রুদ্র-মঙ্গল
কাজী নজরুল ইসলাম
রুদ্র-মঙ্গল
নিশীথ রাত্রি। সম্মুখে গভীর তিমির। পথ নাই। আলো নাই।
প্রলয়-সাইক্লোনের আর্তনাদ মরণ-বিভীষিকার রক্ত-সুর বাজাচ্ছে। তারই মাঝে মাকে আমার
উলঙ্গ করে টেনে নিয়ে চলেছে আর চাবকাচ্ছে যে, সে দানবও নয়, দেবতাও নয়, রক্ত-মাংসের
মানুষ। ধীরে ধীরে পিছনে চলেছে তেত্রিশ কোটি আঁধারের যাত্রী। তারা যতবার আলো
জ্বালাতে চায়, ততবারই নিভে নিভে যায়। তাদের আর্তকণ্ঠে অসহায়ের ক্রন্দন, ‘বোধন না
হতে মঙ্গলঘট ভেঙেছে –’। শুধু ক্রন্দন, শুধু হা-হুতাশ – শক্তি নাই, সাহস নাই।
কোথায় আঘাতের দেবতা! আঘাত করো, আঘাত করো তাদেরে, যারা চোখের
সামনে মায়ের অপমান দেখে শুধু ক্রন্দন করে, প্রতিকারের পন্থার অন্বেষণে উন্মত্ত
উল্লাসে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে না! অবমানিত হয়ে যাদের চোখে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত না হয়ে
অশ্রজল নির্গত হয়, তাদের আঘাত করো, আঘাত করো হে আঘাতের দেবতা! মারো তাদের বুকে মুখে
পিঠে – মারো তাদেরে। জাগাও তাদের আত্মসম্মান! পৌরুষ তাদের হুংকার দিয়ে পড়ুক
অত্যাচারের বুকে।
এ কি বেদনা! এ কী ক্রন্দন! উৎপীড়িতের আর্তনাদে, ‘মজলুমের
ফরিয়াদে’ আকাশের সারা গায়ে আজ জ্বালা, বাতাসের নিশ্বাসে ব্যথা, মাতা বসুমতীর বুক
ফেটে নির্গত হচ্ছে অগ্নিস্রাব আর ভস্মধূম। অত্যাচারীর ভীম নিষ্পেষণে বাসুকির অচল
ফণা থরথর করে কাঁপছে, এই ভূমিকম্পের কম্পিতা ধরণিকে অভয়-তরবারি এনে সান্ত্বনা দেবে,
কে আছ বীর? আনো তোমার প্রলয়-সুন্দর করাল-কমনীয় হস্ত! আনো তোমার রক্ত-কৃপাণের
বিদ্যুৎ-হাসি, আনো তোমার মারণ-মঙ্গল অভয়-অসি! হে আমার ধ্বংসের দেবতা, একবার এই
মহাপ্রলয়ের বুকে তোমার ফুলের হাসি দেখাও! স্তূপীকৃত শবের মাঝে শিবের জটার কচি শশী
হেসে উঠুক! এই কুৎসিত অসুন্দর সৃষ্টিকে নাশ করো, নাশ করো হে সুন্দর রুদ্র-দেবতা! এই
গলিত আর্ত সৃষ্টির প্রলয়-ভস্মটিকা পরে নবীন বেশে এসে দেখা দাও!
জাগো জনশক্তি! হে আমার অবহেলিত পদপিষ্ট কৃষক, হে আমার মুটে-মজুর
ভাইরা! তোমার হাতে এ-লাঙল আজ বলরাম-স্কন্ধে হলের মতো ক্ষিপ্ত তেজে গগনের মাঝে
উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠুক, এই অত্যাচারীর বিশ্ব উপড়ে ফেলুক – উলটে ফেলুক! আনো তোমার
হাতুড়ি, ভাঙো ওই উৎপীড়কের প্রাসাদ – ধূলায় লুটাও অর্থপিশাচ বল-দর্পীর শির। ছোঁড়ো
হাতুড়ি, চালাও লাঙল, উচ্চে তুলে ধরো তোমার বুকের রক্ত-মাখা লালে-লাল ঝান্ডা! যারা
তোমাদের পায়ের তলায় এনেছে, তাদের তোমরা পায়ের তলায় আনো। সকল অহংকার তাদের চোখের জলে
ডুবাও। নামিয়ে নিয়ে এসো ঝুঁটি ধরে ওই অর্থ-পিশাচ যক্ষগুলোকে। তোমাদের পিতৃ-পুরুষের
রক্ত-মাংস-অস্থি দিয়ে ওই যক্ষের দেউল গড়া, তোমাদের গৃহলক্ষ্মীর চোখের জল আর দুধের
ছেলের হৃৎপিণ্ড নিঙড়ে তাদের ওই লাবণ্য, ওই কান্তি। তোমাদের অভিশাপ-তিক্ত
মারি-বিষ-জ্বালা লাগিয়ে তাদের সে-কান্তি, সে-লাবণ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দাও : বলো
নির্জিত ভাইরা আমার, বলো উৎপীড়িত বোনেরা আমার, বলো বেদনাতুর অভাব-ক্লিষ্ট নর-নারী –
জয় ভৈরব জয় শঙ্কর
জয় জয় প্রলঙ্কর
শংকর! শংকর!
মারো তোমার ত্রিশূল ছুঁড়ে, দুলাও তোমার সর্বনাশের ঝাণ্ডা, কে আছ ভৈরব-পন্থী নর-নারী আর হাঁকো – হাঁকো, –
জয় ভৈরব জয় শঙ্কর
জয় জয় প্রলঙ্কর
শংকর! শংকর!
প্রেক্ষাপট, রচনা/প্রকাশকাল
ধূমকেতু পত্রিকা'র প্রথমবর্ষ। প্রথম সংখ্যার [১১ আগষ্ট ১৯২২
(শুক্রবার, ২৬ শ্রাবণ ১৩২৯), ৩-৪ পৃষ্ঠায় 'সারথী পথের খবর' শিরোনামে
সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল। রুদ্রঙ্গল প্রবন্ধগ্রন্থে ওই প্রবন্ধটি 'আমার পথ'
শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
তথ্যসূত্র
নজরুল-রচনাবলী জন্মশতবর্ষ সংস্করণ। দ্বিতীয় খণ্ড। বাংলা একাডেমী ঢাকা। জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮/মে ২০১১।