জীবনস্মৃতি গ্রন্থ পরিচয়
গ্রন্থ পরিচিতি
রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড (বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক মুদ্রণানুসারে)


 [আগের পাঠ] [পরের পাঠ]


    বিদ্যালয়ত্যাগের পূর্বের ও অব্যবহিত পরের জীবন পূর্বোক্ত ‘আশ্রম-বিদ্যালয়ের সূচনা’ প্রবন্ধের আরম্ভে রবীন্দ্রনাথ সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়াছেন:
    'জীবনস্মৃতিতে লিখেছি, আমার বয়স যখন অল্প ছিল তখনকার স্কুলের রীতিপ্রকৃতি এবং শিক্ষক ও ছাত্রেদের আচরণ আমার পক্ষে নিতান্ত দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। তখনকার শিক্ষাবিধির মধ্যে কোনো রস ছিল না, কিন্তু সেইটেই আমার অসহিষ্ণুতার একমাত্র কারণ নয়। কলকাতা শহরে আমি প্রায় বন্দী অবস্থায় ছিলেম। কিন্তু বাড়িতে তবুও বন্ধনের ফাঁকে ফাঁকে বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে আমার একটা আনন্দের সম্বন্ধ জন্মে গিয়েছিল। বাড়ির দক্ষিণ দিকের পুকুরের জলে সকালসন্ধ্যার ছায়া এপার-ওপার করত
হাঁসগুলো দিত সাঁতার, গুগলি তুলত জলে ডুব দিয়ে, আষাঢ়ের জলে-ভরা নীলবর্ণ পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ সারবাঁধা নারকেলগাছের মাথার উপরে ঘনিয়ে আনত বর্ষার গম্ভীর সমারোহ। দক্ষিণের দিকে যে বাগানটা ছিল ওইখানেই নানা রঙে ঋতুর পর ঋতুর আমন্ত্রণ আসত উৎসুক দৃষ্টির পথে আমার হৃদয়ের মধ্যে।...
    'যখন আমার বয়স তেরো, তখন এডুকেশন-বিভাগীয় দাঁড়ের শিকল ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়েছিলেম। তার পর থেকে যে বিদ্যালয়ে হলেম ভর্তি তাকে যথার্থই বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে আমার ছুটি ছিল না, কেননা অবিশ্রাম কাজের মধ্যেই পেয়েছি ছুটি। কোনো কোনো দিন পড়েছি রাত দুটো পর্যন্ত। তখনকার অপ্রখর আলোকের যুগে রাত্রে সমস্ত পাড়া নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে শোনা যেত 'হরিবোল' শ্মশান যাত্রীদের কণ্ঠ থেকে। ভেরেণ্ডা তেলের সেজের প্রদীপে দুটো সলতের মধ্যে একটা সলতে নিবিয়ে দিতুম, তাতে শিখার তেজ হ্রাস হত কিন্তু হত আয়ুবৃদ্ধি। মাঝে মাঝে অন্তঃপুর থেকে বড়দিদি এসে জোর করে আমার বই কেড়ে নিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিতেন বিছানায়। তখন আমি যে-সব বই পড়বার চেষ্টা করেছি কোনো কোনো গুরুজন তা আমার হাতে দেখে মনে করেছেন স্পর্ধা। শিক্ষার কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে যখন শিক্ষার স্বাধীনতা পেলুম তখন কাজ বেড়ে গেল অনেক বেশি, অথচ ভার গেল কমে।’ [কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, একত্র-বাঁধানো বিবিধার্থসংগ্রহ, আরব্য উপন্যাস, পারস্য উপন্যাস, বাংলা রবিন্সন ক্রুসো, সুশীলার উপাখ্যান, রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের জীবনচরিত
        [? বঙ্গাধিপ পরাজয়], বেতালপঞ্চবিংশতি প্রভৃতি তখনকার কালের গ্রন্থগুলি বিস্তর পাঠ করিয়াছিলাম।
'বঙ্কিমচন্দ্র', সাধনা, বৈশাখ ১৩০১।
                                        দ্রষ্টব্য রবীন্দ্র-রচনাবলী নবম খণ্ড, গ্রন্থপরিচয়, পৃ ৫৫০
                                        জীবনস্মৃতি প্রথম পাণ্ডুলিপিতে 'মৎস্যনারীর গল্প' উল্লিখিত হইয়াছে ]

