জীবনস্মৃতি গ্রন্থ পরিচয়
গ্রন্থ পরিচিতি
রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড (বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক মুদ্রণানুসারে)


 [আগের পাঠ] [পরের পাঠ]

    বহু দিন পূর্বের একটি চিঠিতেও এই স্মৃতিচিত্রটিই পাওয়া যায়:
    'দিনযাপনের আজ আর-এক রকম উপায় পরীক্ষা করে দেখা গেছে। আজ বসে বসে ছেলেবেলাকার স্মৃতি এবং তখনকার মনের ভাব খুব স্পষ্ট করে মনে আনবার চেষ্টা করছিলুম। যখন পেনেটির বাগানে ছিলুম, যখন পৈতের নেড়া মাথা নিয়ে প্রথমবার বোলপুরের বাগানে গিয়েছিলুম, যখন পশ্চিমের বারান্দার সবশেষের ঘরে আমাদের ইস্কুলঘর ছিল এবং আমি একটা নীল কাগজের ছেঁড়া খাতায় বাঁকা লাইন কেটে বড়ো বড়ো কাঁচা অক্ষরে প্রকৃতির বর্ণনা লিখতুম, যখন তোষাখানার ঘরে শীতকালের সকালে চিন্তা বলে একটা চাকর গুন্ গুন্ স্বরে মধুকানের সুরে গান করতে করতে মাখন দিয়ে রুটি তোস্ করত
তখন আমাদের গায়ে গরম কাপড় ছিল না, একখানা কামিজ পরে সেই আগুনের কাছে বসে শীত নিবারণ করতুম এবং সেই সশব্দবিগলিত নবনী সুগন্ধি রুটিখণ্ডের উপরে লুব্ধদুরাশ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চুপ করে বসে চিন্তার গান শুনতুম সেই সমস্ত দিনগুলিকে ঠিক বর্তমানের করে দেখছিলুম এবং সেই-সমস্ত দিনগুলির সঙ্গে এই রৌদ্রালোকিত পদ্ম এবং পদ্মার চর ভারি এক রকম সুন্দর ভাবে মিশ্রিত হচ্ছিল ঠিক যেন আমার সেই ছেলেবেলাকার খোলা জানলার ধারে বসে এই পদ্মার একটি দৃশ্যখণ্ড দেখছি বলে মনে হচ্ছিল।

ছিন্নপত্র, ২৭ জুন ১৮৯৪

    নর্মাল স্কুলের শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বহু বৎসর পরে 'হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর স্মৃতিতর্পণ' উপলক্ষে (২০ অগ্রহায়ণ ১৩৩৮) এভাবে স্মৃতিচারণ করেন:
    'সেই যুগে নর্মাল স্কুলে কোনোমতে ছাত্রবৃত্তি ক্লাসের এক ক্লাস নীচে পর্যন্ত আমার উন্নতি হয়েছিল। বংশে ধনমর্যাদা না থাকলে তাও বোধ হয় ঘটত না। তখন যে ভাষাকে সাধুভাষা বলা হোত অর্থাৎ যে ভাষা ভুল করে আমাদের মাতৃভাষার পাড়ায় পা দিলে গঙ্গাস্নান না করে ঢুকতেন না তাঁর সাধনার জন্যে লোহারাম শোরোরত্নের ব্যাকরণ এবং আদ্যানাথ পণ্ডিতমশায়ের সমাসদর্পণ আমাদের অবলম্বন ছিল। আজকের দিনে শুনে সকলের আশ্চর্য লাগবে যে, দ্বিগু সমাস কাকে বলে সুকুমারমতি বালকের তাও জানা ছিল। তখনকার কালের পাঠ্যগ্রন্থের ভূমিকা দেখলেই জানা যাবে সেকালে বালকমাত্রই সুকুমারমতি ছিল।'

“হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর স্মৃতিতর্পণের জন্য”। রবীন্দ্র-পাণ্ডুলিপি, রবীন্দ্রভবন-সংগ্রহ।
শান্তিনিকেতন

