ভাব ও কাজ
কাজী নজরুল ইসলাম
ভাবে আর কাজে সম্বন্ধটা খুব নিকট বোধ হইলেও আদতে এ জিনিস দুইটায়
কিন্তু আশমান-জমিন তফাৎ।
ভাব জিনিসটা হইতেছে পুষ্পবিহীন সৌরভের মতো, একটা অবাস্তব
উচ্ছ্বাস মাত্র। তাই বলিয়া কাজ মানে যে সৌরভবিহীন পুষ্প, ইহা যেন কেহ মনে করিয়া না
বসেন। কাজ জিনিসটাই ভাবকে রূপ দেয়, ইহা সম্পূর্ণভাবে বস্তুজগতের।
তাই বলিয়া ভাবকে যে আমরা মন্দ বলিতেছি বা নিন্দা করিতেছি, তাহা
নহে; ভাব জিনিসটা খুবই ভালো। মানুষকে কব্জায় আনিবার জন্য তাহার সর্বাপেক্ষা কোমল
জায়গায় ছোঁয়া দিয়া তাহাকে মাতাইয়া না তুলিতে পারিলে তাহার দ্বারা কোনো কাজ করানো
যায় না, বিশেষ করে আমাদের এই ভাব-পাগলা দেশে। কিন্তু শুধু ভাব লইয়াই থাকিব, লোককে
শুধু কথায় মাতাইয়া মশগুল করিয়াই রাখিব, এও একটা মস্ত বদ-খেয়াল। এই ‘ভাব’কে কার্যের
দাসরূপে নিয়োগ করিতে না পারিলে ভাবের কোনো সার্থকতাই থাকে না। তাহা ছাড়া ভাব দিয়া
লোককে মাতাইয়া তুলিয়া যদি সেই সময় গরমাগরম কার্যসিদ্ধি করাইয়া লওয়া না হয়, তাহা
হইলে পরে সে ভাবাবেশ কর্পূরের মতো উড়িয়া যায়। অবশ্য, এখানে কার্যসিদ্ধি মানে
স্বার্থসিদ্ধি নয়। যিনি ভাবের বাঁশি বাজাইয়া জনসাধারণকে নাচাইবেন, তাঁহাকে
নিঃস্বার্থ ত্যাগী ঋষি হইতে হইবে। তিনি লোকদিগের সূক্ষ্ম অনুভূতি ও ভাবকে জাগাইয়া
তুলিবেন মানুষের কল্যাণের জন্য, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়। তাঁহাকে একটা খুব
মহত্তর উদ্দেশ্য ও কল্যাণ কামনা লইয়া ভাবের বন্যা বহাইতে হইবে, নতুবা বানভাসির পর
পলি পড়ার মতো সাধারণের সমস্ত উৎসাহ ও প্রাণ একেবারে কাদাঢাকা পড়িয়া যাইবে। এই জন্য
কেহ কেহ বলেন যে, লোকের কোমল অনুভূতিতে গা দেওয়া পাপ। কেননা, অনেক সময়
অনুপযুক্ততা-প্রযুক্ত ইহা হইতে সুফল না ফলিয়া কুফলই ফলে। আগে হইতে সমস্ত কার্যের
বন্দোবস্ত করিয়া বা কার্যক্ষেত্র তৈয়ার রাখিয়া তবে লোকদিগকে সোনার কাঠির ছোঁয়া দিয়া
জাগাইয়া তুলিতে হইবে। নতুবা তাহারা যখন জাগিয়া দেখিবে যে, তাহারা অনর্থক জাগিয়াছে,
কোনো কার্য করিবার নাই, তখন মহা বিরক্ত হইয়া আবার ঘুমাইয়া পড়িবে এবং তখন আর
জাগাইলেও জাগিবে না। কেননা, তখন যে তাহারা জাগিয়া ঘুমাইবে এবং জাগিয়া ঘুমাইলে
তাহাকে কেহই তুলিতে পারে না। তাহা অপেক্ষা বরং কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভালো, সে-ঘুম ঢোল
কাঁসি বাজাইয়া ভাঙানো বিচিত্র নয়।