আশ্রমের রূপ ও বিকাশ (১৩৫৮), পৃ ৩৪-৩৬

    'ঘরের পড়া' পরিচ্ছেদের উপসংহারে প্রথম পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া গিয়াছে:
    'এ কথা বলা বাহুল্য, তখন বিদ্যাপতি অথবা অন্যান্য বৈষ্ণব কবির পদ অবাধে পড়িবার উপযুক্ত বয়স আমার হয় নাই, কিন্তু আমি সেগুলি তন্ন তন্ন করিয়া পড়িয়াছিলাম। ইহাতে আমার বালককালের কল্পনাকে নিঃসন্দেহই কিছু আবিল করিয়াছিল কিন্তু সে আবিলতা এক সময়ে আপনিই কাটিয়া গেল, কিন্তু পদগুলির গভীর সৌন্দর্য আমার অন্তঃকরণের সহিত জড়িত হইয়া গেছে।
    'কেবল বৈষ্ণবপদাবলী নহে, তখন বাংলা সাহিত্যে যে-কোনো বই বাহির হইত আমার লুব্ধ হস্ত এড়াইতে পারিত না। মনে আছে, দীনবন্ধু মিত্রের ‘জামাইবারিক’ বইখানি আমার কোনো সতর্ক আত্মীয়ার হাত হইতে সংগ্রহ করিয়া পড়িতে আমাকে নানাপ্রকার কৌশল করিতে হইয়াছিল। এই-সকল বই পড়িয়া জ্ঞানের দিক হইতে আমার যে অকালপরিণতি হইয়াছিল বাংলা গ্রাম্যভাষায় তাহাকে বলে জ্যাঠামি
প্রথম বৎসরের ভারতীতে প্রকাশিত আমার বাল্যরচনা '
করুণা'-নামক গল্প তাহার নমুনা। কিন্তু এই অকালোচিত জ্ঞানগুলি মস্তিষ্কের উপরিভাগেই ছিল, তাহারা হৃদয়কে স্পর্শ করিতে পারে নাই। বরঞ্চ এখনকার কালের ছেলেদের সঙ্গে তুলনা করিলে দেখিতে পাই, যথার্থভাবে পরিণত হইয়া উঠিতে আমার সুদীর্ঘকাল লাগিয়াছিল। আমার বালকবুদ্ধি আমাকে অনেক দিন ত্যাগ করে নাই আমি অধিক বয়সেও নানা বিষয়ে অদ্ভুত রকম কাঁচা ছিলাম। একটা-কিছু জ্ঞানে জানা এবং তাহাকে আত্মসাৎ করার মধ্যে অনেক প্রভেদ আছে আমার বালককালের সংসারজ্ঞান তাহার একটা দৃষ্টান্ত। এবং সেই দৃষ্টান্ত হইতেই আজ আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারি, ইংরাজি হইতে আমরা যে-সকল শিক্ষা খুব পাইয়াছি বলিয়া চারি দিকে ফলাইয়া বেড়াইতেছি, যদি কালক্রমে সেই শিক্ষা যথার্থভাবে আমাদের প্রকৃতিগত হয় তখন বুঝিতে পারিবআমাদের পূর্বের অবস্থা কিরূপ অদ্ভুত অসত্য এবং হাস্যকর এবং তখন আমাদের আস্ফালনও যথেষ্ট শান্ত হইয়া আসিবে।
    'এই উপলক্ষে প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি কথা বলিয়া লইব। যখন আমার বয়স নিতান্তই অল্প ছিল এবং দূষিতবুদ্ধি আমার জ্ঞানকেও স্পর্শ করে নাই, এমন সময় একদিন বড়দাদা তাঁহার ঘরে ডাকিয়া ইন্দ্রিয়সংযম ও ব্রহ্মচর্যপালন সম্বন্ধে আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার উপদেশ আমার মনে এমনি গাঁথিয়া গিয়াছিল যে, ব্রহ্মচর্য হইতে স্খলন আমার কাছে বিভীষিকাস্বরূপ হইয়াছিল। বোধ করি, এইজন্য বাল্যবয়সে অনেক সময়ে আমার জ্ঞান ও কল্পনা যখন বিপদের পথ দিয়া গেছে তখন আমার সংকোচপরায়ণ আচরণ নিজেকে ভ্রষ্টতা হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছে।'

