চপল বায়,
‘ওরে নদ নদী ওরে নিঝর
ছাড়ি পাহাড় ছুটিয়া আয়।
সাগর! শঙ্খ বাজা রে তোর,
আসিল ওই জ্যোতিষ্মান,
একী আনন্দ একী রে সুখ
এল আলোর একী এ বান!’
ফুলের গন্ধ, পাখির গান
স্পর্শসুখ ভোর হাওয়ার,
জানিল বিশ্ব সেই সেদিন,
সেই প্রথম; আজ আবার
আঁধার নিখিলে এল আবার
আদি প্রাতের সে সম্পদ
নূতন সূর্য উদিল ওই –
মোহাম্মদ ! মোহাম্মদ !