জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
কাজী নজরুল ইসলাম
জাতীয় (ন্যাশনাল) বিদ্যালয় লইয়া একটু খোঁচা দিয়াছি, তাহা অন্য
কোনো ভাব-প্রণোদিত হইয়া নয়। জাতীয় জিনিস লইয়া জাতির প্রত্যেকেরই ভালো-মন্দ বিচার
করিয়া দেখিবার অধিকার আছে। তাহা ছাড়া, ‘মুনিনাঞ্চ মতিভ্রমঃ’, ভুল সকলেরই হয়; নিজের
ভুল নিজে দেখিতে পায় না। অতএব আমাদেরই জাতীয় বিদ্যালয়ের যে ভুল আমাদের চোখে পড়িবে,
তাহা আমাদেরই শোধরাইয়া লইতে হইবে। প্রথম কোনো বড়ো কাজ করিতে গেলে অনেক রকম
ভ্রম-প্রমাদ হওয়া স্বাভাবিক জানি, এবং তাহাকে ক্ষমা করিতেও পারা যায় – যদি জানি যে
তাঁহারা জানিয়া ভুল করিতেছেন না। কিন্তু যদি দেখি যে, এই সব হোমযজ্ঞের হোতারা
জানিয়া শুনিয়া ভুল করিতেছেন বা জাতীয় শিক্ষা-রূপ পবিত্র জিনিসের নামেই নিজ-নিজ
স্বার্থসিদ্ধির পথ খুঁজিতেছেন, তাহা হইলে হাজার অপ্রিয় হইলেও আমাদিগকে তাহা লইয়া
আলোচনা করিতে হইবে। পবিত্র কোনো জিনিসে কীট প্রবেশ করিতে দেখিয়া চুপ করিয়া থাকাও
অপরাধ। এই জাতীয় বিদ্যালয়ে কাঁচা কাঁচা অধ্যাপক নিয়োগ লইয়া যে ব্যাপার চলিতেছে,
তাহা হাজার চেষ্টা করিলেও চাপা দেওয়া যাইবে না; ‘মাছ দিয়া শাক ঢাকা যায় না’। কাঁচা
অধ্যাপক মানে বয়সে কাঁচা নয়, বিদ্যায় কাঁচা। আমাদের আর সবই ভালো, কেবল
বে-বন্দোবস্তই হইতেছে ‘গুণরাশিনাশী।‘ গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতন তদুপরি আবার আমাদের
একগুঁয়েমিও আছে। দোষ করিতেছি জানিয়া শুনিয়াও তাহা শুধরাইব না। যাঁহারা দেশের
মঙ্গলের জন্য সকল স্বার্থ বলিদান দিয়া গোলামখানা হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছেন মনে
করিয়াছিলাম, আজ যদি কর্মগতিকে দেখিতে পাই বা বুঝিতে পারি যে, তাঁহারা অন্য এক
স্বার্থের লোভে বা বেশি লাভের সম্ভাবনায় ওরকম লোকদেখানো ত্যাগ দেখাইয়েছেন, তাহা
হইলে বড়ো কষ্ট বোধ হয়। এখন কিন্তু অনেকেরই কার্য দেখিয়া সেই রকম বোধ হইতেছে। যে সব
অধ্যাপক গোলামখানা ছাড়িয়া আমাদের বাহবা লইয়াছেন, তাঁহাদিগকেই যে জাতীয় বিদ্যালয়ের
অধ্যাপক করিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। কেননা তাঁহারা কখনও এই ত্যাগের বদলে আর একটা
বড়োরকম লাভের আশায় এ ত্যাগ দেখান নাই। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে আরও অনেকে লাফাইয়া
উঠিয়া এইরকম মিথ্যা ভণ্ডামির ত্যাগ দেখাইতে ছুটিতে পারে। কেননা, ইহাতে তাঁহাদের
ক্ষতি তো হইলই না, উলটো দেশময় একটা বাহবা পড়িয়া গেল যে, অমুক লোকটা একেবারে ত্যাগের
চূড়ান্ত করিয়াছে – একেবারে বুদ্ধদেব! কিন্তু এ মিথ্যাকে আর যেই প্রশ্রয় দেন, আমরা
প্রশ্রয় দিতে পারি না। মঙ্গল উৎসবে মিথ্যার অমঙ্গল কিছুতে প্রবেশ করিতে দিব না।
আমরা অন্তর হইতে বলিতেছি, সত্যকে এড়াইয়া চলিয়ো না, ইচ্ছা করিয়া বা স্বার্থান্ধ হইয়া
