ভাষাংশ
গল্পগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
করুণা
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
নিধি নরেন্দ্রের বাড়িতে মাঝে মাঝে আইসে। কিন্তু আমরা যে ঘটনার সূত্র অবলম্বন করিয়া
আসিতেছি সে সূত্রের মধ্যে কখনো পড়ে নাই, এইবার পড়িয়াছে। স্বরূপবাবু তাঁহার
অভ্যাসানুসারে ইচ্ছাপূর্বক বা দৈবক্রমেই হউক, এক খণ্ড কাগজ ঘরে ফেলিয়া গিয়াছেন,
নিধি সে কাগজটি কুড়াইয়া পাইয়াছে। সে কাগজটিতে গুটিকয়েক কবিতা লিখা আছে। অন্য লোক
হইলে সে কবিতাগুলির সরল অর্থটি বুঝিয়া পড়িত ও নিশ্চিন্ত থাকিত, কিন্তু বুদ্ধিমান
নিধি সেরূপ লোকই নহে। যদি বা তাহার কোনো গূঢ় অর্থ না থাকিত তথাপি নিধি তাহা বাহির
করিতে পারিত। তবু ইহাতে তো কিছু ছিল। নিধির সে কবিতাগুলি বড়ো ভালো ঠেকিল না।
ট্যাঁকে গুঁজিয়া রাখিল ও ভাবিল ইহার নিগূঢ় তাহাকে জানিতে হইবে। অমন বুদ্ধিমান লোকের
কাছে কিছুই ঢাকা থাকে না, ইঙ্গিতে সকলই বুঝিয়া লইল। চতুরতাভিমানী লোকেরা নিজবুদ্ধির
উপর অসন্দিগ্ধরূপে নির্ভর করিয়া এক-এক সময়ে সর্বনাশ ঘটায়, এমন আর কেহই নহে।
‘দিদি, কেমন আছ দেখিতে আসিয়াছি’ বলিয়া নিধি করুণার নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। নিধি
ছেলেবেলা হইতেই অনূপের অন্তঃপুরে যাইত ও করুণার মাকে মা বলিয়া ডাকিত। নিধি এখন মাঝে
মাঝে প্রায়ই করুণা কেমন আছে দেখিতে আইসে। একদিন নরেন্দ্র কলিকাতায় গিয়াছে। নরেন্দ্র
কবে কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিবে, করুণা স্বরূপবাবুর নিকট ভবিকে জানিয়া আসিতে কহিল।
নিধি আড়াল হইতে শুনিতে পাইল, মনে মনে কহিল ‘হুঁ হুঁ- বুঝিয়াছি, এত লোক থাকিতে
স্বরূপবাবুকে জিজ্ঞাসা করিতে পাঠানো কেন! গদাধরবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেও তো চলিত।’
একদিন করুণা ভবিকে কী কথা বলিতেছিল, দূর হইতে নিধি শুনিতে পাইল না, কিন্তু মনে হইল
করুণা যেন একবার ‘স্বরূপবাবু’ বলিয়াছিল— আর-একটি প্রমাণ জুটিল। আর একদিন নরেন্দ্র
স্বরূপ ও গদাধর বাগানে বসিয়াছিল, করুণা সহসা জানালা দিয়া সেই দিক পানে চাহিয়া গেল,
নিধি স্পষ্ট বুঝিতে পারিল যে করুণা স্বরূপেরই দিকে চাহিয়াছিল। নিধি এই তো তিনটি
অকাট্য প্রমাণ পাইয়াছে, ইহা অন্য লোকের নিকট যাহাই হউক কিন্তু নিধির নিকট ইহা
সমস্তই পরিষ্কার প্রমাণ। শুদ্ধ ইহাই যথেষ্ট নহে, করুণা যে দিনে দিনে শীর্ণ বিষণ্ন
রুগ্ণ হইয়া যাইতেছে, নিধি স্পষ্ট বুঝিতে পারিল তাহার কারণ আর কিছুই নয়— স্বরূপের
ভাবনা।
এখন স্বরূপের নিকট কথা আদায় করিতে হইবে, এই ভাবিয়া নিধি ধীরে ধীরে তাহার নিকট গিয়া
উপস্থিত হল। হঠাৎ গিয়া কহিল, ‘করুণা তো, ভাই, তোমার জন্য একেবারে পাগল।’
স্বরূপ একেবারে চমকিয়া উঠিল। আহ্লাদে উৎফুল্ল হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কী করিয়া
জানিলে।”
নিধি মনে মনে কহিল, ‘হুঁ-হুঁ, আমি তোমাদের ভিতরকার কথা কী করিয়া সন্ধান পাইলাম
ভাবিয়া ভয় পাইতেছ? পাইবে বৈকি, কিন্তু নিধিরামের কাছে কিছুই এড়াইতে পায় না।’ কহিল,
“জানিলাম, এক রকম করিয়া।”
বলিয়া চোখ টিপিতে টিপিতে চলিয়া গেল। তাহার পরদিন গিয়া আবার স্বরূপকে কহিল, “করুণার
সহিত তুমি যে গোপনে গোপনে দেখা সাক্ষাৎ করিতেছ ইহা নরেন্দ্র যেন টের না পায়।”
স্বরূপ কহিল, “সেকি! করুণার সহিত একবারও তো আমার দেখা সাক্ষাৎ কথাবার্তা হয় নাই।”
নিধি মনে-মনে কহিল, “নিশ্চয় দেখাসাক্ষাৎ হইয়াছিল, নহিলে এত করিয়া ভাঁড়াইবার চেষ্টা
করিবে কেন। ইহাও একটি প্রমাণ হইল, কিন্তু আবার স্বরূপ যদি বলিত যে ‘হাঁ দেখা
সাক্ষাৎ হইয়াছিল’ তবে তাহাও একটি প্রমাণ হইত।”
যাহা হউক, নিধির মনে আর সন্দেহ রহিল না। এমন একটি নিগূঢ় বার্তা নিধি আপনার
বুদ্ধিকৌশলে জানিতে পারিয়াছে, এ কথা কি সে আর গোপনে রাখে। তাহার বুদ্ধির পরিচয় লোকে
না পাইলে আর হইল কী। ‘তুমি যাহা মনে করিতেছ তাহা নয়,
আমি ভিতরকার কথা সকল জানি’— চতুরাভিমানী লোকেরা ইহা বুঝাইতে পারিলে বড়োই সন্তুষ্ট
হয়। নিধির কাছে যদি বল যে, ‘রামহরিবাবু বড়ো সৎলোক’ অমনি নিধি চমকিয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা
করিবে, ‘কী বলিতেছ। কে সৎলোক। রামহরি বাবু? ও’— এমন করিয়া বলিবে যে তুমি মনে করিবে,
এ বুঝি রামহরিবাবুর ভিতরকার কী একটা দোষ জানে। পীড়াপীড়ি করিয়া জিজ্ঞাসা করিলে
কহিবে, ‘সে অনেক কথা।’ নিধি সম্প্রতি যে গুপ্ত খবর পাইয়াছে তাহা পরামর্শ দিবার ছলে
নরেন্দ্রকে বলিবে, এইরূপ মনে-মনে স্থির করিল।