    'নর্মাল স্কুল’ পরিচ্ছেদে উল্লিখিত হরনাথ পণ্ডিতের সহিত 'গিন্নি' গল্পের শিবনাথ পণ্ডিতের সাদৃশ্য পাণ্ডুলিপির নিম্নোদ্‌ধৃত পঙ্‌ক্তি-কয়টিতে পরিস্ফুট:
    'এই পণ্ডিতটি ক্লাসের ছেলেদের অদ্ভুত নামকরণ করিয়া কিরূপ লজ্জিত করিতেন সাধনায় [বস্তুত হিতবাদী'তে] গিন্নি [দ্র রবীন্দ্র-রচনাবলী পঞ্চদশ খণ্ড, পৃ ৪১৫-১৯] নামক যে গল্প বাহির হইয়াছিল তাহাতে সে বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়াছে। আর-একটি ছেলেকে তিনি ভেট্‌কি বলিয়া ডাকিতেন, সে বেচারার গ্রীবার অংশটা কিছু প্রশস্ত ছিল।'

–দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি

    'নানা বিদ্যার আয়োজন' অধ্যায়ের বিজ্ঞানশিক্ষক 'সীতানাথ দত্ত' সম্ভবত: সীতানাথ ঘোষ হইবেন। সীতানাথ নামে অন্য কোনো বৈজ্ঞানিকের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তখন যাতায়াত ছিল না। দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁহার পরিবারবর্গের সহিত বৈজ্ঞানিক সীতানাথ ঘোষ (১২৪৮-৯০) মহাশয়ের ঘনিষ্ঠতার কথা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের 'পিতৃদেব সম্বন্ধে আমার জীবনস্মৃতি' প্রবন্ধে (প্রবাসী, মাঘ ১৩১৮, পৃ ৩৮৮) এবং যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার মহাশয়ের 'বৈজ্ঞানিক সীতানাথ' নামক আলোচনায় (প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩১৯, পৃ ২১৩-১৫) পাওয়া যাইবে। শেষোক্ত প্রবন্ধে ইহাও জানা যায় যে, "দেবেন্দ্রনাথ তাঁহাকে ১৮৭২ সনে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকত্ব প্রদান করেন।"
    'কাব্যরচনাচর্চা পরিচ্ছেদ অনুল্লিখিত একটি নূতন কবিতার উল্লেখ রবীন্দ্রনাথের 'ছেলেবেলা' গ্রন্থে দেখা যায়; এ স্থলে উদ্‌ধৃত হইল:
    'মনে পড়ে পয়ারে ত্রিপদীতে মিলিয়ে একবার একটা কবিতা বানিয়েছিলুম, তাতে এই দুঃখ জানিয়েছিলুম যে, সাঁতার দিয়ে পদ্ম তুলতে গিয়ে নিজের হাতের ঢেউয়ে পদ্মটা সরে সরে যায়
তাকে ধরা যায় না। অক্ষয়বাবু তাঁর আত্মীয়দের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এই কবিতা শুনিয়ে বেড়ালেন, আত্মীয়রা বললেন ছেলেটির লেখবার হাত আছে।'

-ছেলেবেলা, অধ্যায় ১১   

    'পিতৃদেব' পরিচ্ছেদ ৩০৫ পৃষ্ঠায় যে মহানন্দ মুনশির উল্লেখ আছে রবীন্দ্রনাথ কোনো সময় এক মৌখিক ছড়ায় তাহার বর্ণনা করিয়াছিলেন। 'ঘরোয়া' গ্রন্থের আরম্ভে অবনীন্দ্রনাথ সেই ছড়ার এই কয়টি পঙ্‌ক্তি স্মরণ করিয়াছেন:
                    'মহানন্দ নামে এ কাছারিধামে
                            আছেন এক কর্মচারী,
                    ধরিয়া লেখনী লেখেন পত্রখানি
                            সদা ঘাড় হেঁট করি।...
        ‌                             হস্তেতে ব্যজনী ন্যস্ত,
                                     মশা মাছি ব্যতিব্যস্ত

