ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
গীতিনাট্য
প্রথম দৃশ্য
অরণ্য । দস্যুগণ
কাফি
প্রথম দস্যু। আজকে তবে মিলে সবে করব লুটের ভাগ,
এসব আন্তে কত লণ্ডভণ্ড করনু যজ্ঞ-যাগ।
দ্বিতীয় দস্যু। কাযের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন্,
ভাগের বেলায় আসেন আগে আরে দাদা!
এথম দস্যু। এত বড় আস্পর্ধা তোদের, মোরে নিয়ে এ কি হাসি-তামাসা!
এখনি মুণ্ড করিব খণ্ড— খবর্দার রে খবর্দার!
দ্বিতীয় দস্যু। হাঃ হাঃ ভায়া খাপ্পা বড়ো, এ কী ব্যাপার!
আজি বুঝিবা বিশ্ব করবে নস্য, এমনি যে আকার!
তৃতীয় দস্যু। এমনি যোদ্ধা উনি, পিঠেতেই দাগ—
তলোয়ারে মরিচা, মুখেতেই রাগ।
প্রথম দস্যু। আর যে এ-সব সহে না প্রাণে, নাহি কি তোদের প্রাণের মায়া?
দারুণ রাগে কাঁপিছে অঙ্গ, কোথা রে লাঠি, কোথা রে ঢাল?
সকলে। হাঃ হাঃ ভায়া খাপ্পা বড়, এ কী ব্যাপার!
আজি বুঝিবা বিশ্ব করবে নস্য এমনি যে আকার!
বাল্মীকির প্রবেশ
খাম্বাজ
সকলে। এক ডোরে বাঁধা আছি মোরা সকলে।
না মানি বারণ, না মানি শাসন, না মানি কাহারে।
কে বা রাজা, কার রাজ্য, মোরা কী জানি?
প্রতি জনেই রাজা মোরা, বনই রাজধানী!
রাজা-প্রজা উঁচু-নিচু কিছু না গণি!
ত্রিভুবনমাঝে আমরা সকলে কাহারে না করি ভয়—
মাথার উপরে রয়েছেন কালী, সমুখে রয়েছে জয়!
পিলু
প্রথম দস্যু। এখন কর্ব্ব' কি বল্।
সকলে। (বাল্মীকির প্রতি) এখন কর্ব্ব' কি বল্।
প্রথম দস্যু। হো রাজা, হাজির রয়েছে দল!
সকলে। বল্ রাজা, কর্ব্ব' কি বল্ এখন কর্ব্ব' কি বল্।
প্রথম
দস্যু। পেলে মুখেরই কথা, আনি যমেরই মাথা।
ক'রে দিই রসাতল!
সকলে। ক'রে দিই রসাতল!
সকলে। হো রাজা, হাজির রয়েছে দল—
বল্ রাজা, কর্ব্ব' কি বল্ এখন কর্ব্ব কি বল্!
ঝিঁঝিট
বাল্মীকি। শোন্ তোরা তবে শোন্।
অমানিশা আজিকে, পূজা দেব কালীকে—
ত্বরা করি যা তবে, সবে মিলি যা তোরা,
বলি নিয়ে আয়।
[বাল্মীকির প্রস্থান
রাগিণী বেলাবতী
সকলে। তবে আয় সবে আয়, তবে আয় সবে আয়,
তবে ঢাল্ সুরা, ঢাল্ সুরা, ঢাল্ ঢাল্ ঢাল্!
দয়া মায়া কোন্ ছার! ছারখার হোক!
কেবা কাঁদে কার তরে, হাঃ হাঃ হাঃ!
তবে আন্ তলোয়ার, আন্ আন্ তলোয়ার,
তবে আন্ বরষা, আন্ আন্ দেখি ঢাল—
প্রথম দস্যু। আগে পেটে কিছু ঢাল্, পরে পিঠে নিবি ঢাল—
হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!