    'বাড়ির আবহাওয়া' পরিচ্ছেদে উল্লিখিত 'নবনাটক' অভিনয় সম্পর্কে পূর্ণতর পরিচয় এ স্থলে সংকলিত হইল:
    'নাট্যশালা সমিতির [কৃষ্ণবিহারী সেন, গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী এবং জ্যোতিবাবুর ভগিনীপতি যদুনাথ মুখোপাধ্যায়, এই পাঁচজনকে লইয়া গঠিত নাট্যসমিতি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পৃ ৯৬] অনুরোধে রামনারায়ণ তর্করত্ন অল্প সময়ের মধ্যেই 'নব নাটক'-নামক নূতন নাটক প্রণয়ন করিলেন। ১২৭৩ সনের ২৩শে বৈশাখ এক প্রকাশ্য সভা আহূত হইল এবং কলিকাতার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের সমক্ষে নাটকখানি আদ্যোপান্ত পঠিত হইল। সভাপতি প্যারীচাঁদ মিত্র রৌপ্যপাত্রে রক্ষিত পাঁচশত টাকা তর্করত্ন মহাশয়কে প্রতিশ্রুত পুরস্কার বলিয়া প্রদান করিলেন। কেবল ইহাই নহে, গণেন্দ্রনাথ গ্রন্থখানির সহস্র খণ্ড মুদ্রণের সমস্ত ব্যয় এবং গ্রন্থস্বত্বও নাট্যকারকে প্রদান করিলেন।'

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, পৃ ১২

    নবনাটক ১২৭৩ সালে রচিত হয়। ইহাতে কলিকাতা জোড়াসাঁকো-বাসী বাবু গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০ টাকা পারিতোষিক দেন। এই নাটক তাঁহার বাটীতে ৯ বার অভিনয় হয়।

রামনারায়ণের আত্মকথা, সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা ৫, পৃ ৩৪

    এই নির্দোষ আমোদপ্রমোদের আবহাওয়া-রচনায় দেবেন্দ্রনাথের উৎসাহবাক্য তাঁহারা লাভ করিয়াছিলেন:

ওঁ

নাটোর
কালীগ্রাম ৪ঠা মাঘ ১৭৮৮
[১৬ জানুয়ারী ১৮৬৭]

প্রাণাধিক গণেন্দ্রনাথ,
    তোমাদের নাট্যশালার দ্বার উদঘাটিত হইয়াছে, সমবেত বাদ্য-দ্বরা অনেকের হৃদয় নৃত্য করিয়াছে, কবিত্বরসের আস্বাদনে অনেকে পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছে। নির্দোষ আমোদ আমাদের দেশের যে একটি অভাব, তাহা এই প্রকারে ক্রমে ক্রমে দূরীভূত হইবে। পূর্বে আমার সহৃদয় মধ্যম ভায়ার [গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮২০-৫৪)] উপরে ইহার জন্য আমার অনুরোধ ছিল, তুমি তাহা সম্পন্ন করিলে। কিন্তু আমি স্নেহপূর্বক তোমাকে সাবধান করিতেছি যে, এ প্রকার আমোদ যেন দোষে পরিণত না হয়। সদ্‌ভাবের সহিত এ আমোদকে রক্ষা করিলে আমাদের দেশে সত্যতার বৃদ্ধি হইবে, তাহার সন্দেহ নাই। ইতি

