বিষয়: নজরুল সঙ্গীত।
শিরোনাম:
মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে গোপন পায়ে কে ঐ
আস
মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে গোপন পায়ে কে ঐ
আসে,
আকাশ-ছাওয়া চোখের চাওয়া উতল হাওয়া কেশের বাসে॥
উষার রাগে সাঁঝের ফাগে
যুগল তাহার কপোল রাঙে,
কমল দুলে সুর্য শশী নিশীথ-চুলে
আঁধার-রাশে॥
চরণ-ছোঁয়ায় পাতার ঠোঁটে
মুকুল কাঁপে কুসুম ফোটে,
আঁখির পলক- পতন-ছাঁদে নিশীথ কাঁদে দিবস হাসে॥
গ্রহের মালা অলখ-খোঁপায়,
কপোল শোভে তারার টোপায়,
কুসুম-কাঁটায় আঁচল বাধে রুমাল লুটায় সবুজ ঘাসে॥
তোমার লীলা- কমল করে
নিখিল-রানি! দুলাও মোরে।
ঢুলাও আমার সুবাসখানি তোমার মুখের মদির-শ্বাসে॥
- ভাবসন্ধান: কবি মনে করেন প্রাকৃতিক সকল সৌন্দর্যের মূল রয়েছে
কোনো এক রহস্যময়ী অপরূপার স্পর্শ। কবি তাকে অনুভব করেন প্রকৃতির সকল
সৌন্দর্যলীলার ভিতরে। সেই সৌন্দর্যদেবী আসেন গোপন-মৃদু পায়ে। তাঁকে তিনি
দেখেন বকুল বনের ছায়ায়, আকাশব্যাপী অপার দর্শনে। তাঁকে খুঁজে পান তাঁর উতল
হাওয়ায় ভেসে আসা সুবাসিত কেশরাশির সৌরভ-সৌন্দর্য ।
কবি তাঁকে খুঁজে পান ঊষার রঙিন আভায়, খুঁজে পান সন্ধ্যার অস্তাচলে
আবির-রাঙানো আকাশে। ঊষা এবং সন্ধ্যা উভয়ই যেন সেই সৌন্দর্যদেবীকে অপরূপা করে
তোলে তাঁর কপোলকে রঞ্জিত করে । রাত্রির মতো অন্ধকার তাঁর কেশরাশি। সে খানে
সূর্য-চন্দ্র কমল ফুলের মতো দোলে।
সে অপরূপার স্পর্শে বৃক্ষপল্লবের পুষ্পকুঁড়িতে যৌবনের চাঞ্চল্য জাগে, অপার
সৌন্দর্যে বিকশিত হয় পুষ্প। তাঁরই চোখের পলক-পতনে যেন সৌন্দর্য-ছন্দের
উত্থান-পতন ঘটে। রাত্রির অন্ধকারে যে সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়, দিনের আলোতে
যেন তা আবার সহাস্যে জেগে ওঠে।
সে অপরূপরা তাঁর খোঁপায় গেঁথে রেখেছে আবর্তিত গ্রহারাজিকে। আর তারকা রাজি
যেন কপোলে ফুটে আছে উজ্জ্বল সৌন্দর্য গোলকে। (টোপা: কুলের মতো ছোটো ছোটো
বস্তু)। তাঁর আঁচল রচিত হয়েছে কুসুম ও কাঁটায়। সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তর যেন
তাঁর পড়ে থাকা রুমাল।
সন্ধ্যায় গাছের শাখায় পাখির কাকলিতে সে অপরূপাকে ভিন্ন রূপে কবি উপলব্ধি
করেন। কবির মনে হয় পাখির কাকলি যেন কোনো বালিকার কাকনের শব্দসৌন্দর্য। এই
ধ্বনি ধারণ করে থাকেন সৌন্দর্যদেবী। তাঁর জীবন স্বপ্ন সৌন্দর্যে ভরপুর।
শিশুর শান্তির ঘুমের ভিতরে যে স্বপ্নের মধুরতা ছড়িয়ে পড়ে। তেমনি এই অপরূপার
জীবন যেন স্বপ্নবিভোর সৌন্দর্যে পরিব্যাপ্ত।
শেষ অন্তরায়, সে অপরূপার কাছে কবির প্রার্থনা, যেন তিনি তাঁকে (কবিকে) তাঁর
লীলা-কমল করেন এবং তাঁর লীলার অংশভাগী করে নেন। কবি এই অপরূপরা
সৌন্দর্যলীলায় অপার দোলার সঙ্গী হতে চান। কবির প্রার্থনা তাঁর সকল
সৌন্দর্য-সৌরভে জন্য, যেন তিনি সে লীলাময়ীর মোহিত শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে
আন্দোলিত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।
- রচনাকাল ও স্থান:
কল্লোল পত্রিকার মাঘ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি
১৯২৭) সংখ্যায়
প্রকাশিত গানটির সাথে রচনার স্থান ও তারিখ উল্লেখ আছে- 'কৃষ্ণনগর,
১১ পৌষ ১৩৩৩' [(রবিবার
২৬শে ডিসেম্বর ১৯২৬)]। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৭ বৎসর ৭ মাস।
উল্লেখ্য,
২৬শে ডিসেম্বর (রবিবার, ১১ পৌষ ১৩৩৩) নজরুল কৃষ্ণনগর থেকে মুরলীধর বসুকে লেখা থেকে
জানা যায়, নজরুল অসুস্থ অবস্থায় উর্দু গজলের সুরে কয়েকটি বাংলা গজল রচনা
করেছিলেন। এ সকল গজলগুলোর ভিতরে এই গানটি ছিল। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ২৭ বৎসর ৭ মাস।
- গ্রন্থ
-
বুলবুল
- প্রথম সংস্করণ।
নভেম্বর ১৯২৮। কার্তিক ১৩৩৫।
সিন্ধু-ভৈরবী-কাহারবা।
- নজরুল-রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড [বাংলা একাডেমী, ফাল্গুন ১৪১৩। ফেব্রুয়ারি ২০০৭। বুলবুল।
গান ৬। সিন্ধু-ভৈরবী-কাহারবা। পৃষ্ঠা: ১৫৫]
- পত্রিকা:
- কল্লোল। মাঘ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি
১৯২৭) সংখ্যা