সালেক
আজকার প্রভাতের সঙ্গে শহরে আবির্ভূত হয়েছেন এক অচেনা দরবেশ। সাগরমন্থনের মতো হুজুগে লোকের কোলাহল উঠেছে পথে, ঘাটে, মাঠে, – বাইরের সব জায়গায়। অন্তঃপুরচারিণী অসূর্যম্পশ্যা জেনানাদের হেরেম তেমনই, নিস্তব্ধ নীরব, – যেমন রোজই থাকে দুনিয়ার সব কলরব ‘হ-য-ব-র-ল’র একটেরে! বাইরে উঠছে কোলাহল, – ভিতরে ছুটছে স্পন্দন।
সবারই মুখে এক কথা, ‘ইনি কে? যাঁর এই আচমকা আগমনে নূতন করে আজ নিশিভোরে উষার পাখির বৈতালিক গানে মোচড় খেয়ে কেঁপে উঠল আগমনির আনন্দভৈরবী আর বিভাস’?
ছুটছে ছেলে মেয়ে বুড়ো সব একই পথে ঘেঁষাঘেঁষি করে দরবেশকে দেখতে। তবুও দেখার বিরাম নাই। দুঃশাসন টেনেই চলেছে কোন্ দ্রৌপদীর লজ্জাভরণ, এক মুখ বিস্ময়-বিস্ফারিত-অক্ষি বিশ্বের চোখের সুমুখে, আর তা বেড়েই চলেছে। তার আদিও নেই, অন্তও নেই। ওগো, অলক্ষ্যে যে এমন একটি দেবতা রয়েছেন, যিনি গোপনের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেন না।
দরবেশ কথাই কয় না, – একেবারে চুপ।
অনেকে বায়না ধরলে দীক্ষা নেবে; দরবেশ ধরা-ছোঁয়াই দেয় না। যে নিতান্তই ছাড়ে না, তাকে বলে, ‘কাপড় ছেড়ে আয়!’ সে ময়লা কাপড় ছেড়ে খুব ‘আমিরানাশানের’ জামা জোড়া পরে আসে। দরবেশ শুধু হাসে আর হাসে, কিছুই বলে না।
শহরের কাজি শুনলেন সব কথা। তিনিও ধন্না দিতে শুরু করলেন দরবেশের কাছে। দরবেশ যতই আমল দিতে চায় না, কাজি সাহেব ততই নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে থাকেন । দরবেশ বুঝলেন, এ ক্রমে ‘কমলিই ছোড়তা নেই’ গোছের হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাঁর মুখে ফুটে উঠল ক্লান্ত সদয় হাসির ঈষৎ রেখা।
[ খ ]
দরবেশ বললেন, ‘শুন কাজি সাহেব, আমি যা বলব তাই করতে পারবে?’
কাজি সাহেব আস্ফালন করে উঠলেন, ‘হাঁ, হুজুর, বান্দা হাজির!’
দরবেশ হাসলে, তারপর বললে, ‘দেখো, কাল জুম্মা। মুল্লুকের বাদশা আসছেন এখানে। নামাজ পড়বার সময় তোমায় ‘ইমামতি’ করতে বলবেন! তুমি সেই সময় একটা কাজ করতে পারবে?’ কাজি সাহেব বলে উঠলেন, ‘আলবৎ হুজুর, আলবৎ! কী করতে হবে?’
দরবেশ বললে, ‘তোমার দু-বগলে দুটি মদের বোতল দাবিয়ে নিয়ে যেতে হবে; তার পর যেই নামাজে দাঁড়াবে, অমনি মদের বোতল দুটি দিব্যি ‘জায়নামাজের’ উপর ভেঙ্গে দেবে।’
কাজি সাহেবের মুখ হয়ে গেল নীল। কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘হুজুর, তাহলে আপনি আমা হতে মুক্তি পাবেন সত্যি, কেননা ওর পরেই আমার মাথা ধড় হতে আলাদা হয়ে যাবে, – কিন্তু আমার মুক্তি হবে কী?’
দরবেশ বললেন, ‘অনেককেই ভব-যন্ত্রণা হতে মুক্তি দিয়েছ তুমি, একবার নিজের মুক্তিটাই তো দেখতে হবে!’
কাজি সাহেব চলে এলেন। ভাবলেন, ‘যা থাকে অদৃষ্টে, কাল নিয়ে যাওয়া
যাবে দুটো মদের বোতল মসজিদে। দরবেশ নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বেশি জানে’।
[ গ ]
বাদশাহ এসেছেন। সঙ্গে আছে সেনা-সামন্ত উজির-নাজির সব। জুম্মার নামাজ হচ্ছে। ‘এমাম
(আচার্য) হয়েছেন কাজি সাহেব। একটু পরই কাজি সাহেবের বগলতলা হতে খসে পড়ল দুটি ধেনো
মদের বোতল। আর এটা বলাই বাহুল্য যে, সে বোতল সশব্দে বিদীর্ণ হয়ে যে বিশ্রী গন্ধে
মসজিদ ভরিয়ে তুলল তাতে সকলেই একবাক্যে সমর্থন করলে যে, কাজি সাহেবের মতো মাতাল আর
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে হয়নি, হবেও না। যে মদ খায় তার ক্ষমা আছে, কিন্তু যাকে মদে খায় তার
ক্ষমাও নেই নিস্তারও নেই।
বৈঠক বসল, এ অসমসাহসিক মাতালের কী শাস্তি দেওয়া দরকার! উজির ছাড়া সভাস্থ সকলেই বললে, ‘এর আবার বিচার কী জাঁহাপনা? শূলে চড়ানো হোক!’ মন্ত্রী উঠে বললেন, ‘এ বান্দার গোস্তাখি মাফ করতে আজ্ঞা হয় হুজুর! আমার বিবেচনায় এর মতো পাপিষ্ঠ লোকের মৃত্যুদণ্ড উপযুক্ত শাস্তি নয়। সবচেয়ে বেশি শাস্তি দেওয়া হবে যদি তার পদ আর পদবি কেড়ে নেন, আর যা কিছু সম্পত্তি তা বাজেয়াপ্ত করে নেন। মৃত্যদণ্ড হলে তো সব ল্যাঠা চুকেই গেল। কিন্তু এই যে তার জীবনব্যাপী লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা, তা তাকে তিলে তিলে দগ্ধ করে মারবে!’ বাদশা সমেত সভাস্থ সকলেই হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘তাই ভালো!’
