সিন্ধু-হিন্দোল
কাজী নজরুল ইসলাম


                   রাখিবন্ধন

সই পাতাল কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরণ?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরণ!

অলকার পানে বলাকা ছুটিছে মেঘ-দূত-মন মোহিয়া
চঞ্চুতে রাঙা কলমির কুঁড়ি – মরতের ভেট বহিয়া।

সখীর গাঁয়ের সেঁউতি-বোঁটার ফিরোজায় রেঙে পেশোয়াজ
আশমানি আর মৃন্ময়ী সখী মিশিয়াছে মেঠো পথ-মাঝ।

আকাশ এনেছে কুয়াশা-উড়ুনি, আশমানি-নীল কাঁচুলি,
তারকার টিপ, বিজুলির হার, দ্বিতীয়া-চাঁদের হাঁসুলি।

ঝরা-বৃষ্টির ঝর ঝর আর পাপিয়া শ্যামার কূজনে
বাজে নহবত আকাশ ভুবনে – সই পাতিয়েছে দুজনে!

আকাশের দাসী সমীরণ আনে শ্বেত পেঁজা মেঘ ফেনা ফুল,
হেথা জলে-থলে কুমুদে-কমলে আলুথালু ধরা বেয়াকুল।

আকাশ-গাঙে কি বান ডেকেছে গো, গান গেয়ে চলে বরষা,
বিজুরির গুন টেনে টেনে চলে মেঘ-কুমারীরা হরষা।

হেথা মেঘ-পানে কালো চোখ হানে মাটির কুমার মাঝিরা,
জল ছুঁড়ে মারে মেঘ-বালাদল, বলে, ‘চাহে দেখ পাজিরা!’

কহিছে আকাশ, “ওলো সই, তোর চকোরে পাঠাস নিশিতে,
চাঁদ ছেনে দেব জোছনা-অমৃত তোর ছেলে যত তৃষিতে।

আমারে পাঠাস সোঁদা-সোঁদা-বাস তোর ও-মাটির সুরভি
প্রভাত-ফুলের পরিমল মধু, সন্ধ্যাবেলার পুরব।”

হাসিয়া উঠিল আলোকে আকাশ নত হয়ে এলো পুলকে
লতা-পাতা-ফুলে বাঁধিয়া আকাশে ধরা কয়, “সই, ভূলোকে
বাঁধা পলে আজ”, চেপে ধরে বুকে লজ্জায় ওঠে কাঁপিয়া,
চুমিল আকাশ নত হয়ে মুখে ধরণির বুকে ঝাঁপিয়া।