জংলা ভূপালি
সকলে। (উঠিয়া) কালী কালী বলো রে আজ—
বল হো, হো হো, বল হো, হো হো, বলহো—
নামের জোরে সাধিব কাজ—
ঐ ঘোর মত্ত করে নৃত্য রঙ্গমাঝারে,
ঐ লক্ষ লক্ষ যক্ষ রক্ষ ঘেরি শ্যামারে,
ঐ লট্ট পট্ট কেশ, অট্ট অট্ট হাসে রে—
হাহা হাহাহা হাহাহা!
আরে বল্ রে শ্যামা মায়ের জয়, জয় জয়—
জয়, জয়, জয় জয়, জয় জয়, জয় জয়—
আরে বল্ রে শ্যামা মায়ের জয়, জয় জয়!
আরে বল্ রে শ্যামা মায়ের জয়!
[গমনোদ্যম একটি বালিকার প্রবেশ
দেশ-বেহাগ
বালিকা। এ কি এ ঘোর বন! এনু কোথায়!—
পথ যে জানি না, মোরে দেখায়ে দে না!
কি করি এ আঁধার রাতে!
কি হবে মোর হায়।
ঘন ঘোর মেঘ ছেয়েছে গগনে,
চকিতে চপলা চমকে সঘনে—
একেলা বালিকা
তরাসে কাঁপে কায়!
পিলু
প্রথম
দস্যু। (বালিকার
প্রতি) পথ ভুলেছিস সত্যি বটে?
সিধে রাস্তা দেখতে চাস?
এমন জায়গায় পাঠিয়ে দেব, সুখে থাকবি বার মাস।
সকলে। হাঃ হাঃ হাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ!
দ্বিতীয়
দস্যু। (প্রথমের প্রতি) কেমন হে ভাই!
কেমন সে ঠাঁই?
প্রথম দস্যু। মন্দ নহে বড়,
এক দিন না এক দিন সবাই সেথায় হব জড়—
সকলে। হাঃ হাঃ হাঃ!
তৃতীয় দস্যু। আয় সাথে আয়, রাস্তা তোরে দেখিয়ে দিই গে তবে—
আর তা হলে রাস্তা ভুলে ঘুরতে নাহি হবে!
সকলে। হাঃ হাঃ হাঃ!
[সকলের প্রস্থান
দ্বিতীয় দৃশ্য
অরণ্যে কালীপ্রতিমা। বাল্মীকি স্তবে আসীন
কানাড়া
বাল্মীকি।
নিশুম্ভমর্দ্দিনী অম্বে,
মহাসমরপ্রমত্ত মাতঙ্গিনী,
কম্পে রণাঙ্গন পদভারে একি!
থরথর মহী সমুদ্র, পর্ব্বত ব্যোম,
সুরনর শঙ্কাকূল—
কে এ অঙ্গনা!
[বালিকাকে লইয়া দস্যুগণের প্রবেশ]
কাফি
দস্যুগণ। দেখো হো ঠাকুর, বলি এনেছি মোরা।
বড় সরেস, পেয়েছি বলি সরেস—
এমন সরেস মছ্লি, রাজা জালে না পড়ে ধরা!
দেরি কেন ঠাকুর, সেরে ফেলো ত্বরা!
কানাড়া
বাল্মীকি। নিয়ে আয় কৃপাণ, রয়েছে তৃষিতা শ্যামা মা,
শোণিত পিয়াও, যা ত্বরায়!
লোল জিহ্বা লকলকে, তড়িত খেলে চোখে,
করিয়ে খণ্ড দিক্ দিগন্ত ঘোর দন্ত ভায়!
গারা ভৈরবী
বালিকা।
কি দশা হ'ল আমার, হায়!
কোথা গো
মা করুণাময়ী, অরণ্যে প্রাণ যায় গো!