পাশ দিয়ে উড়ো খইয়ের মতো একটা পাগলা যা তা বকে যাচ্ছিল, ‘এই সব লাঞ্ছনা আর গঞ্জনাই তো চন্দন! আর ওতে কিছু দগ্ধ হয় না ভাই, স্নিগ্ধই হয়।’
[ ঘ ]
বাদশার দরবারে কাজি সাহেব যখন এই রকম লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে, সব হারিয়ে একটা অন্ধকার
গলির বাঁকে দাঁড়ালেন, তখন তাঁর দুর্দশা দেখে পথের কুকুরও কাঁদে! ‘হাতি আড় হলে
চামচিকেও লাথি মারে!’ তিনি যখন শহরের কাজি ছিলেন, তখন হয়তো ন্যায়ের জন্যেও যাদিগে
শাস্তি দিয়েছিলেন, তারাই সময় পেয়ে উত্তম-মধ্যম প্রহারের সঙ্গে জানিয়ে দিলে যে,
চিরদিন কারুর সমান যায় না। আর যাদিগে অবিচার করে শাস্তি দিয়েছিলেন, তার প্রতিশোধ
নিলে তারা যে রকম নিষ্ঠুরভাবে, তার চেয়ে শূলে চড়ে মৃত্যুও ছিল শ্রেয়।
এত লাঞ্ছনা আর গঞ্জনার মধ্যেও সে কার স্নিগ্ধ সান্ত্বনা ছুঁয়ে গেল আচমকা এসে, ঠিক যেন জ্বরের কপালে বাঞ্ছিতা প্রেয়সীর গাঢ় করুণ পরশের মতো। কাজি সাহেব বুকের শুকনো হাড়গুলোকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলেন, ‘খোদা, এমনি করে আমার সকল অহংকার চোখের জলে ডুবিয়ে দিলে।’
‘ওগো দরবেশ, কোথায় তুমি? কোন্ সুদূরের পারে?’
তার পর সেই সন্ধ্যায় সরীসৃপের মতো বুকের উপর ভর দিয়ে অতি কষ্টে কাজি সাহেব যখন তাঁর বাঞ্ছিত পথ বেয়ে দরবেশের আস্তানায় এসে পঁহুচলেন, তখন একটা শান্ত ঘুমের সোহাগ-ভরা ছোঁয়ার আবেগে আঁখির পাতা জড়িয়ে আসছে। তবুও একবার প্রাণপণে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘দরবেশ, দীক্ষিত কর! – আমি এসেছি, আর যে সময় নাই।’
পুরবির মিড়ে, সন্ধ্যা গোধূলির সম্মিলনে যে একটা ব্যথার কাঁপুনি রয়ে গেল, তা কেউ লক্ষ করলে না।
কার শান্ত-শীতল ক্রোড় তাঁকে জানিয়ে দিলে, ‘এই যে বাপ! এসো! এখন তোমার মলিন বস্ত্র আর মলিন অহংকার সব চোখের জলে ধুয়ে সাফ হয়ে গেছে।’
দরবেশ সুরবাহারটায় ঝংকার দিয়ে গেয়ে উঠলেন,
‘বমে সাজ্জদা রঙ্গিন কুন গরৎ পীরে মাগাঁ গোয়েদ!
কে সালেক বেখবর না বুদ জেরাহোরসমে মঞ্জেল হা।’
‘জায়েনামাজে শারাব-রঙিন কর, মুর্শেদ বলেন যদি।
পথ দেখায় যে, জানে সে যে , পথের কোথায় অন্ত আদি।’
সৎমা-তাড়ানো মাতৃহারা মেয়ের মতো অশ্রু আর অভিমান-আর্দ্র মুখে একটা-ভারি কালো মেঘ সব ঝাপসা, ক্রমে অন্ধকার করে দিলে। কাজি সাহেব প্রাণের বাকি সমস্ত শক্তিটুকু একত্র করে ভাঙা গলায় বললেন, ‘কে? ওগো পথের সাথি। তুমি কে?’ অনেকক্ষণ কিছু শোনা গেল না! নদীর নিস্তব্ধ তীরে তীরে দুলে গেল আর্ত-গম্ভীর প্রতিধ্বনি, ‘তু – মি – কে?’ খেয়া পার হতে খুব মৃদু একটা আওয়াজ কাঁপতে কাঁপতে কয়ে গেল, ‘মাতাল হাফিজ!’
বকুল' পত্রিকা [আষাঢ় ১৩২৭ (জুন ১৯২০) সংখ্যা]। শিরোনাম: 'সালেক'। এই গল্পটি
পরে
রিক্তের
বেদন [পৌষ ১৩৩১, ডিসেম্বর ১৯২৪
খ্রিষ্টাব্দ] নামক গল্প-সংকলনে
অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।