ভাষাংশ
|
কাজী
নজরুল ইসলাম
|
কাজী নজরুল ইসলামের
রচনাসংগ্রহের সূচি
১৫১. তাল: দাদ্রা
তুমি আমায় যবে জাগাও গুণী তোমার উদার সঙ্গীত
মোর হাত দু’টি
হয় লীলায়িত নমস্কারের ভঙ্গিতে\
সিন্ধু জলের জোয়ার সম, ছন্দ নামে অঙ্গে মম
রূপ হলো মোর নিরুপম তোমার প্রেমের অমৃতে\
আমার আঁখির পল্লবদল উদাস অশ্রুভারে,
ভোরের করুণ তারার মতো কাঁপে বারেবারে।
আনন্দে ধীর বসুন্ধরা, হলো চপল নৃত্যপরা
ঝরে রঙের পাগল ঝোরা তোমার চরণ রঞ্জিতে\
১৫২. তাল: কাহার্বা
ওগো তারি তরে মন কাঁদে হায়, যায় না যারে পাওয়া
ফুল ফোটে না যে কাননে, কাঁদে দখিন হাওয়া\
যে মায়া-মৃগ পালিয়ে বেড়ায়
কেন এ মন তার পিছে ধায়
যে দ’লে
গেল পায়ে আমায় কেন তাহারি পথ চাওয়া\
যে আমারে ভুলে হলো সুখি যায় না তারে ভোলা,
যে ফিরিবে না আর, তারি তরে রাখি দুয়ার খোলা।
মৌন পাষাণ যে দেবতা
হেলার ছলে কয় না কথা
তারি দেউল দ্বারে কেন বন্দনা-গান গাওয়া\
১৫৩. তাল: দাদ্রা
তুমি কেন এলে পথে
ঝরা মল্লিকা ভাসাইতেছিনু
একাকিনী নদী-স্রোতে\
কলসি আমার অলস খেলায়
ধীর তরঙ্গে যদি ভেসে’
যায়
তীরে সে কলসি তুলে’
আনো তুমি
কেন নদী’
জল হ’তে\
আমার নিরালা বনে
আমি গাঁথি হার, তুমি গান গাহি’
ধ্যান ভাঙো অকারণে।
আমি মুখ হেরি’
আরশিতে একা
তুমি সে মুকুরে কেন দাও দেখা
বাতায়নে চাহি’
তুমি কেন হাসো
আসিয়া চাঁদের রথে\
১৫৪. তাল: কাহার্বা
তুমি কি দখিনা পবন
দুলে ওঠে দেহলতা
ফুলে ফুলে ফুল্ল হয়ে ওঠে মন\
অন্তর সৌরভে শিহরে
কথার কোয়েলিয়া কুহরে
তনু অনুরঞ্জিত করে গো পীতির পলাশ রঙ্গন\
কী যেন মধু জাগে হিয়াতে
চাহি’
যেন সেই মধু কোন্ চাঁদে পিয়াতে।
ফুটাইয়া ফুল কোথা চলে যাও
হুতাস নিশাসে কী ব’লে
যাও
মধু পান করি না কো র’চে
যাই শুধু মধু-বন\
১৫৫. রাগ: মাঢ়, তাল: কাহার্বা
পরদেশী বঁধু!ঘুম ভাঙায়ো চুমি’
আঁখি
যদি গো নিশীথ জেগে ঘুমাইয়া থাকি।
আমি ঘুমাইয়া থাকি
ঘুম ভাঙায়ো চুমি’
আঁখি\
যদি দীপ নেভে গো কুটিরে
বাতায়ন-পানে চাহি’
যেয়ো না গো ফিরে’,
নিভেছে আঁখি শিখা প্রাণ আছে বাকি
আজো প্রাণ আছে বাকি
ঘুম ভাঙায়ো চুমি’
আঁখি\
১৫৬. তাল: দাদ্রা
ফিরে এসো, ফিরে এসো প্রিয়তম
তেমনি চাহিয়া আছে নিশীথের তারাগুলি।
লতা-নিকুঞ্জে কাঁদে আজো বন-বুলবুলি\
ঘুমায়ে পড়েছে সবে, মোর ঘুম নাহি আসে
তুমি যে ঘুমায়েছিলে সেদিন আমার পাশে
সাজানো সে গৃহ তব, ঢেকেছে পথের ধূলি\
আমার চোখের জলে মুছে যায় পথ-রেখা
রোহিণী গিয়াছে চলি’
চাঁদ কাঁদে একা-একা
কোন দূর-তারালোকে কেমনে রয়েছ ভুলি’\
১৫৭. তাল: কাহার্বা
বরষা ঋতু এলো এলো বিজয়ীর সাজে
বাজে গুরু গুরু আনন্দ ডম্বরু অম্বর মাঝে\
বাঁকা বিদ্যুৎ তরবারি ঘন ঘন চমকায়
হানে তীর বৃষ্টি অবিরল ধারায়
শুনি’
রথ-চক্রের ধ্বনি অশনির রোলে
সিন্ধু তরঙ্গে মঞ্জির বাজে\
ভীত বন-উপবন লুটায়ে
প্রণতি জানায় সেই বিজয়ীর পায়ে।
তার অশান্ত গতিবেগ শুনি’
পুব হাওয়াতে
চলে মেঘ-কুঞ্জর-সেনা তারি সাথে
তূণীর কেতকীর জল-ধনু হাতে
চঞ্চল দুরন্ত গগনে বিরাজে\
১৫৮. তাল: কাহার্বা
ভোরে স্বপনে কে তুমি দিয়ে দেখা, লুকালে সহসা
মোর তপনের রাঙা কিরণ যেন ঘিরিল তমসা\
না ফুটিতে মোর কথার কুঁড়ি
চপল বুলবুলি গেলে উড়ি’
গেলে ভাসিয়া ভোরের সুর যেন বিষাদ অলসা\
জেগে দেখি হায়, ঝরা ফুলে আছে ছেয়ে তোমার পথতল,
ওগো অতিথি, কাঁদিছে বনভূমি ছড়ায়ে ফুল দল!
