ভাষাংশ | কাজী নজরুল ইসলাম |
কাজী নজরুল ইসলামের রচনাসংগ্রহের সূচি


*৮৫১. তাল: ফের্‌তা
দয়া ক’রে দয়াময়ী ফাঁসিয়ে দে এই ভুঁড়ি
এ ভুঁড়ি তো নয় ভূধর যেন উদর প্রদেশ জুড়ি॥
ক্রমেই ভুঁড়ির পরিধি মা যাচ্ছে ছেড়ে দেহের সীমা
আমার হাত পা রইল বাঙালি ওমা পেট হল ভোজপুরী॥
উপুড় হতে নারি মাগো সর্বদা চিৎপাৎ
ভয় লাগে কাৎ হলেই বুঝি হব কুপোকাৎ
শালীরা কয় হায় রে বিধি রোলার বিয়ে করলেন দিদি
গুঁড়ি ভেবে ঠেস দেয় কেউ কেউ দেয় সুড়সুড়ি॥
(আর) ভুঁড়ি চলে আগে আগে আমি চলি পিছে
কুমড়ো গড়ান গড়িয়ে পড়ি নামতে সিঁড়ির নীচে।
পেট কি ক্রমে ফুলে ফেঁপে উঠবে মাগো মাথা ছেপে
(ওগো) কেউ নাদা কয় কেউ গম্বুজ (বলে) কেউবা গোবর ঝুড়ি।
গাড়িতে মা যেই উঠেছি ভুঁড়ি লাগায় লম্ফ
ভূমিকম্পের চেয়েও ভীষণ আমার ভুঁড়ি কম্প।
সার্ট ক্রমে পেটে এঁটে গেঞ্জি হয়ে গেল সেঁটে
দে ভুঁড়ির ময়দা ফেটে হাত পা গুলো ছুড়ি
হালকা হয়ে মনের সুখে হাত পা গুলো ছুড়ি
এই ভুঁড়ির ময়দা ফেটে দে
ফায়দা কি আর এই ভুঁড়িতে ময়দা ফেটে দে
হালকা হয়ে মনের সুখে ওমা, হাত-পাগুলো ছুড়ি॥
*৮৫২. তাল: ফের্‌তা
দে গরুর গা ধুইয়ে-
নিয়ে ষণ্ডা মার্কা গিন্নি গণ্ডা তিনেক আণ্ডা বাচ্চা
ঠাণ্ডা মেরে গেছি দাদা তোমরা ভাব আজি আচ্ছা
আমি থাকি বাছুর ধরে খায় অন্যে গাই দুইয়ে।
দে গরুর গা ধুইয়ে-
নিতি নূতন পুষ্যি (গজায়) যেন গোদের উপর গ্যাঁজ
যেন দুম্বা ভেড়ার ন্যাজ বাবা
(ঘরে) হাঁড়িতে ইঁদুর ডন ফেলে আর বাহিরে রসুন প্যাঁজ
ভাই হোটেলে রসুন প্যাঁজ
চুটকে আমায় চাটনী করলে সিক্‌নি ঝরে নাক চুইয়ে।
দে গরুর গা ধুইয়ে-
খামচা খামচি করে নিতুই এ সংসারের সাথে
নুন ছাল উঠে গেল প্রাণের মাথা হল আলু ভাতে
করাত চেরা করে বরাত আমার উপর চিৎ শুইয়ে।
দে গরুর গা ধুইয়ে-
পাছড়ে ফেলে স্ত্রী পুত্র যেন প্যাঁচড়া আঁচড়ায়
জিসকা ফাটে উসকা ফাটে ধোবি বসে আছড়ায়
ন্যাংটা শিবের মন্ত্র দাদা পেয়েছি দু-কান খুইয়ে।
দে গরুর গা ধুইয়ে- জোরেসোরো।
*৮৫৩. তাল: কাহার্‌বা
প্রণমামী শ্রীদুর্গে নারায়ণী গৌরী শিবে সিদ্ধি বিধায়িনী
মহামায়া অম্বিকা আদ্যাশক্তি ধর্ম-অর্থ-কাম মোক্ষ-প্রদায়িনী॥
শুম্ভ নিশুম্ভ বিমর্দিনী চণ্ডী নমো নমঃ দশপ্রহরণ ধারিণী
দেবী সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়-বিধাত্রী জয় মহিষাসুর সংহারিণী।
জয় দুর্গে, জয় দুর্গে॥
যুগে যুগে দনুজ দল-নী মহাশক্তি যোগনিদ্রা মধুকৈটভ নাশিনী
বেদ-উদ্ধারিণী মণি-দীপ বাসিনী শ্রীরাম অবতারে বরাভয় দায়িনী।
জয় দুর্গে, জয় দুর্গে॥
*৮৫৪. তাল: ফের্‌তা
বঁধু হে
বঁধু ফিরে এসো আজো প্রাণের প্রদীপ রেখেছি আঁচল ঢেকে
বিরহ নিশাসে দীরঘ বাতাসে কেঁপে ওঠে থেকে থেকে।
আর রাখতে নারি, নিবু নিবু দীপ রাখতে নারি
বুঝি আমার পরান প্রদীপ নিভাবে আমারি নয়ন বারি।
বঁধু যমুনারি তীরে বেণু আছে পড়ে ডাকে না আর রাধা বলে।
অভিমানে বাঁশি আমার বুকে আসি’ কেঁদে কেঁদে কহে যেন গো
হরি আরাধিকা রাধিকা এলে যদি শ্রীহরি এলো না কেন গো।
পায়ে পড়ে কাঁদে এসে যমুনারি ঢেউ
বলে রাধা রাধা বলে আর ডাকে না তো কেউ।
জটিলা কুটিলা আজ কলহ ভুলে জড়াইয়া মোরে কাঁদে যমুনা কূলে।
বলে কৃষ্ণ কই লো প্রলয়েরি কালে আর লইব কার নাম।
এই বিরহ যমুনা পার হব কবে বল হে বিরহী মম
গেলে কোন সে গোলকে রহিবে চোখে চোখে
প্রিয়তম হে কৃষ্ণ আঁখি তারা সম॥
*৮৫৫.
