জীবনস্মৃতি গ্রন্থ পরিচয়
গ্রন্থ পরিচিতি
রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড
(বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক মুদ্রণানুসারে)
জীবনস্মৃতি ১৩১৯ (জুলাই ১৯১২) সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর-কর্তৃক অঙ্কিত চব্বিশটি চিত্রে শোভিত হইয়া এই প্রথম সংস্করণ
বাহির হয়।
তৎপূর্বে জীবনস্মৃতি প্রবাসী মাসিকপত্রে (ভাদ্র ১৩১৮-শ্রাবণ
১৩১৯) ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত। প্রবাসীতে রচনাটি সমর্পণ করিবার পূর্বে পত্রিকার
সহকারী সম্পাদক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহিত রবীন্দ্রনাথের যে-পত্রালাপ হয়
১৩৪৮ কার্তিকের প্রবাসী হইতে তাহার প্রাসঙ্গিক অংশগুলি উদ্ধৃত হইল। পত্রগুলি
শিলাইদহ হইতে লিখিত।—
১
বাঃ তুমি তো বেশ লোক! একেবারে আমার জীবনে হস্তক্ষেপ করতে চাও!
এতদিন আমার কাব্য নিয়ে অনেক টানাটানি গিয়েছে—এখন
বুঝি জীবন নিয়ে ছেঁড়াছেড়ি করতে হবে? সম্পাদক হলে মানুষের দয়ামায়া একেবারে অন্তর্হিত
হয়, তুমি তারই জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছ।
যতদিন বেঁচে আছি ততদিন জীবনটা থাক্...।
২
আমার জীবনের প্রতি দাবি করে তুমি যে-যুক্তি প্রয়োগ করেছ সেটা
সন্তোষজনক নয়। তুমি লিখেছ, "আপনার জীবনটা চাই।" এর পিছনে যদি কামান বন্দুক বা
Halliday
সাহেবের নামস্বাক্ষর থাকত তা হলে তোমার যুক্তির প্রবলতা সম্বন্ধে কারো কোনো সন্দেহ
থাকত না। তদভাবে আপাতত আমার জীবন নিরাপদে আমারই অধীনে থাকবে, এইটেই সংগত।
আসল কথা এই যে, তুমি ইহকাল পরকাল সকল দিক সম্পূর্ণ বিবেচনা করে
এই প্রস্তাবটি করেছ না সম্পাদকীয় দুর্জয় লোভে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে এই দুঃসাহসিকতায়
প্রবৃত্ত হচ্ছ, তা আমি নিশ্চয় বুঝতে পারছি নে বলে কিছু স্থির করতে পারছি নে। তোমার
বয়স অল্প, হঠকারিতাই তোমার পক্ষে স্বাভাবিক ও শোভন, অতএব এ সম্বন্ধে রামানন্দবাবুর
মত কী তা না জেনে তোমাদের মাসিকপত্রের black
and white-এ আমার জীবনটার এক গালে
চুন ও এক গালে কালি লেপন করতে পারব না।
পঞ্চাশ পেরলে লোকে প্রগল্ভ হবার অধিকার লাভ করে, কিন্তু তবুও
সাদা চুল ও শ্বেত শ্মশ্রুতেও অহমিকাকে একেবারে সম্পূর্ণ শুভ্র করে তুলতে পারে না।
[৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৮]
৩