মুখর আমার গানের পাখি
নীরব হলো হায় বারেক ডাকি’
যেন ফাগুনের জোছনা-বর্ষিত রাতে নামিল বরষা\
১৫৯. তাল: ত্রিতাল
ভবনে আসিল অতিথি সুদূর।
সহসা উঠিল বাজি’
রুমু রুমু ঝুম্
নীরব অঙ্গনে চঞ্চল নূপুর\
মুহু-মুহু বন-কুহু বোলে
দোয়েল তমাল-ডালে দোলে;
মেঘের ধ্যান ভুলি’
চমকি’
আঁখি খোলে
‘কে-গো-কে’
বলে বন-ময়ুর\
দগ্ধ হিয়ার জ্বালা জুড়ায়ে
সজল মেঘের শীতল চন্দন কে দিল বুলায়ে?
বকুল-কেয়া-বীথি হ’তে
ছুটে এলো সমীরণ চঞ্চল স্রোতে
চাঁদিনী নিশীথের আবেশ আনে
মিলন তন্দ্রাতুর অলস-দুপুর\
১৬০. তাল: কাহারবা
মোরা কুসুম হয়ে কাঁদি কুঞ্জবনে
সুন্দর শ্যাম হে
আমি মরিতে চাহি ঝরি’
তব চরণে
সুন্দর শ্যাম হে।
ওগো সুন্দর শ্যাম হে\
মোর ক্ষণিক এ জীবন নিশি শেষে
প্রিয় ঝ’রে
যাবে গো স্রোতে ভেসে’
বঁধু কাছে এসে ছুঁয়ো ভালোবেসে
জাগায়ো প্রেম-মধু গোপন মনে
সুন্দর শ্যাম হে\
তব সরস পরশ দিয়ে মনোহর
মোর এ তনু রঙে রসে পূর্ণ করো
আমি তোমার বুকে রবো পরম সুখে
ঝরিব প্রিয়, চাহি’
তব নয়নে
সুন্দর শ্যাম হে\
মোর বিদায় বেলা ঘনায়ে আসে
মোর প্রাণ কাঁদে মিলন-পিয়াসে
এই বিরহ মম ওগো প্রিয়তম,
মিটিবে সে কোন্ শুভ লগনে,
সুন্দর শ্যাম হে\
১৬১. তাল:দাদ্রা
মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল\
কণ্ঠে তোমার পরাব বালিকা
হংস-সারির দুলানো মালিকা
বিজলি জরীণ ফিতায় বাঁধিব মেড়ঘ রঙ এলো চুল\
জোছনার সাথে চন্দন দিয়ে মাখাব তোমার গায়
রামধনু হতে লাল রঙ ছানি’
আল্তা পরাব পায়।
আমার গানের সাত সুর দিয়া
তোমার বাসর রচিব প্রিয়া
তোমারে ঘেরিয়া গাহিবে আমার কবিতার বুলবুল।
১৬২. তাল: কাহারবা
মোরে ভালোবাসায় ভুলিয়ো না
পাওয়ার আশায় ভুলিয়ো
মোরে আদর দিয়ে দুলিয়ো না
আঘাত দিয়ে দুলিয়ো\
হে প্রিয় মোর একি মোহ
এ প্রাণ শুধু চায় বিরহ
তুমি কঠিন সুরে বেঁধে আমায়
সুরের লহর তুলিয়ো\
বঁধু শান্তি চাহে জুড়াতে সব
আমি চাহি পুড়িতে
সুখের ঘরে আগুন জ্বেলে’
পথে পথে ঝুরিতে;
বঁধু পথে পথে ঝুরিতে।
নগ্ন দিনের আলোকেতে
চাহি না তোমায় ব’ক্ষে
পেতে
তুমি ঘুমের মাঝে স্বপনেতে
হৃদয়-দুয়ার খুলিয়ো\
১৬৩. রাগ:কৌশী, তাল: ত্রিতাল
শ্মশানে জাগিছে শ্যামা
অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে
জননী শান্তিময়ী বসিয়া আছে ঐ
চিতার আগুন ঢেকে স্নেহ-আঁচলে\
সন্তানে দিতে কোল ছাড়ি’
সুখ কৈলাস