এ কথাটা যে একটা মস্ত সত্যি, তাহা এতদিনে আমরা ঠেকিয়া শিখিয়াছি।
এই যে সেদিন একটা হুজুগে মাতিয়া হুড়মুড় করিয়া হাজার কতক স্কুল-কলেজের ছাত্রদল বাহির
হইয়া আসিল, কই তাহারা তো তাহাদের এই সৎ সংকল্প, এই মহৎ ত্যাগকে স্থায়ীরূপে বরণ
করিয়া লইতে পারিল না। কেন এমন হইল? একটা সাময়িক উত্তেজনার মুখে এই ত্যাগের অভিনয়
করিতে গিয়া ‘স্পিরিট’কে কী বিশ্রী ভাবেই না মুখ ভ্যাংচানো হইল! যাহারা শুধু ভাবের
চোটে না বুঝিয়া না শুঝিয়া শুধু একটু নামের জন্য বা বদনামের ভয়ে এমন করিয়া তাহাদের
‘স্পিরিট’ বা আত্মার শক্তির পবিত্রতা নষ্ট করিল, তাহারা কী দরকার পড়িলে আবার কাল
এমনই করিয়া বাহির হইয়া আসিতে পারিবে? আজ যাহারা মুখে চাদর জড়াইয়া কল্যকার ত্যক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার মুখটি চুন করিয়া ঢুকিল, কাল দেশের সত্যিকার ডাক আসিলে তাহারা
কী আর তাহাতে সাড়া দিতে পারিবে! হঠকারিতা করিয়া একবার যে ভোগটা ভুগিল বা ভ্রম করিল,
তাহারই অনুশোচনাটা তাহারা কিছুতেই মন হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারিবে না। – বাহিরে যতই
কেন লি-পরওয়া ভাব দেখাক না। এখন সত্যিকার ডাক শুনিয়া প্রাণ চাহিলেও সে লজ্জায়
তাহাতে আসিয়া যোগদান করিতে পারিবে না। এইরূপে আমরা আমাদের দেশের প্রাণশক্তি এই
তরুণদের ‘স্পিরিট’টাকে কুব্যবহারে আনিয়া মঙ্গলের নামে দেশের মহা শত্রুতা সাধনই
করিতেছি না কি? রাগিবার কথা নয়, এখন ইহা রীতিমতো বিবেচনা-সাপেক্ষ। আমাদের এই
আশা-ভরসাস্থল যুবকগণ এত দুর্বল হইল কীরূপে বা এমন কাপুরুষের মতো ব্যবহারই বা করিল
কেন? সে কি আমাদের দোষে নয়? সাপ লইয়া খেলা করিতে গেলে তাহাকে দস্তুরমতো সাপুড়ে হওয়া
চাই, শুধু একটু বাঁশি বাজাইতে পারিলেই চলিবে না। আজ যদি সত্যিকার কর্মী থাকিত দেশে,
তাহা হইলে এমন সুবর্ণ সুযোগ মাঝ-মাঠে মারা যাইত না। ত্যাগী অনেক আছেন দেশে, কিন্তু
কর্মীর অভাবে বা তথাকথিত কর্মী নামে অভিহিত লোকদের সত্য সাধনার অভাবে তাঁহারা কোনো
ভালো কাজে আর কোনো অর্থ দিতে চাহেন না, বা অন্য কোনোরূপ ত্যাগ স্বীকার করিতেও রাজি
নন। কী করিয়া হইবেন? তাঁহারা তাঁহাদের চোখের সামনে দেখিতেছেন যে, কত লোকের কত মাথার
ঘাম পায়ে ফেলার ধন দেশের নামে, কল্যাণের নামে আদায় করিয়া বাজে লোকে নিজেদের উদর
পূর্ণ করিতেছে। যাঁহারা সত্যিকার দেশকর্মী – সে বেচারা সত্যি কথা স্পষ্টভাবে বলিতে