                                     তাকিয়াতে দিয়ে ঠেস...’
    এই পরিচ্ছেদে উল্লিখিত উপনয়ন অনুষ্ঠানের বিস্তৃত বিবরণ ও প্রধান আচার্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উপদেশ ১৭৯৪ শকের চৈত্রের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় 'ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান। উপনয়ন। সমাবর্তন।' এই নামে (পৃ ২০৩-২০৬) মুদ্রিত হইয়াছিল। সেখানে 'তিন বটু'র মধ্যে কেবল অগ্রজ সোমেন্দ্রনাথের নাম উল্লিখিত হইয়াছে।

    'হিমালয়যাত্রা’ পরিচ্ছেদ বোলপুর-ভ্রমণের যে বৃত্তান্ত আছে জীবনস্মৃতি লিখিবার বহু পরে 'আশ্রম-বিদ্যালয়ের সূচনা-নামক প্রবন্ধে (প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৪০) প্রসঙ্গতঃ রবীন্দ্রনাথ তাহার এক বিশদ ও গভীরতর বর্ণনা দিয়াছেন:
    'আমার বয়স যখন অল্প পিতৃদেবের সঙ্গে ভ্রমণে বের হয়েছিলেম। ঘর ছেড়ে সেই আমার প্রথম বাহিরে যাত্রা। ইটকাঠের অরণ্য থেকে অবারিত আকাশের মধ্যে বৃহৎ মুক্তি এই প্রথম আমি ভোগ করেছি। প্রথম বললে সম্পূর্ণ ঠিক বলা হয় না। এর পূর্বে কলকাতায় একবার যখন ডেঙ্গুজ্বর সংক্রামক হয়ে উঠেছিল তখন আমার গুরুজনদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেম গঙ্গার ধারে লালাবাবুদের বাগানে। বসুন্ধরার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সুদূরব্যাপ্ত আস্তরণের একটি প্রান্তে সেদিন আমার বসবার আসন জুটেছিল। সমস্ত দিন বিরাটের মধ্যে মনকে ছাড়া দিয়া আমার বিস্ময়ের এবং আনন্দের ক্লান্তি ছিল না। কিন্তু তখনো আমি আমাদের পূর্ব নিয়মে ছিলেম বন্দী, অবাধে বেড়ানো ছিল নিষিদ্ধ। অর্থাৎ কলকাতায় ছিলেম ঢাকা-খাঁচার পাখি- কেবল চলার স্বাধীনতা নয়, চোখের স্বাধীনতাও ছিল সংকীর্ণ
এখানে রইলুম দাঁড়ের পাখি, আকাশ খোলা চারি দিকে কিন্তু পায়ে শিকল। শান্তিনিকেতনে এসেই আমার জীবন প্রথম সম্পূর্ণ ছাড়া পেয়েছি বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে। উপনয়নের পরেই আমি এখানে এসেছি। উপনয়ন অনুষ্ঠানে ভূর্‌ভূবঃ স্বর্লোকের মধ্যে চেতনাকে পরিব্যাপ্ত করবার যে দীক্ষা পেয়েছিলেম পিতৃদেবের কাছ থেকে এখানে বিশ্বদেবতার কাছ থেকে পেয়েছিলেম সেই দীক্ষাই। আমার জীবন নিতান্তই অসম্পূর্ণ থাকত প্রথম বয়সে এই সুযোগ যদি আমার না ঘটত। পিতৃদেব কোনো নিষেধ বা শাসন দিয়ে আমাকে বেষ্টন করেন নি। সকালবেলায় অল্প কিছুক্ষণ তাঁর কাছে ইংরেজি ও সংস্কৃত পড়তেম, তার পরে আমার অবাধ ছুটি। বোলপুর শহর তখন স্ফীত হয়ে ওঠে নি। চালের কলের ধোঁয়া আকাশকে কলুষিত আর তার দুর্গন্ধ সমল করে নি মলয় বাতাসকে। মাঠের মাঝখান দিয়ে যে লাল মাটির পথ চলে গেছে তাতে লোক চলাচল ছিল অল্পই। বাঁধের জল ছিল পরিপূর্ণ প্রসারিত, চার দিক থেকে পলি-পড়া চাষের জমি তাকে কোণঠেসা করে আনেনি। তার পশ্চিমের উঁচু পাড়ির উপর অক্ষুণ্ণ ছিল ঘন তালগাছের শ্রেণী। যাকে আমরা খোয়াই বলি, অর্থাৎ কাঁকুরে জমির মধ্যে দিয়ে বর্ষার