সখি কই গোপীবল্লভ শ্যামল পল্লব কান্তি
সখি আমার হরি বিনে হরি চন্দনে নাহি শান্তি।
ঐ দেখ্ দেখ্ শ্যাম দাঁড়িয়ে
ও নহে কদম তমাল পিয়াল পিয়া মোর ঐ দাঁড়িয়ে।
ও নহে তরুণ শাখা ও যে মোর বঁধু আসে বাহু বাড়িয়ে।
পুষ্প পাগল তরু কি কখনো দুলে গো অমন করিয়া
(ও যে) বনমালা গলে বনমালী মোর নাচিছে হেলিয়া দুলিয়া।
তোরা দেখে আয় তোরা দেখে আয়
অভিমানে শ্যাম আসিছে না কাছে ডেকে আয় তারে ডেকে আয়
তারি বিগলিত নীল লাবনি কি ঐ যমুনার কালো জলে
বিজলির আঁখি ইঙ্গিতে সে কি ডাকে মোরে মেঘ দলে।
সখি গো! তোরা যেতে দে মোরে যেতে দে আর দিস্‌নে বাধা

(ঐ) গহন কালোতে গাহন করিয়া জুড়াক আলোক রাধা॥
*৮৫৬. তাল: দ্রুত-দাদ্‌রা
বহে বনে সমীরণ ফুল জাগানো
এসো গোপন সাথি মোর ঘুম ভাঙানো
এসো আঁধার রাতেরি চাঁদ পাতি মায়ারি ফাঁদ
এসো এসো মম স্বপন সাধ॥
হৃদয় তিমিরে এসো হৃদ-সায়র দোল লাগানো
সাথি মোর ঘুম ভাঙানো॥
বনে মোর ফুলগুলি আছে তব পথ চেয়ে
পরান পাপিয়া পিউ পিউ ওঠে গেয়ে
তরুণ অরুণ এসো আলোকেরি পথ বেয়ে
এসো আমার তনু মন প্রাণ হৃদয় রাঙানো
এসো ভুবন ভোলানো
কোথা গোপন সাথি মোর ঘুম ভাঙানো॥
*৮৫৭. তাল: দাদ্‌রা
পুরুষ : (বেয়ান, বলি ও বেয়ান ঠাকরুন)
বেয়ান তোমার আলু চেরা চোখে আমি মরে আছি
স্ত্রী : বেয়াই আমি তাইতো তোমার গোদা পায়ে শরণ যাচি।
ও তোমার গোদা পায়ে শরণ যাচি।
পুরুষ : (বলি ও বেয়ান তোমার)
দাঁতে ছাতা গায়ে ছুলি গলায় পেটে কোলাকুলি
আমি দেখেই ছুটি কাছা খুলি
(আমি) দেখেই ছুটি ও আমার কাছা খুলে গো
দেখেই ছুটি হরিবোল বোলে রে
দেখেই ছুটি ও হরিবোল বোলে রে
আমি কাছা খুলে বাহু তুলে দেখেই ছুটি।
স্ত্রী : (বলি ও বেয়াই, ও কাছা তো নয়) এ যে লেজুড়েরি কাছাকাছি।
পুরুষ : (বলি ও বেয়ান ঠাকুরুন তোমার)
ফোকলা দাঁতে প্রেমের বুলি শুনেই কাঁধে নিলেম ঝুলি।
স্ত্রী : (বুঝি গৌর নামের ঝুলি, বলি ও বেয়াই উঁ)
বেয়াই নিয়ে এবার যাবে রাঁচি
যাবে রাঁচি গৌর হে ওহে গৌর (যাবে রাঁচি)
কাছা খুলে বাহু তুলে যাবে রাঁচি (তুমি)।
পুরুষ : (বলি ও বেয়ান)
ভাগলপুরি বিবির মতন বাদুস নুদুস কি সে গঠন
স্ত্রী : (বলি ও হামদো বুড়ো) তুমি মাম্‌দো ভূত যে চামড়া খেকো
ও আমায় করতে এলে আমড়া গাছি।
*৮৫৮. তাল: দাদ্‌রা
ভক্ত নরের কাছে হে নারায়ণ চিরদিন আজ হারি
তাই তো তোমায় নামায়েছি ব্রজে গোলক হইতে কাড়ি॥
চতুর্ভুজের দ্বিভুজ হরিয়া বেঁধেছি যশোদা দুলাল করিয়া
বনমালা পীত বসন পরিয়া হয়েছ ময়ূর মুকুটধারী॥
রাঙা পায়ে তব নূপুর পরায়ে নাচায়েছি পথ মাঝে
হাতে দিয়ে বেণু সাথে দিয়ে ধেণু সাজানু গোপাল সাজে।
ভগবান বলে মোরা না ধেয়াই চোর কপট নিঠুর বলি তাই
সুমধুর গালি দিয়েছি কানাই বামে দিয়ে রাধা প্যারী॥
*৮৫৯. তাল: দাদ্‌রা
শুক বলে, ‘মোর গোঁফের রূপে ভোলে গোপনারী’
সারী বলে, ‘গোঁফের বড়াই আছে বলে দাড়ি
(ও) আমার গোঁফ পিয়ারি॥’
শুক বলে, ‘মোর বাঁকা গোঁফে দেখে ভুবন ভোলে’
সারী বলে, ‘ঝুলন রাসের দোলনা যে দোলে
(ও) আমার দাড়ির আশে।’
শুক বলে, ‘গোঁফ ওষ্ঠে থাকেন গোষ্ঠে যেন কালা’
সারী বলে, ‘আমার দাড়ি কুলের কুলবালা
(ও) চলেন হেলে দুলে।’
শুক বলে, ‘বীর শিকারিয়া এই গোঁফে দেয় চাড়া’
সারী বলে, ‘মুনি ঋষির দেখবে দাড়ি ন্যাড়া
(ও) কিবা বাহার তোলে।’
শুক বলে, ‘মোর ত্রিভঙ্গিম ঠোঁট বিহারী গোঁফ’
সারী বলে, ‘তমাল কানন আমার দাঁড়ির ঝোপ
(আ, ও) দখিন হাওয়ায় দোলে।’
শুক বলে, ‘গোঁফ খুরির দধি চুরি করে খায়’
সারী বলে, ‘দাড়ি মেদীর রং লেগেছে গায়
(ও, আচ্ছাচ্ছা) যেন হোরির আবির।’
সারী বলে, ‘দাড়ি বড় গোঁফের গরব মিছে’
শুক বলে, ‘দাড়ি যতই বাড়ুক তবু গোঁফের নীচে
(ও) সারী টিকবে বল’॥
*৮৬০. নাট্য-গ্রন্থ: ‘ব্লাক আউট’, তাল: ফের্‌তা
মা-মা-মা-মা-মা-মাগো
এবারের পূজা মাগো দশভূজা বড় দুর্গতিময়।
পড়েছিস এ.বি.সি.ডি? বুঝিস ব্ল্যাক আউট কারে কয়?