মুহূর্ত্তের তরে, মা গো, দেখা দেও আমারে—
জনমের মত বিদায়!
সিন্ধু ভৈরবী
বাল্মীকি। এ কেমন হ'ল মন আমার!
কি ভাব এ যে কিছুই বুঝিতে যে পারি নে!
পাষাণ হৃদয়ো গলিল কেন রে,
কেন আজি আঁখিজল দেখা দিল নয়নে!
কি মায়া এ জানে গো,
পাষাণের বাঁধ এ যে টুটিল,
সব ভেসে গেল গো— সব ভেসে গেল গো—
মরুভূমি ডুবে গেল করুণার প্লাবনে!
প্রথম দস্যু। আরে, কি এত ভাবনা কিছু তো বুঝি না—
দ্বিতীয় দস্যু। সময় ব'হে যায় যে!
তৃতীয় দস্যু। কখন্ এনেছি মোরা, এখনো ত হ'ল না—
চতুর্থ দস্যু। এ কেমন রীতি তব, বাহ্ রে।
বাল্মীকি। না না হবে না, এ বলি হবে না,
অন্য বলির তরে যা রে যা!
প্রথম দস্যু। অন্য বলি এ রাতে কোথা মোরা পাব?
দ্বিতীয় দস্যু। এ কেমন কথা কও, বাহ্ রে!
বাঙ্গালী
বাল্মীকি। শোন্ তোরা শোন্ এ আদেশ—
কৃপাণ খর্পর ফেলে দে দে।
বাঁধন কর ছিন্ন,
মুক্ত কর' এখনি রে!
[যথাদিষ্ট কৃত
তৃতীয় দৃশ্য
অরণ্য । বাল্মীকি
খাম্বাজ
বাল্মীকি। ব্যাকুল হয়ে বনে বনে
ভ্রমি একেলা শূন্য মনে!
কে পুরাবে মোর শূন্য এ হিয়া,
জুড়াবে প্রাণ সুধাবরিষণে!
[প্রস্থান
দস্যুগণের প্রবেশ
নটনারায়ণ
দস্যুগণ। আর না , আর না, এখানে আর না—
আয় রে সকলে চলিয়া যাই।
ধনুক বাণ ফেলেছে রাজা,
এখানে কেমনে থাকিব ভাই!
চল চল চল এখনি যাই!
বাল্মীকির প্রবেশ
দস্যুগণ। তোর দশা, রাজা, ভালো ত নয়
রক্তপাতে পাস্ রে ভয়—
লাজে মোরা ম'রে যাই।
পাখীটি মারিলে কাঁদিয়া খুন,
না জানি কে তোরে করিল গুণ—
হেন কভু দেখি নাই॥
[দস্যুগণের প্রস্থান
হাম্বীর
বাল্মীকি। জীবনের কিছু হল না হায়!
হল না গো হল না, হায় হায়!
গহনে গহনে কত আর ভ্রমিব নিরাশার এ আঁধারে?
শূন্য হৃদয় আর বহিতে যে পারি না,
পারি না গো, পারি না আর।
কী ল'য়ে এখন ধরিব জীবন— দিবসরজনী চলিয়া যায়—
দিবসরজনী চলিয়া যায়—
কত কি করিব বলি কত উঠে বাসনা,
কী করিব জানি না গো!
সহচর ছিল যারা ত্যেজিয়া গেল তারা— ধনুর্ব্বাণ ত্যেজেছি—
কোনো আর নাহি কাজ—
কি করি কি করি বলি হাহা করি ভ্রমি গো,
কি করিব জানি না যে!
[ব্যাধগণের প্রবেশ
ও একটি ক্রৌঞ্চমিথুনের প্রতি লক্ষ]
সিন্ধু ভৈরবী
বাল্মীকি। থাম্ থাম্, কি করিবি বধি পাখীটির প্রাণ!
দুটিতে রয়েছে সুখে, মনের উল্লাসে গাহিতেছে গান!