জলধারায় আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু খোদাই পথ, সে ছিল নানা জাতের নানা আকৃতির পাথরে পরিকীর্ণ; কোনোটাতে শির-কাটা পাতার ছাপ, কোনোটা লম্বা-আঁশ-ওয়ালা কাঠের টুকরোর মতো, কোনটা স্ফটিকের-দানা-সাজানো, কোনোটা অগ্নিগলিত মসৃণ।... আমিও সমস্ত দুপুরবেলা খোয়াইয়ে প্রবেশ করে নানা রকম পাথর সংগ্রহ করেছি, ধন-উপার্জনের লোভে নয়, পাথর-উপার্জন করতেই। মাঠের জল চুঁইয়ে সেই খোয়াইয়ের এক জায়গায় উপরের ডাঙা থেকে ছোটো ঝর্ণা ঝরে পড়ত। সেখানে জমেছিল একটি ছোটো জলাশয়, তার সাদাটে ঘোলাজল, আমার পক্ষে ডুব দিয়ে স্নান করবার মতো যথেষ্ট গভীর। সেই ডোবাটা উপচিয়ে ক্ষীণ স্বচ্ছ জলের স্রোত ঝির্ ঝির্ করে বয়ে যেত নানা শাখা-প্রশাখায়, ছোটো ছোটো মাছ সেই স্রোতে উজান মুখে সাঁতার কাটত। আমি জলের ধার বেয়ে বেয়ে আবিষ্কার করতে বেরতুম সেই শিশুভূবিভাগের নতুন নতুন বালখিল্য গিরিনদী। মাঝে মাঝে পাওয়া যেত পাড়ির গায়ে গহ্বর। তার মধ্যে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করে অচেনা জিওগ্র্যাফির মধ্যে ভ্রমণকারীর গৌরব অনুভব করতুম। খোয়াইয়ের স্থানে স্থানে যেখানে মাটি জমা সেখানে বেঁটে বেঁটে বুনোজাম বুনোখেজুর কোথাও বা ঘন কাশ লম্বা হয়ে উঠেছে। উপরে দূর মাঠে গোরু চরছে। সাঁওতালরা কোথাও করছে চাষ, কোথাও চলছে পথহীন প্রান্তরে আর্তস্বরে গোরুর গাড়ি, কিন্তু এই খোয়াইয়ের গহ্বরে জনপ্রাণী নেই। ছায়ায়-রৌদ্রে-বিচিত্র লাল কাঁকরের এই নিভৃত জগৎ, না দেয় ফল, না দেয় ফল, না দেয় ফুল, না উৎপন্ন করে ফসল, এখানে না আছে কোনো জীবজন্তুর বাসা; এখানে কেবল দেখি কোনো আর্টিস্ট্-বিধাতার বিনা কারণে একখানা যেমন-তেমন ছবি আঁকবার শখ; উপরে মেঘহীন নীল আকাশ রৌদ্রে পাণ্ডুর আর নীচে লাল কাঁকরের রঙ পড়েছে মোটা তুলিতে নানা রকমের বাঁকাচোরা বন্ধুর রেখায়; সৃষ্টিকর্তার ছেলেমানুষি ছাড়া এর মধ্যে আর-কিছুই দেখা যায় না। বালকের খেলার সঙ্গেই এর রচনার ছন্দের মিল; এর পাহাড়, এর নদী, এর জলাশয়, এর গুহাগহ্বর, সবই বালকের মনেরই পরিমাপে। এইখানে একলা আপন-মনে আমার বেলা কেটেছে অনেক দিন, কেউ আমার কাজের হিসাব চায় নি, কারো কাছে আমার সময়ের জবাবদিহি ছিল না।... তখন শান্তি নিকেতনে আর-একটি রোমান্টিক অর্থাৎ কাহিনীরসের জিনিস ছিল। যে সর্দার ['আশ্রমের রক্ষী ছিল বৃদ্ধ দ্বারী সর্দার,...মালী হরিশ, দ্বারীর ছেলে।' আশ্রমের রূপ ও বিকাশ] ছিল এই বাগানের প্রহরী এক কালে সেই ছিল ডাকাতের দলের নায়ক। তখন সে বৃদ্ধ, দীর্ঘ তার দেহ, মাংসের বাহুল্য মাত্র নেই, শ্যামবর্ণ, তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি, লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে, কণ্ঠস্বরটা ভাঙা ভাঙা গোছের। বোধ হয় সকলে জানেন, আজ শান্তি নিকেতনের যে অতি প্রাচীন যুগল ছাতিমগাছ মালতীলতায় আচ্ছন্ন, এক কালে মস্ত মাঠের মধ্যে ওই দুটি ছাড়া আর গাছ ছিল না। ঐ গাছতলা ছিল ডাকাতের আড্ডা। ছায়াপ্রত্যাশী অনেক ক্লান্ত