তোমার হাতেই জীবন সমর্পণ করা গেল। রামানন্দবাবুকে লিখেছি। কিন্তু অজিতের প্রবন্ধ ['রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমার চক্রবর্তী, প্রবাসী, আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩১৮ ] শেষ হয়ে গেলে এটা আরম্ভ হলেই ভালো হয়। লোকের তখন জীবন সম্বন্ধে ঔৎসুক্য একটু বাড়তে পারে। [১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৮]
৪
...জীবনস্মৃতি তোমাদের হাতে পূর্বেই সমর্পণ করেছি। ভূমিকাটি আগাগোড়া বদলে দিয়েছি বোধ হয় দেখেছ—জিনিসটাকে সাধারণ পাঠকের সুখপাঠ্য করবার চেষ্টা করেছি— অর্থাৎ আমার জীবন ব'লে একটা বিশেষ গল্প যাতে প্রবল হয়ে না ওঠে তার জন্যে আমার চেষ্টার ত্রুটি হয় নি—আমার তো বিশ্বাস ওতে বিশুদ্ধ সাহিত্যের সৌরভ ফুটে উঠেছে, কিন্তু আপরিতোষাদ বিদুষাং ইত্যাদি।
৫
...কবিকে [সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত] আমার কবিজীবনীটা পড়িতে দিও। সে
তো সম্পাদক শ্রেণীর নহে, সুতরাং তাহার হৃদয় কোমল, অতএব সে ওটা পড়িয়া কিরূপ বিচার
করে জানিতে ইচ্ছা করি। [২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩১৮]
জীবনস্মৃতির ভূমিকায় ষষ্ঠ অনুচ্ছেদের পরে প্রবাসীতে মুদ্রিত হয়:
'এমনি করিয়া ছবি দেখিয়া প্রতিচ্ছবি আঁকার মতো কিছুদিন জীবনের
স্মৃতি লিখিয়া চলিয়াছিলাম। কিছুদূর পর্যন্ত লিখিতেই কাজের ভিড় আসিয়া পড়িল—
লেখা বন্ধ হইয়া গেল।
রবীন্দ্রসদনে রক্ষিত পাণ্ডুলিপিটি সম্ভবতঃ সেই অসম্পূর্ণ
('বালক'-প্রকাশের স্মৃতিকথা পর্যন্ত) প্রথম রচনা। ১৩১৮ সালের ২৫শে বৈশাখ উৎসবের সময়
শান্তিনিকেতনে ঘরোয়া আসরে রবীন্দ্রনাথ এই পাণ্ডুলিপি পাঠ করেন। প্রবাসীতে প্রকাশিত
পরবর্তী পাঠেরও কিয়দংশ রবীন্দ্রসদনে একটি খাতায় আছে। উহার সংশোধিত সম্পূর্ণ
পাণ্ডুলিপি শ্রীমতী সীতাদেবীর নিকটে ছিল (দ্রষ্টব্য 'পুণ্যস্মৃতি', পৃ ২০), তিনি
সম্প্রতি রবীন্দ্রসদনে দিয়াছেন। ১৩১৯ সালে গ্রন্থপ্রকাশের সময় প্রবাসীর পাঠেও
রবীন্দ্রনাথ বহু সংযোজন সংশোধন করিয়াছিলেন। সেই শেষ পাঠের কোনো পাণ্ডুপিলি (?) আমরা
দেখি নাই। রবীন্দ্রসদনের পাণ্ডুলিপি হইতে সূচনাংশ দুইটি এ স্থলে মুদ্রিত হইল:
১
আমার জীবনবৃত্তান্ত লিখিতে অনুরোধ আসিয়াছে। সে অনুরোধ পালন করিব বলিয়া প্রতিশ্রুত
হইয়াছি। এখানে অনাবশ্যক বিনয় প্রকাশ করিয়া জায়গা জুড়িব না। কিন্তু নিজের কথা লিখিতে
বসিলে যে-অহমিকা আসিয়া পড়ে তাহার জন্য পাঠকদের কাছ হইতে ক্ষমা চাই।
যাঁহারা সাধু এবং যাঁহারা কর্মবীর তাঁহাদের জীবনের ঘটনা ইতিহাসের অভাবে নষ্ট হইলে
আক্ষেপের কারণ হয়—
কেননা, তাঁহাদের জীবনটাই তাঁহাদের সর্বপ্রধান রচনা। কবির
সর্বপ্রধান রচনা কাব্য, তাহা তো সাধারণের অবজ্ঞা বা আদর পাইবার জন্য প্রকাশিত হইয়াই
আছে—আবার জীবনের কথা কেন।
