বাংলা সাহিত্যে মুসলমান
কাজী নজরুল ইসলাম
আমাদের বাংলার মুসলমান সমাজ যে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া
স্বীকার করিয়া লইয়াছেন এবং অত্যল্পকাল মধ্যে আশাতীতভাবে উন্নতি দেখাইয়াছেন, ইহা
সকলেই বলিবেন; এবং আমাদের পক্ষে ইহা কম শ্লাঘার বিষয় নহে। সাধারণ-অসাধারণ প্রায় সকল
বাঙালি মুসলমানই এখন বাংলা পড়িতেছেন, বাংলা শিখিবার চেষ্টা করিতেছেন ইহা বড়োই আশা ও
আনন্দের কথা। বাংলা সাহিত্যের পাকা আসন দখল করিবার জন্য সকলেরই মনে যে একটা তীব্র
বাসনা জাগিয়াছে, এবং ইহার জন্য আমাদের এই নূতন পথের পথিকগণ যে বেশ তোড়জোড় করিয়া
লাগিয়াছেন, ইহা নিশ্চয়ই সাহিত্যে আমাদের জীবনের লক্ষণ। ইহারই মধ্যে আমাদের কয়েকজন
তরুণ লেখকের লেখা দেখিয়া আমাদের খুবই আশা হইতেছে যে, ইঁহারা সাহিত্যে বহু উচ্চ আসন
পাইবেন।
এখন আমাদের বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করিতে হইলে
সর্বপ্রথম আমাদের লেখক জড়তা দূর করিয়া তাহাতে ঝরনার মতো ঢেউভরা চপলতা ও সহজ মুক্তি
আনিতে হইবে। যে সাহিত্য জড়, যাহার প্রাণ নাই, সে নির্জীব সাহিত্য দিয়া আমাদের কোনো
উপকার হইবে না, আর তাহা স্থায়ী সাহিত্যও হইতে পারে না । বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ
ছাড়া খুব কম লেখকেরই লেখায় মুক্তির জন্য উদ্দাম আকাঙ্ক্ষা ফুটিতে দেখা যায়। হইবে
কোথা হইতে? সাহিত্য হইতেছে প্রাণের অভিব্যক্তি, যাহার নিজের প্রাণ নাই, যে নিজে জড়
হইয়া গিয়াছে, সে লেখায় প্রাণ দিবে কোথা হইতে? যাহার নিজের বুকে রং-এর আলপনা ফুটে
না, সে চিত্রে রং ফুটাইবে কেমন করিয়া? আমাদের অধিকাংশই হইয়া গিয়াছি জড়, কেননা
আমাদের জীবন ভয়ানক একঘেয়ে; তাহাতে না আছে কোনো বৈচিত্র্য, না আছে কোনো সৌন্দর্য। তা
ছাড়া, ‘বোঝার উপর শাকের আঁটির’ মতো আমরা নাকি আবার জন্ম হইতেই দার্শনিক, কাজেই বয়স
কুড়ি পার না হইতেই আমরা গম্ভীর হইয়া পড়ি অস্বাভাবিক রকমের। আর, গম্ভীর হইলেই অমনি
নির্জীব অচেতন প্রাণীর মতো হাত-পা গুটাইয়া বসিয়া থাকিতে হইবে। এই যে চলার আনন্দ
হইতে বঞ্চিত থাকিয়া জড়-ভরতের মতো বসিয়া থাকা, ইহাই আমাদের প্রাণশক্তিকে টুঁটি
টিপিয়া মারিতেছে। সাহিত্যের মুক্তধারায় থাকিবে চলার আনন্দ, স্রোগের বেগ এবং ঢেউ-এর
কলগান ও চঞ্চলতা।
আমাদিগকে, বিশেষ করিয়া আমাদের তরুণ সম্প্রদায়কে এই দিকে বিশেষ
লক্ষ্য রাখিতে হইবে। অনেক যুবকের লেখা দেখিয়া মনে হয়, ইহা যেন কোনো এক জরাগ্রস্ত
