ভাষাংশ
|
কাজী
নজরুল ইসলাম
|
কাজী নজরুল ইসলামের
রচনাসংগ্রহের সূচি
*৬০১: তাল: কাহার্বা এ কোন্ মধুর শরাব দিলে আল আরাবি সাকি, নেশায় হলাম দিওয়ানা রঙিন হল আঁখি॥ তৌহিদের শিরাজি নিয়ে ডাকলে সবায় যারে পিয়ে, নিখিল জগৎ ছুটে এলো রইল না কেউ বাকি॥ বসলো তোমার মহ্ফিল দূর মক্কা মদিনাতে, আল-কোরানের গাইলে গজল শবে কদর রাতে। নরনারী বাদশা ফকির তোমার রূপে হয়ে অধীর যা ছিল নজ্রানা দিল রাঙা পায়ে রাখি’ *৬০২. তাল: দাদ্রা বনের তাপস কুমারী আমি গো, সখি মোর বনলতা। নীরবে গোপনে দুই জনে কই আপন মনের কথা॥ যবে গিরিপথে ফিরি সিনান করিয়া লতা টানে মোর আঁচল ধরিয়া, হেসে বলি, ওরে ছেড়ে দে, আসিছে তোদের বন-দেবতা॥ ডাকি যদি তারে আদর করিয়া-ওরে বন বল্লরি, আনন্দে তার ফোটা ফুলগুলি অঞ্চলে পড়ে ঝরিল’। লুকায়ে যখন মোর দেবতায় আবরিয়া রাখে কুসুমে পাতায়, চরণে আমার (ও সে) আসিয়া জড়ায় যবে হই ধ্যানরতা॥ *৬০৩. তাল: কাহার্বা যে পাষাণ হানি বারে বারে তুমি আঘাত করেছ, স্বামী, সে পাষাণ দিয়ে তোমার পূজায় এ মিনতি রাখি আমি॥ যে আগুন দিলে দহিতে আমারে হে নাথ, নিভিতে দিইনি তাহারে; আরতি প্রদীপ হয়ে তারি বিভা বুকে জ্বলে দিবা-যামী॥ তুমি যাহা দাও প্রিয়তম মোর তাহা কি ফেলিতে পারি, তাই নিয়ে তব অভিষেক করি নয়নে দিলে যে বারি। ভুলিয়াও মনে কর না যাহারে, হে নাথ, বেদনা দাও না তাহারে, ভুলিতে পারো না মোরে ব্যথা দেওয়া ছলে, তাই নিচে আস নামি’ ॥ *৬০৪. রাগ: কাফি, তাল: কাহার্বা খুশি লয়ে খুশরোজের আয় খেয়ালি খুশ্-নসীব। জ্বাল্ দেয়ালি শবেরাতের জ্বাল রে তাজা প্রাণ-প্রদীপ॥ আন্ নয়া দীনী ফরমান দরাজ দিলের দৃপ্ত গান, প্রাণ পেয়ে আজ গোরস্থান তোর ডাকে জাগুক নকীব॥ আন্ মহিমা হজরতের শক্তি আন্ শেরে খোদার, কুরবানী আন্ কারবালার আন্ রহম মা ফাতেমার, আন্ উমরের শৌর্য বল সিদ্দিকের আন্ সাচ্চা মন, হাসান হোসনের সে ত্যাগ শহীদানের মৃত্যুপণ, রোজ হাসরে করবেন পার মেহেরবান খোদার হাবিব॥ খোৎবা পড়বি মসজিদে তুই খতিব নূতন ভাষায়, শুষ্ক মালঞ্চের বুকে ফুল ফুটাবি ভ ভোর হাওয়ায়, এস্মে-আজম এনে মৃত মুসলিমে তুই কর সজীব॥ *৬০৫. রাগ; ভৈরবী, তাল: কাহার্বা প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই পরি চাঁপা ফুলের শাড়ি খয়েরি টিপ, জাগি বাতায়নে জ্বালি আঁখি প্রদীপ, মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই॥ তুমি আসিবে বলে সুদূর অতিথি জাগে চাঁদের তৃষা লয়ে কৃষ্ণা তিথি, কভু ঘরে আসি কভু বাহিরে চাই॥ আজি আকাশে বাতাসে কানাকানি, জাগে বনে বনে নবফুলের বাণী, আজি আমার কথা যেন বলিতে পাই॥ *৬০৬, রাগ; মাঢ় মিশ্র, তাল: দাদ্রা আয় মরু পারের হাওয়া নিয়ে যা রে মদিনায়- জাত-পাক মুস্তাফার রওজা মুবারক যেথায়॥ মরিয়া আছি দুখে মাশ্রেকী এই মুল্লুকে, পড়ব মাগরিবের নামাজ কবে খানা-এ কাবায়॥ হজরতের নাম তসবি করে যাব রে মিস্কিন বেশে ইসলামের ঐ দ্বীনী ডঙ্কা বাজল প্রথম যে দেশে। কাঁদব ধরে মাজার শরীফ শুনব সেথায় কান পাতি,- নবীর মুখে তেমনি কি রে রব ওঠে এ্যায় উম্মতি। পাক কোরানের কালাম হয়ত সেথা শোনা যায়॥ *৬০৭. তাল: কাহার্বা আল্লাহ রসুল জপের গুণে কি হ’ল দেখ চেয়ে- সদা ঈদের দিনের খুশিতে তোর পরান আছে ছেয়ে॥ আল্লাহ্র রহমত ঝরে ঘরে বাইরে তোর উপরে, আল্লাহ্ রসুল হয়েছেন তোর জীবন-তরীর নেয়ে॥ দুখে সুখে সমান খুশি নাই ভাবনা ভয়, তুই দুনিয়াদারি করিস তবু আল্লাহ্তে মন রয়। মরণকে আর ভয় নাই তোর, খোদার প্রেমে পরান বিভোর, তিনি দেখেন তোর সংসার তোরি ছেলেমেয়ে॥ *৬০৮. রাগ: পিলু-খাম্বাজ, তাল: কাহার্বা আজ নিশীথে অভিসার তোমারি পথে প্রিয়তম। বনের পারে নিরালায় দিও হে দেখা নিরুপম॥ সুদূর নদীর ধারে নিরালাতে বালুচরে চখার তরে যথা একা চখি কেঁদে মরে সেথা সহসা আসিও গোপন প্রিয় স্বপন সম॥ তোমারি আশায় ঘুরি শত গ্রহে শত লোকে, (ওগো) আমারি বিরহ জাগে বিরহী চাঁদের চোখে, আকুল পাথার নিরাশার পারায়ে এসো প্রাণে মম॥ *৬০৯. রাগ; মিশ্র বারোয়াঁ, তাল: দাদ্রা সাঁঝের পাখিরা ফিরিল কুলায় তুমি ফিরিলে না ঘরে, আঁধার ভবন জ্বলেনি প্রদীপ মন যে কেমন করে॥ উঠানে শূন্য কলসির কাছে সারাদিন ধরে ঝ’রে প’ড়ে আছে তোমার দোপাটি গাঁদা ফুলগুলি যেন অভিমান ভরে॥ বাসন্তী রাঙা শাড়িখানি তব ধূলায় লুটায় কেঁদে, তোমার কেশের কাঁটাগুলি বুকে স্মৃতির সমান বেঁধে। যাইনি বাহিরে আজ সারাদিন ঝরিছে বাদল শ্রান্তিবিহীন পিয়া পিয়া ব’লে ডাকিছে পাপিয়া এ বুকের পিঞ্জরে॥ *৬১০. তাল: দাদ্রা ওরে শুভ্রবাসনা রজনীগন্ধা বনের বিধবা মেয়ে, হারানো কাহারে খুঁজিস নিশীথ-আকাশের পানে চেয়ে॥ ক্ষীণ তনুলতা বেদনা-মলিন, উদাস মূরতি ভূষণবিহীন, তোরে হেরি ঝরে কুসুম-অশ্রু বনের কপোল বেয়ে॥ তুই লুকায়ে কাঁদিস রজনী জাগিস সবাই ঘুমায় যবে, বিধাতারে যেন বলিস-দেবতা আমারে লইবে কবে। করুণ শুভ্র ভালোবাসা তোর সুরভি ছড়ায় সারা নিশি ভোর, প্রভাত বেলায় লুটাস ধূলায় যেন-কারে নাহি পেয়ে॥ *৬১১. রাগ: ভৈরবী, তাল: কাহার্বা খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে॥ শূন্যে মহা আকাশে মগ্ন লীলা বিলাসে, ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে॥ তারকা রবি শশী খেলনা তব, হে উদাসী, পড়িয়া আছে রাঙা পায়ের কাছে রাশি রাশি। নিত্য তুমি, হে উদার সুখে দুখে অবিকার; হাসিছ খেলিছ তুমি আপন মনে॥ *৬১২. তাল: দাদ্রা মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যাবেলা- আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এপারে তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা॥ সেই সে বিদায় ক্ষণে শপথ করিলে বন্ধু আমার, রাখিবে আমারে মনে, ফিরিয়া আসিবে খেলিবে আবার সেই পুরাতন খেলা॥ আজো আসিলে না হায়, মোর অশ্রুর লিপি বনের বিহগী দিকে দিকে লয়ে যায়, তোমায়ে খুঁজে না পায়। মোর গানের পাপিয়া ঝুরে গহন কাননে তব নাম লয়ে আজো পিয়া পিয়া সুরে; গান থেমে যায়, হায় ফিরে আসে পাখি বুকে বিঁধে অবহেলা॥ *৬১৩, রাগ; ভৈরবী, তাল: দাদ্রা মোর না মিটিতে আশা ভাঙিল খেলা, জীবন প্রভাতে এলো বিদায় বেলা॥ আঁচলের ফুলগুলি করুণ নয়ানে নিরাশায় চেয়ে আছে মোর মুখপানে, বাজিয়াছে বুকে যেন, কার অবহেলা॥ আঁধারের এলোকেশ দু’হাতে জড়ায়ে যেতে যেতে নিশীথিনী কাঁদে বনছায়ে। বুঝি দুখ-নিশি মোর হবে না হবে না ভোর, ভিড়িবে না কূলে মোর বিরহের ভেলা॥ *৬১৪. তাল: কাহার্বা মালতী মঞ্জরি ফুটিবে যবে অলস বেলায় প্রিয় হে প্রিয় মোরে স্মরিও সেই সন্ধ্যায়॥ ঝরা পল্লবে ফেলি দীরঘ শ্বাস কাঁদিয়া ফিরিবে যবে চৈতী বাতাস, নাগকেশরের ঝরা কেশর দলে খুঁজিও আমায়॥ মল্লিকা মুকুলের প্রথম সুবাস বিরহী পরান যবে করিবে উদাস, পিয়াল নদীর কূলে কাঁদিয়া বাঁশি ডাকিবে প্রিয়ায়॥ *৬১৫. রাগ; আশাবরি, তাল: কাহার্বা নতুন নেশার আমার এ মদ বল কি নাম দেব এর বঁধুয়া। গোগী চন্দন গন্ধ মুখে এর বরণ সোনার চাঁদ চূঁয়া॥ মধু হতে মিঠে পিয়ে আমার মদ গোধূলি রঙ ধরে কাজল নীরদ, প্রিয়েরে প্রিয়তম করে এ মদ মম, চোখে লাগায় নভোনীল ছোঁয়া॥ ঝিম হয়ে আসে সুখে জীবন ছেয়ে, পান্সে জোছনাতে পান্সি চলে বেয়ে, মধুর এ মদ নববধূর চেয়ে আমার মিতালি এ মহুয়া॥ *৬১৬. তাল: কাহার্বা গাছের তলে ছায়া আছে সোঁত নদীর জলে- সেই না সোঁতে এসো বন্ধু ব’স তরুতলে॥ রইবে না এ রূপ বন্ধু রইবে না এ কায়া, অবেলাতে এলে বন্ধু পাবে না তো ছায়া। রূপের কুসুম জলের কমল পড়বে জলে ঢলে রে (বন্ধু)॥ মালঞ্চ মোর একটি দুটি কুসুম ফোটে আজো, সইরা আজো বলে সাঁঝে- বধূর বেশে সাজো। মৌমাছিরা মধু নিয়ে গায়ে এলো ফিরে, বধূর বেশে ফিরতে দেখি পড়শি বৌ-ঝিরে। সিথিতে মোর রইল সিঁদুর, (কেউ) ডাকলো না বউ বলে॥ *৬১৭. রাগ; বারোয়াঁ, তাল: দাদ্রা শ্মশান-কালীর নাম শুনে রে ভয় কে পায়। মা যে আমার শবের মাঝে শিব জাগায়॥ আনন্দেরি নন্দিনী সে শান্তি সুধা কণ্ঠ বিষে মায়ের চরণ শোভে অরুণ আলোর লাল জবায়॥ চার হাতে মা’র চার যুগেরি খঞ্জনি, নৃত্য-তালে নিত্য ওঠে রণ্ঝণি’। মৃতের মাঝে মোর জননী, বিলায় মৃত সঞ্জীবনী মা পায় না ধ্যানে যোগিন্দ্র সেই যোগমায়ায়॥ *৬১৮. তাল: দ্রুত-দাদ্রা ওরে ডেকে দে, দে লো মহুয়া বনে ফুল ফোটাতো বাজিয়ে বাঁশি কে। বনের হরিণ নাচাতো, পাখিকে গান গাওয়াতো, ঢেউ ওঠাতো ঝর্না জলে পাহাড়তলিতে॥ তার গানের কথা জানিয়ে দিত ফুলের মধুকে তার সুরের নেশা করতো ব্যাকুল মনের বঁধুকে, বুকের মাঝে বাজতো নূপুর চপল হাসিতে॥ আঁধার রাতে ফোটাত সে হলুদ গাঁদার ফুল, সে বন কাঁদাতো মন কাঁদাতো, কাজ করাতো ভুল। আর সে বাঁশি শুনি না, ধোঁয়ার ছলে কাঁদি না, রাঙা শাড়ি পরি না, নোটন খোঁপা বাঁধি না- আমি রইতে নারি না হেরে সেই বন উদাসী কে গো॥ *৬১৯. তাল: কাহার্বা আমি শ্যামা বলে ডেকেছিলাম, শ্যাম হ’য়ে তুই কেন এলি। ওমা লীলাময়ী কেমন করে মনের কথা শুনতে পেলি॥ তোরে শৈল-শিরে শিবের সাথে (মা) পূজেছিলাম গভীর রাতে। হেসে কেন কিশোর হয়ে তুই বৃন্দাবনে পালিয়ে গেলি॥ তুই রক্তজবা ফিরিয়ে দিলি (মা) প্রেম চন্দন মুছিয়ে দিয়ে মুক্তি চেয়েছিলাম মা এলি আশির্বাদী মুক্তা নিয়ে। ছিনু তমোগুণে ডুবে (মা), তবু প্রিয়তম হয়ে তুই খেলতে এলি তমাল বনে লয়ে মোর গেরুয়া রাঙা বসন কেড়ে দিলি রাধার সোনার চেলী॥ *৬২০. তাল: কাহার্বা এসো নওল কিশোর এসো এসো, লুকায়ে রাখিব আঁখিতে মম। আমার আঁখির ঝিনুকে বন্দী রহিবে মুকুতা সম॥ তুমি ছাড়া আর এই পৃথিবীতে এ আঁখি কারেও পাবে না দেখিতে, তুমি ও আমারে ছাড়া আর কারেও হেরিবে না প্রিয়তম॥ লুকায়ে রাখিব-ফণিনী যেমন মানিক লুকায়ে রাখে, ঘিরিয়া থাকিব দামিনী যেমন শ্যাম মেঘ ঘিরে থাকে। মেঘ হয়ে আমি হে চাঁদ তোমায় আবরি’ রাখিব আঁখির পাতায়, নিশীথে জাগিয়া কাঁদিব দু’জন প্রিয় হে, চির জনম॥ *৬২১. রাগ; মালকোষ, তাল: তেওড়া মানবতাহীন ভারত শ্মশানে দাও মানবতা হে পরমেশ। কি হবে লইয়া মানবতাহীন ত্রিশ কোটি এই মানুষ মেষ॥ কলের পুতুল এরা প্রাণহীন পাষাণ আত্মা বিশ্বাসহীন, নিজেরে ইহারা চিনে না জানে না, কেমনে চিনিবে নিজের দেশ॥ ভারত শ্মশানে ফেরে প্রেতপাল, নর নাই, শুধু নর-কঙ্কাল; এই চির অভিশপ্তের মাঝে জাগাও হে প্রভু প্রাণের রেশ॥ ভায়ে ভায়ে হেথা নাহি প্রেমবোধ; কেবলি কলহ, কেবলি বিরোধ; হে দেশ-বিধাতা, দূর কর এই লজ্জা ও গ্লানি, এ দীন বেশ॥ *৬২২. তাল: দাদ্রা ভিখারিনী করে পাঠাইলি মোরে, (মাগো) কি দিয়ে পূজিব বল। হাতে আছে শুধু শূন্য প্রণাম, চোখে আছে শুধু জল॥ পূজা ধূপ নাই, চন্দন নাই, মাগো, লাজে মরি দিতে ভয় পাই চুরি করে আনা দুটি জবা ফুল, একটি বিল্বদল॥ তোর ধনী ছেলে মেয়ে ঘটা করে তোর পূজা করে কত রূপে, মাগো ভিখারি মেয়ের বেশে তুই কেন দাঁড়াইলি এসে, মোর কাছে চুপে চুপে কিছু নাই মাগো হাতে দিতে তোর, শুধু নামখানি সম্বল মোর, যদি চাস তুই ঐ রাঙা পায়ে দিব নামের সে শতদল॥ *৬২৩. তাল: কাহার্বা রাঙা পির্হান প’রে শিশু নবী খেলেন পথে। দেখে হুর-পরীরা সব লুকিয়ে বেহেশ্ত্ হ’তে॥ মোহনী সুরত বাঁকা চাঁদে চন্দন মাখা। নূরানী রওশনী তাঁর চমকে দিনের আলোতে॥ নাচের তালে তালে সোনার তাবিজ দোলে, চরণ তলে ধূলি কাঁদে মোহাম্মদ ব’লে। নীল রেশমি রুমাল বাঁধা তাঁর চাঁচর কেশে রাঙা সালোয়ার প’রে নাচে সে হেসে হেসে, খোদার আরশ টলে সে রূপ-সুধা-স্রোতে॥ ৬২৪. তাল: দাদ্রা তুমি বেণুকা বাজাও কার নাম লয়ে শ্যাম- মোর সাধ যায় হরি আমি যদি সেই কিশোরী হইতাম॥ সেই প্রেম মোরে দাও গো শ্রী হরি, যে প্রেমে নেমে আস রূপ ধরি, যে প্রেমে কাঁদো যমুনার তীরে তুলি লয়ে ‘রাধা রাধা’ নাম॥ সেই প্রেম দাও যে প্রেমে ভোল তুমি হে শ্রী ভগবান, রাধার দুয়ারে ভিক্ষা চাহিয়া নিতি সহ অপমান। মোর আঁখি হয়ে উঠুক কমল, দাও প্রিয় মোরে সেই আঁখি জল; দাও সে বিরহ দাও যে বিরহে এই ধরা হয় ব্রজধাম॥ *৬২৫. তাল: দ্রুত-দাদ্রা কালো পাহাড় আলো করে কে ও কে কালো শশী, নিতুই এসে লো বাজায় বাঁশি কদম তলায় বসি॥ সই লো মানা কর্ না ওকে, ও চায় না যেন অমন চোখে, ওর চাউনি দেখে অলপ বয়সে হলাম দোষী॥ গুরুজনের সে ভয় করে না, বাঁকিয়ে ভুরু ডাকে-সে ডাকে, আমারে সে ডাকে। রাতের বেলায় চোরের মত চাহে বেড়ার ফাঁকে। আমি না চাহিলে নূপুর ছুঁড়ে কলসি ভেঙে পালায় দূরে, আমি মরেছি সই প’রে তাহার বনমালার রশি॥ *৬২৬. তাল: দাদ্রা কি নাম ধ’রে ডাকবো তোরে মা তুই দে ব’লে ওমা কি নাম ধরে কাঁদলে পরে ধ’রে তুলিস কোলে (মাগো)॥ বনে খুঁজি মনে খুঁজি পটে দেখি ঘটে পূজি মন্দিরে যাই কেঁদে লুটাই মাগো- পাষাণ প্রতিমা মা তোর একটুও না টলে॥ কোল যদি না দিবি মাগো, আন্লি কেন ভবে, আমি জনম নিয়ে এসেছি যে তোর কোলেরই লোভে। আমি রইতে নারি মা না পেয়ে, মরণ দে মা তাহার চেয়ে এ-ছার জীবনে কোন প্রয়োজন মাগো আমি কোটি বার মা মরতে পারি মা যদি পাই ম’লে॥ *৬২৭. তাল: দাদ্রা আমার হাতে কালি মুখে কালি, মা আমার কালি মাখা মুখ দেখে মা পাড়ার লোকে হাসে খালি॥ মোর লেখা পড়া হ’ল না মা, আমি ‘ম’ দেখতেই দেখি শ্যামা, আমি ‘ক’ দেখতেই কালী ব’লে নাচি দিয়ে করতালি॥ কালো আঁকা দেখে মা ধারাপাতের ধারা নামে আঁখি পাতে, আমার বর্ণ পরিচয় হ’লো না মা তোর বর্ণ বিনা কালী। যা লিখিস মা বনের পাতায় সাগর জলে আকাশ খাতায়, আমি সে লেখা তো পড়তে পারি মূর্খ বলে দিক্ না গালি মা, লোকে মূর্খ ব’লে দিক্ না গালি॥ *৬২৮. তাল: দ্রুত-দাদ্রা রাঙা মাটির পথে লো মাদল বাজে, বাজে বাঁশের বাঁশি, বাঁশি বাজে বুকের মাঝে লো, মন লাগে না কাজে লো, রইতে নারি ঘরে ওলো প্রাণ হলো উদাসী লো॥ মাদলিয়ার তালে তালে অঙ্গ ওঠে দুলে লো, দোল লাগে শাল পিয়াল বনে, নোটন খোঁপার ফুলে লো, মহুয়া বনে লুটিয়ে পড়ে মাতাল চাঁদের হাসি লো॥ চোখে ভাল লাগে যাকে, তাকে দেখব পথের বাঁকে, তার চাঁচর কেশে বেঁধে দেব ঝুমকো জবার ফুল তার গলার মালার কুসুম কেড়ে করব কানের দুল। তার নাচের তালের ইশারাতে বলবো ভালবাসি লো॥ *৬২৯. তাল: দাদ্রা মা তোর কালো রূপের মাঝে রসের সাগর লুকিয়ে আছে, তোর কৃষ্ণ জ্যোতির আড়াল টেনে মোর প্রেমময় কৃষ্ণ নাচে॥ (নাচে, নাচে, নাচে গো) আমি যাঁহার পরম তৃষ্ণা লয়ে কাঁদি (মা), ওমা যোগমায়া সে যে বাজায় বাঁশি তোরই রূপের কদম গাছে॥ আমার অভয় সুন্দরেরে কেন ভয়ের আবরণে রাখলি ঢেকে মাগো, আমি কাঁদব কত এই বিরহের বৃন্দাবনে। ওমা তোর শক্তি যমুনারি তীরে নাম লয়ে মোর শ্যাম যে কেঁদে ফিরে। তুই কোলে করে মেয়েরে তোর নিয়ে যা তাঁর পায়ের কাছে॥ *৬৩০. তাল: দাদ্রা নিশি কাজল শ্যামা আয় মা নিশীথ রাতে। যেমন কালো বাদল নামে নীল আকাশের নয়ন পাতে॥ কুল-কুণ্ডলিনী রূপে ওঠ মা জেগে চুপে চুপে, মা ছেলেতে যাব মা চল্ ভোলানাথের ঘুম ভাঙাতে॥ তোর বরাভয় রূপ দেখায়ে দূর কর্ মা আঁধার ভীতি, কৃষ্ণ চতুর্দশীতে মা দেখা পূর্ণ চাঁদের জ্যোতি। পাতার কোলে কুঁড়ি সম মাগো হৃদয় কমল মম তোর চরণ অরুণ দেখার আশায় রাত্রি জাগে রাতের সাথে॥ ৬৩১. তাল: ফের্তা ত্রিজগত আলো করে আছে কালো মেয়ের পায়ের শোভা। মহাভাবে বিভোর শঙ্কর, ঐ পা জড়িয়ে মনোলোভা॥ দলে দলে গগন বেয়ে গ্রহ তারা এলো ধেয়ে, ঐ চরণ শোভা দেখবে বলে, ঐ পায়ের নূপুর হওয়ার ছলে সেই শোভা কেমন বলতে গিয়ে ব্রহ্ম হলো চির মৌনী বোবা॥ ঐ চরণ শোভা দেখার তরে, যোগী থাকেন ধেয়ান ধ’রে ত্রিভুবন ভুলে অনন্তকাল যোগী থাকেন ধেয়ান ধ’রে। ও শুধু চরণ শোভা নয়, ঐ যে পরব্রহ্ম জ্যোতি শ্রী চণ্ডী বেদ পুরানে ওরি প্রেম-আরতি মা দেখ্তো যদি নিজের চরণ নিজেই দিত বিল্বজবা আপনার ঐ রাঙা পায়ে নিজেই দিত বিল্বজবা॥ *৬৩২. রাগ; সিন্ধুড়া/বারোয়াঁ, তাল: ত্রিতাল আজো বোলে কোয়েলিয়া চাঁপাবনে প্রিয় তোমারি নাম গাহিয়া॥ তব স্মৃতি ভোলেনি চৈতালি সমীরণ, আজো দিকে দিকে খুঁজে ফেরে কাঁদিয়া॥ নিশীথের চাঁদ আজো জাগে ওগো চাঁদ, তব অনুরাগে। জল ধারা উথলে যমুনার সৈকতে খোঁজে তরুলতা ফুল আঁখি মেলিয়া॥ *৬৩৩. তাল: দ্রুত-দাদ্রা তেপান্তরের মাঠে বঁধু হে একা বসে থাকি। তুমি যে পথ দিয়ে গেছ চলে তারি ধূলা মাখি’ হে॥ যেমন পা ফেলেছ গিরিমাটির রাঙা পথের ধূলাতে, অমনি করে আমার বুকে চরণ যদি বুলাতে, আমি খানিক জ্বালা ভুলতাম ঐ মানিক বুকে রাখি’ হে॥ আমার খাওয়া পরার নাই রুচি, আর ঘুম আসে না চোখে হে, আমি আউরী হয়ে বেড়াই পথে, হাসে পাড়ার লোকে দেখে হাসে পাড়ার লোকে। আমি তাল পুকুরে যেতে নারি-একি তোমার মায়া হে, আমি কালো জলে দেখি তোমার কালো রূপের ছায়া হে; আমার কলঙ্কিনী নাম রটিয়ে তুমি দিলে ফাঁকি হে॥ *৬৩৪. তাল: ফের্তা (দাদ্রা ও কাহার্বা) সখি বল্ কোন্ দেশে যাই। সে বৃন্দা আছে সে বন আছে তবু সে বৃন্দাবন নাই- গোবিন্দ বিনে লো বৃন্দে (বৃন্দে গো) রাধার বৃন্দাবন হয়েছে আঁধার। বনে সীতার ছিল যে রাম, মোর বনে নাই ঘনশ্যাম। আমি কি লয়ে থাকি, কেন দেহ রাখি। পিঞ্জর আছে প’ড়ে নাই শ্যাম পাখি, আর ময়ূর ডাকে না ‘কে গো’ বলিয়া। পাপিয়া ডাকে না পিয়া। কৃষ্ণ প্রিয়া গো ‘প্রিয়া প্রিয়া’ বলে পাপিয়া ডাকে না পিয়া। পথে পথে আর রহে না গো ব্রজগোপিনী আড়ি পাতিয়া। আজি রাধার সাথে সবার আড়ি, কৃষ্ণ প্রিয়ার কৃষ্ণ গেছে ছাড়ি’ তাই রাধার সাথে সবার আড়ি, সখি গো- শুকায়ে গিয়াছে দ্বাদশ কুঞ্জ, পূর্ণ চাঁদেরি ব্রজে একাদশীর তিথি, হয়ত আবার বাজিবে বেণু তার রবে না ব্রজে যবে রাধার স্মৃতি॥ *৬৩৫. তাল: কাহার্বা ও কালো শশী রে, বাজায়ো না আর বাঁশি রে। বাঁশি শুনিতে আসি না আমি, জল নিতে আসি হে॥ আঁচল দিয়ে মুছি বন্ধু কাজলেরি কালি, যায় না মোছা তোমার কালি লাগলে বনমালী; তোমার বাঁশির সুরে ভেসে গেল কত রাধার মুখের হাসি রে॥ কাল নাগিনীর ফণায় নাচো, বুঝবে তুমি কিসে, কত কুল-বধূ মরে ঐ বাঁশরির বিষে (বন্ধু) ঘরে ফেরার পথ হারায়ে ফিরি তোমার পায়ে পায়ে, জলের কল্সি জলে ডোবে, আমি আঁখি জলে ভাসি রে॥ *৬৩৬. রাগ; কাফি মিশ্র, তাল: দ্রুত-দাদ্রা ঝরা ফুল দ’লে কে অতিথি সাঁঝের বেলা এলে কানন-বীথি॥ চোখে কি মায়া ফেলেছে ছায়া যৌবন মদির দোদুল কায়া তোমার ছোঁয়ায় নাচন লাগে দখিন হাওয়ায় লাগে চাঁদের স্বপন বকুল চাঁপায়, কোয়েলিয়া কুহরে কু কু গীতি॥ *৬৩৭. রাগ; জয়জয়ন্তী, তাল: কাহার্বা সজল হওয়া কেঁদে বেড়ায় কাজল আকাশ ঘিরে, তুমি এসো ফিরে। উঠ্ছে কাঁদন ভাঙন-ধরা নদীর তীরে তীরে, তুমি এসো ফিরে॥ বন্ধু তব বিরহেরি অশ্রু ঝরে গগন ঘেরি’ লুটিয়ে কাঁদে বনভূমি অশান্ত সমীরে॥ আকাশ কাঁদে, আমি কাঁদি বাতাস কেঁদে সারা, তুমি কোথায়, কোথায় তুমি পথিক পথহারা। দুয়ার খুলে নিরুদ্দেশে চেয়ে আছি অনিমেষে, আঁচল ঢেকে রাখবো কত আশার প্রদীপটিরে। *৬৩৮. রাগ; নীলাম্বরী, তাল: ত্রিতাল লীমাম্বরী- শাড়ি পরি’ নীল যমুনায় কে যায়? যেন জলে চলে থল-কমলিনী ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়॥ কলসে কঙ্কণে রিনিঝিনি ঝনকে, চমকায় উন্মন চম্পা বনকে, দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে, পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়॥ অঙ্গের ছন্দে পলাশ-মাধবী অশোক ফোটে, নূপুর শুনি’ বনতুলসীর মঞ্জরী উলসিয়া ওঠে। মেঘ-বিজড়িত রাঙা গোধুলি নামিয়া এলো বুঝি পথ ভুলি, তাহারি অঙ্গ তরঙ্গ-বিভঙ্গে কূলে কূলে নদী জল উথলায়॥ *৬৩৯. রাগ; দুর্গা, তাল: তেওড়া মহাকালের কোলে এসে গৌরী হ’ল মহাকালী, শ্মশান-চিতার ভস্ম মেঘে ম্লান হ’ল মার রূপের ডালি॥ তবু মায়ের রূপ কি হারায় সে যে ছড়িয়ে আছে চন্দ্র তারায়, মায়ের রূপের আরতি হয় নিত্য সূর্য-প্রদীপ জ্বালি’ ॥ উমা হ’ল ভৈরবী হায় বরণ ক’রে ভৈরবেরে, হেরি’ শিবের শিরে জাহ্নবী রে শ্মশানে মশানে ফেরে। অন্ন দিয়ে ত্রি-জগতে অন্নদা মোর বেড়ায় পথে, ভিক্ষু শিবের অনুরাগে ভিক্ষা মাগে রাজদুলালী॥ *৬৪০. তাল: কাহার্বা খাতুনে জান্নাত ফাতেমা জননী-বিশ্ব-দুলালী নবী নন্দিনী, মদিনাবাসিনী পাপতাপ নাশিনী উম্মত-তারিণী আনন্দিনী॥ সাহারার বুকে মাগো তুমি মেঘ-মায়া, তপ্ত মরুর প্রাণে স্নেহ-তরুছায়া; মুক্তি লভিল মাগো তব শুভ পরশে বিশ্বের যত নারী বন্দিনী॥ হাসান হোসেনে তব উম্মত তরে, মাগো কারবালা প্রান্তরে দিলে বলিদান, বদলাতে তার রোজ হাশরের দিনে চাহিবে মা মোর মত পাপীদের ত্রাণ। এলে পাষাণের বুকে চিরে নির্ঝর সম, করুণার ক্ষীরধারা আবে-জমজম; ফিরদৌস হ’তে রহমত বারি ঢালো সাধ্বী মুসলিম গরবিনী॥ *৬৪১. আরবি সুর; তাল: কাহার্বা চম্’কে চম্’কে ধীর ভীরু পায়, পল্লী-বালিকা বন-পথে যায় একেলা বন-পথে যায়॥ শাড়ি তার কাঁটা লতায়, জড়িয়ে জড়িয়ে যায়, পাগল হাওয়াতে অঞ্চল ল’য়ে মাতে- যেন তার তনুর পরশ চায়॥ শিরীষের পাতায় নূপুর, বাজে তার ঝুমুর ঝুমুর, কুসুম ঝরিয়া মরিতে চাহে তাঁর কবরীতে, পাখি গায় পাতার ঝরোকায়॥ চাহি’ তা’র ঐ নয়নে, হরিণী লুকায় বনে, হাতে তা’র কাঁকন হ’তে মাধবী লতা কাঁদে, ভ্রমরা কুন্তলে লুকায়॥ ৬৪২. তাল: দাদ্রা বল্ রে জবা বল্- কোন্ সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল॥ মায়া-তরুর বাঁধন টু’টে মায়ের পায়ে পড়লি লু’টে মুক্তি পেলি, উঠলি ফুটে আনন্দ-বিহ্বল। তোর সাধনা আমায় শেখা (জবা) জীবন হোক সফল॥ কোটি গন্ধ-কুসুম ফোটে, বনে মনোলোভা- কেমনে মা’র চরণ পেলি, তুই তামসী জবা। তোর মত মা’র পায়ে রাতুল হবো কবে প্রসাদী ফুল, কবে উঠবে রেঙে- ওরে মায়ের পায়ের ছোঁয়া লেগে উঙবে রেঙে, কবে তোরই মত রাঙবে রে মোর মলিন চিত্তদল॥ *৬৪৩. তাল: দাদ্রা তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু। আমরা অবোধ, অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু॥ তোমার মতই তোমার ভুবন চির পূর্ণ, হে নারায়ণ! দেখতে না পায় অন্ধ নয়ন তাই এ দুঃখ প্রভু॥ ঝরে যে ফল ধূলায় জানি, হয় না তাহা (কভু) হারা, ঐ ঝরা ফলে নেয় যে জনম তরুণ তরুর চারা- তারা হয় না কভু হারা। হারালো (ও) মোর প্রিয় যারা, তোমার কাছে আছে তারা; আমার কাছে নাই তাহারা-হারায়নিক’ তবু॥ *৬৪৪. রাগ: ইমন, তাল: দাদ্রা আমি দ্বার খুলে আর রাখব না, পালিয়ে যাবে গো। জানবে সবে গো, নাম ধরে আর ডাকব না॥ এবার পূজার প্রদীপ হয়ে জ্বলবে আমার দেবালয়ে, জ্বালিয়ে যাবে গো-আর আঁচল দিয়ে ঢাকব না॥ হার মেনেছি গো, হার দিয়ে আর বাঁধব না। দান এনেছি গো, প্রাণ চেয়ে আর কাঁদব না। পাষাণ, তোমায় বন্দী ক’রে রাখব আমার ঠাকুর ঘরে, রইব কাছে গো- আর অন্তরালে থাকব না॥ *৬৪৫. রাগ: বৃন্দাবনী সারং মিশ্র, তাল: দাদ্রা এ বাসি বাসরে আসিলে কে গো ছলিতে। কেন পুন বাঁশি বাজালে কাফি ললিতে॥ নিশীথ গভীরে কেন আঁখি-নীরে এলে ফিরে ফিরে গোপন কথা বলিতে॥ দলিত কুসুম-দলে রচিয়াছি শয়ন, অন্ধ তিমির রাতি, নিভু নিভু নয়ন; মরণ বেলায় প্রিয় আনিলে কি অমিয়, এলে কি গো নিঠুর ঝরা ঝুল দলিতে॥ *৬৪৬.রাগ; তিলং-খাম্বাজ, তাল: কাহার্বা কে নিবি ফুল, কে নিবি ফুল- টগর, যূথী, বেলা মালতী চাঁপা, গোলাপ, বকুল, নার্গিস ইরানি-গুল॥ আমার যৌবন-বাগানে হাওয়া লেগেছে ফুল-জাপানে, চ’লে যেতে ঢ’লে পড়ি, খুলে পড়ে এলো চুল; তনু-মন আকুল আঁখি ঢুলুঢুল্। (ওগো) ফুটেছে এত ফুল, ফুলমালী কই? গাঁথিবে মালা কবে? সেই আশে রই; এ মালা দেব কা’রে ভেবে সারা হই, সহিতে পারি না এ ফুল-ঝামালা, চামেলি-পারুল॥ *৬৪৭. রাগ; পিলু; তাল: দাদ্রা রুমুঝুম রুমুঝুম্ কে এলে নূপুর পায় ফুটিল শাখে মুকুল ও রাঙা চরণ-ঘায়॥ সে নাচে তটিনী-জল টলমল টলমল, বনের বেণী উতল ফুলদল মুরছায়॥ বিজরী-জরীর আঁচল ঝলমল ঝলমল নামিল নভে বাদল ছলছল বেদনায়। তালীবন থৈ তাথৈ করতালি হানে ঐ, (হায় রে হায়) ‘কবি, তোর তমালী কই’-শ্বসিছে পুবালি-বায়॥ *৬৪৮. রাগ; বাগেশ্রী-পিলু, তাল: কাহার্বা চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে। জানিতে নাইকো বাকি, সই ও আঁখি কি যাদু জানে॥ একে ঐ চাউনি বাঁকা সুর্মা আঁকা তা’য় ডাগর আঁখি রে বধিতে তা’য় কেন সাধ? যে মরেছে ঐ নয়ন বাণে। মরেছে ঐ আঁখির বাণে॥ চকোর কি প’ড়ল ধরা পীযূষ ভরা ঐ মুখ-চাঁদে (রে), কাঁদিছে নার্গিসের ফুল লাল কপোলের কমল-বাগানে। জ্বলিছে দিবস রাতি মোমের বাতি রূপের দেওয়ালি (রে), নিশিদিন তাই কি জ্বলি’ পড়ছ গলি’ অঝোর নয়ানে। মিছে তুই কথার কাঁটায় সুর বিঁধে হায় হার গাঁথিস কবি (রে)। বিকিয়ে যায় রে মালা এই নিরালা আঁখির দোকানে॥ *৬৪৯. তাল: দাদ্রা হে পাষাণ দেবতা! মন্দির দুয়ার খোল কও কথা॥ দুয়ারে দাঁড়ায়ে শ্রান্তি-হীন দীর্ঘ দিন, অঞ্চলের পূষ্পাঞ্জলি শুকায়ে যায় উষ্ণ বায়; আঁখি দীপ নিভিছে হায়, কাঁপিছে তনুলতা॥ শুভ্রবাসে পূজারিণী, দিন শেষে- গোধূলির গেরুয়া রঙ হের প্রিয় লাগে এসে; খোল দ্বার শরণ দাও, সহে না আর নীরবতা॥ *৬৫০. রাগ; শিবরঞ্জনী, তাল: কাহার্বা হে পার্থসারথি! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ চিত্তের অবসাদ দূর কর কর দূর ভয়-ভীত জনে কর হে নিঃশঙ্ক॥ ধনুকে টঙ্কার হানো হানো, গীতার মন্ত্রে জীবন দানো; ভোলাও ভোলাও মৃত্যু-আতঙ্ক॥ মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে- শোনাও শোনাও-অনন্ত কাল ধরি’ অনন্ত জীবন প্রবাহ বহে। দুর্মদ দুরন্ত যৌবন-চঞ্চল ছাড়িয়া আসুক মা’র স্নেহ-অঞ্চল; বীর সন্তানদল করুক সুশোভিত মাতৃ-অঙ্ক॥ |