শ্রীদেবেন্দ্রনাথ শর্মণঃ
 

    'অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী' প্রসঙ্গে তাঁহার সরল ভাবুকতার দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি ঘটনা 'জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি' হইতে উদ্‌ধৃত হইল:
    'তাঁহাকে [অক্ষয়বাবুকে] অতি সহজেই
April fool করা যাইত। একবার রবি গোঁপদাড়ি পরিয়া একজন পার্শী সাজিয়া, তাঁহাকে বড়ো ঠকাইয়াছিলেন। আমি বলিলামবোম্বাই হইতে একজন পার্শী ভদ্রলোক এসেছেন, তোমার সঙ্গে ইংরাজি সাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করিতে চান। অক্ষয় অমনি তৎক্ষণাৎ স্বীকৃত হইলেন। রবি ছদ্মবেশী পার্শী হইয়া আসিয়া তাঁহার সঙ্গে সাহিত্যালোচনা আরম্ভ করিয়া দিলেন। এই রবিকে তিনি কতবার সেখিয়াছেন, কণ্ঠস্বর তাঁহার কত পরিচিত, কিন্তু ঐ যে পার্শী বলিয়া তাঁহার ধারণা হইয়াছে সে তো শীঘ্র যাইবার নয়। অক্ষয় Byron, Shelly প্রভৃতি আওড়াইয়া খুব গম্ভীর ভাবে আলোচনা জুড়িয়া দিলেন। অনেক ক্ষণ এইরূপ চলিল, শেষে আমরা আর হাস্য সম্বরণ করিতে পারি না, এমন সময় শ্রীযুক্ত তারকনাথ পালিত মহাশয় আসিয়া উপস্থিত। আসিয়াই তিনি "এ কে?-রবি?" বলিয়া রবির মাথায় যেমন এক থাপ্পড় মারিলেন, অমনি কৃত্রিম দাড়িগোঁপ সব খসিয়া পড়িল। অক্ষয় অবাক হইয়া ফ্যাল্-ফ্যাল্ করিয়া চাহিয়া রহিলেন; তখনও কল্পনার নেশাটা তাঁহার মাথা হইতে যেন সম্পূর্ণ ছুটে নাই।'

