সারদামঙ্গল
"সঙ্গম বিরহবিকল্পে বরমিহ বিরহো ন সঙ্গমস্তস্যাঃ
সঙ্গে সৈব তথৈকা ত্রিভুবনমপি তন্ময়ং বিরহে।"


উপহার
প্রথম সর্গ | দ্বিতীয় সর্গ | তৃতীয় সর্গ | চতুর্থ সর্গ | পঞ্চম সর্গ


         পঞ্চম সর্গ
            গীতি
[রাগিণী বেহাগ,
তাল কাওয়ালী]
 
      মধুর রজনী,
      মধুর ধরণী,
মধুর, চন্দ্রমা, মধুর সমীর!
      ভাগীরথী-বুকে
      ভাসি ভাসি সুখে
চলে ফুলময়ী তরী ধীর ধীর!
      আলুথালু কেশ,
      আলুথালু বেশ,
ঘুমায় কামিনী রূপসী রুচির!
      অপরূপ হাস
      আননে বিকাশ,
অধরপল্লব অলপ অধীর!
      না জানি কেমন
      দেখিছে স্বপন
মধুর
মধুরমুরতি মদির!

           ১
      বেলা ঠিক দ্বিপ্রহর!
      দিনকর খরতর,
নিঝুম নীরব সব
গিরি, তরু, লতা।
      কপোতী সুদূর বনে
      ঘুঘু
ঘু করুণ স্বনে
কাঁদিয়ে বলিছে যেন শোকের বারতা।

            ২
      তৃষায় ফাটিছে ছাতি,
      জল খুঁজে পাতি পাতি
বেড়ায় মহিষযূথ চারি দিকে ফিরে।
      এলায়ে পড়িছে গা,
      লটপট করে পা,
ধুঁকিয়ে হরিণগুলি চলে ধীরে ধীরে।

          ৩
      কিবে স্নিগ্ধ দরশন,
      তরুরাজি ঘন ঘন,
অতল পাতালপুরী নিবিড় গহন!
      যত দূর যায় দেখা
      ঢেকে আছে উপত্যকা,
গভীর গম্ভীর স্থির মেঘের মতন।
    
              ৪
      কায়াহীন মহাছায়া
      বিশ্ব-বিমোহিনী মায়া
মেঘে শশীঢাকা রাকা-রজনীরূপিণী,
      অসীম কানন-তল
      ব্যেপে আছে অবিরল;
উপরে উজলে ভানু, ভূতলে যামিনী।

           ৫
      ঘোর্ ঘোর্ সমুদয়,
      কি এক রহস্যময়,
শান্তি, তৃপ্তিময়, ভুলায় নয়ন;
      অনন্ত বরষাকালে
      অনন্ত জলদজালে
লুকায়ে রেখেছে যেন জ্বলন্ত তপন।

          ৬
      পত্র-রন্ধ্র ধরি ধরি
      কিরণের ঝারা ঝরি
মাণিক ছড়িয়ে যেন পড়েছে কাননে,
      চিকন শাদ্বল দলে
      দীপ্ দীপ্ কোরে জ্বলে
তারকা ছড়ান যেন বিমল গগনে


          ৭
      নভ-চুম্বী শৃঙ্গবরে
      ও কি দপ্ দপ্ করে!
কুঞ্জে কুঞ্জে দাবানল হইল আকুল;
      তরু থেকে তরুপরে,
      বন হতে বনান্তরে
ছুটে, যেন ফুটে ওঠে শিমুলের ফুল

      রাশি রাশি শিমুলের ফুল।

           ৮
      অর্চ্চিপুঞ্জ লক লক,
      ভ্বক ভ্বক, ধ্বক ধ্বক,
দাউ দাউ ধুধু ধুধু, ধায় দশ দিকে;
      ঝল্কা ঝল্কা হল্কা ছোটে,
      বোঁবোঁ বোঁবোঁ চর্ক্কি লোটে,
মাতাল ছুটেছে যেন মনের বেটিকে।