এই কথা মনে মনে আলোচনা করিয়া আমি অনেকের অনুরোধসত্ত্বে নিজের জীবনী লিখিতে কোনোদিন
উৎসাহ বোধ করি নাই। কিন্তু সম্প্রতি নিজের জীবনটা এমন একটা জায়গায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে
যখন পিছন ফিরিয়া তাকাইবার অবকাশ পাওয়া গেছে—
দর্শকভাবে নিজেকে আগাগোড়া দেখিবার যেন
সুযোগ পাইয়াছি।
ইহাতে এইটে চোখে পড়িয়াছে যে, কাব্যরচনা ও জীবনরচনা ও-দুটা একই বৃহৎ রচনার অঙ্গ।
জীবনটা যে কাব্যেই আপনার ফুল ফুটাইয়াছে আর কিছুতে নয়, তাহার তত্ত্ব সমগ্র জীবনের
অন্তর্গত।
কর্মবীরদের জীবন কর্মকে জন্ম দেয়, আবার সেই কর্ম তাঁহাদের জীবনকে গঠিত করে। আমি ইহা
আজ বেশ করিয়া জানিয়াছি যে, কবির জীবন যেমন কাব্যকে প্রকাশ করে কাব্যও তেমনি কবির
জীবনকে রচনা করিয়া চলে।
আমার হাতে আমারই রচিত অনেকগুলি পুরাতন চিঠি ফিরিয়া আসিয়াছে—
বর্তমান প্রবন্ধে মাঝে
মাঝে আমার এই চিঠিগুলি হইতে কোনো কোনো অংশ উদ্ধৃত করিব। আজ এই চিঠিগুলি পড়িতে
পড়িতে ১৮৯৪ সালে লিখিত এই ক'টি কথা হঠাৎ চোখে পড়িল।—
'আমি আমার সৌন্দর্য-উজ্জ্বল আনন্দের মুহূর্তগুলিকে ভাষার দ্বারা বারম্বার
স্থায়িভাবে মূর্তিমান করাতেই ক্রমশই আমার অন্তর্জীবনের পথ সুগম হয়ে এসেছে। সেই
মুহূর্তগুলি যদি ক্ষণিক সম্ভোগেই ব্যয় হয়ে যেত তা হলে তারা চিরকালই অস্পষ্ট সুদূর
মরীচিকার মতো থাকত, ক্রমশ এমন দৃঢ়বিশ্বাসে এবং সুস্পষ্ট অনুভূতির মধ্যে সুপরিস্ফুট
হয়ে উঠত না। অনেকদিন জ্ঞাতসারে এবং অজ্ঞাতসারে ভাষার দ্বারা চিহ্নিত করে এসে জগতের
অন্তর্জগৎ, জীবনের অন্তর্জীবন, স্নেহপ্রীতির দিব্যত্ব আমার কাছে আজ আকার ধারণ করে
উঠছে—
নিজের কথা আমার নিজেকে সহায়তা করেছে—
অন্যের কথা থেকে আমি এ জিনিস কিছুতে পেতুম না।'
এই রকমে পদ্মের বীজকোষ এবং তাহার দলগুলির মতো একত্রে রচিত আমার জীবন ও কাব্যগুলিকে
একসঙ্গে দেখাইতে পারিলে সে চিত্র ব্যর্থ হইবে না। কিন্তু তেমন করিয়া লেখা নিতান্ত
সহজ নহে। তেমন সময় এবং স্বাস্থ্যের সুযোগ নাই, ক্ষমতাও আছে কিনা সন্দেহ করি।
এখন উপস্থিতমত আমার জীবন ও কাব্যকে জড়াইয়া একটা রেখাটানা ছবির আভাসপাত করিয়া যাইব।
যে-সকল পাঠক ভালোবাসিয়া আমার লেখা পড়িয়া আসিয়াছেন তাঁহাদের কাছে এটুকুও নিতান্ত
নিষ্ফল হইবে না। আমার লেখা যাঁহারা অনুকূলভাবে গ্রহণ করেন না তাঁহারাও সম্মুখে
বর্তমান আছেন কল্পনা করিলে তাঁহাদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে সংকোচে কলম সরিতে চায়
না—
অতএব এই আত্মপ্রকাশের সময় তাঁহাদিগকে অন্তত মনে মনেও এই সভাক্ষেত্রের অন্তরালে
রাখিলাম বলিয়া তাঁহারা আমাকে ক্ষমা করিবেন।