ব্ল্যাক আউট মানে যত কালো ছিল বাহির হয়েছে মাগো
যত আলো ছিল যত ভালো ছিল, সকলেরে বলে ভাগো।
ডাইনে বাঁ ধারে ভীষণ আঁধারে হাঁটু কাঁপে আর হাঁটি
আমড়ার মত হয়ে আছি মাগো চামড়া এবং আঁটি।
নন্দী ভৃঙ্গী সিঙ্গি যাইলে তাহারাও ভয় পাবে
তাদের দিব্য দৃষ্টি লয়েও মাগো আঁধারে হোঁচট খাবে।
বলি বিগ্রহ তোর কে দেখিতে যাবে মা কুগ্রহের ফেরে
বিড়ি খেয়ে ফেরে গুণ্ডারা যদি দেয় মাগো ভুঁড়ি ফেড়ে।
মা তুই বর দেওয়ার আগেই বের্বরেরা এসে
ঠেসে ধরে নিয়ে যাবে চিত্রগুপ্তের দেশে।
চোঁয়া ঢেকুর ওঠে মা মেকুর ডাকিলে কেঁদে উঠি ওঙা ওঙা;
ঢেঁকির আওয়াজ শুনলে মাগো ভয়ে খাড়া হয়ে ওঠে রোঁয়া।
সত্য পথে চলিতে পারি না পথে কাদা রাখে ফেলে
উচিত কথা মাগো বলিতে পারি না চিৎ করে দেয় ফেলে।
এ চিতে শক্তি দে মা চিৎ করবো ভয়কে
বলবো এবার তোরে খাব দে মা মাগো মা॥
৮৬১. তাল: দাদ্‌রা
ওগো আমিনা তোমার দুলালে আনিয়া আমি ভয়ে ভয়ে মরি
এ নহে মানুষ বুঝি ফেরেশ্‌তা আসিয়াছে রূপ ধরি’ ॥
সে নিশীথে যখন বক্ষে ঘুমায়
চাঁদ এসে তারে চুমু খেয়ে যায়
দিনে যবে মেষ চারণে সে যায় মেঘ চলে ছায়া করি’,
সাথে সাথে তার মেঘ চলে ছায়া করি’ ॥
মনে হয় যেন লুকাইয়া রাতে তোমার শিশুর পায়
কত ফেরেশ্‌তা হুর-পরী এসে সালাম করিয়া যায়।
সে চলে যায় যবে মরুর উপরে
বস্‌রা গোলাপ ফোটে থরে থরে
তার চরণ ঘিরিয়া কাঁদে ফুলবনে অলিকুল গুঞ্জরি’ ॥
*৮৬২. রাগ; দেশ, তাল: একতাল
কেন করুণ সুরে হৃদয় পুরে বাজিছে বাঁশরি
ঘনায় গহন নীরদ সঘন নয়ন মন ভরি॥
বিজলি চমকে পবন দমকে পরান কাঁপে রে
বুকের বঁধুরে বুকে বেঁধে ঝুরে বিধুরা কিশোরী॥
*৮৬৩. রাগ: মান্দ, বৈতালিক
তোমারি মহিমা গাই বিশ্বপালক করতার
করুণা কৃপার তব নাহি সীমা নাহি পার॥
রোজ-হাশরের বিচার-দিনে তুমিই মালিক এয়্ খোদা,
আরাধনা করি প্রভু, আমরা কেবলি তোমার॥
সহায় যাচি তোমারি নাথ, দেখাও মোদের সরল পথ,
সেই পথেতে চালাও খোদা বিলাও যাদের পুরস্কার।
অবিশ্বাসী ধর্মহারা যাহারা সে ভ্রান্ত-পথ,
চালায়ো না তাদের পথে, এই চাহি পরওয়ারদিগার॥
*৮৬৪. তাল: দাদ্‌রা
তোরা যারে এখনি হালিমার কাছে লয়ে ক্ষীর সর ননী
আমি খোয়াবে দেখেছি কাঁদিছে মা বলে আমার নয়ন-মণি॥
মোর শিশু আহমদে যেদিন কাঁদিয়া
হালিমার হাতে দিয়াছি সঁপিয়া
সেই দিন হ’তে কেঁদে কেঁদে মোর কাটিছে দিন রজনী॥
পিতৃহীন সে সন্তান হায় বঞ্চিত মা’র স্নেহে
তারে ফেলে দূর কোল খালি করে (আমি) থাকিতে পারি না গেহে।
অভাগিনী তার মা আমিনায়
মনে করে সে কি আজো কাঁদে হায়
বলিস তাহারি আসার আশায় দিবানিশি দিন গণি॥
*৮৬৫. তাল: যৎ
দিও বর হে মোর স্বামী যবে যাই আনন্দ ধামে
যেন প্রাণ ত্যাজি হে স্বামী শ্রীকৃষ্ণ গোবিন্দ নামে॥
ভাসি যেন আমি ভাগীরথী নীরে অথবা প্রয়াগে যমুনার তীরে
অস্তিম সময়ে হেরি আঁখি নীরে যেন মোর রাধা শ্যামে॥
ব্রজগোপালের শুনায়ে নূপুর মরণ আমার করিও মধুর
বাজায়ো বাঁশি দাঁড়ায়ো আসি’ রাধারে লইয়া বামে॥
*৮৬৬. রাগ: জৌনপুরী, তাল: ত্রিতাল
মম মধুর মিনতি শোন ঘনশ্যাম গিরিধারী