এমন মহৎ অনাবিল অনবদ্য জিনিসকে পঙ্কিল-কলঙ্কিত করিয়ো না, – যদি বুঝি তুমি বুঝিবার
দোষে তাহা করিতেছ, ভণ্ডামি করিতেছ না, তবে তোমায় প্রাণ হইতে দেশবাসী ক্ষমা করিবে,
স্নেহের দাবি লইয়া তোমার ভুল শুধরাইয়া দিবে, এবং তোমার গায়ে কাঁটাটি ফুটিতে দিবে
না। যে সত্যিকার ত্যাগী তাঁহার পায়ে কাঁটা ফুটিলে আমরা দাঁত দিয়া তুলিয়া দিতে রাজি
আছি। দোষ রাজতন্ত্রের নয়, দোষ আমাদেরই। আমরাই নিত্য নিতুই মঙ্গলের নামে, দেশের নামে
নিজের স্বার্থ বাগাইয়া তো লইতেছি। এই ভণ্ডামি আর মোনাফেকিই তো সর্বনাশের মূল।
প্রথমে আমাদিগকে মানুষ হইতে হইবে, স্বার্থের মায়া ত্যাগ করিয়া সত্যকে বড়ো করিয়া
দেখিতে শিখিতে হইবে, তাহার পর যেন বড়ো কাজে হাত দিই। সেবার জাতীয় বিদ্যালয় অঙ্কুরেই
বিনষ্টপ্রায় হইয়াছিল, এবারও যদি ওইরকম হয়, তাহা হইলে লজ্জায় আর মুখ দেখাইবার জো
থাকিবে না। যাহার সত্যিকার কর্মী, তাঁহারাও কী অসত্যের জঞ্জাল হইতে মাথা ঝাড়া দিয়া
উঠিবেন না? মিথ্যাকে সহ্য করার মতো কাপুরুষতা আর পাপ নাই। মহান কোনো কাজে অতি
প্রিয়জনের দোষ থাকিলেও তাহা লুকাইলে চলিবে না। লোকলজ্জা বা মুখচোরা জিনিসটাই
আমাদিগকে এমন দুর্বল করিয়া ফেলিয়াছে। বন্ধুর মর্যাদার চেয়ে সত্যের মর্যাদা অনেক
উপরে।
তাহা ছাড়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম কী? স্টান্ডার্ডেরই
বা কোনো একটা নিয়ম-কানুন বা প্রোগ্রাম আদি আছে কি? হইবে কখন? সকলেই তো দেখি, বসিয়া
বসিয়া মাছি মারিতেছেন। অথচ কাঁদুনি গাহিতেছেন, ‘ছেলে জুটিতেছে না, আবার গোলামখানায়
গিয়া ঢুকিতেছে’, ইত্যাদি! কিন্তু এই সব কাণ্ড দেখিয়া কয়জন বদসাহসী ছেলে ইহাতে আসিতে
পারে? ভালো করিয়া কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া যাও তো, দেখিবে তোমায় তখন ডাকিতে হইবে না –
আপনিই তোমার অঙ্গন-ভরা লক্ষ তরুণ কণ্ঠে ‘হাজির’ ‘হাজির’ রব উত্থিত হইবে। তোমার
মন্ত্রে তবে সে তোমার দোষ বা ক্ষমতার অভাব, তাহা মন্ত্রের দোষ নয়। নাচতে না জানলে
উঠান বাঁকা বলিয়া আক্ষেপ করা – ধৃষ্টতা আর বোকামি মাত্র।
আমরা চাই, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি এমন হউক, যাহা আমাদের জীবনশক্তিকে
ক্রমেই সজাগ, জীবন্ত করিয়া তুলিবে। যে শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে,
তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা। ‘মেদা-মারা’ ছেলের চেয়ে সে হিসাবে ‘ডাংপিটে’ ছেলে বরং
অনেক ভালো। কারণ পূর্বোক্ত নিরীহ জীবরূপী ছেলেদের ‘জান’ থাকে না; আর যাহার জান নাই,
সে-‘মোর্দা’ দিয়া কোনো কাজই হয় নাই, আর হইবেও না। এই দুই শক্তিকে – প্রাণশক্তি আর
কর্মশক্তিকে একত্রীভূত করাই যেন আমাদের শিক্ষার বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য
ও লক্ষ্য হয়, ইহাই আমাদের একান্ত প্রার্থনা। শত্তুর যেন ইহাকে গোলামখানা বা
তেলাম-খানা না বলিতে পারে।