পথিক এই ছাতিমতলায় হয় ধন, নয় প্রাণ, নয় দুইই হারিয়েছে সেই শিথিল রাষ্ট্রশাসনের কালে। এই সর্দার সেই ডাকাতিকাহিনীর শেষ পরিচ্ছেদের শেষ পরিশিষ্ট বলেই খ্যাত। বামাচারী তান্ত্রিক শাক্তের এই দেশে মা কালীর খর্পরে এ যে নররক্ত জোগায় নি তা আমি বিশ্বাস করি নে। আশ্রমের সম্পর্কে কোনো রক্তচক্ষু রক্ততিলকলাঞ্ছিত ভদ্রবংশের শাক্তকে জানতুম যিনি মহামাংসপ্রসাদ ভোগ করেছেন বলে জনশ্রুতি কানে এসেছে।
    'একদা এই দুটিমাত্র ছাতিমগাছের ছায়া লক্ষ্য করে দূরপথযাত্রী পথিকেরা বিশ্রামের আশায় এখানে আসত। আমার পিতৃদেবও রায়পুরের ভুবনসিংহের বাড়িতে নিমন্ত্রণ সেরে পালকি করে যখন একদিন ফিরছিলেন তখন মাঠের মাঝখানে এই দুটি গাছের আহ্বান তাঁর মনে এসে পৌঁছেছিল। এইখানে শান্তির প্রত্যাশায় রায়পুরের সিংহদের কাছ থেকে এই জমি তিনি দান গ্রহণ করেছিলেন। একখানি একতলা বাড়ি পত্তন করে এবং রুক্ষ রিক্তভূমিতে অনেকগুলি গাছ রোপণ করে সাধনার জন্য এখানে তিনি মাঝে মাঝে আশ্রয় গ্রহণ করতেন। সেই সময়ে প্রায়ই তাঁর ছিল হিমালয়ে নির্জনবাস। যখন রেল লাইন স্থাপিত হল, তখন বোলপুর স্টেশন ছিল পশ্চিমে যাবার পথে, অন্য লাইন তখন ছিল না। তাই হিমালয়ে যাবার মুখে বোলপুরে পিতা তাঁর প্রথম যাত্রাভঙ্গ করতেন। আমি যে-বারে তাঁর সঙ্গে এলুম সে-বারেও ড্যালহৌসি পাহাড়ে যাবার পথে তিনি বোলপুরে অবতরণ করেন। আমার মনে পড়ে, সকালবেলায় সূর্য ওঠবার পূর্বে তিনি ধ্যানে বসতেন অসমাপ্ত জলশূন্য পুষ্করিণীর দক্ষিণ পাড়ির উপরে। সূর্যাস্ত কালে তাঁর ধ্যানের আসন ছিল ছাতিমতলায়। এখন ছাতিমগাছ বেষ্টন করে অনেক গাছপালা হয়েছে, তখন তার কিছুই ছিল না
সামনে অবারিত মাঠ পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত ছিল একটানা। আমার 'পরে একটি বিশেষ কাজের ভার ছিল। ভগবদ্‌গীতা গ্রন্থে কতকগুলি শ্লোক তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন, আমি প্রতিদিন কিছু কিছু তাই কপি করে দিতুম তাঁকে। তার পরে সন্ধ্যাবেলা খোলা আকাশের নীচে বসে সৌরজগতের গ্রহমণ্ডলের বিবরণ বলতেন আমাকে, আমি শুনতুম একান্ত ঔৎসুক্যের সঙ্গে। মনে পড়ে, আমি তাঁর মুখের সেই জ্যোতিষের ব্যাখ্যা লিখে তাঁকে শুনিয়েছিলুম। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যাবে শান্তিনিকেতনের কোন্ ছবি আমার মনের মধ্যে কোন্ রঙে ছাপা হয়ে গেছে। প্রথমত, সেই বালকবয়সে এখানকার প্রকৃতির কাছ থেকে যে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেম এখানকার অনবরুদ্ধ আকাশ ও মাঠ, দূর হতে প্রতিভাত নীলাভ শাল ও তাল শ্রেণীর সমুচ্চ শাখাপুঞ্জের শ্যামলা শান্তি,স্মৃতির সম্পদ্ রূপে চিরকাল আমার স্বভাবের অন্তরভুক্ত হয়ে গেছে। তার পরে এই আকাশে এই আলোকে দেখেছি সকালে বিকালে পিতৃদেবের পূজার নিঃশব্দ নিবেদন, তার গভীর গাম্ভীর্য। তখন এখানে আর-কিছুই ছিল না, না ছিল এত গাছপালা, না ছিল মানুষের এবং কাজের এত ভিড়, কেবল দূরব্যাপী নিস্তব্ধতার মধ্যে ছিল একটি নির্মল মহিমা।'