প্রথম ব্যাধ। রাখ' মিছে ওসব কথা, কাছে মোদের এস নাক হেথা,
চাই নে ওসব শাস্তর-কথা, সময় ব'হে যায় যে।
বাল্মীকি। শোনো শোনো, মিছে রোষ কোরো না!
ব্যাধ। থামো থামো ঠাকুর, এই ছাড়ি বাণ!
[একটি ক্রৌঞ্চকে বধ]
বাল্মীকি। মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।
বাহার
কী বলিনু আমি! — এ কী সুললিত বাণী রে!
কিছু না জানি কেমনে যে আমি প্রকাশিনু দেবভাষা—
এমন কথা কেমনে শিখিনু রে!
পুলকে পুরিল মনপ্রাণ, মধু বরষিল শ্রবণে,
এ কী! —হৃদয়ে একি এ দেখি!—
ঘোর অন্ধকার-মাঝে, একি জ্যোতি রে
অবাক! —করুণা এ কার?
[সরস্বতীর আবির্ভাব]
বাল্মীকি। একি এ, একি এ, স্থির চপলা!
কিরণে কিরণে হল সব দিক উজলা।
কি প্রতিমা দেখি এ,
জোছনা মাখিয়ে
কে রেখেছে আঁকিয়ে
আ মরি কমলপুতলা!
[দেবীর অন্তর্ধান] [ব্যাধগণের প্রস্থান
টোড়ী
বাল্মীকি। কোথা লুকাইলে?
সব আশা নিভিল, দশদিশি অন্ধকার!
সবে গেছে চ'লে ত্যেজিয়ে আমারে,
তুমিও কি তেয়াগিলে?
[লক্ষ্মীর আবির্ভাব]
সিন্ধু
লক্ষ্মী। কেন গো আপনমনে ভ্রমিছ বনে বনে, সলিল দু নয়নে
কিসের দুখে?
কমলা দিতেছে আসি রতন রাশি রাশি, ফুটুক তবে হাসি
মলিন মুখে।
কমলা যারে চায়
বলো সে কি না পায়, দুখের এ ধরায়
থাকে সে সুখে।
ত্যেজিয়া কমলসনে এসেছি এ ঘোর বনে, আমারে শুভক্ষণে
হেরো গো চোখে।
টোড়ী
বাল্মীকি। আমার কোথায় সে উষাময়ী প্রতিমা!
তুমি তো নহ সে দেবী, কমলাসনা,
কোরো না আমারে ছলনা!
এনেছ কি ধন মান? তাহা যে চাহে না প্রাণ—
দেবী গো, চাহি না, চাহি না, মণিময় ধূলিরাশি চাহি না—
তাহা ল'য়ে সুখী যারা হয় হোক্, হয় হোক্—
আমি, দেবি, সে সুখ চাহি না।
যাও লক্ষ্মী অলকায়, যাও লক্ষ্মী অমরায়,
এ বনে এস না, এস না, এস না এ দীনজন কুটীরে—
যে বীণা শুনেছি কানে মন প্রাণ আছে ভোর—
আর কিছু চাহি না, চাহি না!
লক্ষ্মীর অন্তর্ধান। সরস্বতীর পুনরাবির্ভাব]
বাহার
বাল্মীকি। এই-যে হেরি গো দেবী আমারি!
এবে কবিতাময় জগত-চরাচর,
সব শোভাময় নেহারি।
ছন্দে উঠিছে চন্দ্রমা, ছন্দে কনকরবি উদিছে,
ছন্দে জগমণ্ডল চলিছে,
জ্বলন্ত কবিতা তারকা সবে—
এ কবিতার মাঝারে তুমি কে গো দেবি,
আলোকে আলো আঁধারি।
আজি মলয় আকুল বনে বনে একি একি গীত গাহিছে,
ফুল কহিছে প্রাণের কাহিনী,
নব রাগরাগিণী উছাসিছে—
এ আনন্দে আজ গীত গাহে মোর হৃদয় সব অবারি!