কৃষ্ণমুরারী, আনন্দ ব্রজে তব সাথে মুরারি॥
যেন নিশিদিন মুরলী-ধ্বনি শুনি
উজান বহে প্রেম-যমুনারি বারি
নূপুর হয়ে যেন হে বনচারী
চরণ জড়ায়ে ধরে কাঁদিতে পারি॥
*৮৬৭. রাগ: নট-বেহাগ, তাল: ত্রিতাল
রুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ নূপুর বোলে
বন-পথে যায় কে বালিকা, গলে শেফালিকা,
মালতী মালিকা দোলে॥
চম্পা মুকুলগুলি চাহে নয়ন তুলি’
নাচে নট-বিহগ শিখা তরুতলে॥
*৮৬৮.রাগ: নট-মল্লার, তাল: ত্রিতাল
রুম্ ঝুম্ বাদল আজি বরষে
আকুল শিখি নাচে ঘন দরশে॥
বারির দরশনে আজি ক্ষণে ক্ষণে
নব নীরদ শ্যাম রূপে পড়ে মনে
না-জানি কোন্ দেশে কোন্ প্রিয়া সনে
রয়েছে ভুলিয়া নটবর সে॥
*৮৬৯. তাল: ফের্‌তা
শ্যামে হারায়েছি বলে কাঁদি বিশাখা হারায়েছি শ্যামের হৃদয়
আমি তারি তরে কাঁদি গো সেই নিদয়ের তরে নয়
তার হৃদয়ের তরে কাঁদি গো হারায়েছি শ্যামের হৃদয়।
যে হৃদয় ছিল একা গোপিকার রাধিকার কুবুজা করেছে তারে জয়, সখি গো
কুবুজা তারে কু বুঝায়েছে
যে রাধা ছাড়া জানত না সই কুবুজা তারে কু বুঝায়েছে
কুবুজা করেছে তারে জয়।
কি হবে মথুরা গিয়া, হেরি সে হৃদয়হীন পাষাণ দেবতায়
সে কিছুই দেবে না, দেবতাই বটে গো সে দেবতাই বটে গো
পাষাণ খুঁজে না রাধা তার প্রিয়া আনন্দঘন শ্যামরায়
তোরা যেতে চাস যা লো-
ঠাকুর দেখিতে তোরা যেতে চাস যা লো, সখি গো
ধরম-করম মম তনু-মন-যৌবন সঁপিনু চরণে যার
সে পর-পুরুষ, হ’ল আজি অপরার পুরুষ স্বভাব ভ্রমরার।
সে ভ্রমরাই সমতুল ফুলে ফুলে ভ্রমে সে ভ্রমরাই সমতুল
তারে, দেখলে ভ্রমে জাতিকুল, ভ্রমরাই সমতুল পুরুষ স্বভাব ভ্রমরার
যা’র হরি ছাড়া বোধ নাই প্রবোধ দিস্‌নে তায়, সজনী
সবারই পোহাবে নিশি, পোহাবে না রাধারই এ আঁধার রজনী॥
*৮৭০. তাল: ফের্‌তা
হোরি খেলে নন্দলালা
প্রেমের রঙে মাতোয়ালা॥
বিশ্বরাধা সে সাথে রঙে খেলায় মাতে
রঙে ত্রিভুবন ছায় রাঙা আলোক আবির ছড়ায়
হোরি রবি-শশী থালা॥
আজি বনে বনে মনে মনে হোরি
মনের মরুতে লতায় তরুতে রাঙা ফুল ফোটে মরি মরি।
আজি প্রাণে প্রাণে ফুল দোল
দোল পূর্ণিমা রাতি রাঙা ফুল তারা বাতি
ধরণীতে আকাশে জ্বালা॥
*৮৭১. রাগ: খাম্বাজ, তাল: দাদ্‌রা
এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল॥
তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দী হতে নয়,
ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন-ভয়।
এই বাঁধন প’রেই বাঁধন-ভয়কে কর্‌ব মোরা জয়,
এই শিকল-বাঁধা পা নয় এ শিকল ভাঙা কল॥
তোমার বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে কর্‌ছ বিশ্ব গ্রাস,
আর ভয় দেখিয়েই ক’র্‌বে ভাবছ বিধির শক্তি হ্রাস
সেই ভয়-দেখানো ভূতের মোরা ক’র্‌বো সর্বনাশ,
এবার আন্‌বো মাভৈঃ বিজয়-মন্ত্র বল-হীনের বল॥
তোমরা ভয় দেখিয়ে কর্‌ছ শাসন জয় দেখিয়ে নয়;
সেই ভয়ের টুঁটি ধর্‌ব টিপে কর্‌ব তারে লয়।
মোরা আপনি ম’রে মরার দেশে আন্‌ব বরাভয়,
প’রে ফাঁসি আন্‌ব হাসি মৃত্যু-জয়ের ফল॥
ওরে ক্রন্দন নয় বন্ধন এই শিকল-ঝঞ্ঝনা,
এ যে মুক্তি-পথের অগ্রদূতের চরণ-বন্দনা!
