ভাঙার গান
কাজী নজরুল ইসলাম

শহীদী-ঈদ

            ১
শহীদের ঈদ এসেছে আজ
শিরোপরি খুন-লোহিত তাজ,
        আল্লার রাহে চাহে সে ভিখ:
জিয়ারার চেয়ে পিয়ারা যে
আল্লার রাহে তাহারে দে,
        চাহি না ফাঁকির মণিমানিক।
                ২
চাহি নাকো গাভি দুম্বা উট,
কতটুকু দান? ও দান ঝুট।
        চাই কোরবানি, চাই না দান।
রাখিতে ইজ্জত ইসলামের
শির চাই তোর,তোর ছেলের,
        দেবে কি? কে আছ মুসলমান?
                ৩
ওরে ফাঁকিবাজ, ফেরেব-বাজ,
আপনারে আর দিসনে লাজ-
        গরু ঘুষ দিয়ে চাস সওয়াব?
যদিই রে তুই গরুর সাথ
পার হয়ে যাস পুলসেরাত,
        কি দিবি মোহাম্মদে জওয়াব!
                ৪
শুধাবেন যবে- ওরে কাফের,
কি করেছ তুমি ইসলামের?
        ইসলামে দিয়ে জাহান্নম
আপনি এসেছ বেহেশত ‘পর-
পুণ্য-পিশাচ! স্বার্থপর!
        দেখাসনে মুখ, লাগে শরম!
            ৫
গরুরে করিলে সেরাত পার,
সন্তানে দিলে নরক-নার!
            মায়া-দোষে ছেলে গেল দোজখ।
কোরবানি দিলি গরু-ছাগল,
তাদেরই জীবন হলো সফল
            পেয়েছে তাহারা বেহেশ্‌ত্-লোক!
            ৬
শুধু আপনারে বাঁচায় যে,
মুসলিম নহে, ভণ্ড সে!
            ইসলাম বলে-বাঁচো সবাই!
দাও কোরবানি জান্ ও মাল,
বেহেশত্ তোমার করো হালাল।
            স্বার্থপরের বেহেশ্‌ত্‌ নাই।
            ৭
ইসলামে তুমি দিয়ে কবর
মুসলিম বলে করো ফখর!
            মোনাফেক তুমি সেরা বে-দীন!
ইসলামে যারা করে জবেহ্,
তুমি তাহাদেরি হও তাঁবে।
            তুমি জুতো-বওয়া তারি অধীন।
            ৮
নামাজ-রোজার শুধু ভড়ং,
ইয়া উয়া পরে সেজেছ সং,
            ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম!
কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা করো জড়ো
ত্যাগের বেলাতে জড়সড়!
            তোর নামাজের কি আছে দাম?
              ৯
খেয়ে খেয়ে গোশ্‌ত্ রুটি তো খুব
হয়েছ খোদার খাসি বেকুব,
            নিজেদের দাও কোরবানি।
বেঁচে যাবে তুমি বাঁচিবে দ্বীন,
দাস ইসলাম হবে স্বাধীন,
            গাহিছে কামাল এই গানই!
            ১০
বাঁচায়ে আপনা ছেলে-মেয়ে
জান্নাত পানে আছ চেয়ে
            ভাবিছ সেরাত হবেই পার।
কেননা, দিয়েছ সাতজনের
তরে এক গরু! আর কি, ঢের!
            সাতটি টাকায় গোনাহ্ কাবার!
            ১১
জানো না কি তুমি, রে বেঈমান!
আল্লা সর্বশক্তিমান
            দেখিছেন তোর সব কিছু?
জাব্বা-জোব্বা দিয়ে ধোঁকা
দিবি আল্লারে, ওরে বোকা!
            কেয়ামতে হবে মাথা নিচু!
            ১২
ডুবে ইসলাম, আসে আঁধার!
ইব্‌রাহিমের মতো আবার
            কোরবানি দাও প্রেয় বিভব!
‘জবিহুল্লাহ্’ ছেলেরা হোক,
যাক সব কিছু-সত্য রোক!
            মা হাজেরা হোক মায়েরা সব।
                ১৩
খা’বে দেখেছিলেন ইবরাহিম-
‘দাও কোরবানি মহামহিম!’
            তোরা যে দেখিস দিবালোকে
কি যে দুর্গতি ইসলামের!
পরীক্ষা নেন খোদা তোদের
            হবিবের সাথে বাজি রেখে!
            ১৪
যত দিন তোরা নিজেরা মেষ,
ভীরু দুর্বল, অধীন দেশ-
            আল্লার রাহে ততটা দিন
দিও নাকো পশু কোরবানি,
বিফল হবে রে সবখানি!
            (তুই) পশু চেয়ে যে রে অধম হীন!
                ১৫
মনের পশুরে করো জবাই,
পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই।
            কশাই-এর আবার কোরবানি!-
আমাদের নয়, তাদের ঈদ,
বীর-সুত যারা হলো শহীদ,
            অমর যাদের বীরবাণী।
                ১৬
পশু কোরবানি দিস তখন
আজাদ-মুক্ত হবি যখন
            জুলম-মুক্ত হবে রে দ্বীন।–
কোরবানির আজ এই যে খুন
শিখা হয়ে যেন জ্বালে আগুন,
            জালিমের যেন রাখে না চিন্�
আমিন্ রাব্বিল্ আলমিন!
আমিন রাব্বিল্ আলমিন!!


রচনা ও প্রকাশকাল:
কবিতাটি মোহাম্মদী পত্রিকায় 'শহিদী ঈদ' সংখ্যায় (?) প্রকাশিত হয়েছিল।