|
উপহার
গীত
[রাগিণী ভৈরবী,–
তাল আড়াঠেকা]
নয়ন-অমৃতরাশি
প্রেয়সী আমার!
জীবন-জুড়ান ধন, হৃদি ফুলহার!
মধুর মূরতি তব
ভরিয়ে রয়েছে ভব,
সমুখে সে মুখ-শশী জাগে অনিবার!
কি জানি কি ঘুমঘোরে,
কি চোকে দেখেছি তোরে,
এ জনমে ভুলিতে রে পারিব না আর!
তবুও ভুলিতে হবে,
কি লয়ে পরাণ রবে,
কাঁদিয়ে চাঁদের পানে চাই বারেবার।
কুসুম-কানন মন
কেন রে বিজন বন,
এমন পূর্ণিমা-নিশি যেন অন্ধকার।
হে চন্দ্রমা, কার দুখে
কাঁদিছ বিষণ্ণ মুখে!
অয়ি দিগঙ্গনে কেন কর হাহাকার!
হয় তো হল না দেখা,
এ লেখাই শেষ লেখা,
অন্তিম কুসুমাঞ্জলি স্নেহ-উপহার,–
ধর ধর স্নেহ-উপহার!
প্রথম সর্গ
গীতি
[রাগিণী ললিত,–
তাল আড়াঠেকা]
ওই কে অমরবালা দাঁড়ায়ে উদয়াচলে,
ঘুমন্ত প্রকৃতি পানে চেয়ে আছে কুতুহলে!
চরণকমলে লেখা
আধ আধ রবি-রেখা,
সর্ব্বাঙ্গে গোলাপ-আভা, সীমন্তে শুক্তারা জ্বলে।
যোগে যেন পায় স্ফুর্ত্তি
সদয়া করুণামূর্ত্তি,
বিতরেন হাসি হাসি শান্তিসুধা ভূমণ্ডলে।
হয় হয় প্রায় ভোর,
ভাঙো ভাঙো ঘুমঘোর,
সুস্বপ্নরূপিণী উনি, ঊষারাণী সবে বলে।
বিরল তিমিরজাল,
শুভ্র অভ্র লালে লাল,
মগন তারকারাজি গগনের নীল জলে!
তরুণ-কিরণাননা
জাগে সব দিগঙ্গনা,
জাগেন পৃথিবী দেবী সুমঙ্গল কোলাহলে।
এস মা ঊষার সনে
বীণাপাণি চন্দ্রাননে,
রাঙা চরণ দুখানি রাখ হৃদয়কমলে!
১
কে তুমি ত্রিদিবদেবী বিরাজ হৃদিকমলে!
নধর নগনা লতা মগনা কমলদলে।
মুখখানি ঢল ঢল,
আলুথালু কুন্তল,
সনাল কমল দুটি হাসে বাম করতলে।
২
কপোলে সুধাংশুভাস,
অধরে অরুণহাস,
নয়ন করুণাসিন্ধু প্রভাতের তারা জ্বলে।
৩
মাথা থুয়ে পয়োধরে
কোলে বীণা খেলা করে,
স্বর্গীয় অমিয় স্বরে জানিনে কি কথা বলে।
৪
ভাবভরে মাতোয়ারা,
যেন পাগলিনী পারা,
আহ্লাদে আপনা-হারা মুগুধা মোহিনী,
নিশান্তে শুকতারা,
চাঁদের সুধার ধারা,
মানস-মরালী মম আনন্দ-রূপিণী!
তুমি সাধনের ধন,
জান সাধকের মন,
এখন আমার আর কোন খেদ নাই ম'লে!
৫
নাহি চন্দ্র সূর্য্য তারা,
অনল-হিল্লোল-ধারা,
বিচিত্র-বিদ্যুত-দাম-দ্যুতি ঝলমল;
তিমিরে নিমগ্ন ভব,
নীরব নিস্তব্ধ সব,
কেবল মরুতরাশি করে কোলাহল।
৬
হিমাদ্রিশিখর পরে
আচন্বিতে আলো করে
অপরূপ জ্যোতি ওই পুণ্য তপোবনে!