আরম্ভেই একটা কথা বলা আবশ্যক চিরকালই তারিখ সম্বন্ধে আমি অত্যন্ত কাঁচা। জীবনের বড়ো
বড়ো ঘটনারও সন-তারিখ আমি স্মরণ করিয়া বলিতে পারি না; আমার এই অসামান্য বিস্মরণশক্তি
নিকটের ঘটনা এবং দূরের ঘটনা, ছোটো ঘটনা এবং বড়ো ঘটনা, সর্বত্রই সমান অপক্ষপাত
প্রকাশ করিয়া থাকে। অতএব আমার এই বর্তমান রচনাটিতে সুরের ঠিকানা যদিবা থাকে, তালের
ঠিকানা না থাকিতেও পারে। প্রথমে আমার রাশিচক্র ও জন্মকালটি ঠিকুজি [রবীন্দ্রসদনে
রক্ষিত পারিবারিক পুরাতন খাতায় প্রাপ্ত রাশিচক্রটি পরপৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য] হইতে
নিম্নে উদ্ধৃত করিয়া দিলাম।—
|
১৭৮৩|০|২৪|৫৩|১৭|৩০ |
ইহা হইতে বুঝা যাইবে ১৭৮৩ সন্বতে অর্থাৎ ইংরেজী ১৮৬১ খৃস্টাব্দে ২৫শে বৈশাখে
কলিকাতায় আমাদের জোড়াসাঁকোর বাটিতে আমার জন্ম হয়। ইহার পর হইতে সন-তারিখ সম্বন্ধে
আমার কাছে কেহ কিছু প্রত্যাশা করিবেন না।
—প্রথম পাণ্ডুলিপি
২
এই লেখাটি জীবনী নহে। ইহা কেবল অতীতের স্মৃতিমাত্র। এই স্মৃতিতে অনেক বড়ো ঘটনা ছোটো
এবং ছোটো ঘটনা বড়ো হইয়া উঠিয়াছে সন্দেহ নাই। যেখানে ফাঁক ছিল না সেখানেও হয়তো ফাঁক
পড়িয়াছে, যেখানে ফাঁক ছিল সেখানটাও হয়তো ভরা দেখাইতেছে। পৃথিবীর স্তর যেরূপ পর্যায়ে
সৃষ্ট হইয়াছিল আজ সর্বত্র সেরূপ পর্যায়ে সর্বত্র রক্ষিত হয় নাই, অনেক স্থানে
উলটপালট হইয়া গিয়াছে। আমার স্মৃতিতে জীবনের স্তরপর্যায় আজ হয়তো সকল জায়গায় ঠিক পরে
পরে প্রকাশ পাইতেছে না, কোথাও হয়তো আগেকার কথা পরে, পরের কথা আগে আসিয়া পড়িয়াছে।
অতএব ইহাকে জীবনের পুরাবৃত্ত বলা চলে না—
ইহা স্মৃতির ছবি। ইহার মধ্যে অত্যন্ত
যথাযথ সংবাদ কেহ প্রত্যাশা করিবেন না—অতীত জীবন মনের মধ্যে যেরূপ ধারণ করিয়া
উঠিয়াছে এই লেখায় সেই মূর্তিটি দেখা যাইবে।
নিজেকে নিজের বাহিরে দেখিবার একটা বয়স আছে। সেই বয়সে পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইলে নিজের
জীবনক্ষেত্র নিজের কাছে অপরাহ্ণের আলোকে ছবির মতো দেখা দেয়। অন্যান্য নানা ছবির মতো
সেই আপন জীবনের ছবিও সাহিত্যের পটে আঁকা চলে। কয়েক বৎসর হইল তেমনি করিয়া অতীত
জীবনের কথা কয়েক পাতা লিখিয়াছিলাম।
জন্ম ১৭৮৩ শক। ২৫ শে বৈশাখ |
|
কৃষ্ণপক্ষ ত্রয়োদশী সোমবার রেবতী মীন শুক্রের দশা ভোগ্য ১৪|৩|১১|৩৯ |
জীবনের সকল স্মৃতি স্তূপাকার করিয়া ধরিলে তাহার কোনো শ্রী থাকে না। সেইজন্য আমি
একটি সূত্র বাহিয়া স্মৃতিগুলিকে সাজাইতেছিলাম। সেই সূত্রটিই আমার জীবনের প্রধান
সূত্র, অর্থাৎ তাহা আমার লেখক-জীবনের ধারা।
এই ধারাটিকে আমার স্মৃতির দ্বারা অনুসরণ করিয়াছিলামা—