বুড়োর লেখা; তাহাতে না আছে প্রাণ, না আছে চিন্তাশক্তি, না আছে ভাব, – শুধু আবর্জনা,
কঙ্কাল আর জড়তা। ইহা বড়োই দুঃখের কথা। সাহিত্যকে এই প্রাণের সোনার কাঠি দিয়া
জাগাইবার যে জাদুশক্তি, ইহা লাভ করিতে হইলে আমাদের তরুণ সাহিত্যিক সম্প্রদায়কে
সর্বপ্রথম শরীরের দিকে দৃষ্টি রাখিতে হইবে। শরীর নীরোগ হইলে মনে আপনি একটা বিমল
আনন্দ উছলিয়া পড়িতে থাকে। দেখিবেন যে সাহিত্যিকের স্বাস্থ্য যত ভালো, যিনি যত বেশি
প্রফুল্লচিত্ত, তাঁর লেখা তত বেশি স্বাস্থ্য-সম্পন্ন, তত বেশি কলমুখর। নবীন
সাহিত্যিকগণ সর্বদা প্রফুল্লচিত্ত থাকিবার জন্য যদি এক-আধটু করিয়া সংগীতের আলোচনা
করেন, তাহা হইলে দেখিবেন তাহাদের লেখার মধ্যে এই সংগীত, সুরের এই ঝংকার, উন্মুক্ত
প্রফুল্লচিত্তের এই মোহন-বিকাশ ফুটিয়া উঠিয়া তাঁহাদের লেখার মধ্যে এক নূতন মাদকতা,
অভিনব শক্তি দান করিতেছে। অধিকাংশ ‘পুঁয়ে মারা’ পিলে-রোগাক্রান্ত সাহিত্যিকের লেখাই
দেখিবেন অসুস্থ (morbid) ; ইহাই সাহিত্যের স্বচ্ছ ধারায় আবিলতা আনে। যাঁহার চিত্ত
যত নিরাবিল, নির্মল, উন্মুক্ত, হাস্য-মুখর, তাঁহার লেখাও তত নূতন নূতন সম্পদে ভরা
(rich)। ইউরোপের লোকেরা যেমন স্বাস্থ্য-সম্পন্ন, খেলাধুলা, দৌড়-ঝাঁপ, মারামারি,
হাসি-খুশি যেমন তাহাদের নিত্যকার সঙ্গী, তাহাদের লেখার মধ্যেও ঠিক তাহাদের জীবনের
ওইসব গুণ সুন্দরভাবে ফুটিয়া উঠিতেছে।
অপরপক্ষে, উহারই বিপরীত সমস্ত দোষসম্পন্ন বলিয়া আমাদের লেখা,
আমাদের সাহিত্য-সৃষ্টি আবার তেমনই সংকীর্ণ, ভণ্ডামি, অসত্য, রোগের বীজাণু প্রভৃতিতে
ভরা। লেখকের লেখা হইতেছে তাঁহার প্রাণের সত্য অভিব্যক্তি। যেখানে লেখক সত্য, তাঁহার
লেখাতেও সে-সত্য সত্যভাবেই ফুটিয়া উঠিবে; যেখানে লেখক মিথ্যা, সেখানে সেই মিথ্যাকে
তিনি হাজার চেষ্টা করিলেও লুকাইতে পারিবেন না। সাধারণের চক্ষে যদি না পড়ে, তবে
জহুরির চক্ষে তাহা পড়িবেই পড়িবে। সাহিত্যে এই প্রাণ, এই উদ্দাম-চঞ্চলতা, এই উদার
মুক্তি আনয়নের চেষ্টা আপাতত আমাদের মাত্র দুই একজন তরুণ সাহিত্যিক ভিন্ন অন্য কারুর
লেখায় দেখিতে পাইতেছি না। সেই গড্ডলিকা প্রবাহ। সাহিত্যে যে একটা নূতন ধারা
চলিয়াছে, সে-সম্বন্ধে আমাদের অনেক নূতন লেখক এখনও অন্ধ। এই সব কারণে সাহিত্যিকের,
কবির, লেখকের প্রাণ হইবে আকাশর মতো উন্মুক্ত উদার, তাহাতে কোনো ধর্মবিদ্বেষ,
জাতিবিদ্বেষ, বড়ো-ছোটো জ্ঞান থাকিবে না। বাঁধ-দেওয়া ডোবার জলের মতো যদি সাহিত্যিকের
জীবন পঙ্কিল, সংকীর্ণ, সীমাবদ্ধ হয়, তাহা হইলে তাঁহার সাহিত্যসাধনা সাংঘাতিকভাবে
