সিন্ধু-হিন্দোল
কাজী নজরুল ইসলাম


                   দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জির

                    দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জির,
                    খোলো দ্বার ওঠো ওঠো বীর!
নিদাঘের রৌদ্র খর কণ্ঠে শোনে প্রদীপ্ত আহ্বান—
                    জয় অভিনব যৌবন-অভিযান!...
শ্রান্ত গত বরষের বিশীর্ণ শর্বরী
স্খলিত মন্থর পদে দূরে যায় সরি
                    বিরাটের চক্রনেমি-তলে।
                    চম্প-মালা দোলাইয়া গলে
        আলোক-তাঞ্জামে আসে অভিযান-রথী,
        ঘুম-জাগা বিহগের কন্ঠে কন্ঠে আনন্দ-আরতি
                    ভেসে চলে খেয়া-সম দিকে দিকে আজি।
        বজ্রাঘাতে ঘন ঘন আকাশ-কাঁসর ওঠে বাজি।

        মরমর-মঞ্জীর-পায়ে মাতে ঘূর্ণি-নটী
        বিশুষ্ক পল্লব-নৃত্যে, ডগমগ পড়িছে উছটি
                    অসহ আনন্দ-মদে!
সুন্দর আসিছে পিছে অবগাহি বেদনার জবা-রক্ত হ্রদে।
                    ওড়ে তার ধূলি-রাঙা গৈরিক পতাকা
                    বৈশাখের বাম করে! ক্ষত-চিহ্ন আঁকা
        নিখিল পীড়িত মুখে মুখচ্ছবি তার।
        একি রূপ হেরি তব বেদনার মুকুরে আমার
                    অপরূপ! ওগো অভিনব!
কত অশ্রু জমাইয়া কত দিনে গড়েছ এ তরবারি তব?
                    সাঁতরিয়া কত অশ্রুজল,
হে রক্ত-দেবতা মোর, পেলে আজি স্থল?
কোন সে বেদনা-পানি বাণী অশ্রুমতী
                    করিতেছে তোমার আরতি?
মন্দির-বেদির শ্বেত প্রস্তরের আস্তরণ তলে
এলায়িত কুন্তলা কে স্খলিত অঞ্চলে
                        ছিন্নপর্ণা স্থলপদ্ম-প্রায়
                        প্রাণহীন দেবতার চরণে লুটায়?
জানি, তারই স-বেদন আবেদনখানি
            খড়্গ হয়ে ঝলে তব করে, শস্ত্রপাণি!
মরণ-উৎসবে রণে ক্রন্দন-বাসরে
                    নিখিল-ক্রন্দসী, বীর, তব স্তব করে!
                    বধূ তব নিখিলের প্রাণ
বিদায়-গোধূলি-লগ্নে মৃত্যু-মঞ্চে করে মাল্য দান! ...

        হে সুন্দর, মোরা তব দূর যাত্রাপথ
        করিতেছি সহজ সরল, রচিতেছি তব ভবিষ্যৎ!
        সতেজ তরুণ কণ্ঠে তব আগমনী
        গাহিতেছি রাত্রিদিন, দৃপ্ত জয়ধ্বনি
        ঘোষিতেছে আমাদের বাণী বজ্র-ঘোষ!
        বুকে বুকে জ্বালিতেছি বহ্নি-অসন্তোষ।
        আশার মশাল জ্বালি আলোকিয়া চলেছি আঁধার
                        অগ্রদূত নিশান-বরদার!
অতন্দ্রিত নিশীথ-প্রহরী—হাঁকিতেছি প্রহরে প্রহরে,
        যৌবনের অভিযান-সেনাদল, ওরে,
                    ওঠ তোরা করি ত্বরা!
        তিমিরাবরণ খোল, ছুঁড়ে ফেলো স্বপন-পসরা!
                    ওঠো ওঠো বীর,
        দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জীর!
        বিপ্লব-দেবতা ওই শিয়রে তোমার
        দাঁড়ায়েছ আসিয়া আবার!

        বারে বারে এসেছে দেবতা
        যুগান্তের এনেছে বারতা।
                    বারে বারে করাঘাত করি
                    দ্বারে দ্বারে হেঁকেছি প্রহরী
        নিদ্রাহীন রাত্রিদিন,
                    আঘাতে ছিঁড়েছে তন্ত্রী, ভাঙিয়াছে বীণ;
                            জাগিসনি তোরা,
        ফিরে গেছে দেবতা সুন্দর, এসেছে কুৎসিত মৃত্যু জরা।
        এবার দুয়ার ভাঙি শিয়রে দেবতা যদি
        আসিয়াছে পারাইয়া গিরি দরি সিন্ধু নদ নদী,
                    ওরে চির-সুন্দরের পূজারির দল,
                    এবার এ লগ্ন যেন না হয় বিফল!
        বারে বারে করিয়াছি যারে অপমান,
        মন্দির-প্রদীপ যারে বারে বারে করেছি নির্বাণ,
                        বরণ করিতে হবে তারে।
        পলে পলে বিলাইয়া মোরা আপনারে
        যে আত্মদানের ডালা রেখেছি সাজায়ে
                        তাই দান দিব রক্ত-দেবতার পায়ে!
        এবার পরান খুলে এ দর্প করিতে যেন পারি,
                                জিতি আর হারি,
        ধরিয়াছি তোমার পতাকা—শুনিয়াছি তোমার আদেশ,
        আত্মবলি দিয়া দিয়া আপনারে করেছি নিঃশেষ!
        দাঁড়ায়েছি আসি তব পাশ
        শিরে ধরি অনির্বাণ জ্যোতিষ্কের উলঙ্গ আকাশ!
                        বাহিরের রাজপথ বাহি,
                হে সারথি, চলিয়াছি তব রথ চাহি!
                            আলোক-কিরণ
                করিয়াছি পান মোরা পুরিয়া নয়ন! —
                সুপ্তরাতে গুপ্তপথ বাহি,
                আসিয়াছে অসুন্দর শত্রুর সিপাহি,
                            অকস্মাৎ
                পিছে হতে করেছে আঘাত।
                মসিময় করিয়াছে তব রশ্মিপথ,
                নিন্দার প্রস্তর হানি রচেছে পর্বত,
পথে পথে খুঁড়িয়াছে মিথ্যার পরিখা,
চোখে-মুখে লিখিয়াছের ভণ্ডামির নীতিবাণী লিখা,
দলে দলে করিয়াছে রিরংসার উলঙ্গ চিৎকার,
ফুঁ দিয়া নিবাতে গেছে, হে ভাস্কর, প্রদীপ তোমার!

                হে সুন্দর, মোরা শুধু তব অনুরাগে
                কোনো দিকে দেখি নাই, চলিয়াছি আগে
                            লঙ্ঘি বাধা, লঙ্ঘিয়া নিষেধ,
মানিনিকো কোরান পুরাণ শাস্ত্র, মানিনিকো বেদ!
                নির্বেদ তোমার ডাকে শুধু চলিয়াছি,
যখনই ডেকেছ তুমি, হাঁকিয়াছি: ‘আছি, মোরা আছি!’
                ভরি তব শুভ্র শুচি ললাট-অঙ্গন
                কলঙ্ক-তিলক-পঙ্ক করেছে লেপন,
                বারে বারে মুছিয়াছিল, প্রিয় ওগো প্রিয়,
তোমার ললাট-পঙ্কে ম্লান হল আমাদের রক্ত-উত্তরীয়!

                জাদুকর মিথ্যুকের সপ্তসিন্ধুনীর
কত দিনে হব পার, পাব শভ্র আনন্দের তীর?
                হে বিপ্লব-সেনাধিপ, হে রক্ত-দেবতা,
                            কহো, কহো কথা!
                শ্মশানের শিবা-মাঝে হে শিব সুন্দর
                এসো এসো, দাও তব চরম নির্ভর!
                দাও বল, দাও আশা, দাও তব পরম আশ্বাস,
                হিংসুকের বদ্ধদ্বার জতুগৃহে আনো অবকাশ!
                            অপগত হোক এ-সংশয়,
                দশদিকে দিগঙ্গনা গেয়ে যাক যৌবনের জয়!
                            অসুন্দর মিথ্যুকের হোক পরাজয়,
                            এসো এসো আনন্দ-সুন্দর, জাগো জ্যোতির্ময়!

১৩ চৈত্র, ১৩৩৩