তুমিই কি দেবী ভারতী! কৃপাগুণে অন্ধ আঁখি ফুটালে,
উষা আনিলে প্রাণের আঁধারে,
প্রকৃতির রাগিণী শিখাইলে?
তুমি ধন্য গো!
রব চিরকাল চরণ ধরি তোমারি।
গৌড় মল্লার
হৃদয়ে রাখ, গো দেবি, চরণ তোমার।
এস মা করুণারাণী, ও বিধু-বদনখানি
হেরি হেরি আঁখি ভরি হেরিব আবার।
এস আদরিণী বাণী সমুখে আমার।
মৃদু মৃদু হাসি হাসি বিলাও অমৃতরাশি—
আলোয় করেছ আলো, স্নেহের প্রতিমা,
তুমি গো পাবণ্যলতা, মূর্ত্তি মধুরিমা।
বসন্তের বনবালা, অতুল রূপের ডালা,
মায়ার মোহিনী মেয়ে ভাবের আধার,
ঘুচাও মনের মোর সকল আঁধার।
অদর্শন হ'লে তুমি ত্যেজি লোকালয়ভূমি
অভাগা বেড়াবে কেঁদে নিবিড় গহনে—
হেরে মোরে তরুলতা বিষাদে কবে না কথা
বিষণ্ণ কুসুমকুল বনফুল-বনে।
'হা দেবী' হা দেবী' বলি গুঞ্জরি কাঁদিবে অলি,
ঝরিবে ফুলের চোখে শিশির-আসার—
হেরিব জগত শুধু আঁধার! আঁধার !
সরস্বতী। দীনহীন বালিকার সাজে,
আইনু এ ঘোর বনমাঝে
গলাতে পাষাণ তোর মন,
কেন, বৎস, শোন্ তাহা শোন্!
আমি বীণাপাণি, তোরে এসেছি শিখাতে গান।
তোর গানে গ'লে যাবে সহস্র পাষাণপ্রাণ।
যে রাগিণী শুনে তোর গ'লেছে কঠোর মন,
সে রাগিণী তোরি কণ্ঠে বাজিবে রে অনুক্ষণ।
অধীর হইয়া সিন্ধু কাঁদিবে চরণতলে,
চারি দিকে দিক্বধূ আকুল নয়নজলে।
মাথার উপরে তোর কাঁদিবে সহস্র তারা,
অশনি গলিয়া গিয়া হইবে অশ্রুর ধারা।
যে করুণ রসে আজি ডুবিল রে ও হৃদয়
শত স্রোতে তুই তাহা ঢালিবি জগতময়।
যেথায় হিমাদ্রি আছে সেথা তোর নাম র'বে,
যেথায় জাহ্নবী বহে তোর কাব্যস্রোত ব'বে।
সে জাহ্নবী বহিবেক অযুত হৃদয় দিয়া
শ্মশান পবিত্র করি, মরুভূমি উর্ব্বরিয়া।
শুনিতে শুনিতে, বৎস, তোর সে অমর গীত'
জগতের শেষ দিনে রবি হবে অস্তমিত'।
যত দিন আছে শশী, যত দিন আছে রবি,
তুই বাজাইবি বীণা তুই আদি মহাকবি!
মোর পদ্মাসনতলে রহিবে আসন তোর,
নিত্য নব নব গীতে সতত রহিবি ভোর।
বসি তোর পদতলে কবিবালকেরা যত
শুনি তোর কণ্ঠস্বর শিখিবে সঙ্গীত কত!
এই নে আমার বীণা দিনু তোরে উপহার!
