ভাষাংশ
গল্পগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


রুণা
বিংশ পরিচ্ছেদ

স্বরূপ ও করুণা কাশীতে আছে। করুণার দুরবস্থা বলিবার নহে সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকিয়া সে যে কী অবস্থায় দিন যাপন করিতেছে তাহা সেই জানে। স্বরূপের ভ্রম অনেক দিন হইল ভাঙিয়াছে, এখন বুঝিয়াছে করুণা তাহাকে ভালোবাসে না। সে ভাবিতেছে, ‘একি উৎপাত! এত করিয়া আনিলাম, গাড়িভাড়া দিলাম—সকলই ব্যর্থ হইল!’ সে যে বিরক্ত হইয়াছে তাহা আর বলিবার নহে। সে মনে করিয়াছিল এতদিন কবিতায় যাহা লিখিয়া আসিয়াছে, কল্পনায় চিত্র করিয়াছে, আজ সেই প্রেমের সুখ উপভোগ করিবে। কিন্তু সে কাছে আসিলে করুণা ভয়ে জড়োসড়ো আড়ষ্ট হইয়া মরিয়া যায়, তাহার সঙ্গে কথাই কহে না। স্বরূপ ভাবিল, ‘একি উৎপাত! এ গলগ্রহ বিদায় করিতে পারিলে যে বাঁচি।’ ভাবিল দিন-কতক কাছে থাকিতে থাকিতেই ভালোবাসা হইবে। স্বরূপ তো তাহার যথাসাধ্য করিল, কিন্তু করুণার ভালোবাসার কোনো চিহ্ন দেখিল না।

করুণা বেচারির তো আরাম বিশ্রাম নাই। এক তো সর্বক্ষণ পরের বাড়িতে অচেনা পুরুষের সঙ্গে আছে বলিয়া সর্বদাই আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হইতেছে। তাহা ছাড়া স্বরূপের ভাব-গতিক দেখিয়া সে তো ভয়ে আকুল—সে কাছে বসিয়া গান গায়, কবিতা শুনাইতে থাকে, মনের দুঃখ নিবেদন করে, অবশেষে মহা রুক্ষভাবে গাড়িভাড়ার টাকার জন্য নালিশ করিবে বলিয়া শাসাইতে আরম্ভ করিয়াছে। করুণা যে কী করিবে কিছুই ভাবিয়া পায় না, ভয়ে বেচারি সারা হইতেছে। স্বরূপ রাত দিন খিট্‌ খিট্‌ করে, এমন-কি করুণাকে মাঝে মাঝে ধম্‌কাইতে আরম্ভ করিয়াছে। করুণার কিছু বলিবার মুখ নাই, সে শুধু কাঁদিতে থাকে।

এইরূপে কত দিন যায়, স্বরূপের এলাহাবাদে যাইবার সময় হইয়াছে। সে ভাবিতেছে, ‘এখন করুণাকে লইয়া কী করি। এইখানে কি ফেলিয়া যাইব। না, এত করিয়া আনিলাম, গাড়িভাড়া দিলাম, এতদিন রাখিলাম, অবশেষে কি ফেলিয়া যাইব। আরো দিন-কতক দেখা যাক।’

অনেক ভাবিয়া-সাবিয়া করুণাকে তো ডাকিল। করুণা ভাবিল, ‘যাইব কি না। কিন্তু না যাইয়াই বা কী করি। এখানে কোথায় থাকিব। এত দূর দেশে অচেনা জায়গায় কার কাছে যাইব। দেশে থাকিতাম তবু কথা থাকিত।’

করুণা চলিল। উভয়ে স্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইল। গাড়ি ছাড়িতে এখনো দেরি আছে। জিনিসপত্র পুঁটুলি-বোঁচকা লইয়া যাত্রিগণ মহা কোলাহল করিতেছে। কানে-কলম-গোঁজা রেলওয়ে ক্লার্ক্‌গণ ভারি উঁচু চালে ব্যস্তভাবে ইতস্তত ফর্ ফর্ করিয়া বেড়াইতেছেন। পান সোডাওয়াটার নানাপ্রকার মিষ্টান্নের বোঝা লইয়া ফেরিওয়ালারা আগামী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিতেছে। এইরূপ তো অবস্থা। এমন সময়ে একজন পুরুষ করুণার পাশে সেই বেঞ্চে আসিয়া আসিয়া বসিল।

করুণা উঠিয়া যাইবে-যাইবে করিতেছে, এমন সময়ে তাহার পার্শ্বস্থ পুরুষ বিস্ময়ের স্বরে কহিয়া উঠিল, “মা, তুমি যে এখানে! ”

করুণা পণ্ডিতমহাশয়ের স্বর শুনিয়া চমকিয়া উঠিল। অনেক্ষণ কিছু বলিতে পারিল না। অনেকক্ষণ নির্জল নয়নে চাহিয়া চাহিয়া, কাঁদিয়া ফেলিয়া। কাঁদিতে কাঁদেতে কহিল, “সার্বভৌমমহাশয়, আমার ভাগ্যে কী ছিল! ”

পণ্ডিতমহাশয় তো আর অশ্রুসংবরণ করিতে পারেন না। গদ্‌গদ স্বরে কহিলেন, “মা, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, তাহার জন্য আর ভাবিয়ো না। আমি প্রয়াগে যাইতেছি, আমার সঙ্গে আইস। পৃথিবীতে আর আমার কেহই নাই—যে কয়টা দিন বাঁচিয়া আছি ততদিন আমার কাছে থাকো, ততদিন আর তোমার কোনো ভাবনা নাই।”