ব্যর্থ হইবে। তাঁহার সৃষ্ট সাহিত্য আঁতুড়-ঘরেই মারা যাইবে। যাঁহার প্রাণ যত উদার,
যত উন্মুক্ত, তিনি তত বড়ো সাহিত্যিক। কারণ, সাহিত্য হইতেছে বিশ্বের, ইহা একজনের
হইতে পারে না। সাহিত্যিক নিজের কথা নিজের ব্যথা দিয়া বিশ্বের কথা বলিবেন, বিশ্বের
ব্যথায় ছোঁয়া দিবেন। সাহিত্যিক যতই কেন সূক্ষ্মতত্ত্বের আলোচনা করুন না, তাহা
দেখিয়াই যেন বিশ্বের যে কোনো লোক বলিতে পারে, ইহা তাঁহারই অন্তরের অন্তরতম কথা; ইহা
তাঁহারই বুকে গুমরিয়া মরিতেছিল, প্রকাশের পথ পাইতেছিল না। এইরূপেই বিশ্ব-সাহিত্য
সৃষ্টি হয়, ইহাকেই বলে সাহিত্যে সর্বজনীনতা।
এই বিশ্ব-সাহিত্য সৃষ্টি করিতে পারিয়াছেন বলিয়াই আজ রবীন্দ্রনাথ
এমন জগদ্বিখ্যাত হইয়া পড়িয়াছেন। যাহা বিশ্ব-সাহিত্যে স্থান পায় না, তাহা স্থায়ী
সাহিত্য নয়, খুব জোর দু-দিন আদর লাভের পর তাহার মৃত্যু হয়। আমাদিগকেও তাই এখন করিতে
হইবে সাহিত্যে সর্বজনীনতা সৃষ্টি। অবশ্য, নিজের জাতীয় ও দেশীয় বিশেষত্বকে না
এড়াইয়া, না হারাইয়া। যিনি যে দেশেরই হউন, সকলেরই অন্তরের কতকগুলি সত্য আছে,
সূক্ষ্মতম ভাব আছে, যাহা সকল দেশের লোকের পক্ষেই সমান; সাহিত্যসৃষ্টির সময় ভিতরের
এইসব সূক্ষ্মদিকে দৃষ্টি রাখিতে হইবে। এইদিকে লক্ষ্য রাখিয়া জীবনের গূঢ় রহস্যকে
বিশ্লেষণ করিয়া সত্যের সৌন্দর্য ও মঙ্গল ফুটাইয়া তুলিতে হইবে, – এই মহাশক্তি আমাদের
তরুণ লেখক সম্প্রদায়কে অর্জন করিতে হইবে। সত্য যদি লক্ষ্য হয়, সুন্দর ও মঙ্গলের
সৃষ্টি সাধনা ব্রত হয়, তবে তাঁহার লেখা সম্মান লাভ করিবেই লরিবে। অন্যের ঠিক প্রাণে
গিয়া আঘাত করিবার মতো শক্তি পাইতে নিজের প্রাণ থাকা চাই। এসব কথা আমরা শুধু কোনো
বিশেষ লেখক-সম্প্রদায়কে উল্লেখ করিয়া বলিতেছি না; ইহা ঔপন্যাসিক, কবি,
ছোটোগল্প-লেখক সকলেরই প্রতি প্রযোজ্য। এই তিন রকমের লেখকের মধ্যে কেহই ছোটো নন,
কারণ প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য – সৃষ্টি। তিনিই আর্টিস্ট, যিনি আর্ট ফুটাইয়া তুলিতে
পারেন। আর্ট-এর অর্থ সত্যের প্রকাশ (Execution of truth), এবং সত্য মাত্রেই সুন্দর,
সত্য চিরমঙ্গলময়। আর্টকে সৃষ্টি, আনন্দ বা মানুষ এবং প্রকৃতি (man plus nature)
ইত্যাদি অনেক কিছু বলা যাইতে পারে; তবে সত্যের প্রকাশই হইতেছে ইহার অন্যতম
উদ্দেশ্য। আমাদের নবীন তরুণ আর্টিস্ট সাহিত্যিক ও কবিগণ এই কয়েকটি কথা মনে রাখিয়া
স্থায়ী সাহিত্য সৃষ্টির দিকে চেষ্টা ও প্রাণ প্রয়োগ করিবেন, ইহাই আমাদের বাসনা।
আমাদের এ আশা পূর্ণ-হউক!