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পৃ১৫৩-৫৪

    'গীতচর্চা' পরিচ্ছেদটির প্রথম পাণ্ডলিপিতে প্রাপ্ত স্বতন্ত্ররূপ নিম্নে মুদ্রিত হইল:
    'আমাদের পরিবারে গানচর্চার মধ্যেই শিশুকাল হইতে আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। কবে যে গান গাহিতে পারিতাম না তাহা মনে পড়ে না। মনে আছে, বাল্যকালে গাঁদা ফুল দিয়া ঘর সাজাইয়া মাঘোৎসবের অনুকরণে আমরা খেলা করিতাম। সে খেলায় অনুকরণের আর-আর সমস্ত অঙ্গ একেবারেই অর্থহীন ছিল কিন্তু গানটা ফাঁকি ছিল না। এই খেলায় ফুল দিয়া সাজানো একটা টেবিলের উপরে বসিয়া আমি উচ্চকণ্ঠে 'দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম-আননে' [গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর-রচিত ব্রহ্মসংগীত।] গান গাহিতেছি, বেশ মনে পড়ে।
    'চিরকালই গানের সুর আমার মনে একটা অনির্বচনীয় আবেগ উপস্থিত করে। এখনো কাজকর্মের মাঝখানে হঠাৎ একটা গান শুনিলে আমার কাছে এক মুহূর্তেই সমস্ত সংসারের ভাবান্তর হইয়া যায়। এই-সমস্ত চোখে-দেখার রাজ্য গানে-শোনার মধ্য দিয়া হঠাৎ একটা কী নূতন অর্থ লাভ করে। হঠাৎ মনে হয়, আমরা যে জগতে আছি বিশেষ করিয়া কেবল তাহার একটা তলার সঙ্গেই সম্পর্ক রাখিয়াছি
এই আলোকের তলা, বস্তুর তলা, কিন্তু এইটেই সমস্তটা নয়। যখন এই বিপুল রহস্যময় প্রাসাদে সুর আর-একটা মহলের একটা জালনা ক্ষণিকের জন্য খুলিয়া দেয় তখন আমরা কী দেখিতে পাই! সেখানকার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নাই, সেইজন্য ভাষায় বলিতে পারি না কী পাইলাম কিন্তু বুঝিতে পারি সেদিকেও অপরিসীম সত্য পদার্থ আছে। বিশ্বের সমস্ত স্পন্দিত জাগ্রত শক্তি আজ প্রধানত বস্তু ও আলোক-রূপেই প্রতিভাত হইতেছে বলিয়া আজ আমরা এই সূর্যের আলোকে বস্তুর অক্ষর দিয়াই বিশ্বকে অহরহ পাঠ করিতেছি, আর কোনো অবস্থা কল্পনা করিতে পারি না কিন্তু এই অসীম স্পন্দন যদি আমাদের কাছে আর-কিছু না হইয়া কেবল গগনব্যাপী অতি বিচিত্র সংগীতরূপেই প্রকাশ পাইত তবে, অক্ষররূপে নহে, বাণীরূপেই আমরা সমস্ত পাইতাম। গানের সুরে যখন অন্তঃকরণের সমস্ত তন্ত্রী কাঁপিয়া উঠে তখন অনেক সময় আমার কাছে এই দৃশ্যমান জগৎ যেন আকার-আয়তন-হীন বাণীর ভাবে আপনাকে ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করে তখন যেন বুঝিতে পারি জগৎটাকে যে-ভাবে জানিতেছি তাহা ছাড়া কত রকম ভাবেই যে তাহাকে জানা যাইতে পারিত তাহা আমরা কিছুই জানি না।
    'সেই সময় জ্যোতিদাদার পিয়ানোযন্ত্রের উত্তেজনায়, কতক বা তাঁহার রচিত সুরে কতক বা হিন্দুস্থানি গানের সুরে বাল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্য রচনা করিয়াছিলাম। তখন বিহারীলাল চক্রবর্তীর
সারদামঙ্গল সংগীত আর্যদর্শনে বাহির হইতেছিল এবং আমরা তাহাই লইয়া মাতিয়াছিলাম। এই সারদামঙ্গলের আরম্ভ-সর্গ হইতেই বাল্মীকিপ্রতিভার ভাবটা আমার মাথায় আসে এবং সারদামঙ্গলের দুই-একটি কবিতাও রূপান্তরিত অবস্থায় বাল্মীকিপ্রতিভায় গানরূপে স্থান পাইয়াছে।
    'তেতালার ছাদের উপর পাল খাটাইয়া স্টেজ বাঁধিয়া এই
বাল্মীকি প্রতিভা'র অভিনয় হইল। তাহাতে আমি বাল্মীকি সাজিয়াছিলাম। রঙ্গমঞ্চে আমার এই প্রথম অবতারণ। দর্শকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন; তিনি এই গীতিনাট্যের অভিনয় দেখিয়া তৃপ্তিপ্রকাশ করিয়াছিলেন।
    'ইহার পরে 'দশরথকর্তৃক মৃগভ্রমে মুনিবালকবধ' ঘটনা অবলম্বন করিয়া গীতিনাট্য লিখিয়াছিলাম। তাহাও অভিনীত হইয়াছিল। আমি তাহাতে অন্ধমুনি সাজিয়াছিলাম। এই গীতিনাট্যের অনেকগুলি গান পরে বাল্মীকিপ্রতিভার অন্তর্গত হইয়া তাহারই পুষ্টিসাধন করিয়াছে।’

