ভাষাংশ
|
কাজী
নজরুল ইসলাম
|
কাজী নজরুল ইসলামের
রচনাসংগ্রহের সূচি
*৬৫১. তাল: ফের্তা সখি তখন আমার বালিকা বয়স বেণু শুনেছিনু যবে। আমি বুঝিনি সেদিন, ডাকে বাঁশুরিয়া আমারেই বেণু রবে, সখি আমারেই বেনু রবে॥ তার বাঁশরির সুরে মাঝে মাঝে সখি শিহরিয়া উঠতাম গো- মনে হ’ত ঐ সুরের আড়ালে আছে যেন মোর নাম গো। ডাকিত-‘রাধা জাগো, জাগো প্রিয়া’ হের গো যমুনা তোমার বিরহে উঠিয়াছে উথলিয়া॥ শিহরিত কলেবর, জাগিত ভীতি গো, ওকি পূর্বানুরাগ, ও কি প্রথম প্রীতি গো। সখি গো- সখি, হেরিণু স্বপনে নব জলধর রসে-ঢলঢল কালা মোর বুকে এসে কাঁদে, বলে লহ, রাধে, কণ্ঠের বনমালা তার শিরে শিখি-পাখা, চাঁচর চিকুর দোলে কপোলের কাছে লো দোলে দোলে দোলে দোলে গো- সে বাঁশি রেখে পায় মুখপানে চায়, কি যেন ভিক্ষা যাচে॥ আমি দিতে যে নারি লো, যাহা চায় তাহা আমি দিতে যে নারি লো; ও বোঝে না কুলবতীর কুলের বাধা, দিতে যে নারি লো, দিতে যে নারি লো॥ *৬৫২.রাগ; সরফর্দা, তাল: কাহার্বা মৌন আরতি তব বাজে নিশিদিন ত্রিভুবন মাঝে প্রভু বাণী-বিহীন॥ সম্ভ্রমে-শ্রদ্ধায় গ্রহ-তারা দল স্থির হয়ে রয় অপলক অচপল, ধ্যান-মৌনী মহাযোগী অটল আপন মহিমায় তুমি সমাসীন॥ মৌন সে সিন্ধুতে জলবিম্বের প্রায় বাণী ও সঙ্গীত যায় হারাইয়া যায়। বিস্ময়ে অনিমেঘ আঁখি চেয়ে রয় তব পানে অনন্ত সৃষ্টি-প্রলয়, তব ধ্রুব-লোকে, হে চির অক্ষয়, সকল ছন্দ-গতি হইয়াছে লীন॥ *৬৫৩.তাল:দ্রুত-দাদ্রা মহুয়া বনে লো মধু খেতে, সই, বাহিরে চাঁদ এলো, ঘরে মোর চাঁদ কই॥ আমার নাচের সাথি কোথা পাইনে দেখা সরে না পা ওলো নাচতে একা সে বিনে সখি লো আমি আমার নই॥ মিছে মাদলে তাল হানে মাদলিয়া, সে কি গেল বিদেশ, মোরে না বলিয়া। দূরে বাঁশি বাজে পলাশ পিয়াল বনে, বুঝি ঐ বঁধু মোর, যেন লাগে মনে সে মোরে ভুলে নাচে কাহার সনে? সে যে জানতো না-সজনী কভু আমি বৈ॥ ৬৫৪. নাটক; ‘চক্রব্যুহ’, তাল: কাহার্বা বিধুর তব অধর-কোণে মধুর হাসির রেখা। তারি লাগি’ ভিখারি মন ফেরে একা একা॥ সজাগ হয়ে আছে শ্রবণ, থির হয়েছে অধীর পবন। তুমি কথা কইবে কখন গাইবে কুহু কেকা॥ কখন তুমি চাইবে, প্রিয়া, সলাজ অনুরাগে। তিমির-তীরে অরুণ ঊষা তারি আশায় জাগে। কেমন ক’রে চাঁদ যে টানে-সিন্ধু জানে, জোয়ার জানে- দেখিতে আসি, আসিনিকো দিতে তোমায় দেখা॥ *৬৫৫. বেতার গীতিচিত্র: ‘যুগল মিলন’, তাল: ফের্তা বাঁধিয়া দুইজনে দুঁহু ভুজ বন্ধনে কাঁদিছে শ্যাম রাই। মিলনের মাঝে এত বেদনা যে বাজে গো-দেখি নাই, শুনি নাই॥ সাগরে মিশে নদী, তবু কাঁদে নিরবধি, বুঝি না কেন গো-
বুকে যত পায়, তত তৃষ্ণা বেড়ে যায়, সাধ মেটে না যেন গো॥ মেঘ দেখে চাতকিনীর সাধ কি মেটে গো। হের, নব নাগরি নব নাগর মাতিল প্রেম-রসে, নব প্রভাত-কমলে যেন বন ভ্রমর বসে। নব সোনার শতদলে যেন নব মেঘের ছায়া কনকমালা ঘিরিল যেন বন নীল গিরি কায়া। গিরিধারীরে ধরিল, ধিরিধিরি রাধা গিরিধারীরে ধরিল॥ আধ অধরে ধরে নাক’ হাসি, আধ-অধরে বাঁশি, হেরি’ আধ অঙ্গ দাস হতে চায়, আধ অঙ্গ দাসী; শ্রীচরণ ঘিরিয়া মন মধুকর গাহে, চরণাম্বুজ-রজ মাধুকরী চাহে॥ বলে, ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও- ওই চরণ কমল-মধু ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও, ঐ যুগল-রূপ রাধা শ্যাম দেখি যেন অবিরাম (ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও) আমি আনন্দ-যমুনা হয়ে, চরণ ধুয়ে যাব বয়ে, (ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও) আমি নিত্য হৃদি-ব্রজধামে হরিব মোর রাধা-শ্যামে, (ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও)॥ *৬৫৬. বৈতালিক ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে অঝোর নয়নে রে॥ দু’হাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি-পড়িল কি মনে রে॥ দুধের ছাওয়াল আসগর এই পানি চাহিয়ে রে, দুশ্মনের তীর খেয়ে বুকে ঘুমাল খুন্ পিয়ে রে; শাদির নওশা কাশেম শহীদ এই পানি বিহনে রে॥ এই পানিতে মুছিল রে হাতের মেহেদী সকিনার, এই পানিরই ঢেউয়ে ওঠে, তারি মাতম্ হাহাকার; শহীদানের খুন মিশে আছে, এই মানিরই সনে রে॥ বীর আব্বাসের বাজু শহীদ হ’ল এরি তরে রে, এই পানির বিহনে জয়নাল খিয়াম তৃষ্ণায় মরে রে; শোকে শহীদ হ’লেন হোসেন জয়ী হয়েও রণে রে॥ *৬৫৭. রাগ; দেশ-খাম্বাজ, তাল: দাদ্রা তুমি আমারে কাঁদাও নিজেরে আড়াল রাখি’, তুমি চাও আমি নিশি-দিন যেন তব নাম ধরে ডাকি॥ হে লীলা-বিলাসী অন্তরতম, অন্তর-মধু চাও বুঝি মম গোপনে করিতে পান, ওগো বঁধু অন্তরালে সে থাকি॥ বিরহ তোমার ছল, কেন নাহি বুঝি! আমাতে রহিয়া কাঁদাও আমারে তবু কেন মরি খুঁজি’। ভুলিয়া থাকি সুখের মোহে তাই বুঝি প্রিয় কাঁদাও বিরহে- বন্ধু. ওগো বন্ধু; তুমি অন্তরে এলে রাজ-সমারোহে নয়নেরে দিয়ে ফাঁকি॥ *৬৫৮, তাল:দ্রুত-দাদ্রা চুড়ির তালে নুড়ির মালা রিনিঝিনি বাজে লো- খোঁপায় দোলে বুনো ফুলের কুঁড়ি। কালো ছোঁড়ার কাঁকাল ধ’রে নাচে মাতাল ছুঁড়ি লো॥ মহুয়া মদের নেশা পিয়ে বুঁদ হয়েছে বৌয়ে-ঝিয়ে চাঁদ ছুটেছে মনকে নিয়ে ডুরি ছেঁড়া ঘুড়ি (যেন) লো॥ বাজে নূপুর পাঁইজোর সারা গায়ে নাচের ঘোর ওলো লেগেছে, মন হ’ল নেশায় বিভোর; ঐ আকাশে চাঁদ হের মেঘের সাথে যেন করে খুনসুড়ি লো॥ *৬৫৯.তাল: কাহার্বা চীন আরব হিন্দুস্থান নিখিল ধরাধাম। জানে আমায় চেনে আমায় মুসলিম আমার নাম॥ অন্ধকারে আজান দিয়ে ভাঙনু ঘুমঘোর, আলোর অভিযান এনেছি রাত করেছি ভোর; এক সমান করেছি ভেঙে উচ্চ নীচ তামাম॥ চেনে মোরে সাহারা গোবি দুর্গম পর্বত, মন্হন করেছে সাগর, আমার সিন্ধু রথ; বয়েছি আফ্রিকা ইউরোপ আমারই তাঞ্জাম॥ পাক মুলুকে বসিয়েছি খোদার মসজিদ, জগৎ সাক্ষী পাপীদেরকে পিইয়েছি তৌহিদ; বিরান বনে রচেছি রে হাজার নগর গ্রাম॥ *৬৬০. তাল: দাদ্রা গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, কে যেন আমারে ডাকে- সে কি তুমি, সে কি তুমি? কার স্মৃতি বুকে পাষাণের মত ভার হয়ে যেন থাকে- সে কি তুমি, সে কি তুমি?? কাহার ক্ষুধিত প্রেম যেন, হায়, ভিক্ষা চাহিয়া কাঁদিয়া বেড়ায়; কার সকরুণ আঁখি দু’টি যেন রাতের তারার মত মুখ পানে চেয়ে থাকে-সে কি তুমি, সে কি তুমি? নিশির বাতাসে কাহার হুতাশ দীরঘ নিশাস সম ঝড় তোলে এসে অন্তরে মোর, ওগো দুরন্ত মম! সে কি তুমি, সে কি তুমি? মহাসাগরের ঢেউ-এর মতন, বুকে এসে বাজে কাহার রোদন, ‘পিয়া পিয়া’ নাম জপে অবিরাম বনের পাপিয়া পাখি আমার চম্পা-শাখে-সে কি তুমি, সে কি তুমি? *৬৬১. আমার মনের বেদনা বুঝিলে না, আমার মনের বেদনা॥ চাহিনি মালার ফুল বুঝিলে না আপনার ভুল মালা দিলে মন দিলে না॥ *৬৬২. বৈতালিক ওগো মা-ফাতেমা ছুটে আয়, তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি। দীনের শেষে বাতি নিভিয়া যায় মাগো, বুঝি আঁধার হ’ল মদিনা-পুরী॥ কোথায় শেরে খোদা, জুলফিকার কোথা, কবর ফেঁড়ে এসো কারবালা যথা- তোমার আওলাদ বিরান হ’ল আজি, নিখিল শোকে মরে ঝুরি’ ॥ কোথায় আখেরী নবী, চুমা খেতে তুমি, যে গলে হোসনের সহিছ কেমনে? সে গলে দুশমন হানিছে শমসের। রোজ্হাশরে নাকি কওসরের পানি পিয়াবে তোমরা গো গোনাহাগারে আনি, দেখ না কি চেয়ে, দুধের ছেলেমেয়ে পানি বিহনে মরে পুড়ি॥ *৬৬৩. তাল: ফের্তা (দাদ্রা ও কাহার্বা) এ কি অপরূপ রূপের কুমার হেরিলাম সখি যমুনা কূলে, তার এ সুনীল লাবনি গলিয়া গলিয়া ঢালিয়া পড়িছে গগন-মূলে॥ যেন কমল ফুটেছে সখি, সহস্র দল রূপে-কমল ফুটেছে, রূপের সাগর মন্হন করি’ সখি চাঁদ যেন উঠেছে। সখি গো- কালো সে রূপের মাঝে হয়ে যায় হারা কোটি আলো-রাধিকা-রবি, শশী, তারা, প্রেম-যমুনার তীরে সই আমি নিরবধি দেখি তারে, দেখি আর চেয়ে রই আমি এই রূপ চেয়ে থাকি সখি জনমে জনমে জীবনে মরণে এই রূপ চেয়ে থাকি। ঐ মোহন কালোর গহন কাননে হারাইয়া যাক আঁখি॥ *৬৬৪. তাল: দাদ্রা আমি সন্ধ্যামালতী বনছায়া অঞ্চলে লুকাইয়া রই ঘন পল্লব তলে॥ বিহগের গীতি ভ্রমরের গুঞ্জন, নীরব হয় যখন- আমি চাঁদেরে তখন পূজা করি আঁখি-জলে॥ আমি লুকাইয়া কাঁদি বনের শকুন্তলা মনের কথা এ জনমে হ’ল না বলা। গভীর নিশীথে বন-ঝিল্লীর সুরে, ডাকি দূর বন্ধুরে- আমি ঝ’রে পড়ি যবে প্রভাতে সবার হৃদয় মুকুল খোলে॥ *৬৬৫. তাল. দাদ্রা সন্ধ্যা ঘনালো আমার বিজন ঘরে তব গৃহে জ্বলে বাতি। হাসিয়া ফুরায় তব উৎসব-নিশি (প্রিয়) পোহায় না মোর রাতি॥ আমার আয়ুর ঝরা ফুলগুলি ল’য়ে দোলে তব গলে মিলনের মালা হ’য়ে, তোমার ভবনে আলোর দীপালি জ্বলে আঁধার আমার সাথি॥ মোর মালঞ্চে ঘুমায়ে পড়েছে কুহু, নীরব হয়েছে গান- তোমার কুঞ্জে গানের পাখিরা বুঝি তুলিয়াছে কলতান। পৃথিবীর আলো মোর চোখে নিভে আসে, বাজিছে বাঁশরি তোমার মিলন-রাসে; ওপারের বাঁশি আমারে ডাকিবে কবে আছি তাই কান পাতি’ ॥ *৬৬৬. তাল: দাদ্রা আমার হৃদয় মন্দিরে ঘুমায় গিরিধারী। জাগে আমার জাগ্রত প্রেম দুয়ারে তার দ্বারী॥ কানু আমার বুকে ঘুমায়- ভক্তি জেগে চামর ঝুলায়, শিয়রে দীপ আমার আঁখি, প্রীতি দাসী তারি॥ চোরের মত মোর গুরুজন ঘুরুক কাছে কাছে- আমি তাদের ভয় করিনে, (আমার) প্রেম যে জেগে আছে। আধেক রাতে নিরালাতে জাগবে হরি, ধরবে হাতে, ওগো ধ্যান করে গো সেই আশাতে এ প্রাণ রাধা-প্যারী॥ *৬৬৭. তাল: কাহার্বা মোর দুখ নিশি কবে হবে ভোর ভুবনে ছড়ালো প্রভাতের আলো- আমারি ভবনে কেন আঁধার ঘোর॥ সূর্য-কিরণে সাগর শুকায়- সে রবি-কিরণে শুকালো না হায় আমার বিরহী আঁখির লোর॥ আশোক বনে সীতার সঙ্গিনী প্রমীলার সম নিশীথের আঁধার মুখ লুকায়ে কাঁদে অন্তরে মম। মালা চন্দন লয়ে মন্দির মাঝে ফেলে নববধূ সাজ পূজারিণী-সাজে শূন্য মন্দিরে আমি একা কাঁদি জড়ায়ে ছিন্ন মালার ডোর॥ *৬৬৮. তাল: দাদ্রা তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা কর হজরত। মোরা ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমারি দেখানো পথ॥ বিলাস-বিভব দলিয়াছ পায় ধূলি সম তুমি, প্রভু, তুমি চাহ নাই আমরা হইব বাদশা-নবাব কভু। এই ধরণীর ধন-সম্ভার- সকলেরি তাহে সম অধিকার; তুমি বলেছিলে ধরণীতে সবে সমান পুত্র-বৎ॥ প্রভু তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণ্য নাহি ক’রে আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে। ভিন্ ধর্মীর পূজা-মন্দির, ভাঙিতে আদেশ দাওনি, হে বীর, প্রভু আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারিনে’ক পর-মত॥ তুমি চাহ নাই, ধর্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি, তলোয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী। মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা, বেহেশ্ত্ হ’তে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত॥ *৬৬৯. তাল: ফের্তা (কাহার্বা ও দাদ্রা) যদি শালের বন হ’ত শালার বোন, ক’নে বউ হ’ত ঐ গৃহেরই কোণ, ছেড়ে যেতাম না গো শালার বোন, আমি থাকতাম পড়ে সদা, খেতাম না গো, শালার বোনথ- বনে হারিয়ে যেতাম, শালার বোন ঐ বৃন্দাবনে না হয় চারিয়ে যেতাম- দাদা গো, ওগো দাদা- আর মাকুন্দ হত যদি কুন্দবালা, হ’ত দাড়িম্ব সুন্দরী দাড়িওয়ালা, আমি ঝুলে যে পড়তাম দাড়ি ধ’রে তার- জয়নাথ তরকনাথ বলে আমি ঝুলে যে পড়তাম দাড়ি ধ’রে, বাবা দুগ্গা ব’লে আমি ঝুলে যে পড়তাম দাড়ি ধ’রে তার- দাদা গো, ওগো দাদা- আহা বাচ্চা হইত যদি চৌবাচ্চায় নিতি পানকৌড়ি হ’য়ে ডুবে থাকিতাম তায়, যদি দামড়ার ল্যাজ হ’ত কুন্তল দাম বেণী রূপে ল্যাজ ধ’রে মাঠে দাঁড়াতাম-ঘুরে যে বেড়াতাম, তার আমি ল্যাজ ধ’রে ঘুরে যে বেড়াতাম, দাদা গো- যদি ভাগ্যগুণে এক মিলিল শালী- বাবা বিশাল বপু তার সে যে বিশালী, ওযে শালী নয় শালী নয়, শাল্মলী তরু সম সে যে বিশালী গো, শাল্মলী তরু সম সে যে বিশালী গো, আহা চিম্টি শালীর হ’ত বাবলা কাঁটা, হ’ত শর-বন তার খ্যাংড়া ঝ্যাঁটা খ্যাংড়া মেরে বিষ ঝেড়ে যে দিত গো- *৬৭০. তাল: কাহার্বা তুমি সারাজীবন দুঃখ দিলে, তব দুঃখ দেওয়া কি ফুরাবে না! যে ভালোবাসায় দুঃখে ভাসায় সে কি আশা পুরাবে না॥ মোর জনম গেল ঝুরে ঝুরে- লোকে লোকে ঘুরে ঘুরে, তব স্নিগ্ধ পরশ দিয়ে কি, নাথ, দগ্ধ হিয়া জুড়াবে না॥ তুমি অশ্রুতে যে-বুক ভাসালে- সেই বক্ষে এসো দিন ফুরালে তুমি আঘাত দিয়ে ফুল ঝরালে, হাত দিয়ে কি কুড়াবে না॥ *৬৭১. রাগ; বৃহন্নট-কেদারা, তাল: একতাল দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার হে! লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার॥ দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ- ছিঁড়িয়াছে পাল কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত। কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিয্যত, এ তুফান ভারি, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার॥ তিমির রাত্রি, মাতৃ-মন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান! যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান। ফেনাইয়া ওঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান, ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার॥ অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ, কাণ্ডারি, আজি দেখিব তোমার মাতৃ-মুক্তি-পণ। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম’-ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন, কাণ্ডারি, বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র॥ গিরি-সঙ্কট, ভীরু যাত্রীরা, গুরু গরজায় বাজ- পশ্চাৎ পথ যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ। কাণ্ডারি, তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ মাঝ? করে হানাহানি, তবু চল টানি’-নিয়েছ যে মহাভার॥ ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান- আসি’ অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান! আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ, দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কাণ্ডারি হুঁশিয়ার॥ *৬৭২. তাল: কাহার্বা রাস-মঞ্চে দোল-দোল লাগে রে, জাগে ঘূর্ণি-নৃত্যের দোল। আজি রাস-নৃত্য নিরাশ চিত্ত জাগো রে, চল যুগলে যুগলে বন-ভবনে- আনো নিথর হেমন্ত হিম পবনে চঞ্চল হিল্লোল॥ শতরূপে প্রকাশ আজি শ্রী হরি, শত দিকে শত সুরে বাজে বাঁশরি- সকল গোপিনী আজি রাই কিশোরী, যাবে তৃষ্ণা, পাবে কৃষ্ণের কোল॥ তরল তাল ছন্দ-দুলাল নন্দ-দুলাল নাচে রে, অপরূপ রঙ্গে নৃত্য-বিহঙ্গে অঙ্গের পরশ যাচে রে; মানস-গঙ্গা অধীর-তরঙ্গা প্রেমের-যমুনা হ’ল রে উতরোল॥ *৬৭৩. রাগ; ইমন-ভূপালী, তাল: দাদ্রা ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হ’য়ে আমার গানের বুলবুলি- করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি॥ ফুল ফুটিয়ে ভোর বেলাতে গান গেয়ে নীরব হ’ল কোন নিষাদের বাণ খেয়ে; বনের কোলে বিলাপ করে সন্ধ্যা-রানী চুল খুলি’ ॥ কাল হ’তে আর ফুটবে না হায় লতার বুকে মঞ্জুরি, উঠছে পাতায় পাতায় কাহার করুণ নিশাস্ মর্মরি’। গানের পাখি গেছে উড়ে, শূন্য নীড়- কণ্ঠে আমার নাই যে আগের কথার ভীড় আলেয়ার এ আলোতে আসবে না কেউ কূল ভুলি’ ॥ *৬৭৪. রাগ; সামন্ত-কল্যাণ, তাল: ত্রিতাল সন্ধ্যা-গোধূলি লগনে কে রাঙিয়া উঠিলে কারে দেখে॥ হাতের আলতা পড়ে গেল পায়ে অস্ত-দিগন্ত বনান্ত রাঙায়ে, আঁখিতে লজ্জা, অধরে হাসি- কেন অঞ্চলে মালা ফেলিলে ঢেকে॥ চিরুনি বিনোদ বিনুনিতে বাঁধে দেখিলে সে কোন সুন্দর চাঁদে, হৃদয়ে ভীরু প্রদীপ শিখা কাঁপে আনন্দে থেকে থেকে॥ *৬৭৫. রাগ; তিলক-কামোদ, তাল:আদ্ধা রাখ রাখ রাঙা পায়, হে-শ্যামরায়! ভুলে গৃহ স্বজন সবই সঁপেছি তোমায়॥ সংসার মরু ঘোর, নাহি তরু-ছায়া, নব নীরদ শ্যাম, আনো মেঘ-মায়া; আনন্দ-নীপবনে নন্দ দুলাল এসো, বহাও উজান, হরি, অশ্রুর যমুনায়॥ একা জীবন মোর গহন ঘন ঘোর, এসো এ বনে বনমালী, গোপ কিশোর, কুঞ্জ রচেছি দুখ-শোক তমাল-ছায়- প্রেম-প্রীতির গোপী চন্দন শুকায়ে যায়॥ দারা সুত প্রিয়জন, হরি হে, নাহি চাই, পদ্মা-পলাশ-আঁখি যদি দেখিতে পাই; রাখাল-রাজা এসো, এসো হে ঋষিকেশ, গোকুলে লহ ডাকি’, অকূলে ভাসি হায়॥ *৬৭৬. তাল দাদ্রা ওরে সর্বনাশী! মেখে এলি এ কোন চুলোর ছাই! শ্মশান ছাড়া খেলার তোর জায়গা কি আর নাই॥ মুক্তকেশী, কেশ এলিয়ে ওমা বেড়াস কখন কোথায় গিয়ে আমি এক নিমেষ তোকে নিয়ে (আমি) শান্তি নাহি পাই॥ ওরে হাড়-জ্বালানী মেয়ে, হাড়ের মালা কোথায় পেলি, ভুবন-মোহন গৌরী রূপে কালি মেখে এলি! তোর গায়ের কালি চোখের জলে আমি ধুইয়ে দেব আয় মা কোলে; তোরে বুকে ধরেও মরি জ্ব’লে, আমি দিই মা গালি তাই॥ ৬৭৭. রাগ; দরবারী কানাড়া, তাল: তেওড়া আমায় যারা দেয় মা ব্যথা আমায় যারা আঘাত করে, তোরই ইচ্ছায় ইচ্ছাময়ী! আমায় যারা ভালবাসে বন্ধু ব’লে বক্ষে ধরে,- তোরই ইচ্ছায় ইচ্ছাময়ী!! আমার আপমান করে যে মাগো তোরই ইচ্ছা সে যে আমায় যারা যায় মা ত্যেজে যারা আমার আসে ঘরে, তোরই ইচ্ছায় ইচ্ছাময়ী॥ আমার ক্ষতি করতে পারে অন্য লোকের সাধ্য কি মা; দুঃখ যা পাই তোরই সে দান, মাগো সবই তোর মহিমা! তাই পায়ে কেহ দলে যবে হেসে সয়ে যাই নীরবে, কে কারে দুখ্ দেয় মা কবে তোর আদেশ না পেলে পরে তোরই ইচ্ছায় ইচ্ছাময়ী!! *৬৭৮. তাল: দাদ্রা আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে (মাকে) কে দিয়াছে গালি- রাগ ক’রে সে সারা গায়ে মেখেছে তাই কালি॥ যখন রাগ করে মোর অভিমানী মেয়ে আরো মধুর লাগে তাহার হাসি-মুখের চেয়ে- কে কালো দেউল ক’রলে আলো অনুরাগের প্রদীপ জ্বালি’॥ পরেনি সে বসন-ভূষণ, বাঁধেনী সে কেশ,- তারি কাছে হার মানে যে ভুবন-মোহন বেশ। রাগিয়ে তারে কাঁদি যখন দুখে, (দয়াময়ী মা-) দয়াময়ী মেয়ে আমার ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে; আমার রাগী মেয়ে, তাই তারে দিই জবা ফুলের ডালি॥ *৬৭৯. তাল: কাহার্বা বেণুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধুর- সে আমারি গান, প্রিয় সে আমারি সুর॥ হলুদ চাঁপার ডালে সহসা নিশীথ কালে ডেকে ওঠে সাথি হারা পাখি ব্যথাতুর॥ নদীর ভাটির স্রোতে শ্রান্ত সাঁঝে অশ্রু জড়িত মোর সুর যে বাজে। সে সুরের আভাসে আঁখিপুরে জল আসে, মনে পড়ে চলে-যাওয়া প্রিয়রে সুদূর॥ *৬৮০. নাটক; ‘চক্রব্যূহ’, তাল: দ্রুত-দাদ্রা কিশোরী, মিলন-বাঁশরি শোন বাজায় রহি’ রহি’ বনের বিরহী,- লাজ বিসরি’ চল জল্কে। তার বাঁশরি শুনি’ কথার কুহু ডেকে ওঠে কুহুকুহু-মুহুমুহু; রস যমুনা-নীর হ’ল অধীর, রহে না থির; ও তার দু-কূল ছাপায়ে তরঙ্গদল ওঠে ছল্কে॥ কেন লো চম্কে দাঁড়ালি থম্কে- পেলি দেখতে কি তোর প্রিয়তম্কে! পেয়ে তারি কি দেখা নাচিছে কেকা, হ’ল উতলা মূগ কি দেখে চপল্কে॥ *৬৮১. রাগ; গৌড় সারং, তাল: দাদ্রা ভুলিতে পারিনে তাই আসিয়াছি পথ ভুলি’। ভোল মোর সে অপরাধ, আজি যে লগ্ন গোধূলি॥ এমনি রঙিন বেলায় খেলেছি তোমায় আমায়, খুঁজিতে এসেছি তাই সেই পুরানো দিনগুলি॥ তুমি যে গেছ ভুলে-ছিল না আমার মনে, তাই আসিয়াছি তব বেড়া-দেওয়া ফুলবনে। গেঁথেছি কতই মালা এই বাগানের ফুল তুলি’- আজো সেথা গাহে গান আমার পোষা বুলবুলি॥ *৬৮২. তাল: কাহার্বা যে পেয়েছে আল্লার নাম সোনার কাঠি, তার কাছে ভাই এই দুনিয়া দুধের বাটি॥ দীন দুনিয়া দুই-ই পায় সে মজা লোটে, রোজা রেখে সন্ধ্যাবেলা শিরনি জোটে, সে সদাই বিভোর পিয়ে খোদার এশ্ক খাঁটি॥ সে গৃহী তবু ঘরে তাহার মন থাকে না, হাঁসের মতন জলে থেকেও জল মাখে না; তার সবই সমান খাঁটি সোনা এঁটেল মাটি॥ সবই খোদার দান ভেবে সে গ্রহণ করে, দুঃখ-অভাব সুখের মতই জড়িয়ে ধরে, ভোগ করে সে নিত্য বেহেশ্ত্ পরিপাটি॥ *৬৮৩. তাল: দাদ্রা [শোন গিন্নী শুন্ছ-] আজকে হোরি ও নাগরী, ওগো গিন্নী ও ললিতে। ফাগের রাঙা জল ভ’রে দাও, ফর্সি হুঁকোর পিচ্কিরিতে॥ গাজর বিট আর লাল বেগুনে, রাঁধবে শালগম তেলে নুনে, রাঙা দেখে লঙ্কা দিও, লাল নটে আর ফুলকারিতে॥ গাইব গান দোল পূর্ণিমাতে, মালোয়ারী জ্বর আসলে রাতে, তুমি দোহার ধ’রবে সাথে, গিঁটে বাতের গিটকিরিতে॥ (আর) আমি লাল গামছা প’রে যাবো, লাল বাজারে পায়চারিতে, তুমি যাবে চিড়িয়াখানায়, এই মুখেতে গণ্ডার মারিতে॥ (না হয়) তুমি যাও বাপের বাড়ি, পাছুপাছু যাবো আমি ওগো শ্বশুর বাড়িতে পাছু পাছু যাবো তোমার, না হয় শ্বশুর বাড়িতে॥ *৬৮৪. তাল: কাহার্বা আজি নাহি কিছু মোর মান-অপমান ব’লে। সকলি দিয়াছি মোর ঠাকুরের রাঙা চরণের তলে॥ মোর দেহ-প্রাণ, জাতি কুল মান, লজ্জা ও গ্লানি আর অভিমান; (আমি) দিছি চিরতরে জলাঞ্জলি গো কালো যমুনার জলে॥ মোরে যদি কেহ ভালোবাসে আজ জল আসে আঁখি ভ’রে। মোর ছল ক’রে সে যে ভালোবাসে মোর শ্যামসুন্দরে। মোরে না বুঝিয়া কেহ করিলে আঘাত কেঁদে বলি, ওরে ক্ষমা করো নাথ্ বৃন্দাবনে যে প্রেম মধুর হয় আঘাত নিন্দাছলে॥ *৬৮৫. রাগ; জয়জয়ন্তী, তাল: দাদ্রা আঁধার রাতের তিমির দুলে আমার মনে। দুলে গো আমার ঘুমে-জাগরণে॥ হতাশ-ভরা বাতাস বহে, আমার কানে কি কথা কহে, দিনগুলি মোর যায় যে ঝ’রে যায়- ওগো যায় যে ঝ’রে ঝরা পাতার সনে॥ গিয়াছে চলিয়া সুখে যাহারা ছিল গো সাথি, গিয়াছে নিভিয়া জ্বলেতেছিল যে শিয়রে বাতি। স্মৃতির মালার ফুল শুকাইয়া, একে একে হায় পড়িছে ঝরিয়া; বিদায়-বেলা শুনিয়ে বাঁশি ক্ষণে ক্ষণে॥ *৬৮৬. তাল: দাদ্রা আর কত দুখ দেবে, বল মাধব বল বল মাধব বল। দুখ দিয়ে যদি সুখ পাও তুমি কেন আঁখি ছলছল॥ তব শ্রীচরণ তলে আমি চাহি ঠাঁই, তুমি কেন ঠেল বাহিরে সদাই; আমি কি এতই ভার এ জগতে যে, পাষাণ তুমিও টল॥ ক্ষুদ্র মানুষ অপরাধ ভোলে তুমি নাকি ভগবান, তোমার চেয়ে কি পাপ বেশি হ’ল (মোরে) দিলে না চরণে স্থান। হে নারায়ণ! আমি নারায়ণী সেনা, মোরে কুরুকুল দিতে ব্যথা কি বাজে না, (যদি) চার হাতে মেরে সাধ নাহি মেটে দু’চরণ দিয়ে দ’ল॥ *৬৮৭. তাল: দাদ্রা ওগো মাগো আজো, বেঁচে আছি, তোরই প্রসাদ পেয়ে। তোর দয়াময়ী অন্নপূর্ণা, তোরই অন্ন খেয়ে॥ কবে কখন খেলার ছলে, ডেকেছিলাম শ্যামা ব’লে; সেই পুণ্যে ধন্য আমি, আজ তোরই নাম গেয়ে॥ তোরই নাম-গান বিনা আমার পুণ্য কিছুই নাই, পাপী হয়েও পাই আমি তাই, যখন যাহা চাই। দুঃখে শোকে বিপদ ঝড়ে, বাঁচাস্ মা তুই বক্ষে ধ’রে; দয়াময়ী নাই কেহ মা, ভবানী তোর চেয়ে॥ *৬৮৮. তাল: কাহার্বা ওরে মাঝি ভাই। ও তুই, কি দুখ পেয়ে কূল হারালি অকূল দরিয়ায়॥ চোখের জল্ তুই ছাপাতে চাস্ নদীর জলে এসে, শেষে নদীই এলো চক্ষে রে তোর; তুই চলিলি ভেসে। ও তুই কলস দেখে নামলি জলে রে, এখন ডুবে দেখিস্ কলস নাই॥ ও তুই কূলে যাহার কূল পেলিনে তরী অগাধ জলে মিছে খুঁজে মরিস ওরে পাগল, তরী বাওয়ার ছলে। ও রে দুই ধারে এর চোরা বালি রে, (ও) তোর হেথায় মনের মানুষ নাই॥ *৬৮৯. তাল: দাদ্রা চুরি ক’রে এনো গিরি, আমার উমার দুই কুমারে। দেখ্ব তখন ভোলা মেয়ে কেমন ভু’লে থাকতে পারে॥ তার ছেলেরে আনলে হেথা, বুঝবে মেয়ে মায়ের ব্যথা; (বিনা) সাধনাতে গৌরী তখন, আসবে ছুটে আমার দ্বারে॥ জামাই আমার শিব ভোলানাথ, ডাকিলেই সে আসিবে জানি চাইবে নাকো আসতে শুধু, তোমার মেয়ে ঐ পাষাণী। কুমার গণেশ তুমি আমি, শিব পূজিব দিবস যামী; শৈব হ’লে শিবাণী মোর, রইতে নারে ছেড়ে তারে॥ *৬৯০. তাল: দাদ্রা জগৎ জুড়ে জাল ফেলেছিস্ মা, শ্যামা কি তুই জেলের মেয়ে। (তোর) মায়ার জালে মহামায়া, বিশ্বভুবন আছে ছেয়ে॥ প’ড়ে মা তোর মায়ার ফাঁদে কোটি নর,নারী কাঁদে; তোর মায়াজাল ততই বাঁধে পালাতে চায় যত ধেয়ে॥ চতুর যে-মীন সে জানে মা জাল থেকে যে মুক্তি আছে; (তাই) জেলে যখন জাল ফেলে মা সে লুকায় জেলের পায়ের কাছে। জাল এড়িয়ে তাই সে বাঁচে। তাই মা আমি নিলাম শরণ তোর ও দুটি রাঙা চরণ এড়িয়ে গেলাম মায়ার বাঁধন মা তোর অভয়-চরণ পেয়ে॥ *৬৯১. রাগ; ভৈরব: ত্রিতাল জয় বিগলিত করূণা রূপিণী গঙ্গে জয় কলুষহারিণী পতিতপাবনী নিত্যা পবিত্রা যোগী-ঋষি সঙ্গে॥ হরি শ্রীচরণ ছুঁয়ে আপন-হারা, পরম প্রেমে হ’লে দ্রবীভূত ধারা; ত্রিলোকের ত্রিতাপ পাপ তুমি নিলে মা, নির্মলে, তোমার পবিত্র অঙ্গে॥ *৬৯২. তাল: ফের্তা টিকি আর টুপিতে লেগেছে দ্বন্দ্ব বচন যুদ্ধ ঘোর কে বড় কে ছোট চাই মীমাংসা, কার আছে কিবা শোভা। যেন প্রকাণ্ড কুষ্মাণ্ডের বৃন্তটি মনোলোভা। এ যে চতুর্বর্গ ফলেরি বোঁটা। শুনে টুপি ফিক্ ক’রে হেসে বল্লে: ‘ভায়া, শিরে বিরাজ করবার শোভার কথা যদি বল তো ও বড়াই আমারি মুখে মানায়, ও বড়াই আমার মুখে মানায়।’ আমি বাঁকা হয়ে যবে শিরে বসি, দেখে বিবিরা মূর্ছা যায়॥ টিকি বলে, মোরে বলে চৈতন্ কভু বা আর্কফলা আর আমারি প্রসাদে প্রণামীটা মেলে দুটি বেলা চাল-কলা। (মেলে দাদা) দুটি বেলা চাল-কলা॥ [শুনে বাদশাহী চালে টুপি বল্লে: ‘আরে তোবা তোবা চাল আর কলা? ওসব আবার খাদ্য নাকি হে? এ্যাঁ?’] বাদশাহী চালে টুপি বলে ওসব খাদ্য নাকি? দেখো, আমারি দোয়ায়, আহা তোফা জুটে যায়, গোস্ত ও রামপাখি। টিকি বলে মিয়া, আমার কৃপায় স্বর্গে free pass মেলে (আর) আমার through দিয়ে মগজে বুদ্ধি electricity খেলে মিয়া আমার কৃপায় স্বর্গে free pass মেলে এ যে পারে যাবার টিকিট-শুধু টিকিট নয়। [শুনে টুপি রেগে কাঁই, বল্লে।] বেহেশ্তে মোর একচেটে অধিকার কাফেরের তরে no admission খোদার ইস্তাহার। (এই রূপে) ক্রমশঃ তর্ক বাড়িল ভীষণ বচনে বেজায় দড়, এ উহারে কয় মোর ঠাঁই উঁচু তুমি বাপু স’রে পড়॥ সহসা মুণ্ড ছিন্ন হইল শত্রু কৃপাণ ঘায়। টুপি আর টিকি একই সঙ্গে ভুঁয়ে গড়াগড়ি যায়॥ *৬৯৩. রাগ; ভৈরবী, তাল: কাহার্বা দাও দাও দরশন পদ্ম-পলাশ লোচন, কেঁদে দু’নয়ন হ’ল অন্ধ। আকাশ বাতাস ঘেরা, তব ও মন্দির বেড়া আর কতকাল রবে বন্ধ॥ পাখি যেমন সন্ধ্যাকালে, বন্ধু-স্বজন পালে পালে উড়ে এসে ব’সেছিল ডালে হে। রাত পোহালে একে একে, উড়ে গেল দিগ্বিদিকে, প’ড়ে আছি একা নিরানন্দ। টুটিল বাঁধন মায়ার, কবে শুনিব এবার ও রাঙা চরণ নূপুর ছন্দ॥ দুখ-শোক রৌদ্রজলে, ফেলে মোরে পলে পলে ছলিতেছ হরি কত ছল হে জীবনের বোঝা প্রভু, বহিতে কি হবে তবু সহিতে পারি না আর দ্বন্দ্ব। মরণের সোনার ছোঁওয়ায়, ডেকে লও ও রাঙা পায় দেখাও এবার মুখ-চন্দ॥ *৬৯৪. রাগ; পাহাড়ি, তাল: সেতারখানি ধীরে যায় ফিরে ফিরে চায়। চলে নব অভিসারে, ভীরু কিশোরী, ওঠে পাতাটি নড়লে সে চম্কে॥ হরিণ নয়নে সভয় চাহনি, আসিছে কে যেন দেখিবে এখনি পথে সে দেয় ফেলে মুখর নূপুর খুলে, আপন ছায়া হেরি ওঠে গা ছম্কে॥ ‘চোখ গেল চোখ গেল’ ডাকে পাপিয়া শুনিয়া শরমে ওঠে কাঁপিয়া; হায়, যার লাগি এত, কোথায় সে ঝিল্লি-রবে ভাবে কেউ হবে বনে ফুল ঝরার আওয়াজে দাঁড়ায় সে থম্কে॥ *৬৯৫. রাগ; বেহাগ মিশ্র; তাল: কাহার্বা নাচিয়া নাচিয়া এসো নন্দদুলাল, মোর প্রাণে মোর মনে, এসো ব্রজগোপাল॥ এসো নূপুর রুনুঝুনু পায়ে, এসো প্রেম যমুনা নাচায়ে এসো বেণু বাজায়ে, এসো ধেনু চরায়ে এসো কানাই রাখাল॥ ঝুলনে হোরিতে রাসে, এসো কুরুক্ষেত্র রণে এসো প্রভাসে, (এসো) শিশু রূপে, এসো কিশোর বেশে এসো কংস, অরি, এসো মৃত্যুকরাল॥ *৬৯৬. রাগ; ললিত, তাল: ত্রিতাল পিউ পিউ বিরহী পাপিয়া বোলে; কৃষ্ণচূড়া বনে ফাগুন সমীরণে ঝুরে ফুল বন পথতলে॥ নিশি পোহায়ে যায় কাহার লাগি নয়নে নাহি ঘুম বসিয়া জাগি আমারই মত হায় চাহিয়া আশা পথ নিশীথের চাঁদ পড়ে গগনে ঢলে॥ *৬৯৭. তাল: দাদ্রা বল প্রিয়তম বল- মোর নিরাশা-আঁধারে আলো দিতে তুমি কেন দীপ হ’য়ে জ্বল॥ যত কাঁটা পড়ে মোর পথে যেতে যেতে, কেন তুমি তাহা লহ বঁধু বুক পেতে। যদি ব্যথা পাই বুঝি পথে তাই তুমি ফুল বিছাইয়া চল॥ বল হে বিরহী, তুমি আমারে অমৃত এনে দাও কেন নিজে উপবাসী রহি’। মোর পথের দাহন আপন বক্ষে নিয়ে, মেঘ হয়ে চল সাথে সাথে ছায়া দিয়ে। মোর ঘুম না আসিলে কেন কাঁদ চাঁদ হয়ে ঢলঢল॥ *৬৯৮. তাল: কাহার্বা (যখন) প্রেমের জ্বালায় অঙ্গ জ্বলে, জুড়াই জ্বালা গজলে। ছাতা দিয়ে মারি খোঁচা যেন সুরের বগলে॥ সিঁড়ির ধারে পিঁড়ি পেতে বিড়ি বাঁধি হায় কলকাতায়, মিলন আশার তামাক ঠাসি হায় বিরহের শাল পাতায়, [“আরে লুল্লু আট পয়সার বিড়ি কিনে লিস্রে হাঁ হাঁ”] জালিম বিবির দিলের ছিপি (দাদা) খুলি সুরের ফজলে॥ কার্ফা তালে চার পা তুলে (হায়) ছুটাই তালের লাল ঘোড়া, ভজুয়া নাত্নি ছুটে আসে হায় ফেলে দিয়ে হায় ঝালবড়া; সুরে-তালে লাগে লড়াই যেন পাঠান মোগলে॥ *৬৯৯. তাল: দাদ্রা সেদিন ব’লেছিলে এই সে ফুলবনে, আবার হবে দেখা ফাগুনে তব সনে॥ ফাগুন এলো ফিরে লাগে না মন কাজে, আমার হিয়া ভরি, উদাসী বেণু বাজে; শুধাই তব কথা সখিনা সমীরণে॥ শপথ ভুলিয়াছ বন্ধু, ভুলিলে পথ কি গো, বারেক দিয়ে দেখা লুকালে মায়ামৃগ। আঁচলে ফুল লয়ে হল’ না মালা গাঁথা, আসার পথ তব ঢাকিল ঝরা পাতা; পূজার চন্দন শুকালো অঙ্গনে॥ ৭০০. রাগ; গৌড় সারং, তাল: কাহার্বা অনাদরে স্বামী প’ড়ে আছি আমি তব কোলে তুলে নাও নিয়ে ধরণীর ধূলি আছি আমি ভুলি’ চরণের ধূলি দাও॥ বিভবে বিলাসে সংসার কাজে অশান্ত প্রাণ কাঁদে বন্ধন মাঝে বৃথা দ্বারে দ্বারে চেয়েছি সবারে এবার তুমি মোরে চাও॥ যাহা কিছু প্রিয় জীবনের মম হরিয়া লহ তুমি, লও প্রিয়তম। সূর্যের পানে সূর্যমুখী ফুল যেমন চাহিয়া রয় বিরহ-ব্যাকুল |