               ৯
      দেখিতে দেখিতে দেখ
      কেবল অনল এক,
এক মাত্র মহাশিখা ওঠে নিরবধি;
      আগ্নেয় শিখর ’পরে
      যেন ওঠে বেগভরে
ভীষণ গগন-মুখী আগুনের নদী।

            ১০
      দিগঙ্গনাগণ যেন
      আতঙ্কে আড়ষ্ট হেন,
অটল প্রশান্ত গিরি বিভ্রান্ত উদাস;
      চতুর্দ্দিকে লম্ফে ঝম্পে,
      মত্ত যেন রণদম্ফে
তোল্‌পাড় কোরে ধায় দারুণ বাতাস

উঃ! কি আগুন-মাখা দারুণ বাতাস!

             ১১
      ত্রিলোকতারিণী গঙ্গে,
      তরল তরঙ্গ রঙ্গে
এ বিচিত্র উপত্যকা আলো করি করি,
      চলেছে মা মহোল্লাসে!
      তোমারি পুলিনে হাসে,
সুদূর সে কলিকাতা আনন্দ-নগরী।

            ১২
      আহা, স্নেহ-মাখা নাম,
      আনন্দ
আনন্দধাম,
প্রিয় জন্মভূমি তুমি কোথায় এখন!
      এ বিজন গিরি-দেশে
      প্রকৃত প্রশান্ত বেশে
যতই সান্ত্বনা করে, কেঁদে ওঠে মন;

কেন মা! আমার তত কেঁদে ওঠে মন!

            ১৩
      হে সারদে দাও দেখা!
      বাঁচিতে পারি নে একা,
কাতর হয়েছে প্রাণ, কাতর হৃদয়;
      কি বলেছি অভিমানে
      শুনো না শুনো না কানে,
বেদনা দিও না প্রাণে ব্যথার সময়!

              ১৪
     অহ, অহ, ওহো, ওহো,
     কি মহান্ সমারোহ!
ঘোর-ঘটা মহাছটা কেমন উদার!
     নিসর্গ মহান্ মূর্ত্তি
     চতুর্দ্দিকে পায় স্ফুর্ত্তি,
চতুর্দ্দিকে যেন মহাসমুদ্র অপার।

            ১৫
      অনন্ত তরঙ্গ-মালা
      করিতে করিতে খেলা
কোথায় চলিয়া গেছে, চলে না নজর;
      দৃষ্টিপথ-প্রান্তভাগে
      ময়ায় মিশিয়া জাগে
উদার পরার্থরাজি সাজি থরে থর।

            ১৬
      উদার-উদারতর
      দাঁড়ায়ে শিখর-পর
এই যে হৃদয়-রাণী ত্রিদিব-সুষমা!
      এ নিসর্গ-রঙ্গভূমি,
      মনোরমা নটী তুমি,
শোভার সাগরে এক শোভা নিরুপমা।

            ১৭
       আননে বচন নাই,
       নয়নে পলক নাই,
কান নাই মন নাই আমার কথায়;
       মুখখানি হাসহাস,
       আলুথালু বেশ বাস
আলুথালু কেশপাশ বাতাসে লুটায়।


            ১৮
      না জানি কি অভিনব
      খুলিয়ে গিয়েছে ভব
আজি ও বিহ্বল মত্ত প্রফুল্ল নয়নে!
      আদরিণী, পাগলিনী,
      এ নহে শশি-যামিনী;
ঘুমাইয়ে একাকিনী কি দেখ স্বপনে!

           ১৯
     আহা কি ফুটিল হাসি!
     বড় আমি ভালবাসি
ওই হাসিমুখখানি প্রেয়সী তোমার,
     বিষাদের আবরণে
     বিমুক্ত ও চন্দ্রাননে
দেখিবার আশা আর ছিল না আমার!
     দরিদ্র ইন্দ্রত্ব লাভে
     কতটুকু সুখ পাবে,
আমার সুখের সিন্ধু অনন্ত উদার;

কবির সুখের সিন্ধু অনন্ত উদার!