বিকচ নয়নে চেয়ে
হাসিছে দুধের মেয়ে,–
তামসী-তরুণ-ঊষা কুমারীরতন।
কিরণে ভুবন ভরা,
হাসিয়ে জাগিল ধরা,
হাসিয়ে জাগিল শূন্যে দিগঙ্গনাগণে।
হাসিল অম্বরতলে
পারিজাত দলে দলে,
হাসিল মানস সরে কমল-কানন।
৭
হরিণী মেলিল আঁখি,
নিকুঞ্জে কূজিল পাখী,
বহিল সৌরভময় শীতল সমীর,
ভাঙ্গিল মোহের ভুল,
জাগিল মানবকুল,
হেরিয়ে তরুণ-ঊষা আনন্দে অধীর।
৮
অম্বরে অরুণোদয়,
তলে দুলে দুলে বয়
তমসা তটিনী-রাণী কুলু কুলু স্বনে;
নিরখি লোচনলোভা
পুলিন-বিপিন-শোভা
ভ্রমেন বাল্মীকি মুনি ভাবভোলা মনে।
৯
শাখি-শাখে রসসুখে
ক্রৌঞ্চ ক্রৌঞ্চী মুখে মুখে
কতই সোহাগ করে বসি দুজনায়,
হানিল শবরে বাণ,
নাশিল ক্রৌঞ্চের প্রাণ,
রুধিরে আপ্লুত পাখা ধরণী লুটায়।
১০
ক্রৌঞ্চী প্রিয় সহচরে
ঘেরে ঘেরে শোক করে,
অরণ্য পূরিল তার কাতর ক্রন্দনে
চক্ষে করি দরশন
জড়িমা-জড়িত মন,
করুণ-হৃদয় মুনি বিহ্বলের প্রায়;
সহসা ললাটভাগে
জ্যোতির্ম্ময়ী কন্যা জাগে,
জাগিল বিজলী যেন নীল নব ঘনে।
১১
কিরণে কিরণময়
বিচিত্র আলোকোদয়,
ম্রিয়মাণ রবি-ছবি, ভুবন উজলে।
চন্দ্র নয়, সূর্য্য নয়,
সমুজ্জ্বল শান্তিময়,
ঋষির ললাটে আজি না জানি কি জ্বলে।
১২
কিরণ-মণ্ডলে বসি
জ্যোতির্ম্ময়ী সুরূপসী
যোগীর ধ্যানের ধন ললাটিকা মেয়ে
নামিলেন ধীর ধীর,
দাঁড়ালেন হয়ে স্থির
মুগ্ধ নেত্রে বাল্মীকির মুখ পানে চেয়ে।
১৩
করে ইন্দ্রধনু বালা,
গলায় তারার মালা,
সীমন্তে নক্ষত্র জ্বলে, ঝলমলে কানন;
কর্ণে কিরণের ফুল,
দোদুল্ চাঁচর চুল
উড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকিয়ে আনন।
১৪
হাসিহাসি-শশি-মুখী,
কতই কতই সুখী!
মনের মধুর জ্যোতি উছলে নয়নে।
কভু হেসে ঢল ঢল,
কভু রোষে জ্বল জ্বল,
বিলোচন ছল ছল করে প্রতি ক্ষণে।
১৫
করুণ ক্রন্দন রোল
উত উত উতোরোল,
চমকি বিহ্বলা বালা চাহিলেন ফিরে;
হেরিলেন রক্তমাখা
মৃত ক্রৌঞ্চী ভগ্ন-পাখা,
কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে ক্রৌঞ্চী ওড়ে ঘিরে ঘিরে।
১৬
একবার সে ক্রৌঞ্চীরে
আর বার বাল্মীকিরে
নেহারেন ফিরে ফিরে, যেন উন্মাদিনী;
কাতরা করুণা-ভরে,
গান্ সকরুণ স্বরে,
ধীরে ধীরে বাজে করে বাণা বিষাদিনী।
১৭
সে শোক-সংগীত-কথা
শুনে কাঁদ তরু লতা,
তমসা আকুল হয়ে কাঁদে উভরায়।
নিরখি নন্দিনী-ছবি
গদ গদ আদি-কবি
অন্তরে করুণা-সিন্ধু উথলিয়া ধায়।
১৮
রোমাঞ্চিত কলেবর,
টলমল থরথর,
প্রফুল্ল কপোল বহি বহে অশ্রুজল।
হে যোগেন্দ্র! যোগাসনে
ঢুল ঢুল দু-নয়নে
বিভোর বিহ্বল মনে কাঁহারে ধেয়াও!
