গীতবিতান
পূজা (৩০১-৪০০
সংখ্যক গান)
ভক্ত করিছে প্রভুর চরণে জীবনসমর্পণ-
ওরে দীন, তুই জোড়কর করি কর্ তাহা দরশন ॥
মিলনের ধারা পড়িতেছে ঝরি, বহিয়া যেতেছে অমৃতলহরী,
ভূতলে মাথাটি রাখিয়া লহো রে শুভাশিস্-বরিষণ ॥
ওই-যে আলোক পড়িছে তাঁহার উদার ললাটদেশে,
সেথা হতে তারি একটি রশ্মি পড়ুক মাথায় এসে।
চারি দিকে তাঁর শান্তিসাগর স্থির হয়ে আছে ভরি চরাচর-
ক্ষণকাল-তরে দাঁড়াও রে তীরে, শান্ত করো রে মন ॥
এসেছে সকলে কত আশে দেখো চেয়ে-
হে প্রাণেশ, ডাকে সবে ওই তোমারে ॥
এসো হে মাঝে এসো, কাছে এসো,
তোমায় ঘিরিব চারি ধারে ॥
উত্সবে মাতিব হে তোমায় লয়ে,
ডুবিব আনন্দ-পারাবারে ॥
ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর-মাঝে,
দিকে দিগন্তরে ভুবনমন্দিরে শান্তিসঙ্গীত বাজে ॥
হেরো গো অন্তরে অরূপসুন্দরে, নিখিল সংসারে পরমবন্ধুরে,
এসো আনন্দিত মিলন-অঙ্গনে শোভন মঙ্গল সাজে ॥
কলুষ কল্মষ বিরোধ বিদ্বেষ হউক নির্মল, হউক নিঃশেষ-
চিত্তে হোক যত বিঘ্ন অপগত নিত্য কল্যাণকাজে।
স্বর তরঙ্গিয়া দাও বিহঙ্গম, পূর্বপশ্চিমবন্ধুসঙ্গম-
মৈত্রীবন্ধনপুণ্যমন্ত্র-পবিত্র বিশ্বসমাজে ॥
কী গাব আমি, কী শুনাব, আজি আনন্দধামে।
পুরবাসী জনে এনেছি ডেকে তোমার অমৃতনামে ॥
কেমনে বর্ণিব তোমার রচনা, কেমনে রটিব তোমার করুণা,
কেমনে গলাব হৃদয় প্রাণ তোমার মধুর প্রেমে ॥
তব নাম লয়ে চন্দ্র তারা অসীম শূন্যে ধাইছে-
রবি হতে গ্রহে ঝরিছে প্রেম, গ্রহ হতে গ্রহে ছাইছে।
অসীম আকাশ নীলশতদল তোমার কিরণে সদা ঢলঢল,
তোমার অমৃতসাগর-মাঝারে ভাসিছে অবিরামে ॥
সফল করো হে প্রভু আজি সভা, এ রজনী হোক মহোত্সবা ॥
বাহির অন্তর ভুবনচরাচর মঙ্গলডোরে বাঁধি এক করো-
শুষ্ক হৃদয় করো প্রেমে সরসতর, শূন্য নয়নে আনো পূণ্যপ্রভা ॥
অভয়দ্বার তব করো হে অবারিত, অমৃত-উত্স তব করো উত্সারিত,
গগনে গগনে করো প্রসারিত অতিবিচিত্র তব নিত্যশোভা।
সব ভকতে তব আনো এ পরিষদে, বিমুখ চিত্ত যত করো নত তব পদে,
রাজ-অধীশ্বর, তব চিরসম্পদে সব সম্পদ করো হতগরবা ॥
হৃদিমন্দিরদ্বারে বাজে সুমঙ্গল শঙ্খ ॥
শত মঙ্গলশিখা করে ভবন আলো,
উঠে নির্মল ফুলগন্ধ ॥
ওই পোহাইল তিমিররাতি।
পূর্বগগনে দেখা দিল নব প্রভাতছটা,
জীবনে-যৌবনে হৃদয়ে-বাহিরে
প্রকাশিল অতি অপরূপ মধুর ভাতি ॥
কে পাঠালে এ শুভদিন নিদ্রা-মাঝে,
মহা মহোল্লাসে জাগাইলে চরাচর,
সুমঙ্গল আশীর্বাদ বরষিলে
করি প্রচার সুখবারতা-
তুমি চির সাথের সাথি ॥
আজি বহিছে বসন্তপবন সুমন্দ তোমারি সুগন্ধ হে।
কত আকুল প্রাণ আজি গাহিছে গান, চাহে তোমারি পানে আনন্দে হে ॥
জ্বলে তোমার আলোক দ্যুলোকভূলোকে গগন-উত্সবপ্রাঙ্গণে—
চিরজ্যোতি পাইছে চন্দ্র তারা, আঁখি পাইছে অন্ধ হে ॥
তব মধুরমুখভাতিবিহসিত প্রেমবিকশিত অন্তরে
কত ভকত ডাকিছে, ‘নাথ, যাচি দিবসরজনী তব সঙ্গ হে।’
উঠে সজনে প্রান্তরে লোকলোকান্তরে যশোগাথা কত ছন্দে হে—
ওই ভবশরণ, প্রভু অভয়পদ তব সুর মানব মুনি বন্দে হে ॥
আনন্দগান উঠুক তবে বাজি
এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে।
অশ্রুজলের ঢেউয়ের 'পরে আজি
পারের তরী থাকুক ভাসিতে ॥
যাবার হাওয়া ওই-যে উঠেছে, ওগো, ওই-যে উঠেছে,
সারারাত্রি চক্ষে আমার ঘুম যে ছুটেছে।
হৃদয় আমার উঠেছে দুলে দুলে
অকূল জলের অট্টহাসিতে-
কে গো তুমি দাও দেখি তান তুলে
এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে ॥
হে অজানা, অজানা সুর নব
বাজাও আমার ব্যথার বাঁশিতে,
হঠাৎ এবার উজান হাওয়ায় তব
পারের তরী থাক্-না ভাসিতে।
কোনো কালে হয় নি যারে দেখা, ওগো, তারি বিরহে
এমন করে ডাক দিয়েছে- ঘরে কে রহে!
বাসার আশা গিয়েছে মোর ঘুরে,
ঝাঁপ দিয়েছি আকাশরাশিতে
পাগল, তোমার সৃষ্টিছাড়া সুরে
তান দিয়ো মোর ব্যথার বাঁশিতে ॥
এ দিন আজি কোন্ ঘরে গো খুলে দিল দ্বার ?
আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার ?।
কাহার অভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে,
উষা কাহার আশিস বহি হল আঁধার পার ?।
বনে বনে ফুল ফুটেছে, দোলে নবীন পাতা-
কার হৃদয়ের মাঝে হল তাদের মালা গাঁথা ?