             ২০
    ও বিধু-বদন-হাসি
    গোলাপ-কুসুম-রাশি,
ফুটে আছে যে জনার নেশার নয়নে;
     সে যেন কি হয়ে যায়,
     সে যেন কি নিধি পায়,
বিহ্বল পাগল প্রায়, বেড়ায় কি বোকে বোকে আপনার মনে,
     এস বোন, এস ভাই
     হেসে খেলে চ’লে যাই
আনন্দে আনন্দ করি আনন্দ-কাননে!
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে!

            ২১
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে!
      হে প্রশান্ত গিরি-ভূমি,
      জীবন জুড়ালে তুমি
জীবন্ত করিয়ে মম জীবনের ধনে!
এমন আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে!

             ২২
     প্রিয়ে সঞ্জীবনী লতা,
     কত যে পেয়েছি ব্যথা
হেরে সে বিষাদময়ী মূরতি তোমার!
     হেরে কত দুঃস্বপন
     পাগল হয়েছে মন,
কতই কেঁদেছি আমি কোরে হাহাকার!

             ২৩
     আজি সে সকলি মম
     মায়ার লহরী সম
আনন্দ-সাগর-মাঝে খেলিয়া বেড়ায়।
     দাঁড়াও হৃদয়েশ্বরী,
     ত্রিভুবন আলো করি,
দু নয়ন ভরি ভরি দেখিব তোমায়!

             ২৪
     দেখিয়ে মেটে না সাধ
     কি জানি কি আছে স্বাদ,
কি জানি কি মাথা আছে ও শুভ আননে!
     কি এক বিমল ভাতি,
     প্রভাত করেছে রাতি;
হাসিছে অমরাবতী নয়ন-কিরণে!

             ২৫
     এমন সাধের ধনে
     প্রতিবাদী জনে জনে,
দয়া মায়া নাই মনে, কেমন কঠোর!
     আদরে গেঁথেছে বালা
     হৃদয়-কুসুম-মালা,
কৃপাণে কাটিবে কে রে সেই ফুলডোর!

             ২৬
     পুন কেন অশ্রুজল!
     বহ তুমি অবিরল!
চরণ-কমল আহা ধুয়াও দেবীর!
     মানস-সরসী-কোলে
     সোণার নলিনী দোলে,
আনিয়ে পরাও গলে সমীর সুধীর!

      বিহঙ্গম! খুলে প্রাণ
      ধর রে পঞ্চম তান!
সারদা-মঙ্গল গান গাও কুতূহলে!
 
      ইতি

               শান্তি
                  গীতি
   [রাগিণী সিন্ধু-ভৈরবী,-তাল ঠুংরি]
 
প্রিয়ে,    কি মধুর মনোহর মূরতি তোমার!
            সদা যেন হাসিতেছে আলয় আমার!
                  সদা যেন ঘরে ঘরে
                  কমলা বিরাজ করে,
            ঘরে ঘরে দেববীণা বাজে সারদার!
                 ধাইয়ে হরষ-ভরে
                 কল কোলাহল করে,
            হাসে খেলে চারি দিকে কুমারী কুমার!
                 হয়ে কত জ্বালাতন
                 করি অন্ন আহরণ,
           ঘরে এলে উলে যায় হৃদয়ের ভার!
                 মরুময় ধরাতল,
                 তুমি শুভ্র শতদল,
           করিতেছ ঢলঢল সমূখে আমার!
                ক্ষুধা তৃষা দূরে রাখি,
                ভোর হ’য়ে ব’সে থাকি,
           নয়ন পরাণ ভোরে দেখি অনিবার!

                তোমায়, দেখি অনিবার।
                তুমি লক্ষ্মী-সরস্বতী,
                আমি ব্রহ্মাণ্ডের পতি,
          হোগ্‌গে এ বসুমতী যায় খুসি তার!