বরাভয় রূপে মা শ্মশানে করেন বাস,
কি ভয় শ্মশানে শান্তিতে যেখানে
ঘুমাবি জননীর চরণ-তলে\
জ্বলিয়া মরিলি কে সংসারে জ্বালায়
তাহারে ডাকিছে মা
‘কোলে
আয়, কোলে আয়’
জীবনে শ্রান্ত ওরে ঘুম পাড়াইতে তোরে
কোলে তুলে নেয় মা মরণেরি ছলে\
১৬৪. তাল: দাদ্রা
কথা কও, কও কথা, থাকিও না চুপ ক’রে।
মৌন গগনে হের কথার বৃষ্টি ঝরে\
ধীর সমীরণ নাহি যদি কহে কথা
ফোটে না কুসুম, নাহি দোলে বনলতা।
কমল মেলে না দল, যদি ভ্রমর না গুঞ্জরে\
শোন কপোতীর কাছে কপোত কি কথা কহে
পাহাড়ের ধ্যান ভাঙি’
মুখর ঝর্না বহে।
আমার কথার লঘু মেঘগুলি হায়!
জ’মে
হিমু হয়ে যায় তোমার নীরবতায়;
এসো আরো কাছে এসো কথার নূপুর প’রে\
১৬৫. তাল: দাদ্রা
তুমি শুনিতে চেয়ো না আমার মনের কথা
দখিনা বাতাস ইঙ্গিতে বোঝে
কহে যাহা বনলতা\
চুপ ক’রে
চাঁদ সুদূর গগনে
মহা-সাগরের ক্রন্দন শোনে,
ভ্রমর কাঁদিয়া ভাঙিতে পারে না
কুসুমের নীরবতা\
মনের কথা কি মুখে সব বলা যায়?
রাতের আঁধারে যত তারা ফোটে
আঁখি কি দেখিতে পায়?
পাখায় পাকায় বাঁধা যবে রয়
বিহগ-মিথুন কথা নাহি কয়,
মধুকর যবে ফুলে মধু পায়
রহে না চঞ্চলতা\
১৬৬. তাল:কাহার্বা
যুগ যুগ ধরি’
লোকে-লোকে মোর
প্রভুরে খুঁজিয়া বেড়াই;
সংসারে গেহে, প্রীতি ও স্নেহে
আমার স্বামী বিনে সুখে নাই\
তাঁর চরণ পাবার আশা ল’য়ে
মনে
ফুটিলাম ফুল হয়ে কত বার বনে,
পাখি হয়ে তাঁর নাম
শত বার গাহিলাম
তবু হায় কভু তাঁর দেখা নাহি পাই\
গ্রহ-তারা হয়ে খুঁজেছি আকাশে,
দিকে দিকে ছুটেছি মিশিয়া বাতাসে,
পর্বত হয়ে নাম
কোটি যুগ ধিয়ালাম,
নদী হয়ে কাঁদিলাম খুঁজিয়া বৃথাই\
১৬৭. রাগ:ভূপালী মিশ্র, তাল: কাহার্বা
দোলে প্রাণের কোলে প্রভুর নামের মালা।
সকাল সাঁঝে সকল কাজে জপি সে নাম নিরালা\
সেই নাম বসন-ভূষণ আমারি
সেই নামে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারি,
সেই নাম লয়ে বেড়াই কেঁদে’
সেই নামে আবার জুড়াই জ্বালা\
সেই নামেরই নামাবলী গ্রহ-তারা রবি-শশী দোলে গগন-কোলে।
মধুর সেই নাম প্রাণে সদা বাজে,
মন লাগে না সংসার-কাজে,
সে নামে সদা মন মাতোয়ালা\
আদর-সোহাগ, মান-অভিমান আপন মনে তার সাথে;
কাঁদায়ে কাঁদি, পায়ে ধ’রে
সাধি,
কভু করি পূজা, কভু বুকে বাঁধি,ড়
আমার স্বামী সে ভুবন-উজালা\
১৬৮. তাল: কাহার্বা
ফুট্লো যেদিন ফাল্গুনে, হায়, প্রথম গোলাপ-কুঁড়ি
বিলাপ গেয়ে বুলবুলি মোর গেল কোথায় উড়ি\