প্রথম পাণ্ডুলিপি

    'দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি এবং 'প্রবাসী'তে 'গীতচর্চা' অধ্যায়ের শেষাংশ ছিল:
    'জ্যোতিদাদার পিয়ানোযন্ত্র যখন খুব চলিতেছে সেই সময়ে সেই উৎসাহেই কতক তাঁহার সুরে কতক হিন্দি গানের সুরে বাল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্য রচনা করিয়াছিলাম। তখন এই নাটক লিখিবার একটি উপলক্ষ ঘটিয়াছিল।
    'বৎসরে একবার দেশের সমস্ত সাহিত্যিকগণকে একত্র করিবার অভিপ্রায়ে আমাদের বাড়িতে ‘বিদ্বজ্জনসমাগম’-নামক এক সভা স্থাপিত হইয়াছিল। সেই সম্মিলন উপলক্ষে গান বাজনা আবৃত্তি ও আহারাদি হইত।
    'দ্বিতীয় বৎসরে দাদারা এই সম্মিলনে একটি নাট্যভিনয় করিবার ইচ্ছা করিলেন। কোন্ বিষয় অবলম্বন করিয়া নাটক লিখিলে এই সভার উপযুক্ত হইবে তাহারই আলোচনাকালে দস্যুরত্নাকরের কবি হইবার কাহিনীই সকলের চেয়ে সংগত বলিয়া বোধ হইল। ইহার কিছু পূর্বেই আর্যদর্শনে বিহারীলাল চক্রবর্তী মহাশয়ের 'সারদামঙ্গল সংগীত' বাহির হইয়া আমাদের সকলেই মাতাইয়া তুলিয়াছিল। এই কাব্যে বাল্মীকির কাহিনী যেরূপ বর্ণিত হইয়াছে তাহারই সঙ্গে দস্যু রত্নাকরের বিবরণ জড়াইয়া দিয়া এই নাটকের গল্পটা একরূপ খাড়া হইল। তাহার পর জ্যোতিদাদা বাজাইতে লাগিলেন, আমি গান তৈরি করিতে লাগিলাম এবং অক্ষয়বাবুও মাঝে মাঝে যোগ দিলেন। অক্ষয়বাবুর রচিত দুই-তিনটি গান বাল্মীকিপ্রতিভার মধ্যে আছে।
    'তেতালার ছাদের উপর পাল খাটাইয়া স্টেজ বাঁধিয়া বাল্মীকিপ্রতিভার অভিনয় হইল। আমি সাজিয়াছিলাম বাল্মীকি। আমার ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা সরস্বতী সাজিয়াছিল।[প্রথম অভিনয়ে শরৎকুমারদেবীর কন্যা সুশীলাদেবী লক্ষ্মী সাজিয়াছিলেন] বাল্মীকিপ্রতিভার নামের মধ্যে সেই ইতিহাসটুকু রহিয়াছে। দর্শকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন [অভিনয়মঞ্চ হইতে আমি তাঁহাকে চক্ষে দেখিতে পাইলাম না কিন্তু শুনিতে পাইলাম] [এই অংশ প্রবাসীতে আছে, পাণ্ডুলিপিতে নাই]
তিনি খুশি হইয়া গিয়াছিলেন।'

দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি ও প্রবাসী (পৃ ৩১৯), মাঘ ১৩১৮

    গ্রন্থে এই অংশ বর্জিত এবং স্বতন্ত্র ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ অধ্যায় সংযোজিত হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সদ্যরচিত সুরের সহিত রবীন্দ্রনাথ ও অক্ষয়চন্দ্রের গান-রচনার পূর্ণতর একটি চিত্র এ স্থলে সংকলিত হইল।
    'এই সময়ে আমি [জ্যোতিরিন্দ্রনাথ] পিয়ানো বাজাইয়া নানাবিধ সুর রচনা করিলাম। আমার দুই পার্শ্বে অক্ষয়চন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ কাগজ পেন্সিল লইয়া বসিতেন। আমি যেমনি একটি সুর রচনা করিলাম অমনি ইঁহারা সেই সুরের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ কথা বসাইয়া গান রচনা করিতে লাগিয়া যাইতেন। একটি নূতন সুর তৈরী হইবামাত্র সেটি আরও কয়েকবার বাজাইয়া ইঁহাদিগকে শুনাইতাম। সেইসময় অক্ষয়চন্দ্র চক্ষু মুদিয়া বর্মা সিগার টানিতে টানিতে মনে মনে কথার চিন্তা করিতেন। পরে যখন তাঁহার নাক মুখ দিয়া অজস্রভাবে ধুমপ্রবাহ বহিত তখনি বুঝা যাইত যে, এইবার তাঁহার মস্তিষ্কের ইঞ্জিন চলিবার উপক্রম করিয়াছে। তিনি অমনি বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া চুরুটের টুকরাটি সম্মুখে যাহা পাইতেন, এমন-কি, পিয়ানোর উপরেই, তাড়াতাড়ি রাখিয়া দিয়া হাঁফ ছাড়িয়া 'হয়েছে হয়েছে' বলিতে বলিতে আনন্দদীপ্ত মুখে লিখিতে শুরু করিয়া দিতেন। রবি কিন্তু বরাবর শান্তভাবেই ভাবাবেশে রচনা করিতেন। রবীন্দ্রনাথের চাঞ্চল্য ক্কচিৎ লক্ষিত হইত। অক্ষয়ের যত শীঘ্র হইত রবির রচনা তত শীঘ্র হইত না।'

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পৃ ১৫৫-৫৬