আশ্রমের রূপ ও বিকাশ (১৩৫৮),পৃ ৪৮-৫৬

    প্রথম হিমালয়দর্শনের নিম্নোদ্‌ধৃত স্মৃতিটুকু এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য:
    'তুমি বোধ হয় এই প্রথম হিমালয় যাচ্ছ। আমিও প্রায় তোমার বয়সে আমার পিতৃদেবের সঙ্গে হিমালয়ে গিয়েছিলুম। তার আগে ভূগোলে পড়েছিলুম, পৃথিবীতে হিমালয়ের চেয়ে উঁচু জিনিস আর কিছু নেই, তাই হিমালয় সম্বন্ধে মনে মনে কত কী যে কল্পনা করেছিলুম তার ঠিক নেই। বাড়ি থেকে বেরবার সময় মনটা একেবারে তোলপাড় করেছিল। অমৃতসর হয়ে ডাকের গাড়ি চড়ে প্রথমে পাঠানকোটে গিয়ে পড়লুম। সেখানে পাহাড়ের বর্ণপরিচয় প্রথমভাগ। তুমি কাঠগোদাম দিয়ে উপরে উঠেছ
পাঠানকোট সেইরকম কাঠগোদামের মতো। সেখানকার ছোটো ছোটো পাহাড়গুলো 'কর খল', 'জল পড়ে', 'পাতা নড়ে'-এর বেশি আর নয়। তার পরে ক্রমে ক্রমে যখন উপরে উঠতে লাগলুম তখন কেবল এই কথাই মনে হতে লাগল, হিমালয় যত বড়োই হোক-না, আমার কল্পনা তার চেয়ে তাকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়েছে; মানুষের প্রত্যাশার কাছে হিমালয় পাহাড়ই বা লাগে কোথায়।' শান্তিনিকেতন, ১ ভাদ্র ১৩২৫

ভানুসিংহের পত্রাবলী, পত্রসংখ্যা ১২

    মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের সংগীত কিরূপ ভালোবাসিতেন তাহা এই পরিচ্ছেদের ৩১৭ পৃষ্ঠায় বর্ণিত। এ বিষয়ে সৌদামিনীদেবী 'পিতৃস্মৃতি' প্রবন্ধে বলেন:
    'সংগীত বিশেষরূপ ভালো না হইলে তিনি [দেবেন্দ্রনাথ] শুনিতে ভালোবাসিতেন না। প্রতিভার [হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা। 'বাল্মীকিপ্রতিভা' পরিচ্ছেদ (পৃ ৩৮০ দ্রষ্টব্য)] পিয়ানো বাজানো এবং রবির গান শুনিতে তিনি ভালোবাসিতেন। বলিতেন রবি আমাদের বাংলাদেশের বুলবুল।'