কিসের আশায় গোলাপ বনে
গাইতো সে গান আপন মনে,
লতার সনে পাতার সনে খেল্তো লুকোচুরি (হায়)\
সেই লতাতে প্রথম প্রেমের ফুট্লো মুকুল যবে
পালিয়ে গেল ভীরু পাখি অম্নি নীরবে।
বাস্লে ভালো যে-জন কাঁদে
বাঁধবো তা’রে
কোন্ সে ফাঁদে,
ফুল নিয়ে তাই অবসাদে বনের পথে ঘুরি (হায়)\
১৬৯. তাল:কাহার্বা
স্বপন যখন ভাঙবে তোমার দেখবে আমি নাই।
মোরে শূন্য বুকেরি কাছে খুঁজ্বে গো বৃথাই\
দেখবে জেগে’
বাহুর’
পরে
আছে নীরব অশ্রু ঝ’রে
কাছ থেকেও ছিলাম দূরে যাই গো চ’লে
যাই\
কাঁটার মতো ছিলাম বিঁধে আমি তোমার বুকে,
বিদায় নিলাম চিরতরে ঘুমাও তুমি সুখে (ওগো)।
একলা ঘরে জেগে’
ভোরে
হয়তো মনে পড়বে মোরে,
দূরে স’রে
হয়তো পাব অন্তরেতে ঠাঁই\
১৭০. তাল: কাহার্বা
যত ফুল তত ভুল কণ্টক জাগে
মাটির পৃথিবী তাই এত ভালো লাগে\
হেথা চাঁদে আছে কলঙ্ক, সাধে অবসাদ
হেথা প্রেমে আছে গুরুগঞ্জনা অপবাদ:
আছে মান-অভিমান পিরিতি-সোহাগে\
হেথা হারাই ভয়, প্রিয়তমে তাই
ব’ক্ষে
জড়ায়ে কাঁদি ছাড়িতে না চাই।
স্বর্গের প্রেমে নাই বিরহ-অনল
সুন্দর আঁখি আছে, নাই আঁখি-জল;
রাধার অশ্রু নাই কুমকুম-ফাগে\
১৭১. তাল:
যবে ভোরের কুন্দ-কলি মেলিবে আঁখি
ঘুম ভাঙায়ে হাতে বাঁধিও রাখী\
রাতের বিরহ যবে
প্রভাতে নিবিড় হবে
অকরুণ কলরবে গাহিবে পাখি\
যেন অরুণ দেখিতে গিয়া তরুণ কিশোর
তোমারে প্রথম হেরি’
ঘুম ভাঙে মোর।
কবরীর মঞ্জরি
আঙিনায় রবে ঝরি,’
সেই ফুল পায়ে দলি’
এসো একাকী\
১৭২. তাল: দাদ্রা
যত নাহি পাই দেবতা তোমায়, তত কাঁদি আর পূজি।
যতই লুকাও ধরা নাহি দাও, ততই তোমারে খুজি
কত সে রূপের রঙের মায়ায়, আড়াল করিয়া রাখ আপনায়
তবু তব পানে অশান্ত মন কেন ধায় নাহি বুঝি\
কাঁদালে যদি গো এমন করিয়া কেন প্রেম দিলে তবে
অন্তবিহীন এ লুকোচুরির শেষ হবে নাথ কবে?
সহে না হে নাথ বৃথা আসা-যাওয়া-
জনমে জনমে এই পথ চাওয়া
কাঁদিয়া কাঁদিয়া ফুরায়ে গেল চোখের জলের পুঁজি\
১৭৩. তাল: দাদ্রা
হয়ত আমার বৃথা আশা তুমি ফিরে আস্বে না।
আশার তরী ডুব্বে কূলে দুখের স্রোতে ভাসবে না\
হয়তো তুমি এম্নি ক’রে
পথ চাওয়াবে জনম ভ’রে
রইবে দূরে চিরতরে সাম্নে এসে হাস্বে না\
কামনা মোর রইলো মনে রূপ ধ’রে
তা উঠ্লো না;
বারে বারে ঝর্লো মুকুল ফুল হয়ে তা ফুট্লো না।
অবুঝ এ প্রাণ তবু কেন
তোমার ধ্যানে বিভোর হেন
তুমি চির-চপল নিঠুর-জানি, ভালোবাস্বে না\