গিয়া এই সব কর্মীদের কারচুপিতে পুয়াল চাপা পড়িয়া গিয়াছে, বেচারারা এখন ভালো বলিতে
গেলেও এই সব মুখোশ-পরা ত্যাগী মহাপুরুষগণ হট্টগোল বাধাইয়া লোককে সম্পূর্ণ উলটা
বুঝাইয়া দিয়া তাহাকে একদম খেলো, ঝুটা ইত্যাদি প্রমাণ করিয়া দেন। সহজ জনসাধারণের সরল
মন এসব না ধরিতে পারার দরুন তাহাদের মন অতি অল্পেই ওই সত্যিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে
বিষাইয়া উঠে। ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ কথাটা মস্ত সত্যি কথা।
তাহা হইলে এখন উপায় কী? এক সহজ উপায় এই যে, এখন হইতে জনসাধারণের
বা শিক্ষিত কেন্দ্রের উচিত, ভাবের আবেগে অতিমাত্রায় বিহ্বল হইয়া কান্ডাকাণ্ড
ভালোমন্দ জ্ঞান হারাইয়া না ফেলা। ভাব জিনিসটা মদের নেশার চেয়েও গাঢ়। পাঁড়-মাতালরা
বলে, ‘মদ খাও, কিন্তু তোমায় যেন মদে না খায়।’ আমরাও বলিব, ভাবের সুরা পান করো ভাই,
কিন্তু জ্ঞান হারাইয়ো না। তাহা হইলে তোমার পতন, তোমার দেশের পতন, তোমার ধর্মের পতন,
মনুষ্যত্বের পতন! ভাবের দাস হইয়ো না, ভাবকে তোমার দাস করিয়া লও। কর্মে শক্তি আনিবার
জন্য ভাব-সাধনা করো। ‘স্পিরিট’ বা আত্মার শক্তিকে জাগাইয়া তোলো, কিন্তু তাই বলিয়া
কর্মকে হারাইয়ো না। অন্ধের মতো কিছু না বুঝিয়া না শুনিয়া ভেড়ার মতো পেছন ধরিয়া
চলিয়ো না। নিজের বুদ্ধি, নিজের কর্মশক্তিকে জাগাইয়া তোলো। তোমার এই
ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যই দেশকে উন্নতির দিকে, মুক্তির দিকে আগাইয়া লইয়া যাইবে। এসব
জিনিস ভাব-আবিষ্ট হইয়া চক্ষু বুঁজিয়া হয় না। কোমর বাঁধিয়া কার্যে নামিয়া পড়িতে হইবে
এবং নামিবার পূর্বে ভালো করিয়া বুঝিয়া-সুঝিয়া দেখিয়া লইতে হইবে, ইহার ফল কী। শুধু
হোড়ের মতো বা উদ্মো ষাঁড়ের মতো দেয়ালের সঙ্গে গা ঘেঁসাইয়া নিজের চামড়া তুলিয়া ফেলা
হয় মাত্র। দেয়াল-প্রভু কিন্তু দিব্যি দাঁড়াইয়া থাকেন। তোমার বন্ধন ওই সামনের
দেয়ালকে ভাঙিতে হইলে একেবারে তাহার ভিত্তিমূলে শাবল মারিতে হইবে।
আবার বলিতেছি, আর ভাবের ঘরে চুরি করিয়ো না। আগে ভালো করিয়া চোখ
মেলিয়া দেখো। কার্যের সম্ভাবনা-অসম্ভাবনার কথা অগ্রে বিবেচনা করিয়া পরে কার্যে
নামিলে তোমার উৎসাহ অনর্থক নষ্ট হইবে না। মনে রাখিও, তোমার ‘স্পিরিট’ বা আত্মার
শক্তিকে অন্যের প্ররোচনায় নষ্ট করিতে তোমার কোনো অধিকার নাই। তাহা পাপ – মহাপাপ!