কমলা ঠমকে হাসি
ছড়ান্ রতনরাশি,
অপাঙ্গে ভ্রূভঙ্গে আহা ফিরে নাহি চাও!
ভাবে ভোলা খোলা প্রাণ,
ইন্দ্রাসনে তুচ্ছ জ্ঞান,
হাসিয়ে পাগল বলে পাগল সকল।
১৯
এমন করুণা মেয়ে
আছে যাঁর মুখ চেয়ে,
ছলিতে এসেছ তাঁরে কেন গো চপলা!
হেরে কন্যা করুণায়
শোক তাপ দূরে যায়,
কি কাজ–
কি কাজ তাঁর তোমায় কমলা!
২০
এস মা করুণারাণী,
ও বিধু-বদনখানি
হেরি হেরি আঁখি ভরি হেরি গো আবার;
শুন সে উদার কথা
জুড়াক মনের ব্যথা,
এস আদরিণী বাণী সমুখে আমার!
যাও লক্ষ্মী অলকায়,
যাও লক্ষ্মী অমরায়,
এস না এ যোগি-জন-তপোবন-স্থলে!
২১
ব্রহ্মার মানস সরে
ফুটে ঢলঢল করে
নীল জলে মনোহর সুবর্ণ-নলিনী,
পাদপদ্ম রাখি তায়
হাসি হাসি ভাসি যায়
ষোড়শী রূপসী বামা পূর্নিমা-যামিনী।
২২
কোটি শশী উপহাসি
উথলে লাবণ্যরাশি,
তরল দর্পণে যেন দিগন্ত আবরে;
আচম্বিতে অপরূপ
রূপসীর প্রতিরূপ
হাসি হাসি ভাসি ভাসি উদয় অম্বরে।
২৩
ফটিকের নিকেতন,
দশ দিকে দরপণ,
বিমল সলিল যেন করে তক্ তক্;
সুন্দরী দাঁড়ায়ে তায়
হাসিয়ে যে দিকে চায়
সেই দিকে হাসে তার কুহকিনী ছায়া,
নয়নের সঙ্গে সঙ্গে
ঘুরিয়া বেড়ায় রঙ্গে,
অবাক্ দেখিলে, হয় অমনি অবাক্; চক্ষে পড়ে না পলক।
তেমনি মানস সরে
লাবণ্য-দর্পণ-ঘরে
দাঁড়ায়ে লাবণ্যময়ী দেখিছেন মায়া।–
২৪
যেন তাঁরে হেরি হেরি,
শূন্যে শূন্যে ঘেরি ঘেরি,
রূপসী চাঁদের মালা ঘুরিয়া বেড়ায়;
চরণকমলতলে
নীল নভ নীল জলে
কাঞ্চন-কমলরাজি ফুটে শোভা পায়।
২৫
চাহি তাঁদের পানে
আনন্দ ধরে না
আনত আননে হাসি জলতলে চান;
তেমনি রূপসী-মালা
চারি দিকে করে খেলা,
অধরে মৃদুল হাসি আনত বয়ান।
২৬
রূপের ছটায় ভুলি
শ্বেত শতদল তুলি
আদরে পরাতে যান সীমন্তে সবার,
তাঁরাও তাঁহারি মত
পদ্ম তুলি যুগপত
পরাতে আসেন সবে সীমন্তে তাঁহার।
২৭
অমনি স্বপন প্রায়
বিভ্রম ভাঙিয়া যায়,
চমকি আপন পানে চাহেন রূপসী;
চমকে গগনে তারা,
ভূধরে নির্ঝরধারা,
চমকে চরণতলে মানস-সরসী।
২৮
কুবলয়-বনে বসি
নিকুঞ্জে-শারদশশী
ইতস্তত শত শত সুরসীমন্তিনী
সঙ্গে সঙ্গে ভাসি যায়,
অনিমেষে দেখে তাঁয়,
যোগাসনে যেন সব বিহ্বলা যোগিনী
২৯
কিবে এক পরিমল
বহে বহে অবিরল!