এই লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে হান্‌ছে লাঞ্ছনা,
মোদের অশ্রু দিয়েই জ্ব’লবে দেশে আবার বজ্রানল॥
*৮৭২. রাগ; পাহাড়ি মিশ্র, তাল: দাদ্‌রা
দাঁড়ালে দুয়ারে মোর কে তুমি ভিখারিনী।
গাহিয়া সজল চোখে বেলা-শেষের রাগিণী॥
মিনতি-ভরা আঁখি ওগো কে তুমি ঝড়ের পাখি
(ওগো) কি দিয়ে জুড়াই ব্যথা কেমনে কোথায় রাখি
কোন্ প্রিয় নামে ডাকি’ মান ভাঙাব মানিনী॥
বুকে তোমায় রাখতে প্রিয় চোখে আমার বারি ঝরে,
(ওগো) চোখে যদি রাখিতে চাই বুকে ওঠে ব্যথা ভ’রে।
যত দেখি তত হায়, ওগো পিপাসা বাড়িয়া যায়
কে তুমি যাদুকরী স্বপন-মরু চারিণী॥
*৮৭৩. রাগ: ছায়ানট, তাল: একতাল
দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে
বাঁশরি বাজিল ছায়ানটে মনে মনে॥
চিত্তে চপল নৃত্যে কে
ছন্দে ছন্দে যায় ডেকে;
যৌবনের বিহঙ্গ ঐ ডেকে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে॥
বাজে বিজয়-ডঙ্কা তারই এলো তরুণ ফাল্গুনী,
জাগো ঘুমন্ত-দিকে দিকে ঐ গান শুনি’।
টুটিল সব অন্ধকার-
খোলো খোলো বন্ধ দ্বার;
বাহিরে কে যাবি আয় সে শুধায় জনে জনে॥
*৮৭৪. রাগ: বাগেশ্রী, তাল: ত্রিতাল
মাগো চিন্ময়ী রূপ ধ’রে আয়।
মৃন্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রী দুর্গা তাই দুর্গতি কাটিল না হায়॥
যে মহা-শক্তির হয় না বিসর্জন
অন্তরে বাহিরে প্রকাশ যার অনুখন
মন্দিরে দুর্গে রহে না যে বন্দী সেই দুর্গারে দেশ চায়॥
আমাদের দ্বিভুজে দশভুজা-শক্তি দে পরম ব্রহ্মময়ী।
শক্তি পূজার ফল ভক্তি কি পাব শুধু হব না কি বিশ্বজয়ী?
এই পূজা-বিলাস সংহার কর্ যদি, পুত্র শক্তি নাহি পায়॥
*৮৭৫. রাগ: ষট্ টোড়ি, তাল: ত্রিতাল
সেদিন অভাব ঘুচবে কি মোর যেদিন তুমি আমার হবে
আমার ধ্যানে আমার জ্ঞানে প্রাণ মন মোর ঘিরে রবে॥
রইবে তুমি প্রিয়তম
আমার দেহে আত্মা-সম
জানি না সাধ মিটাবে কি-না-তেমন করেও পাব যবে॥
পাওয়ার আমার শেষ হবে না পেয়েও তোমায় বক্ষতলে
সাগর মাঝে মিশে গিয়েও নদী যেমন ব’য়ে চলে।
চাঁদকে দেখে পরান জুড়ায়
তবু দেখার সাধ কি ফুরায়
মিটেছেল সাধ কি রাধার নিত্য পেয়েও নীল-মাধবে॥
*৮৭৬. তাল: কাহার্‌বা
আমি বিহান-বেলা উঠে রে ভাই চাষ করি এই মাটি।
যে মাটির বুকে আছে পাকা ধানের সোনার কাঠি॥
ফসল বুনে রোদের তাতে উঠি যখন ঘেমে
সদয় হয়ে আকাশ বেয়ে বৃষ্টি আসে নেমে
(ওরে) মুচকি হেসে বৌ এনে দেয় পান্তা ভাতের বাটি॥
আশ মেটে না চারা ধানের পানে চেয়ে চেয়ে
মরাই ভ’রে থাকবে ওরাই আমার ছেলে মেয়ে।
(আমি) চাই না স্বর্গ, পাই যদি এই পাকা ধানের আটি (রে ভাই)॥
জল নিতে যায় আড়চোখে চায় বৌ-ঝি নদীর কূলে
খুশিতে বুক ভ’রে ওঠে, খাটুনি যাই ভুলে।
এ মাঠ নয় ভাই বৌ পেতেছে ঠাণ্ডা শীতল পাটি॥
*৮৭৭. রাগ: ভীমপলশ্রী মিশ্র, তাল: একতাল
বিদায়-সন্ধ্যা আসিল ঐ ঘনায় নয়নে অন্ধকার।
হে প্রিয়, আমার, যাত্রা-পথ অশ্রু-পিছল ক’রো না আর॥
এসেছিনু ভেসে স্রোতের, ফুল
তুমি কেন প্রিয় করিলে ভুল
তুলিয়া খোঁপায় পরিয়া তা’য় ফেলে দিলে হায় স্রোতে আবার॥
হেথা কেহ কারো বোঝে না মন
যারে চাই হেলা হানে সে’জন
যারে পাই সে না হয় আপন হেথা নাহি হৃদি ভালোবাসার।
তুমি বুঝিবে না কি অভিমান
মিলনের মালা করিল ম্লান
উড়ে যাই মোর, দূর বিমান সেথা গা’ব গান আশে তোমার॥
*৮৭৮. তাল: দাদ্‌রা
আমার বিফল পূজাঞ্জলি অশ্রু-স্রোতে যায় যে ভেসে
তোমার আরাধিকার পূজা হে বিরহী, লও হে এসে॥
খোঁজে তোমায় চন্দ্র তপন
পূজে তোমায় বিশ্বভুবন,
আমার যে নাথ ক্ষণিক জীবন মিটবে কি সাধ ভালবেসে॥
না দেখা মোর, বন্ধু ওগো কোথায়, তুমি কোথায়, বাঁশি বাজাও একা,
প্রাণ বোঝে তা অনুভবে নয়ন কেন পায় না দেখা।
সিন্ধু যেমন বিপুল টানে
তটিনীরে টেনে আনে,
তেমনি করে তোমার পানে আমায় ডাকো নিরুদ্দেশে॥
*৮৭৯. তাল: কাহার্‌বা
এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা।
সকাল বেলা আমির, রে ভাই (ও ভাই) ফকির, সন্ধ্যাবেলা॥
সেই নদীর ধারে কোন্ ভরসায়
বাঁধলি বাসা, ওরে বেভুল, বাঁধলি বাসা, কিসের আশায়?