করুণা অধীর উচ্ছ্বাসে কাঁদিতে লাগিল। এমন সময়ে নিধি আসিয়া উপস্থিত হইল। নিধি পণ্ডিতমহাশয়ের খরচে কাশী দর্শন করিতে আসিয়াছেন। পণ্ডিতমহাশয় তজ্জন্য নিধির কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ আছেন। তিনি বলেন, নিধির ঋণ তিনি এ জন্মে শোধ করিতে পারিবেন না। করুণাকে দেখিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিল; কহিল, “ভট্রাচার্যমহাশয়, একটা কথা আছে।”

পণ্ডিতমহাশয় শশব্যস্তে উঠিয়া গেলেন। নিধি কহিল।, ‘ঐ বাবুটিকে দেখিতেছেন?’
পণ্ডিতমহাশয় চাহিয়া দেখিলেন—স্বরূপ। নিধি কহিল, “দেখিলেন করুণার ব্যবহারটা একবার দেখিলেন! ছি-ছি, স্বর্গীয় কর্তার নামটা একেবারে ডুবাইল! ”

পণ্ডিতমহাশয় অনেকক্ষণ হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন,অবশেষে হাত উল্‌টাইয়া আস্তে আস্তে কহিলেন—
                    “স্ত্রিয়াশ্চরিত্রাং পুরুষস্য ভাগ্যং
                    দেবা না জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ।”

নিধি কহিল, “আহা, নরেন্দ্র এমন ভালো লোক ছিল। ঐ রাক্ষসীই তো তাহাকে নষ্ট করিয়াছে।”

নরেন্দ্র যে ভালো লোক ছিল সে বিষয়ে পণ্ডিতমহাশয়ের সংশয় ছিল না, এখন যে খারাপ হইয়া গিয়াছে তাহারও প্রমাণ পাইয়াছেন, কিন্তু এতক্ষণে কেন যে খারাপ হইয়া গিয়াছে তাহার কারণটা জানিতে পারিলেন। পণ্ডিতমহাশয়ের স্ত্রীজাতির উপর দারুণ ঘৃণা জন্মাইল। পণ্ডিতমহাশয় ভাবিলেন, আর না—স্ত্রীলোকেই তাঁহার সর্বনাশ করিয়াছে, স্ত্রীজাতিকে আর বিশ্বাস করিবেন না।

নিধি লাল হইয়া কহিল, “দেখুন দেখি, মহাশয়, পাপাচরণ করিবার আর কি স্থান নাই। এই কাশীতে!”
এ কথা পণ্ডিতমহাশয় এতক্ষণ ভাবেন নাই। শুনিয়া তিনি কিয়ৎক্ষণ একদৃষ্টে অবাক হইয়া নিধির মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন; ভাবিলেন, ‘সত্যই তো!’

একটা ঘন্টা বাজিল, মহা ছুটাছুটি চেঁচামেচি পড়িয়া গেল। পণ্ডিতমহাশয় বেঞ্চের কাছে বোঁচকা ফেলিয়া আসিয়াছিলেন, তাড়াতাড়ি লইতে গেলেন। এমন সময় স্বরূপ তাড়াতাড়ি করুণাকে ডাকিতে আসিল—পণ্ডিতমহাশয়কে দেখিয়া সট্‌ করিয়া সরিয়া পড়িল। করুণা কাতরস্বরে পণ্ডিতমহাশয়কে কহিল, “সার্বভৌমমহাশয়, আমাকে ফেলিয়া যাইবেন না।”

পণ্ডিতমহাশয় কহিলেন, “মা, অনেক প্রতারণা সহিয়াছি—মনে করিয়াছি বৃদ্ধবয়সে আর কোনো দিকে মন দিব না— দেবসেবায় কয়েকটি দিন কাটাইয়া দিব।”
করুণা কাঁদিতে কাঁদিতে পণ্ডিতমহাশয়ের পা জড়াইয়া ধরিল; কহিল, “আমাকে ছাড়িয়া যাইবেন না—আমাকে ছাড়িয়া যাইবেন না।”
পণ্ডিতমহাশয়ের নেত্রে অশ্রু পূরিয়া আসিল; ভাবিলেন, ‘যাহা অদৃষ্টে আছে হইবে—ইহাকে তো ছাড়িয়া যাইতে পারিব না।’
নিধি ছুটিয়া আসিয়া মহা একটা ধমক দিয়া কহিল, “এখানে হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলে কী হইবে। গাড়ি যে চলিয়া যায়! ”
এই বলিয়া পণ্ডিতমহাশয়ের হাত ধরিয়া হড়্‌ হড়্‌ করিয়া টানিয়া একটা গাড়ির মধ্যে পূরিয়া দিল।

করুণা অন্ধকার দেখিতে লাগিল। মাথা ঘুরিয়া মুখচক্ষু বিবর্ণ হইয়া সেইখানে মূর্ছিত হইয়া পড়িল। স্বরূপের দেখাসাক্ষাৎ নাই, সে গোলেমালে অনেক ক্ষণ হইল গাড়িতে উঠিয়া পড়িয়াছে। অগ্নিময় অঙ্কুশের তাপে আর্তনাদ করিয়া লৌহময় গজ হন্‌ হন্‌ করিয়া অগ্রসর হইল। স্টেশনে আর বড়ো লোক নাই।