বহু যুগের উপহারে বরণ করি নিল কারে,
কার জীবনে প্রভাত আজি ঘুচায় অন্ধকার ?।
ওই অমল হাতে রজনী প্রাতে আপনি জ্বালো
এই তো আলো- এই তো আলো ॥
এই তো প্রভাত, এই তো আকাশ, এই তো পূজার পুষ্পবিকাশ,
এই তো বিমল, এই তো মধুর, এই তো ভালো-
এই তো আলো- এই তো আলো ॥
আঁধার মেঘের বক্ষের জেগে আপনি জ্বালো
এই তো আলো- এই তো আলো।
এই তো ঝঞ্ঝা তড়িৎ-জ্বালা, এই তো দুখের অগ্নিমালা,
এই তো মুক্তি, এই তো দীপ্তি, এই তো ভালো-
এই তো আলো- এই তো আলো ॥
তার অন্ত নাই গো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ।
তার অণু-পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
তারে মোহনমন্ত্র দিয়ে গেছে কত ফুলের গন্ধ,
তারে দোলা দিয়ে দুলিয়ে গেছে কত ঢেউয়ের ছন্দ,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
আছে কত সুরের সোহাগ যে তার স্তরে স্তরে লগ্ন,
সে যে কত রঙের রসধারায় কতই হল মগ্ন,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
কত শুকতারা যে স্বপ্নে তাহার রেখে গেছে স্পর্শ,
কত বসন্ত যে ঢেলেছে তায় অকারণের হর্ষ,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
সে যে প্রাণ পেয়েছে পান করে যুগ-যুগান্তরের স্তন্য-
ভুবন কত তীর্থজলের ধারায় করেছে তায় ধন্য,
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
সে যে সঙ্গিনী মোর, আমারে সে দিয়েছে বরমাল্য।
আমি ধন্য, সে মোর অঙ্গনে যে কত প্রদীপ জ্বালিল-
ও তার অন্ত নাই গো নাই।
তোমার আনন্দ ওই এল দ্বারে, এল এল এল গো। ওগো পুরবাসী
বুকের আঁচলখানি ধুলায় পেতে আঙিনাতে মোলো গো ॥
পথে সেচন কোরো গন্ধবারি মলিন না হয় চরণ তারি,
তোমার সুন্দর ওই এল দ্বারে, এল এল এল গো।
আকুল হৃদয়খানি সম্মুখে তার ছড়িয়ে ফেলো ফেলো গো ॥
তোমার সকল ধন যে ধন্য হল হল গো।
বিশ্বজনের কল্যাণে আজ ঘরের দুয়ার খোলো গো।
হেরো রাঙা হল সকল গগন, চিত্ত হল পুলকমগন,
তোমার নিত্য আলো এল দ্বারে, এল এল এল গো।
তোমার পরানপ্রদীপ তুলে ধোরো, ওই আলোতে জ্বেলো গো ॥
প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে।
ভয়-ভাবনা বাধা টুটেছে ॥
দুঃখকে আজ কঠিন বলে জড়িয়ে ধরতে বুকের তলে
উধাও হয়ে হৃদয় ছুটেছে ॥
হেথায় কারো ঠাঁই হবে না মনে ছিল এই ভাবনা,
দুয়ার ভেঙে সবাই জুটেছে।
যতন করে আপনাকে যে রেখেছিলেম ধুয়ে মেজে,
আনন্দে সে ধুলায় লুটেছে ॥
পারবি না কি যোগ দিতে এই ছন্দে রে
এই খসে যাবার, ভেসে যাবার, ভাঙবারই আনন্দে রে ॥
পাতিয়া কান শুনিস না যে দিকে দিকে গগনমাঝে
মরণবীণায় কী সুর বাজে তপন-তারা-চন্দ্রে রে-
জ্বালিয়ে আগুন ধেয়ে ধেয়ে জ্বলবারই আনন্দে রে ॥
পাগল-করা গানের তানে ধায় যে কোথা কেই বা জানে,
চায় না ফিরে পিছন-পানে, রয় না বাঁধা বন্ধে রে-
লুটে যাবার, ছুটে যাবার, চলবারই আনন্দে রে।
সেই আনন্দ-চরণ-পাতে ছয় ঋতু যে নৃত্যে মাতে,
প্লাবন বহে যায় ধরাতে বরণ গীতে গন্ধে রে-
ফেলে দেবার, ছেড়ে দেবার, মরবারই আনন্দে রে ॥
প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোকে ভূলোকে
তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া ॥
দিকে দিকে আজি টুটিয়া সকল বন্ধ
মুরতি ধরিয়া জাগিয়া উঠে আনন্দ,
জীবন উঠিল নিবিড় সুধায় ভরিয়া ॥
চেতনা আমার কল্যাণরসসরসে
শতদলসম ফুটিল পরম হরষে
সব মধু তার চরণে তোমার ধরিয়া।
নীরব আলোকে জাগিল হৃদয়প্রান্তে
উদার উষার উদয়-অরুণকান্তি,
অলস আঁখির আবরণ গেল সরিয়া ॥
জগতের আনন্দযঞ্জে আমার নিমন্ত্রণ।
ধন্য হল, ধন্য হল মানবজীবন ॥
নয়ন আমার রূপের পুরে সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে,
শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন ॥
তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি-
গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্না হাসি।
এখন সময় হয়েছে কি ? সভায় গিয়ে তোমায় দেখি
জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব এ মোর নিবেদন ॥
গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর-
হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখীর ডোরে ?।
আজিকে এই আকাশতলে জলে স্থলে ফুলে ফলে
কেমন ক’রে, মনোহরণ, ছড়ালে মন মোর ?।
কেমন খেলা হল আমার আজি তোমার সনে !
পেয়েছি কি খুঁজে বেড়াই ভেবে না পাই মনে।
আনন্দ আজ কিসের ছলে কাঁদিতে চায় নয়নজলে,
বিরহ আজ মধুর করেছে প্রাণ ভোরে গায়ে ॥
আলোয় আলোকময় করে হে এলে আমার আলো।
আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো ॥
সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা,
যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো ॥
তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ।
তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান।
তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে,
হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো ॥
আজি এ আনন্দসন্ধ্যা সুন্দর বিকাশে, আহা ॥
মন্দ পবনে আজি ভাসে আকাশে
বিধুর ব্যাকুল মধুমাধুরী, আহা ॥
স্তব্ধ গগনে গ্রহতারা নীরবে
কিরণসঙ্গীতে সুধা বরষে, আহা।
প্রাণ মন মম ধীরে ধীরে প্রসাদরসে আসে ভরি,
দেহ পুলকিত উদার হরষে, আহা ॥
৩২১
বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে-
অমলকমল-মাঝে, জ্যোৎস্নারজনী-মাঝে,
কাজলঘন-মাঝে, নিশি-আঁধার-মাঝে,
কুসুমসুরভি-মাঝে বীনরণন শুনি যে-
প্রেমে প্রেমে বাজে ॥
নাচে নাচে রম্যতালে নাচে-
তপন তারা নাচে, নদী সমুদ্র নাচে,
জন্মমরণ নাচে, যুগযুগান্ত নাচে,
ভকতহৃদয় নাচে বিশ্বছন্দে মাতিয়ে-
প্রেমে প্রেমে নাচে ॥
সাজে সাজে রম্যবেশে সাজে-
নীল অম্বর সাজে, উষাসন্ধ্যা সাজে,
ধরণীধুলি সাজে, দীনদুঃখী সাজে,
প্রণত চিত্ত সাজে বিশ্বশোভার লুটায়ে-
প্রেমে প্রেমে সাজে ॥
বিপুল তরঙ্গ রে, বিপুল তরঙ্গ রে।
সব গগন উদ্বেলিয়া- মগন করি অতীত অনাগত
আলোকে-উজ্জ্বল জীবনে-চঞ্চল একি আনন্দ-তরঙ্গ ॥
তাই, দুলিছে দিনকর চন্দ্র তারা,
চমকি কম্পিছে চেতনাধারা,
আকুল চঞ্চল নাচে সংসার, কুহরে হৃদয়বিহঙ্গ ॥
সদা থাকো আনন্দে, সংসারে নির্ভয়ে নির্মলপ্রাণে ॥
জাগো প্রাতে আনন্দে, করো কর্ম আনন্দে,
সন্ধ্যায় গৃহে চলো হে আনন্দগানে ॥
সঙ্কটে সম্পদে থাকো কল্যাণে,
থাকো আনন্দে নিন্দা-অপমানে।
সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে,
চির-অমৃতনির্ঝরে শান্তিরসপানে ॥
বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা ॥
বাজে অসীম নভোমাঝে অনাদি রব,
জাগে অগণ্য রবিচন্দ্রতারা ॥
একক অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডরাজ্য
পরম-এক সেই রাজরাজেন্দ্র রাজে।
বিস্মিত নিমেষহত বিশ্ব চরণে বিনত,
লক্ষশত ভক্তচিত বাক্যহারা ॥
অমল কমল সহজে জলের কোলে আনন্দে রহে ফুটিয়া,
ফিরে না সে কভু ‘আলয় কোথায়’' ব’লে ধুলায় ধুলায় লুটিয়া ॥
তেমনি সহজে আনন্দে হরষিত
তোমার মাঝারে রব নিমগ্নচিত,
পূজাশতদল আপনি সে বিকশিত সব সংশয় টুটিয়া ॥
কোথা আছ তুমি পথ না খুঁজিব কভু, শুধাব না কোনো পথিকে—
তোমারি মাঝারে ভ্রমিব ফিরিব প্রভু, যখন ফিরিব যে দিকে।
চলিব যখন তোমার আকাশগেহে
তোমার অমৃতপ্রবাহ লাগিবে দেহে,
তোমার পবন সখার মতন স্নেহে বক্ষে আসিবে ছুটিয়া ॥
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে,
দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে ॥
পান করে রবি শশী অঞ্জলী ভরিয়া-
সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি-
নিত্য
পূর্ণ ধরা জীবনে কিরণে
॥
বসিয়া আছ কেন আপন-মনে,
স্বার্থনিমগন কী কারণে
?