যখন ধরলো ভাঙন পেলি নে তুই পারে যাবার ভেলা।
এই তো বিধির খেলা রে ভাই এই তো বিধির খেলা॥
এই দেহ ভেঙে হয় রে মাটি, মাটিতে হয় দেহ
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ, তার খোঁজ নিল না কেহ (রে ভাই)।
রাতে রাজা সাজে নাচমহলে
দিনে ভিক্ষা মেগে বটের তলে
শেষে শ্মশান ঘাটে গিয়ে দেখে সবাই মাটির ঢেলা
এই তো বিধির খেলা রে ভাই ভব নদীর খেলা॥
*৮৮০. তাল:কাহার্‌বা
অমন করে হাসিস্‌নে আর রাই লো।
তুই পোড়ার মুখে হাসিস্‌নে আর রাই লো।
ছি ছি রঙ্গ করিস অঙ্গে মেখে কৃষ্ণ কালির ছাই লো॥
বাঁশি হাতে গাছে চড়া, কয়লা-বরণ গয়লা ছোঁড়া সে লো
সেই নাটের গুরু নষ্টের গোড়া তোর প্রেমের গোঁসাই লো॥
ঐ গো-রাখা রাখালের সনে তোর নিন্দা শুনি বৃন্দাবনে রাই লো
ছি ছি কেষ্ট ছাড়া ইষ্ট কি আর ত্রিভুবনে নাই লো॥
ঐ অমাবস্যার কৃষ্ণ-চাঁদে, বাস্‌লি ভালো কোন্ সুবাদে তুই লো
তুই দিন-কানা হয়েছিস রাধে ভাবিয়া কানাই লো॥
*৮৮১. তাল: দাদ্‌রা
মা, মা গো-
আমার অহঙ্কারের মূল কেটে দে কাঠুরিয়ার মেয়ে,
কত নিরস তরু হ’ল মঞ্জুরিত তোর চরণ-পরশ পেয়ে॥
রোদে পুড়ে জলে ভিজে মা দিয়েছি ফুল ফল
শাখায় আমার, নীড় বেঁধেছে বিহঙ্গের দল।
বটের মত সারা দেহ মাগো মায়ার জটে আছে ছেয়ে॥
ও মা মূল আছে তাই বৈতরণীর কূলে আছি পড়ি
নইলে হ’তাম খেয়াঘাটের পারাপারের তরী।
তুই খড়গের ভয় দেখাস মিছে
মুক্তি আছে এরি পিছে মাগো
তোর হাসির বাঁশি শুনতে পাবো অসির আঘাত খেয়ে॥
*৮৮২. তাল: দাদ্‌রা
(মা) আমি, মুক্তা নিতে আসিনি মা ও মা তোর মুক্তি-সাগর কূলে।
মোর ভিক্ষা-ঝুলি হ’তে মায়ার মুক্তা মানিক নে মা তুলে॥
মা তুই, সবই জানিস অন্তর্যামী,
সেই চরণ-প্রসাদ ভিক্ষু আমি,
শবেরও হয় শিবত্ব লাভ মা তোর যে চরণ ছুঁলে॥
তুই অর্থ দিয়ে কেন ভুলাস এই পরমার্থ ভিখারিরে,
তোর প্রসাদী ফুল পাই যদি মা গঙ্গা ধারাও চাই না শিরে।
তোর শক্তিমন্ত্রে শক্তিময়ী
আমি হতে পারি ব্রহ্ম-জয়ী,
সেই মাতৃনামের মহাভিক্ষু তোর মায়াতেও নাহি ভুলে॥
*৮৮৩. তাল: দাদ্‌রা
ওমা এক্‌লা ঘরে ডাকব না আর দুয়ার বন্ধ ক’রে
তুই সকল ছেলের মা যেখানে ডাকব মা সেই ঘরে॥
রুদ্ধ আমার একলা এ মন্দিরে,
পথ না পেয়ে যাস্ বুঝি মা ফিরে,
মোরে জ্যোতির্লোকে ঘুম্ পাড়িয়ে তাপিত সন্তানে নিয়ে
মাগো কাঁদিস্ বুকে ধ’রে॥
আমি একলা মানুষ হ’তে গিয়ে হারাই মা তোর স্নেহ,
আমি যে ঘর যেতে ঘৃণা করি মা,- সেই তোর গেহ।
দুর্বল মোর ভাই বোনদের তুলে,
আমি দাঁড়াব মা যেদিন চরণ মূলে।
সেদিন মা তুই আপনি এসে কোলে তুলে নিবি হেসে,
আর হারাব না তোরে॥
*৮৮৪. তাল: কাহার্‌বা
জগতের নাথ তুমি, তুমি প্রভু প্রেমময়।
আমি জগতের বাহিরে নহি দেহ চরণে আশ্রয়॥
যাহাদের তরে আমি খাটিনু দিবস-রাতি,
(আমার) যাবার বেলায় কেহ তাদের হ’ল না সাথের সাথি।
সম্পদ মোর পাঁচ ভূতে খায়, কর্ম কেবল সঙ্গে রয়॥
ভুলিয়া সংসার মোহে লই নাই তোমারি নাম-
তরাতে এমন পাপী পাবে না হে ঘনশ্যাম।
শুনেছি তোমারে যদি কাঁদিয়া কেহ ডাকে-
তুমি অমনি তারে কর ক্ষমা চরণে রাখ তাকে।
আমি সেই আশাতে এসেছি নাথ যদি তব কৃপা হয়॥
*৮৮৫. তাল: কাহার্‌বা
আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়।
মোছ আঁখি, দুয়ার খোলো, দাও বিদায়॥
ফোটে যে ফুল আঁধার রাতে
ঝরে ধূলায় ভোর বেলাতে
আমায় তারা ডাকে সাথে-আয় রে আয়।
সজল করুণ নয়ন তোলো, দাও বিদায়॥
অন্ধকারে এসেছিলাম থাকতে আঁধার যাই চ’লে;
ক্ষণিক ভালোবেসেছিলেম চিরকালের না-ই হ’লে।
হ’লো চেনা হ’লো দেখা
নয়ন-জলে রইলো লেখা
দূর বিরহের ডাকে কেকা বরষায়
ফাগুন স্বপন ভোলো ভোলো, দাও বিদায়॥
*৮৮৬. তাল: ফের্‌তা (দাদ্‌রা ঝাঁপ ও কাহার্‌বা)
আমি কি সুখে লো গৃহে রবো
সখি গো-