শান্তিময়ী দিগঙ্গনা দেখেন উল্লাসে।
শূন্যে বাজে বীণা বাঁশী,
সৌদামিনী ধায় হাসি,
সংগীত-অমৃত-রাশি উথলে বাতাসে।
ত'রে ঘেরে, যোড় করে
অমর কিন্নর নরে
সম স্বরে স্তব করে, ভাসে অশ্রুজলে–
অমর কিন্নর নরে ভাসে অশ্রুজলে॥
৩০
তোমারে হৃদয়ে রাখি
সদানন্দমনে থাকি,
শ্মশান অমরাবতী দু-ই ভাল লাগে;
গিরিমালা, কুঞ্জবন,
গৃহ, নাট-নিকেতন,
যখন যেখানে যাই, যাও আগে আগে।
জাগরণে জাগ হেসে,
ঘুমালে ঘুমাও শেষে,
স্বপনে মন্দার-মালা পরাইয়ে দাও গলে॥
৩১
যত মনে অভিলাষ,
তত তুমি ভালবাস,
তত মন প্রাণ ভোরে আমি ভালবাসি;
ভক্তিভাবে একতানে
মজেছি তোমার ধ্যানে;
কমলার ধন মানে নহি অভিলাষী।
থাক হৃদে জেগে থাক,
রূপে মন ভোরে রাখ,
তপোবনে ধ্যানে থাকি এ নগর-কোলাহলে॥
৩২
তুমিই মনের তৃপ্তি,
তুমি নয়নের দীপ্তি,
তোমা-হারা হ'লে আমি প্রাণ-হারা হই;
করুণা-কটাক্ষে তব
পাই প্রাণ অভিনব
অভিনব শান্তিরসে মগ্ন হয়ে রই।
যে ক দিন আছে প্রাণ,
করিব তোমায় ধ্যান,
আনন্দে ত্যেজিব তনু ও রাঙা চরণতলে॥
৩৩
অদর্শন হ'লে তুমি,
ত্যেজি লোকালয় ভূমি,
অভাগা বেড়াবে কেঁদে নিবিড় গহনে;
হেরে মোরে তরু লতা
বিষাদে কবে না কথা,
বিষণ্ণ কুসুমকুল বন-ফুল-বনে।
'হা দেবী, হা দেবী,' বলি
গুঞ্জরি কাঁদিবে অলি;
নীরবে হরিণীবালা ভাসিবে নয়নজলে॥
৩৪
নির্ঝ র ঝর্ঝ র রবে
পবন পূরিয়ে যবে
অঘোষিবে সুরপুরে কাননের করুণ ক্রন্দন হাহাকার,
তখন টলিবে হায় আসন তোমারে–
হায় রে, তখন মনে পড়িবে তোমার !
হেরিবে কাননে আসি
অভাগার ভস্মরাশি,
অথবা হাড়ের মালা, ধাতাসে ছড়ায় ;
করুণা জাগিবে মনে,
ধারা রবে দুনয়নে,
নীরবে দাঁড়ায়ে রবে, প্রতিমার প্রায়।
৩৫
ভেবে সে শোকের মুখ
বিদরে আমার বুক,
মরিতে পারিনে তাই আপনার হাতে;
বেঁধে মারে, কত সয়!
জীবন যন্ত্রণাময়
ছার্খার্ চুর্মার্ বিনি বজ্রপাতে।
অন্তরাত্মা জর জর,
জীর্ণারণ্য চরাচর,
কুসুমকানন-মন বিজন শ্মশান;
কি করিব, কোথা যাব,
কোথা গেলে দেখা পাব,
হৃদি-কমল-বাসিনী কোথা রে আমার;
কোথা সে প্রাণের আলো,
পূর্ণিমা-চন্দ্রিমাজাল,
কোথা সেই সুধামাখা সহাস বয়ান!
কোথা গেলে সঞ্জীবনী!
মণি-হারা মহাখনি
অহো, সেই হৃদিরাজ্য কি ঘোর আঁধার!
তুমি তো পাষাণ নও,
দেখে কোন্ প্রাণে সও,
অয়ি, সুপ্রসন্ন হও কাতর পাগলে!
|