চারি
দিকে দেখো চাহি হৃদয়
প্রসারি,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে ॥
নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে
শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে ॥
উত্সারিত নব জীবননির্ঝর উচ্ছ্বাসিত আশাগীতি,
অমৃতপুষ্পগন্ধ বহে আজি এই শান্তিপবনে ॥
হেরি তব বিমলমুখভাতি দূর হল গহন দুখরাতি।
ফুটিল মন প্রাণ মম তব চরণলালসে, দিনু হৃদয়কমলদল পাতি ॥
তব নয়নজ্যোতিকণা লাগি তরুণ রবিকিরণ উঠে জাগি।
নয়ন খুলি বিশ্বজন বদন তুলি চাহিল তব দরশপরশসুখ মাগি।
গগনতল মগন হল শুভ্র তব হাসিতে,
উঠিল ফুটি কত কুসুমপাঁতি- হেরি তব বিমলমুখভাতি ॥
ধ্বনিত বন বিহগকলতানে, গীত সব ধায় তব পানে।
পূর্বগগনে জগত জাগি উঠি গাহিল, পূর্ণ সব তব রচিত গানে।
প্রেমরস পান করি গান করি কাননে
উঠিল মন প্রাণ মম মাতি- হেরি তব বিমলমুখভাতি ॥
এত আনন্দধ্বনি উঠিল কোথায়,
জগতপুরবাসী সবে কোথায় ধায় ॥
কোন্ অমৃতধনের পেয়েছে সন্ধান,
কোন্ সুধা করে পান!
কোন্ আলোকে আঁধার দূরে যায় ॥
আঁধার রজনী পোহালো, জগত পূরিল পুলকে।
বিমল প্রভাতকিরণে মিলিল দ্যুলোকে ভূলোকে ॥
জগত নয়ন তুলিয়া হৃদয়দুয়ার খুলিয়া
হেরিছে হৃদয়নাথেরে আপন হৃদয়-আলোকে ॥
প্রেমমুখহাসি তাঁহারি পড়িছে ধরার আননে-
কুসুম বিকশি উঠিছে, সমীর বহিছে কাননে।
সুধীরে আঁধার টুটিছে, দশ দিক ফুটে উঠিছে-
জননীর কোলে যেন রে জাগিছে বালিকা বালকে ॥
জগত যে দিকে চাহিছে সে দিকে দেখিনু চাহিয়া,
হেরি সে অসীম মাধুরী হৃদয় উঠিছে গাহিয়া।
নবীন আলোকে ভাতিছে, নবীন আশায় মাতিছে,
নবীন জীবন
লভিয়া জয়-জয় উঠে ত্রিলোকে
॥
হৃদয়বাসনা পূর্ণ হল আজি
মম পূর্ণ হল, শুন সবে জগতজনে
॥
কী হেরিনু শোভা, নিখিলভুবননাথ
চিত্ত-মাঝে বসি স্থির আসনে ॥
ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে,
নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে ॥
কী হল না, কী পেলে না, কে তব শোধে নি দেনা
সে সকলই মরীচিকা মিলাইবে পিছে ॥
এই-যে হেরিল চোখে অপরূপ ছবি
অরুণ গগনতলে প্রভাতের রবি-
এই তো পরম দান সফল করিল প্রাণ,
সত্যের আনন্দরূপ
এই তো জাগিছে ॥
আমি সংসারে মন দিয়েছিনু, তুমি আপনি সে মন নিয়েছ।
আমি সুখ ব’লে দুখ চেয়েছিনু, তুমি দুখ ব’লে সুখ দিয়েছ ॥
হৃদয় যাহার শতখানে ছিল শত স্বার্থের সাধনে
তাহারে কেমনে কুড়ায়ে আনিলে, বাঁধিলে ভক্তিবাঁধনে ॥
সুখ সুখ করে দ্বারে মোরে কত দিকে কত খোঁজালে,
তুমি যে আমার কত আপনার এবার সে কথা বোঝালে-
করুণা তোমার কোন্ পথ দিয়ে কোথা নিয়ে যায় কাহারে-
সহসা দেখিনু নয়ন মেলিয়ে,
এনেছ তোমারি দুয়ারে ॥
আজিকে এই সকালবেলাতে
বসে আছি আমার প্রাণের সুরটি মেলাতে
॥
আকাশে ওই অরুণ রাগে
মধুর তান করুণ লাগে,
বাতাস মাতে আলোছায়ার মায়ার খেলাতে
॥
নীলিমা এই নিলীন হল আমার চেতনায়।
সোনার আভা জড়িয়ে গেল মনের কামনায়।
লোকান্তরের ও পার হতে
কে উদাসী বায়ুর স্রোতে
ভেসে বেড়ায় দিগন্তে ওই মেঘের ভেলাতে
॥
যে ধ্রুবপদ দিয়েছে বাঁধি বিশ্বতানে
মিলাব তাই জীবনগানে ॥
গগনে তব বিমল নীল- হৃদয়ে লব তাহারি মিল,
শান্তিময়ী গভীর বাণী নীরব প্রাণে ॥
বাজায় উষা নিশীথকূলে যে গীতভাষা
সে ধ্বনি নিয়ে জাগিবে মোর নবীন আশা।
ফুলের মতো সহজ সুরে প্রভাত মম উঠিবে পূরে,
সন্ধ্যা মম সে সুরে যেন মরিতে জানে ॥
ওরে, তোরা যারা শুনবি না
তোদের তরে আকাশ-'পরে নিত্য বাজে কোন্ বীণা।
দূরের শঙ্খ উঠল বেজে, পথে বাহির হল সে যে,
দুয়ারে তোর আসবে কবে তার লাগি দিন গুনবি না ?।
রাতগুলো যায় হায় রে বৃথায়, দিনগুলো যায় ভেসে-
মনে আশা রাখবি না কি মিলন হবে শেষে ?
হয়তো দিনের দেরি আছে, হয়তো সে দিন আস্ল কাছে-
মিলনরাতে ফুটবে যে ফুল তার কি রে বীজ বুনবি না ?।
মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে ॥
তুমি আছ, বিশ্বনাথ, অসীম রহস্যমাঝে
নীরবে একাকী আপন মহিমানিলয়ে ॥
অনন্ত এ দেশকালে, অগণ্য এ দীপ্ত লোকে,
তুমি আছ মোরে চাহি- আমি চাহি তোমা-পানে।
স্তব্ধ সর্ব কোলাহল, শান্তিমগ্ন চরাচর-
এক তুমি, তোমা-মাঝে আমি একা নির্ভয়ে ॥
আছ আপন মহিমা লয়ে মোর গগনে রবি,
আঁকিছ মোর মেঘের পটে তব রঙেরই ছবি ॥
তাপস, তুমি ধেয়ানে তব কী দেখ মোরে কেমনে কব—
তোমার জটে আমি তোমারি ভাবের জাহ্নবী ॥
তোমারি সোনা বোঝাই হল, আমি তো তার ভেলা
নিজেরে তুমি ভোলাবে ব’লে আমারে নিয়ে খেলা।
কণ্ঠে মম কী কথা শোন অর্থ আমি বুঝি না কোনো—
বীণাতে মোর কাঁদিয়া ওঠে তোমারি ভৈরবী ॥
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে ॥
দেহমনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে,
গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে ॥
আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,
দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।
বিশ্ববিধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা-
জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে ॥
আমার প্রাণের গভীর গোপন মহা-আপন সে কি,
অন্ধকারে হঠাৎ তারে দেখি ॥
যবে দুর্দম ঝড়ে আগল খুলে পড়ে,
কার সে নয়ন-’পরে নয়ন যায় গো ঠেকি ॥
যখন আসে পরম লগন তখন গগন-মাঝে
তাহার ভেরী বাজে।
বিদ্যুত-উদ্ভাসে বেদনারই দূত আসে,
আমন্ত্রণের বাণী যায় হৃদয়ে লেখি ॥
আজি মর্মরধ্বনি কেন জাগিল রে !