আমার শ্যাম হলো যদি যোগী ওলো সখি আমিও যোগিনী হবো।
আমি যোগিনী হবো
শ্যাম যে তরুর তলে বসিবে লো ধ্যানে
সেথা অঞ্চল পাতি’ রবো
আমার বঁধুর পথের ধূলি হবো
আমায় চলে যেতে দলে যাবে সেই সুখে লো ধূলি হবো
সখি গো-
আমি আমার সুখের গোধূলি বেলার
রঙে রঙে তারে রাঙাইব
তার গেরুয়া রাঙা বসন হয়ে
জড়াইয়া রবো দিবস যামী
সখি গো-
সখি আমার কঠিন এ রূপ হবে রুদ্রাক্ষেরই মালা
তার মালা হয়ে ভুলব আমার পোড়া প্রাণের জ্বালা
আমার এ দেহ পোড়ায়ে হইব চিতা ছাই
মাখিবে যোগী মোর পুড়িব সেই আশায়
পোড়ার কি আর বাকি আছে
আমার শ্যাম গেছে যোগী হয়ে ছায়া শুধু পড়ে আছে॥
*৮৮৭. রাগ: বেহাগ মিশ্র, তাল: দাদ্‌রা
আমি দেখন-হাসি
আমায় দেখ্‌লে পরে হাসতে হাসতে পেয়ে যাবে কাশী॥
আমি হাসির হাঁসলী ফিরি করি এলে আমার হাসির দেশে
বুড়োরা সব ছোঁড়া হয়, আর ছোঁড়ারা যায় টেসে।
আমার হাস-খালিতে বাড়ি, আমি হাস্নুহানার মাসি॥
এলে আমার হাসির হেঁসেলে তার হাঁসফাঁসানি লেগে
অন্তে শুধু সন্ত থাকে শরীরটা যায় ভেগে।
(আমি) পাতি হাঁসির আণ্ডা বেচি আর হাসির ময়দা খাঁসি॥
সেদিন পথে যাচ্ছিল সব রাজার হাতি ঘোড়া উট
তারা না আমায় দেখি হাসতে হাসতে
‘চোঁ চোঁ চোঁ’ এই না বলি’ অমনি দিলে ছুট
হেসে পালিয়ে গেল দড়ি ছিঁড়ে মটরু মিঞার খাসি॥
*৮৮৮. রাগ: বাগেশ্রী, তাল:দাদ্‌রা
আর লুকাবি কোথা মা কালী
বিশ্ব-ভুবন আঁধার ক’রে তোর রূপে মা সব ডুবালি॥
সুখের গৃহ শ্মশান ক’রে বেড়াস্ মা তায় আগুন জ্বালি’
দুঃখ দেবার রূপে মা তোর ভুবন-ভরা রূপ দেখালি॥
পূজা ক’রে পাইনি তোরে মা গো এবার চোখের জলে এলি
বুকের ব্যথায় আসন পাতা ব’স্ মা সেথা দুখ্-দুলালী॥
*৮৮৯. রাগ: ভৈরবী-আশাবরি, তাল: আদ্ধা
আজ বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে।
হায় কী মনে পড়ে মন এমন করে॥
আজ এমন দিনে কোন্ নীড়হারা পাখি
যাও কাঁদিয়া কোথায় কোন্ সাথীরে ডাকি’।
তোর ভেঙেছে পাখা কোন্ আকুল ঝড়ে॥
আয় ঝড়ের পাখি আয় আমার এ বুকে
আয় দিব রে আশয় মোর গহন-দুখে।
আয় বাঁধিব বাসা আজ নূতন ক’রে॥
*৮৯০. রাগ: জৌনপুরী, তাল: দাদ্‌রা
কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।
(তার) রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব যার হাতে মরণ বাঁচন॥
কালো মায়ের আঁধার কোলে
শিশু রবি শশী দোলে
(মায়ের) একটুখানি রূপের ঝলক স্নিগ্ধ বিরাট নীল-গগন॥
পাগলী মেয়ে এলোকেশী নিশীথিনীর দুলিয়ে কেশ
নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার রে তার নাই কো শেষ।
সিন্ধুতে মা’র বিন্দুখানিক
ঠিক্‌রে পড়ে রূপের মানিক
বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না মা আমার তাই দিগ্‌-বসন॥

*৮৯১. তাল: কাহার্‌বা
দেশে দেশে গেয়ে বেড়াই তোমার নামের গান
হে খোদা, এ যে তোমারই হুকুম, তোমারই ফরমান॥
এমনি তোমার নামের আছর-
নামাজ রোজার নাই অবসর,
তোমার নামের নেশায় সদা মশগুল মোর প্রাণ॥
তকদিরে মোর এই লিখেছ হাজার গানের সুরে
নিত্য দিব তোমার আজান আঁধার মিনার-চূড়ে।
কাজের মাঝে হাটের পথে
রণ-ভূমে এবাদতে
আমি তোমার নাম শোনাব, করব শক্তি দান॥
*৮৯২. রাগ: দেশ-খাম্বাজ, তাল: ত্রিতাল
পিউ পিউ পিউ বোলে পাপিয়া
বুকে তারি পিয়ারে চাপিয়া॥
বাতাবি নেবুর ফুলেলা কুঞ্জে
মাতাল সমীরণ প্রলাপ গুঞ্জে
ফুলের মহলায় চাঁদিনী শিহরায়
নদীকূলে ঢেউ ওঠে ছাপিয়া॥
এমনি নেবু ফুল এমনি মধুরাতে
পরাতো বঁধু মোর বিনোদ খোঁপাতে,
বাতায়নে পাখি করিত ডাকাডাকি
মনে পড়ে তায় উঠি কাঁপিয়া॥
*৮৯৩. তাল: দাদ্‌রা
প্রাণের ঠাকুর লীলা করে আমার দেহের আঙিনাতে
রসের লুকোচুরি খেলা নিত্য আমার তারই সাথে॥
তারে নয়ন দিয়ে খুঁজি যখন
অন্তরে সে লুকায় তখন
অন্তরে তায় ধরতে গেলে লুকায় গিয়ে নয়ন-পাতে॥
