ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
ছবি ও গান
		
		
		 উৎসর্গ
		গত বৎসরকার বসন্তের ফুল লইয়া এ বৎসরকার 
		বসন্তে মালা গাঁথিলাম । 
		যাঁহার নয়ন-কিরণে প্রতিদিন প্রভাতে এই ফুলগুলি 
		একটি একটি করিয়া ফুটিয়া উঠিত, 
		তাঁহারি চরণে ইহাদিগকে উৎসর্গ করিলাম ।
		
		
 
		ছবি 
		ও গান নিয়ে আমার বলবার কথাটা বলে নিই । এটা বয়ঃসন্ধিকালের লেখা, শৈশব যৌবন 
		যখন সবে মিলেছে । ভাষায় আছে ছেলেমানুষি, ভাবে এসেছে কৈশোর । তার পূর্বেকার 
		অবস্থায় একটা বেদনা ছিল অনুদ্দিষ্ট, সে যেন প্রলাপ বকে আপনাকে শান্ত করতে 
		চেয়েছে । এখন সেই বয়স যখন কামনা কেবল সুর খুঁজছে না, রূপ খুঁজতে বেরিয়েছে 
		। কিন্তু আলো-আঁধারে রূপের আভাস পায়, স্পষ্ট করে কিছু পায় না । ছবি এঁকে 
		তখন প্রত্যক্ষতার স্বাদ পাবার ইচ্ছা জেগেছে মনে কিন্তু ছবি আঁকবার হাত তৈরি 
		হয় নি তো । 
		
		কবি সংসারের ভিতরে তখনও প্রবেশ করে নি, তখনও সে বাতায়নবাসী । দূর থেকে যার 
		আভাস দেখে তার সঙ্গে নিজের মনের নেশা মিলিয়ে দেয় । এর কোনো-কোনোটা চোখে 
		দেখা একটুকরো ছবি পেনসিলে আঁকা, রবারে ঘষে দেওয়া, আর কোনো-কোনোটা 
		সম্পূর্ণ বানানো । মোটের উপরে অক্ষম ভাষার ব্যাকুলতায় সবগুলিতেই বানানো ভাব 
		প্রকাশ পেয়েছে, সহজ হয় নি । কিন্তু সহজ হবার একটা চেষ্টা দেখা যায় । 
		সেইজন্যে চলতি ভাষা আপন এলোমেলো পদক্ষেপে এর যেখানে-সেখানে প্রবেশ করেছে । 
		আমার ভাষায় ও ছন্দে এই একটা মেলামেশা আরম্ভ হল । ছবি ও গান কড়ি ও কোমলের 
		ভূমিকা করে দিলে।
		
		
বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী প্রথম খণ্ডের গ্রন্থ পরিচয় অংশে লিখিত- এই গ্রন্থ সম্পর্কিত পাঠ।
				
				
				ছবি ও গান ১২৯০ সালের ফাল্গুনে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রথম 
				সংস্করণে
				গ্রন্থাকারের বিজ্ঞাপনে লিখিত আছে—
				
				'এই গ্রন্থে প্রকাশিত ছোটো ছোটো কবিতাগুলি গত বৎসরে লিখিত হয়- কেবল 
				শেষ তিনটি কবিতা পূর্বেকার লেখা, এই নিমিত্ত তাহারা কিছু স্বতন্ত্র 
				হইয়া পড়িয়াছে।
				
				'ছন্দের সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক। এই পুস্তকের কোনো কোনো গানে 
				ছন্দ নাই বলিয়া মনে হইতে পারে, কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে। যে-সকল 
				পাঠকের কান আছে, তাহারা ছন্দ খুঁজিয়া লইবেন, দেখিতে পাইবেন 
				বাঁধাবাধি ছন্দ অপেক্ষা তাহা শুনিতে মধুর; হসন্ত বর্ণকে অকারান্ত 
				করিয়া পড়িলে কোনো কোনো স্থলে ছন্দের ব্যাঘাত হইবে।'
				
				প্রমথ চৌধুরীকে লিখিত একটি পত্রে (১৮৯০) রবীন্দ্রনাথ ছবি ও গান 
				সম্বন্ধে লিখিতেছেন-
				
				'আমার ছবি ও গান আমি যে কী মাতাল হয়ে লিখেছিলুম...আমি তখন দিনরাত 
				পাগল হয়ে ছিলুম। আমার সমস্ত বাহ্যলক্ষণে এমন-সকল মনোবিকার প্রকাশ 
				পেত যে, তখন যদি তোমরা আমাকে প্রথম দেখতে তো মনে করতে এ ব্যক্তি 
				কবিত্বের খেপামি দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার সমস্ত শরীরে মনে নবযৌবন যেন 
				একেবারে হঠাৎ বন্যার মতো এসে পড়েছিল। আমি জানতুম না আমি কোথায় 
				যাচ্ছি, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। একটা বাতাসের হিল্লোলে একরাত্রির 
				মধ্যে কতকগুলো ফুল মায়ামন্ত্রবলে ফুটে উঠেছিল, তার মধ্যে ফলের 
				লক্ষণ কিছু ছিল না। কেবলই একটা সৌন্দর্যের পুলক, তার মধ্যে পরিণাম 
				কিছুই ছিল না।
				
				তোমাদেরও বোধ হয় এমন অবস্থা হয়-
            উড়িতেছে কেশ, 
				উড়িতেছে বেশ,
            উদাস পরাণ 
				কোথা নিরুদ্দেশ,
            হাতে লয়ে 
				বাঁশি মুখে লয়ে হাসি
                       
				ভ্রমিতেছি আনমনে।
            চারি দিকে মোর 
				বসন্ত হসিত,
           যৌবনমুকুল প্রাণে 
				বিকশিত,
           সৌরভ তাহার বাহিরে 
				আসিয়া
                     
				রটিতেছে বনে বনে।
				
				'সত্যি কথা বলতে কি, সেই নবযৌবনের নেশা এখনো আমার হৃদয়ের মধ্যে 
				লেগে রয়েছে। ছবি ও গান পড়তে পড়তে আমার মন যেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে, এমন 
				আমারে কোনো পুরনো লেখায় হয় না।'
				
				ছবি ও গানের প্রথম সংস্করণের প্রথম ও শেষ কবিতা দুইটি ('আজু সখি 
				মুহু মুহু' ও 'মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামসমান') পরে ভানুসিংহ ঠাকুরের 
				পদাবলীর অন্তর্গত হয়। প্রথম সংস্করণের অন্য কবিতাগুলি ছবি ও গানের 
				শেষ স্বতন্ত্র সংস্করণে মুদ্রিত আছে। এই শেষোক্ত সংস্করণ হইতে 
				'ধীরে ধীরে প্রভাত হল' ("বিরহ") কবিতাটি বর্তমান রচনাবলীতে বর্জিত 
				ও অন্যগুলি গৃহীত হইয়াছে।
				
				ছবি ও গানের 'রাহুর প্রেম' কবিতাটি সঞ্চয়িতার বহুলাংশে পরিবর্তিত 
				হইয়াছে।