প্রবাসী, ফাল্গুন, ১৩১৮ পৃ ৪৭৪
অপিচ, রবীন্দ্রনাথ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, পৃ ১৫৬

    'ঘরের পড়া' পরিচ্ছেদে উল্লিখিত 'কুমারসম্ভব'এর অনুবাদপ্রসঙ্গে ইহা উল্লেখযোগ্য যে, উক্ত অনুবাদের পাঠবিশেষ 'মদন ভস্ম' নামে 'ভারতী'র প্রথম বর্ষে (১২৮৪) মাঘ সংখ্যায় 'সম্পাদকের বৈঠক' বিভাগে (পৃ ৩২৯-৩১) প্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল; অনুবাদকের নাম ছিল না। [পৃ ৩৩০, পাদটীকা ১ দ্রষ্টব্য। উত্তরসূরী পত্রের রবীন্দ্র-জন্ম-শতবার্ষিকী সংখ্যায় (১৩৬৮) মুদ্রিত পূর্ববর্তন পাঠ দ্রষ্টব্য, পৃ ১৬১-৬৫]
    এই পরিচ্ছেদে বর্ণিত রামসর্বস্ব পণ্ডিতমহাশয়ের নিকট সংস্কৃত পড়িবার কালে নিম্নলিখিত ব্যাপারটি ঘটিয়াছিল; জীবনস্মৃতিতে ইহার উল্লেখ নাই।

    'রবীন্দ্রনাথ তখন [১৮৭৫] বাড়িতে রামসর্বস্ব পণ্ডিতের নিকট সংস্কৃত পড়িতেন। আমি [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ] ও রামসর্বস্ব দুইজনে রবির পড়ার ঘরে বসিয়াই 'সরোজিনী'র প্রুফ সংশোধন করিতাম। রামসর্বস্ব খুব জোরে জোরে পড়িতেন। পাশের ঘর হইতে রবি শুনিতেন, ও মাঝে মাঝে পণ্ডিতমহাশয়কে উদ্দেশ্য করিয়া কোন্ স্থানে কী করিলে ভালো হয় সেই মতামত প্রকাশ করিতেন। রাজপুত-মহিলাদের চিতাপ্রবেশের যে একটা দৃশ্য আছে, তাহাতে পূর্বে আমি গদ্যে একটা বক্তৃতা রচনা করিয়া দিয়াছিলাম। যখন এই-স্থানটা পড়িয়া প্রুফ দেখা হইতেছিল, তখন রবীন্দ্রনাথ পাশের ঘরে পড়াশুনা বন্ধ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া শুনিতেছিলেন। গদ্যরচনাটি এখানে একেবারেই খাপ খায় নাই বুঝিয়া কিশোর রবি একেবারে আমাদের ঘরে আসিয়া হাজির। তিনি বলিলেন, এখানে পদ্য রচনা ছাড়া কিছুতেই জোর বাঁধিতে পারে না। প্রস্তাবটা আমি উপেক্ষা করিতে পারিলাম না
কারণ, প্রথম হইতেই আমারও মনটা কেমন খুঁত খুঁত করিতেছিল। কিন্তু এখন আর সময় কই? আমি সময়াভাবের আপত্তি উত্থাপন করিলে, রবীন্দ্রনাথ সেই বক্তৃতাটির পরিবর্তে একটা গান রচনা করিয়া দিবার ভার লইলেন এবং তখনই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই 'জ্বল্ জ্বল্ চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ' [গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের 'সরোজিনী নাটক'এর (১৮৭৫) অন্তর্গত। দ্রষ্টব্য গীতবিতান, তৃতীয় খণ্ড] এই গানটি রচনা করিয়া আনিয়া আমাদিগকে চমৎকৃত করিয়া দিলেন।'

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পৃ ১৪৭

[ পরবর্তী পাঠ ]