ঐ দেখি তার হাসির ঝিলিক আমার ধ্যানের ললাট-মাঝে
ধরতে গেলে দেখি সে নাই কোন্ সুদূরে নূপুর বাজে।
এত কাছে রয় সে তবু পাই না তারে হাতে হাতে॥
*৮৯৪. রাগ: পিলু, তাল: ফের্‌তা
ভুলি কেমনে আজো যে মনে
বেদনা-সনে রহিল আঁকা।
আজ সজনী দিন রজনী
সে বিনে গনি সকলি ফাঁকা॥
আগে মন করলে চুরি
মর্মে শেষে হানলে ছুরি
এত শঠতা এত যে ব্যথা
তবু যেন তা মধুতে মাখা॥
চকোরী দেখলে চাঁদে
দূর থেকে সই আজো কাঁদে
আজো বাদলে ঝুলন ঝুলে
তেমনি জলে চলে বলাকা॥
বকুলের তলায় দোদুল
কাজলা মেয়ে কুড়োয় লো ফুল
চলে নাগরী কাঁখে গাগরি
চরণ ভারি কোমর বাঁকা॥
ডালে তোর করলে আঘাত
দিস্ রে কবি ফুল সওগাত
ব্যথা-মুকুলে অলি না ছুঁলে
বনে কি দুলে ফুল-পতাকা॥
*৮৯৫. বৈতালিক
যেয়ো না যেয়ো না মদিনা-দুলাল হয়নি যাবার বেলা।
সংসার-পাথারে, আজো দোলে পাপের ভেলা॥
মেটেনি তোমায় দেখার পিয়াসা
মেটেনি কদম জিয়ারত আশা
হযরত, এই জমেছে প্রথম দীন-ই-ইসলাম মেলা॥
ছড়ায়ে পড়েনি তোমার কালাম আজিও সকল দেশে,
ফিরিয়া আসেনি সিপাহীরা তব আজও বিজয়ীর বেশে।
দিনের বাদশা চাও ফিরে চাও
শোক-দুর্দিনে বেদনা ভোলাও
গুনাহ্‌গার এই উম্মতে তব হানিও না অবহেলা॥
*৮৯৬. তাল: দাদ্‌রা
শোক দিয়েছ তুমি হে নাথ তুমি এ প্রাণে শান্তি দাও।
দুখ্ দিয়ে কাঁদালে যদি তুমি হে নাথ সে দুখ ভোলাও॥
যে হাত দিয়ে হানলে আঘাত
তুমি অশ্রু মোছাও সেই হাতে নাথ
বুকের মানিক হ’রলে যা’র, তারে তোমার শীতল বক্ষে নাও॥
তোমার যে চরণ প্রলয় ঘটায়
সেই চরণ কমল ফোটায়
শূন্য করলে তুমি যে বুক সেথা তুমি এসে বুক জ্বড়াও॥
*৮৯৭.তাল: কাহার্‌বা
শ্রীকৃষ্ণ নাম মোর জপ-মালা নিশিদিন শ্রীকৃষ্ণ নাম মোর ধ্যান।
শ্রীকৃষ্ণ বসন শ্রীকৃষ্ণ ভূষণ ধরম করম মোর জ্ঞান॥
শয়নে স্বপনে ঘুমে জাগরণে বিজড়িত শ্রীকৃষ্ণ নাম (মোর)
কৃষ্ণ আত্মা মম কৃষ্ণ প্রিয়তম ওই নাম দেহ মন প্রাণ॥
কৃষ্ণ নয়ন-ধার কৃষ্ণ গলার হার এ হৃদয় তাঁরি ব্রজধাম
ঐ নাম-কলঙ্ক ললাটে আঁকিয়া গো ত্যাজিয়াছি লাজ কুল মান॥
*৮৯৮. তাল: কাহার্‌বা
শ্রীকৃষ্ণ নামের তরীতে কে হবি পার কৃষ্ণ নামের তরীতে!
তরাইতে পাপী পতিত মানবে এলো তরী ভব-নদীতে॥
ডাকিছে আর্তজনে বাঁশির সুরে নাইয়া কানাইয়া ‘আয় আয়’ ব’লে
মধুর নামের তরী টলমল দোলে আশ্রিতে পারে নিতে॥
ঘন দুর্দিন-ঘেরা আঁধার সংসার নাম প্রদীপ আশার;
জপ প্রেম-ভরে তাঁহারই প্রিয় নাম (তরঙ্গে) তরী ডুবিবে না আর।
তাঁর নাম পারের তরী, কাণ্ডারি শ্রীচরণ শরণ নে রে তোরা তাঁরই
নামের আলোকে যাবি রে গোলকে নাম গাহিতে গাহিতে॥
*৮৯৯. তাল: দ্রুত-দাদ্‌রা
সন্ধ্যা হলো ঘরকে চলো, ও ভাই মাঠের চাষি
ভাটিয়ালি সুরে বাজে রাখাল ছেলের বাঁশি॥
পিদিম নিয়ে একলা জাগে একলা ঘরের বধূ
হৃদয়-পাতে লুকিয়ে রেখে সারা দিনের মধু;
পথ চেয়ে সে বসে আছে কাজ হয়েছে বাসি রে তার
কাজ হয়েছে বাসি।
(যে) মন সারাদিন ছিল প’ড়ে হালের গরুর পানে,
দিনের শেষে ঘরের জরু সেই মনকে টানে
সেথা মেটে ঘরের দাওয়ায় লুটায় রে
মেটে ঘরের দাওয়ায় লুটায় কালো চোখের হাসি রে ভাই
কালো চোখের হাসি।
পুবান হাওয়া ঢেউ দিয়ে যায় আউশ ধানের ক্ষেতে,
এই ফসলের দেখব স্বপন শুয়ে শুয়ে রেতে;
ও ভাই শুয়ে শুয়ে রেতে
সকাল বেলা আবার যেন মাঠে ফিরে আসি রে
এই মাটে ফিরে আসি॥
*৯০০. রাগ: ভৈরবী, তাল: ত্রিতাল
হে মাধব, হে মাধব, হে মাধব!
তোমারেই প্রাণের বেদনা কব তোমারি শরণ লব॥
সুখের সাগরে লহরি সমান
হিল্লোলি’ উঠে যেন তব নাম গান
দুঃখে শোকে কাঁদে যবে প্রাণ যেন নাম না ভুলি তব॥
তুমি ছাড়া বিশ্বে কাহারও কাছে
এ প্রাণ যেন কিছু নাহি যাচে।
যেন তোমারি অধিক কেহ প্রিয় নাহি হয়
বিশ্ব ভুবনে যেন হেরি তুমি-ময়
কলঙ্ক-লাঞ্ছনা যত বাধা ভয় তব প্রেমে সকলি স’ব॥