মম পল্লবে পল্লবে হিল্লোলে হিল্লোলে
থরথর কম্পন লাগিল রে ॥
কোন্ ভিখারি হায় রে এল আমারি এ অঙ্গনদ্বারে,
বুঝি সব মন ধন মম মাগিল রে ॥
হৃদয় বুঝি তারে জানে,
কুসুম ফোটায় তারি গানে।
আজি মম অন্তরমাঝে সেই পথিকেরই পদধ্বনি বাজে,
তাই চকিতে চকিতে ঘুম ভাঙিল রে ॥
প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই
নীড়বিরাগী হৃদয় আমার উধাও হল সেই ॥
নীল অতলের কোথা থেকে উদাস তারে করল যে কে
গোপনবাসী সেই উদাসীর ঠিক-ঠিকানা নেই ॥
সুপ্তিশয়ন আয় ছেড়ে আয়' জাগে যে তার ভাষা,
সে বলে চল্ আছে যেথায় সাগরপারের বাসা'।
দেশ-বিদেশের সকল ধারা সেইখানে হয় বাঁধনহারা
কোণের প্রদীপ মিলায় শিখা জ্যোতিসমুদ্রেই ॥
তোমার হাতের রাখীখানি বাঁধো আমার দখিন-হাতে
সূর্য যেমন ধরার করে আলোক-রাখী জড়ায় প্রাতে ॥
তোমার আশিস আমার কাজে সফল হবে বিশ্ব-মাঝে,
জ্বলবে তোমার দীপ্ত শিখা আমার সকল বেদনাতে ॥
কর্ম করি যে হাত লয়ে কর্মবাঁধন তারে বাঁধে।
ফলের আশা শিকল হয়ে জড়িয়ে ধরে জটিল ফাঁদে।
তোমার রাখী বাঁধো আঁটি- সকল বাঁধন যাবে কাটি,
কর্ম তখন বীণার মতন বাজবে মধুর মূর্ছনাতে ॥
বুঝেছি কি বুঝি নাই বা সে তর্কে কাজ নাই,
ভালো আমার লেগেছে যে রইল সেই কথাই ॥
ভোরের আলোয় নয়ন ভ'রে নিত্যকে পাই নূতন করে,
কাহার মুখে চাই ॥
প্রতিদিনের কাজের পথে করতে আনাগোনা
কানে আমার লেগেছে গান, করেছে আন্মনা।
হৃদয়ে মোর কখন জানি পড়ল পায়ের চিহ্নখানি
চেয়ে দেখি তাই ॥
ফেলে রাখলেই কি পড়ে রবে ও অবোধ।
যে তার দাম জানে সে কুড়িয়ে লবে ও অবোধ ॥
ও যে কোন্ রতন তা দেখ্-না ভাবি ওর ’পরে কি ধুলোর দাবি ?
ও হারিয়ে গেলে তাঁরি গলার হার গাঁথা যে ব্যর্থ হবে ॥
ওর খোঁজ পড়েছে জানিস নে তা ?
তাই দূত বেরোল হেথা সেথা।
যারে করলি হেলা সবাই মিলি আদর যে তার বাড়িয়ে দিলি-
যারে দরদ দিলি তার ব্যথা কি সেই দরদীর প্রাণে সবে ?।
দেওয়া নেওয়া ফিরিয়ে-দেওয়া তোমায় আমায়-
জনম জনম এই চলেছে, মরণ কভু তারে থামাঅ ?।
যখন তোমার গানে আমি জাগি আকাশে চাই তোমার লাগি,
আবার একতারাতে আমার গানে মাটির পানে তোমায় নামায় ॥
ওগো, তোমার সোনার আলোর ধারা, তার ধারি ধার-
আমার কালো মাটির ফুল ফুটিয়ে শোধ করি তার।
আমার শরৎরাতের শেফালিবন সৌরভেতে মাতে যখন
তখন পালটা সে তান লাগে তব শ্রাবণ-রাতের প্রেম-বরিষায় ॥
অরূপবীণা রূপের আড়ালে লুকিয়ে বাজে,
সে বীণা আজি উঠিল বাজি হৃদয়মাঝে ॥
ভুবন আমার ভরিল সুরে, ভেদ ঘুচে যায় নিকটে দূরে,
সেই রাগিণী লেগেছে আমার সকল কাজে ॥
হাতে-পাওয়ার চোখে-চাওয়ার সকল বাঁধন
গেল কেটে আজ, সফল হল সকল কাঁদন।
সুরের রসে হারিয়ে যাওয়া সেই তো দেখা, সেই তো পাওয়া—
বিরহ মিলন মিলে গেল আজ সমান সাজে ॥
আমি জ্বালব না মোর বাতায়নে প্রদীপ আনি,
আমি শুনবো বসে আঁধার-ভরা গভীর বাণী ॥
আমার এ দেহ মন মিলায়ে যাক নিশীথরাতে,
আমার লুকিয়ে-ফোটা এই হৃদয়ের পুষ্পপাতে,
থাক-না ঢাকা মোর বেদনার গন্ধখানি ॥
আমার সকল হৃদয় উধাও হবে তারার মাঝে
যেখানে ওই আঁধারবীণায় আলো বাজে।
আমার সকল দিনের পথ খোঁজা এই হল সারা,
এখন দিক্-বিদিকের শেষে এসে দিশাহারা
কিসের আশায় বসে আছি অভয় মানি ॥
আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই তখন যাহা পাই
সে যে আমি হারাই বারে বারে ॥
তিনি যখন ভিক্ষা নিতে আসেন আমার দ্বারে
বন্ধ তালা ভেঙে দেখি আপন-মাঝে গোপন রতনভার,
হারায় না সে আর ॥
প্রভাত আসে তাঁহার কাছে আলোক ভিক্ষা নিতে,
সে আলো তার লুটায় ধরণীতে।
তিনি যখন সন্ধ্যা-কাছে দাঁড়ান উর্ধ্বকরে, তখন স্তরে স্তরে
ফুটে ওঠে অন্ধকারের আপন প্রাণের ধন-
মুকুটে তাঁর পরেন সে রতন ॥
আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে তোমারি নাম সকল তারার মাঝে ॥
সে নামখানি নেমে এল ভুঁয়ে কখন আমার ললাট দিল ছুঁয়ে,
শান্তিধারায় বেদন গেল ধুয়ে— আপন আমার আপনি মরে লাজে ॥
মন মিলে যায় আজ ওই নীরব রাতে তারায়-ভরা ওই গগনের সাথে।
অমনি করে আমার এ হৃদয় তোমার নামে হোক-না নামময়,
আঁধারে মোর তোমার আলোর জয় গভীর হয়ে থাক্ জীবনের কাজে ॥
অকারণে অকালে মোর পড়ল যখন ডাক
তখন আমি ছিলেম শয়ন পাতি।
বিশ্ব তখন তারার আলোয় দাঁড়ায়ে নির্বাক,
ধরায় তখন তিমিরগহন রাতি।
ঘরের লোকে কেঁদে কইল মোরে,
‘আঁধারে পথ চিনবে কেমন করে?’
আমি কইনু, ‘চলব আমি নিজের আলো ধরে,
হাতে আমার এই-যে আছে বাতি।’
বাতি যতই উচ্চ শিখায় জ্বলে আপন তেজে
চোখে ততই লাগে আলোর বাধা,
ছায়ায় মিশে চারি দিকে মায়া ছড়ায় সে-যে—
আধেক দেখা করে আমায় আঁধা।
গর্বভরে যতই চলি বেগে
আকাশ তত ঢাকে ধুলার মেঘে,
শিখা আমার কেঁপে ওঠে অধীর হাওয়া লেগে—
পায়ে পায়ে সৃজন করে ধাঁদা॥
হঠাৎ শিরে লাগল আঘাত বনের শাখাজালে,
হঠাৎ হাতে নিবল আমার বাতি।
চেয়ে দেখি পথ হারিয়ে ফেলেছি কোন্ কালে—
চেয়ে দেখি তিমিরগহন রাতি।
কেঁদে বলি মাথা করে নিচু,
‘শক্তি আমার রইল না আর কিছু!’
সেই নিমেষে হঠাৎ দেখি কখন পিছু পিছু
এসেছে মোর চিরপথের সাথি॥
ভুবনজোড়া আসনখানি
আমার হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি ॥
রাতের তারা, দিনের রবি, আঁধার-আলোর সকল ছবি,
তোমার আকাশ-ভরা সকল বাণী- হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি ॥
ভুবনবীণার সকল সুরে
আমার হৃদয় পরান দাও-না পূরে।
দুঃখসুখের সকল হরষ, ফুলের পরশ, ঝড়ের পরশ-
তোমার করুণ শুভ উদার পাণি হৃদয়-মাঝে দিক্-না আনি ॥
ডাকে বার বার ডাকে,
শোনো রে, দুয়ারে দুয়ারে আঁধারে অলোকে ॥
কত সুখদুঃখশোকে কত মরণে জীবনলোকে
ডাকে বজ্রভয়ঙ্কর রবে,
সুধাসঙ্গীতে ডাকে দু্যলোকে ভূলোকে ॥
অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো!
সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো
সেই তো তোমার ভালো ॥
পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে সেই গেহ
সেই তো তোমার গেহ।
সমরঘাতে অমর করে রুদ্রনিঠুর স্নেহ
সেই তো তোমার স্নেহ ॥
সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান
সেই তো তোমার দান।
মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ
সেই তো তোমার প্রাণ।
বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি
সেই তো স্বর্গভূমি।
সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি
সেই তো আমার
তুমি
॥
৩৫৫
সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ
তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ ॥
মেঘের কলস ভ'রে ভ'রে প্রসাদ বারি পড়ে ঝ'রে,
সকল দেহে প্রভাতবায়ু ঘুচায় অবসাদ-
তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ ॥
তৃণ যে এই ধুলার 'পরে পাতে আঁচলখানি,
এই-যে আকাশ চিরনীরব অমৃতময় বাণী,
ফুল যে আসে দিনে দিনে বিনা রেখার পথটি চিনে,
এই-যে ভুবন দিকে দিকে পুরায় কত সাধ-
তোমার আশীর্বাদ, হে প্রভু, তেমার আশীর্বাদ ॥
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া ॥
এই-যে বিপুল ঢেউ লেগেছে তোর মাঝেতে উঠুক নেচে,
সকল পরান দিক-না নাড়া ॥
বোস্-না, ভ্রমর, এই নীলিমায় আসন লয়ে
অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু-মাখা হয়ে।
যেখানেতে অগাধ ছুটি মেল সেথা তোর ডানাদুটি,
সবার মাঝে পাবি ছাড়া ॥
যে থাকে থাক-না দ্বারে, যে যাবি যা-না পারে ॥
যদি ওই ভোরের পাখি তোরি নাম যায় রে ডাকি
একা তুই চলে যা রে ॥
কুঁড়ি চায় আঁধার রাতে শিশিরের রসে মাতে।
ফোটা ফুল চায় না নিশা প্রাণে তার আলোর তৃষা,
কাঁদে সে অন্ধকারে ॥
আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায় ও কে !
সে সুধা ছড়িয়ে গেল লোকে লোকে ॥
গাছেরা ভরে নিল সবুজ পাতায়,
ধরণী ধরে নিল আপন মাথায়।
ছেলেরা সকল গায়ে নিল মেখে,
পাখিরা পাখায় পাখায় নিল এঁকে।
ছেলেরা কুড়িয়ে নিল মায়েরা বুকে,
মায়েরা দেখে নিল ছেলের মুখে ॥
সে যে ওই দুঃখশিখায় উঠল জ্বলে,
সে যে ওই অশ্রুধারায় পড়ল গলে।
সে যে ওই বিদীর্ণ বীর-হৃদয় হতে
বহিল মরণরূপী জীবনস্রোতে।
সে যে ওই ভাঙাগড়ার তালে তালে
নেচে যায় দেশে দেশে কালে কালে ॥
নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে
তারি মধু কেন মনমধুপে খাওয়াও না ?
নিত্যসভা বসে তোমার প্রাঙ্গণে,
তোমার ভৃত্যেরে সেই সভায় কেন গাওয়াও না ?।
বিশ্বকমল ফুটে চরণচুম্বনে,
সে যে তোমার মুখে মুখ তুলে চায় উন্মনে,
আমার চিত্ত-কমলটিরে সেই রসে
কেন তোমার পানে নিত্য-চাওয়া চাওয়াও না ?।
আকাশে ধায় রবি-তারা-ইন্দুতে,
তোমার বিরামহারা নদীরা ধায় সিন্ধুতে,
তেমনি করে সুধাসাগর-সন্ধানে
আমার জীবনধারা নিত্য কেন ধাওয়াও না ?।
পাখির কণ্ঠে আপনি জাগাও আনন্দ,
তুমি ফুলের বক্ষে ভরিয়া দাও সুগন্ধ,
তেমনি করে আমার হৃদয়ভিক্ষুরে
কেন দ্বারে তোমার নিত্যপ্রসাদ পাওয়াও না ?।
এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে,
আর তো গতি নাহি রে মোর নাহি রে ॥
যে পথে তব রথের রেখা ধরিয়া
আপনা হতে কুসুম উঠে ভরিয়া,
চন্দ্র ছুটে, সূর্য ছুটে, সে পথতলে পড়িব লুটে-
সবার পানে রহিব শুধু চাহি রে ॥
তোমার ছায়া পড়ে যে সরোবরে গো।
জলের ঢেউ তরল তানে সে ছায়া লয়ে মাতিল গানে,
ঘিরিয়া তারে ফিরিব তরী বাহি রে।
যে বাঁশিখানি বাজিছে তব ভবনে
সহসা তাহা শুনিব মধু পবনে।
তাকায়ে রব দ্বারের পানে, সে তানখানি লইয়া কানে
বাজায়ে বীণা বেড়াব গান গাহি রে ॥
কোলাহল তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে।
এখন হবে প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে ॥
রাজার পথে লোক ছুটেছে, বেচা-কেনার হাঁক উঠেছে,
আমার ছুটি অবেলাতেই দিন-দুপুরের মধ্যখানে-
কাজের মাঝে ডাক পড়েছে কেন যে তা কেই-বা জানে ॥
মোর কাননে অকালে ফুল উঠুক তবে মুঞ্জরিয়া।
মধ্যদিনের মৌমাছিরা বেড়াক মৃদু গুঞ্জরিয়া।
মন্দভালোর দ্বন্দ্বে খেটে গেছে তো দিন অনেক কেটে,
অলস বেলার খেলার সাথি এবার আমার হৃদয় টানে-
বিনা কাজের ডাক পড়েছে
কেন যে তা কেই-বা জানে ॥
যেথায় তোমার লুট হতেছে ভুবনে।
সেইখানে মোর চিত্ত যাবে কেমনে?
সোনার ঘটে সূর্য তারা নিচ্ছে তুলে আলোর ধারা,
অনন্ত প্রাণ ছড়িয়ে পড়ে গগনে ॥
যেথায় তুমি বস দানের আসনে
চিত্ত আমার সেথায় যাবে কেমনে?