সন্ধান-সংগ্রহ বিচারের দ্বারা
নহে। এইজন্য, একটা গল্পমাত্রের যেটুকু গুরুত্ব ইহাতে তাহার বেশি গুরুত্ব নাই।
এই কারণেই সম্পাদকমহাশয় যখন এই লেখাটিকে বাহির করিবার জন্য ঔৎসুক্য প্রকাশ করিলেন
তখন এই কথা মনে করিয়াই সংকোচ পরিহার করিলাম যে, আমারই জীবন বলিয়া ইহার গৌরব নহে,
কোনো মানবজীবনের ছবি বলিয়া সাহিত্যে ইহা স্থান দাবি করিতে পারো—সে দাবি অসংগত হইলে
ডিস্মিস্ হইতে বিলম্ব হইবে না।
ইহার মধ্যে একটা আশ্বাসের কথা এই যে, যেটুকু লিখিয়াছি তাহা বেশি নহে, তাহা জীবনের
আরম্ভ-অংশটুকু মাত্র।
—দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি
রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি জন্ম-তারিখ লইয়া মতবিরোধ হওয়ায় কিশোরীমোহন সাঁতরা মহাশয়
রবীন্দ্রনাথকে সে সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন। তাহার উত্তরে কালিম্পং হইতে রবীন্দ্রনাথ
যে-পত্র লেখেন তাহা নিম্নে সংকলিত হইল:
'রোসো, আগে তোমার সঙ্গে জন্ম-তারিখের হিসেব-নিকেশ করা যাক। তুমি হলে হিসেবী মানুষ।
যে-বছরের ২৫শে বৈশাখ আমার জন্ম সে-বছরে ইংরেজি পাঁজি মেলাতে গেলে চোখে ঠেকবে ৬ই মে।
কিন্তু ইংরেজের অদ্ভূত রীতি অনুসারে রাত দুপুরের পরে ওদের তারিখ বদল হয়, অতএব সেই
গণনায় আমার জন্ম ৭ই।—তর্কের শেষ এখানেই নয়, গ্রহনক্ষত্রের চক্রান্তে বাংলা পাঁজির
দিন ইংরেজি পাঁজির সঙ্গে তাল রেখে চলবে না—
ওরা প্রাগ্রসর জাত, পঁচিশে বৈশাখকে
ডিঙিয়ে যাচ্ছো—কয়েক
বছর ধরে হল ৭ই, তার পরে দাঁড়িয়েছে ৮ই। তোমরা ওই তিন দিনই যদি আমাকে অর্ঘ্য নিবেদন কর, ফিরিয়ে দেব না, কোনোটাই বে-আইনী হবে না। এই কথাটা মনে
রেখো। ইতি ২৬ বৈশাখ ১৩৪৫।'
—প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৬, পৃ১৯৬
অতঃপর জীবনস্মৃতির বিভিন্ন অধ্যায় বা পরিচ্ছেদ সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য নূতন তথ্য বা
বর্ণনা গ্রন্থপরিচয়ে একে একে সন্নিবেশিত হইল।
'শিক্ষারম্ভের' পূর্ববর্তী একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার বর্ণনা সৌদামিনী দেবীর
'পিতৃস্মৃতি' প্রবন্ধ হইতে নিম্নে সংকলিত হইল:
'রবির জন্মের পর হইতে আমাদের পরিবারে জাতকর্ম হইতে আরম্ভ করিয়া সকল অনুষ্ঠান
অপৌত্তলিক প্রণালীতে সম্পন্ন হইয়াছে। পূর্বে যে-সকল ভট্টাচার্যেরা পৌরোহিত্য
প্রভৃতি কার্যে নিযুক্ত ছিল রবির জাতকর্ম উপলক্ষ্যে তাহাদের সহিত পিতার অনেক
তর্কবিতর্ক হইয়াছিল, আমার অল্প অল্প মনে পড়ে। রবির অন্নপ্রাশনের যে পিঁড়ার উপরে
