ভাষাংশ
গল্পগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


রুণা
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

মহেন্দ্র চলিয়া গেলে রজনী মনে করিল, “আমিই বুঝি মহেন্দ্রের চলিয়া যাইবার কারণ! ”

মহেন্দ্রের মাতা মনে করিলেন যে, রজনী বুঝি মহেন্দ্রের উপর কোনো কর্কশ ব্যবহার করিয়াছে; আসিয়া কহিলেন, “পোড়ারমুখী ভালো এক ডাকিনীকে ঘরে আনিয়াছিলাম! ”

রজনীর শ্বশুর আসিয়া কহিলেন, “ রাক্ষসী, তুই এই সংসার ছারখার করিয়া দিলি! ”
রজনীর ননদ আসিয়া কহিলেন, “হতভাগিনীর সহিত দাদার কী কুক্ষণেই বিবাহ হইয়াছিল! ”

রজনী একটি কথাও বলিল না। রজনীর নিজেরই যে আপনার প্রতি দারুণ ঘৃণা জন্মিয়াছিল, সেই ঘৃণার যন্ত্রণায় সে মনে করিল— বুঝি ইহার একটি কথাও অন্যায় নহে। সে মনে করিল, যে তিরস্কার তাহাকে করা হইতেছে সে তিরস্কার বুঝি তাহার যথার্থই পাওয়া উচিত। রজনী কাহাকেও কিছু বলিল না, একবার কাঁদিলও না। এ কয়দিন তাহার মুখশ্রী অতিশয় গম্ভীর— অতিশয় শান্ত— যেন মনে-মনে কী একটি সংকল্প করিয়াছে, মনে-মনে কী একটি প্রতিজ্ঞা বাঁধিয়াছে।

এই দুই মাস হইল মহেন্দ্র বিদেশে গিয়াছে— এই দুই মাস ধরিয়া রজনী যেন কী একটা ভাবিতেছিল, এত দিনে সে ভাবনা যেন শেষ হইল, তাই রজনীর মুখ অতি গম্ভীর অতি শান্ত দেখাইতেছে।

সন্ধ্যা হইলে ধীরে ধীরে সে মোহিনীর বাড়িতে গেল। মোহিনীর সহিত দেখা হইল, থতমত খাইয়া দাঁড়াইল। যেন কী কথা বলিতে গিয়াছিল, বলিতে পারিল না, বলিতে সাহস করিল না। মোহিনী অতি স্নেহের সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “কী রজনী। কি বলিতে আসিয়াছিস।”

রজনী ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে কহিল, “দিদি, আমার একটি কথা রাখতে হবে।”
মোহিনী আগ্রহের সঙ্গে কহিল, “কী কথা বলো।”

রজনী কতবার ‘না বলি’ ‘না বলি’ করিয়া অনেক পীড়াপীড়ির পর আস্তে আস্তে কহিল মোহিনীকে একটি চিঠি লিখিতে হইবে। কাহাকে লিখিতে হইবে। মহেন্দ্রকে। কী লিখিতে হইবে। না, তিনি বাড়িতে ফিরিয়া আসুন, তাঁহাকে আর অধিক দিন যন্ত্রণা ভোগ করিতে হবে না। রজনী তাহার দিদির বাড়িতে থাকিবে। বলিতে বলিতে রজনী কাঁদিয়া ফেলিল।