যে গান গাহিতে সাধ ধ্বনিবে ইহার তার।
|
ইহা ১৮০২ শকের ফাল্গুন মাসে
প্রথম প্রকাশিত হয়, সম্ভবতঃ বিদ্বজ্জনসমাগম উপলক্ষে অভিনীত গীতিনাট্যের
অনুষ্ঠানপত্র-হিসাবে। 'ভারতী'র তৎকালীন প্রচ্ছদ পট এই পুস্তকের মলাট হইয়াছিল।
পৃষ্ঠাসংখ্য ছিল ১৩। আন্দাজ ১৮৮১ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে 'বাল্মীকিপ্রতিভা'
প্রথম অভিনয় হয়। পুস্তকটিও এই দিনে প্রকাশিত হইয়া থাকিবে। 'বাল্মীকিপ্রতিভা'
সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ 'জীবনস্মৃতি' গ্রন্থে লিখিয়াছেন—
এই দেশী ও বিলাতী সুরের চর্চ্চার মধ্যে বাল্মীকি-প্রতিভার জন্ম
হইল। ... আমি বিলাত হইতে ফিরিয়া আসার পর একবার এই [বিদ্বজ্জনসমাগম] সম্মিলনী আহূত
হইয়াছিলা— ইহার শেষবার। এই সম্মিলনী উপলক্ষ্যেই বাল্মীকি-প্রতিভা রচিত হয়। আমি
বাল্মীকি সাজিয়াছিলাম এবং আমার ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা সরস্বতী সাজিয়াছিল
—বাল্মীকি-প্রতিভা নামের মধ্যে সেই ইতিহাসটুকু রহিয়া গিয়াছে। ... বাল্মীকিপ্রতিভায়
অক্ষয়বাবুর কয়েকটি গান আছে এবং ইহার দুইটি গানে বিহারী চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের
সারদামঙ্গল সঙ্গীতের দুই এক স্থানের ভাষা ব্যবহার করা হইয়াছে।
—প্রথম সংস্করণ, পৃ. ১৩৮-৪১
১২৯২ সালের ফাল্গুন মাসে
[২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬] পরিবর্ধিত ও পরিবর্তিত হইয়া ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র দ্বিতীয়
সংস্করণ বাহির হয়, ‘কালমৃগয়া’র কিয়দংশ তখনই ইহাতে যুক্ত হয়। এই নাটিকার পরবর্তী
সংস্করণ মূল রবীন্দ্র-রচনাবলীর প্রথম খণ্ডে এবং বর্তমানে-প্রচলিত গীতবিতানের তৃতীয়
খণ্ডে পুনর্মুদ্রিত হইয়াছে।
বর্তমান খণ্ডে সংকলিত গ্রন্থগুলির সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার
জন্য দ্রষ্টব্য শ্রীপুলিনবিহারী সেন-সংকলিত রবীন্দ্রগ্রন্থপঞ্জী, প্রথম খণ্ড
(বিশ্বভারতী। ১৩৭৯)।
প্রথম প্রকাশকালে (১৩৪৭) রবীন্দ্র-রচনাবলীর বর্তমান খণ্ডের
গ্রন্থ-পরিচয় রচনা করেন সজনীকান্ত দাস ও ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। উহার কিছু
কিছু তথ্য সংযোজন ও সম্পাদনা করিয়াছেন শ্রীকানাই সামন্ত ১৩৬৯ ও ১৩৮১ বঙ্গাব্দের
মুদ্রণে।
সংশোধন। ৩০২ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত নেপথ্যসংগীতে শেষ
ছত্রের পূর্বে ‘ফুলটির মৃদুপ্রাণ হায়’ এই দ্রষ্ট ছত্র সংযোজিত হইয়াছে।
৩৫৯ পৃষ্ঠার চতুর্দশ ছত্রে বর্তমান সংস্করণে যে পরিবর্তিত পাঠ পাওয়া যাইবে তাহাই
‘ভারতী’পত্রে মুদ্রিত শুদ্ধ পাঠ।
বৈশাখ ১৩৬৯