আলপনার সঙ্গে তাহার নাম লেখা হইয়াছিল, সেই পিঁড়ির চারি ধারে পিতার আদেশে ছোটো ছোটো
গর্ত করানো হয়। সেই গর্তের মধ্যে সারি সারি মোমবাতি বসাইয়া তিনি আমাদের তাহা
জ্বালিয়া দিতে বলিলেন। নামকরণের দিন তাহার নামের চারি দিকে বাতি জ্বলিতে লাগিল-রবির
নামের উপরে সেই মহাত্মার আশীর্বাদ এইরূপেই ব্যক্ত হইয়াছিল।'
―প্রবাসী, ফাল্গুন
১৩১৮, পৃ৪৭২
অপিচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, ১৩৭৫, পৃ ১৫২
'ঘর ও বাহির' পরিচ্ছেদের অনুবৃত্তিস্বরূপ একটি বাল্যস্মৃতি
'পথে ও পথের প্রান্তে'
গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত হইল:
সেদিন হঠাৎ এক সময়ে জানি নে কেন ছেলেবেলাকার একটা ছবি খুব স্পষ্ট করে আমার মনে
জেগে উঠল। শীতকালের সকাল বোধ হয় সাড়ে-পাঁচটা। অল্প অল্প অন্ধকার আছে। চির-অভ্যাস-মত
ভোরে উঠে বাইরে এসেছি। গায়ে খুব অল্প কাপড়, কেবল একখানা সুতোর জামা এবং ইজের। এইরকম
খুব গরিবের মতোই আমাদের বাল্যকাল কেটেছে। ভিতরে ভিতরে শীত করছিল―
তাই একটা কোণের ঘর,
যাকে আমরা তোষাখানা বলতুম, যেখানে চাকররা থাকত, সেইখানে গেলুম। আধা-অন্ধকারে
জ্যোতিদার চাকর চিন্তে লোহার আঙটায় কাঠের কয়লা জ্বালিয়ে তার উপরে ঝাঁঝরি রেখে
জ্যৈদা'র জন্যে রুটি তোস্ করছে। সেই রুটির উপর মাখন গলার লোভনীয় গন্ধে ঘর ভরা। তার
সঙ্গে ছিল চিন্তের গুন্গুন্ রবে মধুকানের গান, আর সেই কাঠের আগুন থেকে বড়ো আরামের
অল্প-একটুখানি তাত। আমার বয়স বোধ হয় তখন নয় হবে। ছিলুম স্রোতের শ্যাওলার মতো―
সংসারপ্রবাহের উপরতলে হালকাভাবে ভেসে বেড়াতুম―
কোথাও শিকড় পৌঁছয় নি―
যেন কারো ছিলুম
না, সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত চাকরদের হাতেই থাকতে হত; কারো কাছে কিছুমাত্র আদর
পাবার আশা ছিল না। জ্যৈদা তখন বিবাহিত, তাঁর জন্যে ভাববার লোক ছিল, তাঁর জন্যে
ভোরবেলা থেকেই রুটি-তোস্ আরম্ভ। আমি ছিলুম সংসার পদ্মার বালুচরের দিকে, অনাদরের
কূলে―
সেখানে ফুল ছিল না, ফল ছিল না, ফসল ছিল না―
কেবল একলা বসে ভাববার মতো আকাশ
ছিল। আর, জ্যৈদা পদ্মার যে কূলে ছিলেন সেই কূল ছিল শ্যামল―
সেখানকার দূর থেকে কিছু
গন্ধ আসত, কিছু গান আসত, সচল জীবনের ছবি একটু-আধটু চোখে পড়ত। বুঝতে পারতুম ওইখানেই
জীবনযাত্রা সত্য। কিন্তু পার হয়ে যাবার খেয়া ছিল না―
তাই শূন্যতার মাঝখানে বসে
কেবলই চেয়ে থাকতুম আকাশের দিকে। ছেলেবেলায় বাস্তব জগৎ থেকে দূরে ছিলুম বলেই তখন
থেকে চিরদিন 'আমি সুদূরের পিয়াসী'।
অকারণে ওই ছবিটা অত্যন্ত পরিস্ফুট হয়ে মনে জেগে উঠল।'
―পথে ও পথের প্রান্তে, পত্রসংখ্যা ৩২, ১৪ মার্চ্ ১৯২৯
[
পরবর্তী
পাঠ ]