নিত্য নূতন রসে ঢেলে আপনাকে যে দিচ্ছ মেলে,
সেথা কি ডাক পড়বে না গো জীবনে?।
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও ॥
নয়কো বনে, নয় বিজনে, নয়কো আমার আপন মনে-
সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়, সেথায় আপন আমারও ॥
সবার পানে যেথায় বাহু পসারো
সেইখানেতেই প্রেম জাগিবে আমারও।
গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে-
সবার তুমি আনন্দধন হে প্রিয়, আনন্দ সেই আমারও ॥
প্রভু, আজি তোমার দক্ষিণ হাতে রেখো না ঢাকি।
এসেছি তোমারে, হে নাথ, পরাতে রাখী ॥
যদি বাঁধি তোমার হাতে পড়ব বাঁধা সবার সাথে,
যেখানে যে আছে কেহই রবে না বাকি ॥
আজি যেন ভেদ নাহি রয় আপনা পরে,
তোমায় যেন এক দেখি হে বাহিরে ঘরে।
তোমা সাথে যে বিচ্ছেদে ঘুরে বেড়াই কেঁদে কেঁদে
ক্ষণেকতরে ঘুচাতে তাই তোমারে ডাকি ॥
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।
এবার হৃদয়-মাঝে লুকিয়ে বোসো, কেউ জানবে না, কেউ বলবে না ॥
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি দেশে-বিদেশে কতই ঘুরি—
এবার বলো আমার মনের কোণে দেবে ধরা, ছলবে না ॥
জানি আমার কঠিন হৃদয় চরণ রাখার যোগ্য সে নয়—
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায় তবু কি প্রাণ গলবে না ?
নাহয় আমার নাই সাধনা— ঝরলে তোমার কৃপা কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল, চকিতে ফল ফলবে না ?।
কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই-
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই ॥
পুরানো আবাস ছেড়ে যাই যবে মনে ভেবে মরি কী জনি কী হবে-
নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন সে কথা যে ভুলে যাই ॥
জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে যখনি যেখানে লবে
চিরজনমের পরিচিত ওহে তুমিই চিনাবে সবে।
তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর, নাহি কোনো মানা, নাহি কোনো ভয়-
সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ দেখা যেন সদা পাই ॥
৩৬৭
সবার মাঝারে
তোমারে স্বীকার করিব হে।
সবার মাঝারে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে ॥
শুধু আপনার মনে নয়, আপন ঘরের কোণে নয়,
শুধু আপনার রচনার মাঝে নহে- তোমার মহিমা যেথা উজ্জ্বল রহে
সেই সবা-মাঝে তোমারে স্বীকার করিব হে।
দ্যুলোকে ভূলোকে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে ॥
সকলই তেয়াগি তোমারে স্বীকার করিব হে।
সকলই গ্রহণ করিয়া তোমারে বরিব হে।
কেবলই তোমার স্তবে নয়, শুধু সঙ্গীতরবে নয়,
শুধু নির্জনে ধ্যানের আসনে নহে- তব সংসার যেথা জাগ্রত রহে,
কর্মে সেথায় তোমারে স্বীকার করিব হে।
প্রিয়ে অপ্রিয়ে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে ॥
জানি না বলিয়া তোমারে স্বীকার করিব হে।
জানি ব'লে, নাথ, তোমারে হৃদয়ে বরিব হে।
শুধু জীবনের সুখে নয়, শুধু প্রফুল্লমুখে নয়,
শুধু সুদিনের সহজ সুযোগে নহে- দুখশোক যেথা আঁধার করিয়া রহে
নত হয়ে সেথা তোমারে স্বীকার করিব হে।
নয়নের জলে তোমারে হৃদয়ে বরিব হে ॥
মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্তদ্বারে তোমার বিশ্বের সভাতে
আজি এ মঙ্গলপ্রভাতে ॥
উদয়গিরি হতে উচ্চে কহো মোরে : তিমির লয় হল দীপ্তিসাগরে-
স্বার্থ হতে জাগো, দৈন্য হতে জাগো, সব জড়তা হতে জাগো জাগো রে
সতেজ উন্নত শোভাতে ॥
বাহির করো তব পথের মাঝে, বরণ করো মোরে তোমার কাজে।
নিবিড় আবরণ করো বিমোচন, মুক্ত করো সব তুচ্ছ শোচন,
ধৌত করো মুগ্ধ লোচন তোমার উজ্জ্বল শুভ্ররোচন
নবীন নির্মল বিভাতে ॥
যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক্, তারা তো পারে না জানিতে-
তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ আমার হৃদয়খানিতে॥
যারা কথা বলে তাহারা বলুক, আমি করিব না কারেও বিমুখ-
তারা নাহি জানে ভরা আছে প্রাণ তব অকথিত বাণীতে।
নীরবে নিয়ত রয়েছ আমার নীরব হৃদয়খানিতে॥
তোমার লাগিয়া কারেও, হে প্রভু, পথ ছেড়ে দিতে বলিব না কভু,
যত প্রেম আছে সব প্রেম মোরে তোমা-পানে রবে টানিতে-
সকলের প্রেমে রবে তব প্রেম আমার হৃদয়খানিতে।
সবার সহিতে তোমার বাঁধন হেরি যেন সদা এ মোর সাধন-
সবার সঙ্গ পারে যেন মনে তব আরাধনা আনিতে।
সবার মিলনে তোমার মিলন
জাগিবে হৃদয়খানিতে॥
জাগ্রত বিশ্বকোলাহল-মাঝে
তুমি গম্ভীর, স্তব্ধ, শান্ত, নির্বিকার,
পরিপূর্ণ মহাজ্ঞান ॥
তোমা-পানে ধায় প্রাণ সব কোলাহল ছাড়ি,
চঞ্চল নদী যেমন ধায় সাগরে ॥
শান্তিসমুদ্র তুমি গভীর,
অতি অগাধ আনন্দরাশি।
তোমাতে সব দুঃখ জ্বালা
করি নির্বাণ ভুলিব সংসার,
অসীম সুখসাগরে ডুবে যাব ॥
ডুবি অমৃতপাথারে- যাই ভুলে চরাচর,
মিলায় রবি শশী ॥
নাহি দেশ, নাহি কাল, নাহি হেরি সীমা-
প্রেমমুরতি হৃদয়ে জাগে,
আনন্দ নাহি ধরে ॥
ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হউক জয়।
তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়, তোমারি হউক জয় ॥
হে বিজয়ী বীর, নব জীবনের প্রাতে
নবীন আশার খড়্গ তোমার হাতে-
জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতে, বন্ধন হোক ক্ষয় ॥
এসো দুঃসহ, এসো এসো নির্দয়, তোমারি হউক জয়।
এসো নির্মল, এসো এসো নির্ভয়, তোমারি হউক জয়।
প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজে,
