ভাঙার গান
কাজীনজরুল ইসলাম
ভাঙার গান
[গান]
১
কারার ঐ লৌহ-কবাট
ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ!
ধ্বংস-নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।
২
গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত-স্বাধীন সত্যকে রে?
হা হা হা পায় যে হাসি
ভগবান পরবে ফাঁসি?
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে?
৩
ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয়-দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেঁচকা টানে!
মার হাঁক হায়দরি হাঁক,
কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!
৪
নাচে ঐ কাল-বোশেখি,
কাটবি কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!
লাথি মার, ভাঙ রে তালা!
যত সব বন্দি-শালায়—
আগুন জ্বালা,
আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।
রচনা ও
প্রকাশকাল:
ড.
মুজফ্ফর আহমদ-এর বিবৃতি অনুসারে বলা যায়, গানটি নজরুল ইসলামের ২২ বৎসর বয়সের
রচনা।
'ভাঙার গান' শীর্ষক গানটি সম্পর্কে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ 'কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা'-তে লিখেছেন—
"আমার সামনেই দাশ-পরিবারের শ্রী সুকুমাররঞ্জন দাশ 'বাঙ্গলার কথা'র জন্য একটি কবিতা চাইতে এসেছিলেন। শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবী তাঁকে কবিতার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন জেলে। ... অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নজরুল তখনই কবিতা লেখা শুরু ক'রে দিল। সুকুমাররঞ্জন আর আমি আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে নজরুল আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তার সেই মুহূর্তে রচিত কবিতাটি আমাদের পড়ে শোনাতে লাগল। ... নজরুল 'ভাঙার-গান' লিখেছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক তারিখে। 'ভাঙার গান' বাঙ্গলার কথা'য় ছাপা হয়েছিল।"
উল্লেখ্য, ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'বাঙ্গলার কথা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য, ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশ-কে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এই সময় পত্রিকার হাল ধরেন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী। বাসন্তী দেবী তাঁর পত্রিকায় একটি কবিতা পাঠানোর জন্য সুকুমাররঞ্জন দাশকে নজরুল ইসলামের কাছে পাঠান। সেই সূত্রে নজরুল ইসলাম এই কবিতাটি রচনা করে সুকুমাররঞ্জন দাশ-এর হাতে অর্পণ করেন। তিনি (চিত্তরঞ্জন দাশ) এই গানটি হুগলী জেলে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত বন্দী এবং অন্যান্য বন্দীদের সাথে গাইতেন বলে জানা যায়। অবশ্য এই কবিতার 'যত সব বন্দী-শালায়' অংশটি 'বন্দী-শালা' পড়ে হট্টগোল করে। পরে অবশ্য তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন ভারত সরকার গানটিকে নিষিদ্ধ করেছিল।
কবিতাকারে এই গানটি প্রকাশিত হয়েছিল 'বাঙ্গালার কথা' পত্রিকার ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ২০ শে জানুয়ারি। গান হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে, কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে। রেকর্ড নম্বর জি.ই ৭৫০৬। নিতাই ঘটকের পরিচালনায় প্রকাশিত এই রেকর্ডের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। এরপর ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এই গানটির দ্বিতীয় রেকর্ড প্রকাশ করে এইচ.এম.ভি। রেকর্ড নম্বর- এন. ৩১১৫২। এই গানটিরও শিল্পী ছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। গানটি 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন' চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছিল।