প্রলয়-শিখা
 
 
কাজী নজরুল ইসলাম
	
    পূজা অভিনয় 
মানুষের পদ-পূত মাটি দিয়া
   
দেবতা রচিছে পূজারিদল।
সে দেবতা গেল স্বর্গে, মানুষ
   
রহিল আঁকড়ি মর্ত্যতল।
দেবতারে যারা করেছে সৃজন,
   
সৃজিতে পারে না আপনারে,
আসে না শক্তি, পায় না আশিস,
   
ব্যর্থ সে পূজা বারে বারে।
মাটির প্রতিমা মাটিই রহিল,
   
হায় কারে দিবে শক্তিবর,
দেবতার বর নিতে পারে হাতে
   
হেথা কোথা সেই শক্তিধর!
বিগ্রহ-চালে হাসে বুড়োশিব,
   
বলে, ‘দেখো দেখো দশভুজা,
নেংটি পরিয়া নেংটে ইঁদুর –
   
ভক্তরা এল দিতে পূজা;
গণেশ-ভক্ত ইঁদুরে-বুদ্ধি
   
হস্তীকর্ণ লম্বোদর,
কার্তিকে মোর সাজায়েছে দেখো,
   
যেন উহাদের মিয়ের বর!
উহাদের দেব-সেনাপতি পরে
   
ছেঁড়া কটিবাস আধ-হাতি,
সেনাদল হল চরকাবুড়ি গো,
   
তরুণেরা হল জোলা তাঁতি!
মাথা কেটে আর অস্ত্র হেনেও
   
হয় না স্বাধীন আর সকল,
সূতা কেটে আর বস্ত্র বুনিয়া
   
কেল্লা করিবে ওরা দখল!
বলি দেয় ওরা কুমড়ো ছাগল
   
বড়ো জোর দুটো পোষা মহিষ,
মহিষাসুরেরে বলি দিতে নারে,
   
বলে, ‘মাগো ওটা তুই বধিস।’
লক্ষ্মীর হাতে অমৃতভাণ্ড,
   
লক্ষ্মী ছেলেরা তাহাই চায়,
তাই পূজা করে ওরা বণিকেরে –
   
লক্ষ্মীবাহন কালপ্যাঁচায়!
অমৃত চাহিছে, ওরা তো চাহে না
   
মোর কণ্ঠের বিষের ভাগ,
ওদেরই মরুতে জঙ্গলে চরে
   
তোমার বাহন সিংহ-বাঘ!
দেখিয়া তরাসে পলায় উহারা;
   
বাহন দেখিয়া যাদের ভয়,
সিংহবাহিনী! পূজিয়া তোমায়
   
তারাই করিবে অসুর জয়?
সেথা তব হাতে টিনের খড়গ,
   
সারা গায়ে মোড়া ঝালতা রাং,
দেখে হাসে আর ঘুমাই শ্মশানে,
   
ভক্তের দল জোগায় ভাং।
কোন রূপ তব ধ্যান করে ওরা,
   
শুনিবে? শুনিয়া যাও ঘুমোও,
শ্বশুর-বাড়ির ফেরত যেন গো,
   
অসুর-বাড়ির ফেরত নও!
বাণী-মেয়ে মোর বোবা হয়ে বসে,
   
ভাঙা বীণা কোলে বসিয়া রয়,
কথায় কথায় সেথা সিডিসন,
   
কী জানি কখন জেলের ভয়।
নিজেরা বন্দি, তাই দেখো ওরা
   
ধরিয়া ও কোন কন্যারে
কলা-বউ করে রেখেছে তাদের 
   
হীন কামনার কারাগারে!
ভূতো ছেলেগুলো কলেজেতে পড়ে,
   
কে জানে ক-ল্যাজ পায় হোথায়,
কেহ শাখামৃগ হইয়াছে উঠি
   
আধ্যাত্মিক উঁচু শাখায়!’
  
এমনই শরৎ সৌরাশ্বিনে
   
অকাল-বোধনে মহামায়ার
যে পূজা করিল বধিতে রাবণে
   
ত্রেতায় স্বয়ং রামাবতার,
আজিও আমরা সে দেবী-পূজার
   
অভিনয় করে চলিয়াছি!
লঙ্কা-সায়রী রাবণ ধরিয়া
   
টুঁটিতে ফাঁসায়ে দেয় কাছি।
দুঃসাহসীরা দুর্গা বলিয়া
   
হয়তো কাছিতে পড়ে ঝুলে,
দেবীর আসন তেমনই অটল,
   
হয়তো ঈষৎ ওঠে দুলে।
কে ঘুচাবে এই পূজা-অভিনয়,
   
কোথায় দূর্বাদলশ্যাম
ধরণি-কন্যা শস্য-সীতারে
   
উদ্ধারিবে যে নবীন রাম!
  
দশমুখো ওই ধনিক রাবণ
   
দশ দিকে আছে মেলিয়া মুখ,
বিশ হাতে করে লুণ্ঠন তবু
   
ভরে নাকো ওর ক্ষুধিত বুক।
হয়তো গোকুলে বাড়িছে সে আজ,
   
উহারে কল্য বধিবে যে,
গোয়ালার গরে খেঁটে-লাঠি-করে
   
হলধর-রূপী রাম সেজে!