দুঃখের পথে তোমারি তূর্য বাজে-
অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্তমাঝে, মৃত্যুর হোক লয় ॥
হবে জয়, হবে জয়, হবে জয় রে
ওহে বীর, হে নির্ভয়॥
জয়ী প্রাণ, চিরপ্রাণ, জয়ী রে আনন্দগান,
জয়ী প্রেম, জয়ী ক্ষেম, জয়ী জ্যোতির্ময় রে॥
এ আঁধার হবে ক্ষয়, হবে ক্ষয় রে,
ওহে বীর, হে নির্ভয়।
ছাড়ো ঘুম, মেলো চোখ, অবসাদ দূর হোক,
আশার অরুণালোক হোক অভ্যুদয় রে ॥
জয় হোক, জয় হোক নব অরুণোদয়।
পূর্বদিগঞ্চল হোক জ্যোতির্ময় ॥
এসো অপরাজিত বাণী, অসত্য হানি-
অপহত শঙ্কা, অপহত সংশয় ॥
এসো নবজাগ্রত প্রাণ, চিরযৌবনজয়গান।
এসো মৃত্যুঞ্জয় আশা জড়নাশা-
ক্রন্দন দূর হোক, বন্ধন হোক ক্ষয় ॥
জয় তব বিচিত্র আনন্দ, হে কবি,
জয় তোমার করুণা।
জয় তব ভীষণ সব-কলুষ-নাশন রুদ্রতা।
জয় অমৃত তব, জয় মৃত্যু তব,
জয় শোক তব, জয় সান্ত্বনা ॥
জয় পূর্ণজাগ্রত জ্যোতি তব,
জয় তিমিরনিবিড় নিশীথিনী ভয়দায়িনী।
জয় প্রেমমধুময় মিলন তব, জয় অসহ বিচ্ছেদবেদনা ॥
সকলকলুষতামসহর, জয় হোক তব জয়-
অমৃতবারি সিঞ্চন কর' নিখিলভুবনময়-
মহাশান্তি, মহাক্ষেম, মহাপূণ্য, মহাপ্রেম ॥
জ্ঞানসূর্য-উদয়-ভাতি ধ্বংস করুক তিমিররাতি-
দুঃসহ দুঃস্বপ্ন ঘাতি অপগত কর' ভয় ॥
মোহমলিন অতি-দুর্দিন-শঙ্কিত-চিত পান্থ
জটিল-গহন-পথসঙ্কট-সংশয়-উদ্ভ্রান্ত।
করুণাময়, মাগি শরণ- দুর্গতভয় করহ হরণ,
দাও দুঃখবন্ধতরণ মুক্তির পরিচয় ॥
রাখো রাখো
রে জীবনে জীবনবল্লভে,
প্রাণমনে ধরি রাখো নিবিড় আনন্দবন্ধনে
॥
আলো জ্বালো হৃদয়দীপে অতিনিভৃত অন্তরমাঝে,
আকুলিয়া দাও প্রাণ গন্ধচন্দনে ॥
হৃদয়মন্দিরে, প্রাণাধীশ, আছ গোপনে।
অমৃতসৌরভে আকুল প্রাণ, হায়,
ভ্রমিয়া জগতে না পায় সন্ধান-
কে পারে পশিতে আনন্দভবনে
তোমার করুণাকিরণ-বিহনে ॥
ওই শুনি যেন চরণধ্বনি রে,
শুনি আপন-মনে।
বুঝি আমার মনোহরণ আসে গোপনে ॥
পাবার আগে কিসের আভাস পাই,
চোখের জলের বাঁধ ভেঙেছে তাই গো,
মালার গন্ধ এল যারে জানি স্বপনে ॥
ফুলের মালা হাতে ফাগুন আছে ওই যে-
তার চলার পথের কাছে ওই-যে।
দিগঙ্গনার অঙ্গনে যে আজি
ক্ষণে ক্ষণে শঙ্খ ওঠে বাজি,
আশার হাওয়া লাগে ওই নিখিল-গগনে ॥
বেঁধেছ প্রেমের পাশে ওহে প্রেমময়।
তব প্রেম লাগি দিবানিশি জাগি ব্যাকুলহৃদয় ॥
তব প্রেমে কুসুম হাসে, তব প্রেমে চাঁদ বিকাশে,
প্রেমহাসি তব উষা নব নব
প্রেমে-নিমগন নিখিল নীরব,
তব প্রেম-ভরে ফিরে হা হা ক'রে উদাসী মলয় ॥
আকুল প্রাণ মম ফিরিবে না সংসারে,
ভুলেছে তোমারি রূপে নয়ন আমারি।
জলে স্থলে গগনতলে তব সুধাবাণী সতত উথলে-
শুনিয়া পরান শান্তি না মানে,
ছুটে যেতে চায় অনন্তেরই পানে,
আকুল হৃদয় খোঁজে বিশ্বময় ও প্রেম-আলয় ॥
দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও।
আমার দিকে ও মুখ ফিরাও ॥
কাছে থেকে চিনতে নারি, কোন্ দিকে যে কী নেহারি,
তুমি আমার হৃদ্বিহারী হৃদয়-পানে হাসিয়া চাও ॥
বলো আমায় বলো কথা, গায়ে আমার পরশ করো।
দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমায় তুমি তুলে ধরো।
যা বুঝি সব ভুল বুঝি হে, যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে-
হাসি মিছে, কান্না মিছে -সামনে এসে এ ভুল ঘুচাও ॥
আর নহে, আর নয়,
আমি করি নে আর ভয়।
আমার ঘুচল কাঁদন, ফলল সাধন, হল বাঁধন ক্ষয় ॥
ওই আকাশে ওই ডাকে,
আমায় আর কে ধ’রে রাখে-
আমি সকল দুয়ার খুলেছি, আজ যাব সকলময় ॥
ওরা ব’সে ব’সে মিছে
শুধু মায়াজাল গাঁথিছে-
ওরা কী-যে গোনে ঘরের কোণে আমায় ডাকে পিছে।
আমার অস্ত্র হল গড়া,
আমার বর্ম হল পরা-
এবার ছুটবে ঘোড়া পবনবেগে, করবে ভুবন জয় ॥
আরো চাই যে, আরো চাই গো- আরো যে চাই।
ভাণ্ডারী যে সুধা আমায় বিতরে নাই ॥
সকালবেলার আলোয় ভরা এই-যে আকাশ বসুন্ধরা
এরে আমার জীবন-মাঝে কুড়ানো চাই-
সকল ধন যে বাইরে আমার, ভিতরে নাই ॥
প্রাণের বীণায় আরো আঘাত, আরো যে চাই।
গুণীর পরশ পেয়ে সে যে শিহরে নাই।
দিনরজনীর বাঁশি পূরে যে গান বাজে অসীম সুরে
তারে আমার প্রাণের তারে বাজানো চাই।
আপন গান যে দূরে তাহার, নিয়ড়ে নাই ॥
নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, এলে সকল-মাঝে-
তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে ॥
ফুরায় যবে মিলনরাতি তবু চির সাথের সাথি
ফুরায় না তো তোমায় পাওয়া, এসো স্বপনসাজে ॥
তোমার সুধারসের ধারা গহনপথে এসে
ব্যথারে মোর মধুর করি নয়নে যায় ভেসে।
শ্রবণে মোর নব নব শুনিয়েছিলে যে সুর তব
বীণা থেকে বিদায় নিল, চিত্তে আমার বাজে ॥
আরাম-ভাঙা উদাস সুরে
আমার বাঁশির শূন্য হৃদয় কে দিল আজ ব্যথায় পূরে ॥
বিরামহারা ঘরছাড়াকে ব্যাকুল বাঁশি আপনি ডাকে-
ডাকে স্বপন-জাগরণে, কাছের থেকে ডাকে দূরে ॥
আমার প্রাণের কোন্ নিভৃতে লুকিয়ে কাঁদায় গোধূলিতে-
মন আজও তার নাম জানে না, রূপ আজও তার নয়কো চেনা-
কেবল যে সে ছায়ার বেশে স্বপ্নে আমার বেড়ায় ঘুরে ॥
আসা-যাওয়ার মাঝখানে
একলা আছ চেয়ে কাহার পথ-পানে ॥
আকাশে ওই কালোয় সোনায় শ্রাবণমেঘের কোণায় কোণায়
আঁধার-আলোয় কোন্ খেলা যে কে জানে
আসা-যাওয়ার মাঝখানে ॥
শুকনো পাতা ধুলায় ঝরে, নবীন পাতায় শাখা ভরে।
মাঝে তুমি আপন-হারা, পায়ের কাছে জলের ধারা
যায় চলে ওই অশ্রু-ভরা কোন্ গানে
আসা-যাওয়ার মাঝখানে ॥
বারে বারে পেয়েছি যে তারে
চেনায় চেনায় অচেনারে ॥
যারে দেখা গেল তারি মাঝে না-দেখারই কোন্ বাঁশি বাজে,
যে আছে বুকের কাছে কাছে চলেছি তাহারি অভিসারে ॥
অপরূপ সে যে রূপে রূপে কী খেলা খেলিছে চুপে চুপে।
কানে কানে কথা উঠে পূরে কোন সুদূরের সুরে সুরে
চোখে-চোখে-চাওয়া নিয়ে চলে কোন্ অজানারই পথপারে ॥
এ পথ গেছে কোন্খানে গো কোন্খানে-
তা কে জানে তা কে জানে ॥
কোন্ পাহাড়ের পারে, কোন্ সাগরের ধারে,
কোন্ দুরাশায় দিক্-পানে-
তা কে জানে তা কে জানে ॥
এ পথ দিয়ে কে আসে যায় কোন্খানে
তা কে জানে তা কে জানে।
কেমন যে তার বাণী, কেমন হাসিখানি,
যায় সে কাহার সন্ধানে-
তা কে জানে তা কে জানে ॥
নিত্য নব সত্য তব শুভ্র আলোকময়
পরিপূর্ণ জ্ঞানময়
কবে হবে বিভাসিত মম চিত্ত-আকাশে ?।
রয়েছি বসি দীর্ঘনিশি
চাহিয়া উদয়দিশি
ঊর্ধ্বমুখে করপুটে-
নবসুখ-নবপ্রাণ-নবদিবা-আশে ॥
কী দেখিব, কী জানিব,
না জানি সে কী আনন্দ-
নূতন আলোক আপন মনোমাঝে।
সে আলোকে মহাসুখে
আপন আলয়মুখে
চলে যাব গান গাহি-
কে রহিবে আর দূর পরবাসে ॥
যদি ঝড়ের মেঘের মতো আমি ধাই চঞ্চল-অন্তর
তবে দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে ঈশ্বর ॥
ওহে অপাপপুরুষ, দীনহীন আমি এসেছি পাপের কূলে-
প্রভু, দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে, দয়া করে লও তুলে ॥
আমি জলের মাঝারে বাস করি, তবু তৃষায় শুকায়ে মরি-
প্রভু দয়া কোরো হে, দয়া করে দাও সুধায় হৃদয় ভরি ॥
তুমি আমাদের পিতা,
তোমায় পিতা ব’লে যেন জানি,
তোমায় নত হয়ে যেন মানি,
তুমি কোরো না কোরো না রোষ।
হে পিতা, হে দেব, দূর করে দাও যত পাপ, যত দোষ-
যাহা ভালো তাই দাও আমাদের, যাহাতে তোমার তোষ।
তোমা হতে সব সুখ হে পিতা, তোমা হতে সব ভালো।
তোমাতেই সব দুখ হে পিতা, তোমাতেই সব ভালো।
তুমিই ভালো হে তুমিই ভালো সকল-ভালোর সার-
তোমারে নমস্কার হে পিতা, তোমারে নমস্কার॥
প্রেমানন্দে রাখো পূর্ণ আমারে দিবসরাত।
বিশ্বভুবনে নিরখি সতত সুন্দর তোমারে,
চন্দ্র-সূর্য-কিরণে তোমার করুণ নয়নপাত ॥
সুখসম্পদে করি হে পান তব প্রসাদবারি,
দুখসঙ্কট পরশ পাই তব মঙ্গলহাত ॥
জীবনে জ্বালো অমর দীপ তব অনন্ত আশা,
মরণ-অন্তে হউক তোমারি চরণে সুপ্রভাত ॥
লহো লহো মম সব আনন্দ, সকল প্রীতি-গীতি-
হৃদয়ে বাহিরে একমাত্র তুমি আমার নাথ ॥
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না ?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না ?।
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে তোমায় যবে পাই দেখিতে
হারাই-হারাই সদা ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে ॥
কী করিলে বলো পাইব তোমারে, রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।
এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ, তোমারে হৃদয়ে রাখিতে ?
আর কারো পানে চাহিব না আর, করিব হে আমি প্রাণপণ-
তুমি যদি বল এখনি করিব বিষয়বাসনা বিসর্জন ॥
তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল।
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া পান করে শুধু হলাহল॥
আপনি কেটেছে আপনার মূল- না জানে সাঁতার, নাহি পায় কূল,
স্রোতে যায় ভেসে, ডোবে বুঝি শেষে, করে দিবানিশি টলোমল॥
আমি কোথা যাব, কাহারে শুধাব, নিয়ে যায় সবে টানিয়া।
একেলা আমারে ফেলে যাবে শেষে অকূল পাথারে আনিয়া।
সুহৃদের তরে চাই চারি ধারে, আঁখি করিতেছে ছলছল,
আপনার ভারে মরি যে আপনি কাঁপিছে হৃদয় হীনবল॥
কেন বাণী তব নাহি শুনি নাথ হে ?
অন্ধজনে নয়ন দিয়ে অন্ধকারে ফেলিলে, বিরহে তব কাটে দিনরাত হে ॥
স্বপনসম মিলাবে যদি কেন গো দিলে চেতনা-
চকিতে শুধু দেখা দিয়ে চিরমরমবেদনা,
আপনা-পানে চাহি শুধু নয়নজলপাত হে ॥
পরশে তব জীবন নব সহসা যদি জাগিল
কেন জীবন বিফল কর- মরণশরঘাত হে।
অহঙ্কার চূর্ণ করো, প্রেমে মন পূর্ণ করো,
হৃদয় মন হরণ করি রাখো তব সাথ হে ॥
তুমি ছেড়ে ছিলে, ভুলে ছিলে ব’লে হেরো গো কী দশা হয়েছে-
মলিন বদন, মলিন হৃদয়, শোকে প্রাণ ডুবে রয়েছে ॥
বিরহীর বেশে এসেছি হেথায় জানাতে বিরহবেদনা ;
দরশন নেব তবে চ’লে যাব, অনেক দিনের বাসনা ॥
‘নাথ নাথ’ ব’লে ডাকিব তোমারে, চাহিব হৃদয়ে রাখিতে-
কাতর প্রাণের রোদন শুনিলে আর কি পারিবে থাকিতে ?
ও অমৃতরূপ দেখিব যখন মুছিব নয়নবারি হে-
আর উঠিব না, পড়িয়া রহিব চরণতলে তোমারি হে ॥
অসীম আকাশে অগণ্য কিরণ, কত গ্রহ উপগ্রহ
কত চন্দ্র তপন ফিরিছে বিচিত্র আলোক জ্বালায়ে—
তুমি কোথায়, তুমি কোথায় ?।
হায় সকলই অন্ধকার— চ্ন্দ্র, সূর্য, সকল কিরণ,
আঁধার নিখিল বিশ্বজগত।
তোমার প্রকাশ হৃদয়মাঝে সুন্দর মোর নাথ—
মধুর প্রেম-আলোকে তোমারি মাধুরী তোমারে প্রকাশে ॥
চরণধ্বনি শুনি তব, নাথ, জীবনতীরে
কত নীরব নির্জনে কত মধুসমীরে ॥
গগনে গ্রহতারাচয় অনিমেষে চাহি রয়,
ভাবনাস্রোতে হৃদয়ে বয় ধীরে একান্তে ধীরে ॥
চাহিয়া রহে আঁখি মম, তৃষ্ণাতুর পাখিসম,
শ্রবণ রয়েছি মেলি চিত্তগভীরে-
কোন্ শুভপ্রাতে দাঁড়াবে হৃদিমাঝে,
ভুলিব সব দুঃখ সুখ ডুবিয়া আনন্দনীরে ॥
শূন্য হাতে ফিরি, হে নাথ ও পথে পথে- ফিরি হে দ্বারে দ্বারে-
চিরভিখারি হৃদি মম নিশিদিন চাহে কারে॥
চিত্ত না শান্তি জানে, তৃষ্ণা না তৃপ্তি মানে-
যাহা পাই তাই হারাই, ভাসি অশ্রুধারে ॥
সকল যাত্রী চলি গেল, বহি গেল সব বেলা,
আসে তিমিরযামিনী, ভাঙিয়া গেল মেলা-
কত পথ আছে বাকি, যাব চলি ভিক্ষা রাখি,
কোথা জ্বলে গৃহপ্রদীপ কোন্ সিন্ধুপারে ॥