জীবনস্মৃতি গ্রন্থ পরিচয়
গ্রন্থ পরিচিতি
রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড (বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক মুদ্রণানুসারে)


 [আগের পাঠ] [পরের পাঠ]

    'সাহিত্যের সঙ্গী' পরিচ্ছেদে ৩৪৩ পৃষ্ঠায় 'বউঠাকুরানী'র বিহারীলালকে একখানি আসন দিবার কথা উল্লিখিত হইয়াছে। সেই প্রসঙ্গে বিহারীলালের গ্রন্থাবলী হইতে 'সাধের আসন' কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা অংশ নিম্নে উদ্‌ধৃত হইল:
    'কোনো সম্ভ্রান্ত সীমন্তিনী আমার 'সারদামঙ্গল' পাঠে সন্তুষ্ট হইয়া চারি মাস যাবৎ স্বহস্তে বুনিয়া একখানি উৎকৃষ্ট আসন আমাকে উপহার দেন। এই আসনের নাম 'সাধের আসন'। সাধের আসনে অতি সুন্দর সুন্দর অক্ষর বুনিয়া 'সারদামঙ্গল' হইতে এই শ্লোকার্ধ উদ্‌ধৃত করা হইয়াছে
হে যোগেন্দ্র! যোগাসনে
                  ঢুলু ঢুলু দুনয়নে
            বিভোর বিহ্বল মনে কাহারে ধেয়াও? [সারদামঙ্গল, প্রথম সর্গে ১৮শ শ্লোক দ্রষ্টব্য]
    প্রদানকালে আসনদাত্রী উদ্‌ধৃত শ্লোকার্ধের উত্তর চাহেন। আমিও উত্তর লিখিব বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়া আসি এবং বাটিতে আসিয়া তিনটি শ্লোক লিখি। কিছুদিন গত হইলে উত্তর লিখিবার কথা একপ্রকার ভুলিয়া গিয়াছিলাম। সেই আসনদাত্রী দেবী এখন জীবিত নাই! তাঁহার মৃত্যুর পরে উত্তর সাঙ্গ হইয়াছে!! এই ক্ষুদ্র খণ্ড কাব্যের উপহৃত আসনের নামে নাম রহিল
'সাধের আসন।'
    'সাধের আসন' রচনার ইতিহাসটি কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য তাঁহার স্মৃতিকথায় ('পুরাতন প্রসঙ্গ', প্রথম পর্যায়, পৃ ১৭২) এরূপ বর্ণনা করিয়াছেন:
    জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বিহারীর বিশেষ আদর ছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় তাঁহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতেন; দ্বিজেন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার ভ্রাতৃবৎ ভাব ছিল। সে পরিবারের মহিলারাও বিহারীকে বিশেষ শ্রদ্ধা করিতেন। শ্রীযুক্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী তাঁহাকে স্বহস্তরচিত একখানি আসন উপহার দিয়াছিলেন। সে-উপলক্ষে বিহারী 'সাধের আসন' লিখেন।'

সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা ২৫, পৃ ১৯

    'স্বাদেশিকতা' অধ্যায়ের সূচনাংশ প্রথম পাণ্ডুলিপিতে এরূপ আছে:
    'আমাদের পরিবারে শিশুকাল হইতে স্বদেশের জন্য বেদনার মধ্যে আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। আমাদের পরিবারে বিদেশী প্রথার কতকগুলি বাহ্য অনুকরণ অনেক দিন হইতে প্রবেশ করিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু আমাদের পরিবারের হৃদয়ের মধ্যে অকৃত্রিম স্বদেশানুরাগ সাগ্নিকের পবিত্র অগ্নির মতো বহুকাল হইতে রক্ষিত হইয়া আসিতেছে। আমাদের পিতৃদেব যখন স্বদেশের প্রচলিত পূজাবিধি পরিত্যাগ করিয়াছিলেন তখনো তিনি স্বদেশী শাস্ত্রকে ত্যাগ করেন নাই ও স্বদেশী সমাজকে দৃঢ়ভাবে আশ্রয় করিয়া ছিলেন। আমার পিতামহ এবং ছোটোকাকা মহাশয় বিলাতের সমাজে বর্ষযাপন করিয়া ইংরাজের বেশ পরিয়া আসেন নাই, এই দৃষ্টান্ত আমাদের পরিবারের মধ্যে সজীব হইয়া আছে। বড়দাদা বাল্যকাল হইতে আন্তরিক অনুরাগের সহিত মাতৃভাষাকে জ্ঞান ও ভাব সম্পদে ঐশ্বর্যবান করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছেন। মেজদাদা বিলাতে গিয়া সিভিলিয়ান হইয়া আসিয়াছেন কিন্তু তাঁহার ভাবপ্রকাশের ভাষা বাংলাই রহিয়া গেছে। সেজদাদার অকালে মৃত্যু হইয়াছিল, কিন্তু তিনিও নিজের চেষ্টায় ও মেডিকাল কলেজে অধ্যয়ন করিয়া বিজ্ঞানের যে-পরিমাণ চর্চা করিয়াছিলেন তাহা বাংলাভাষায় প্রকাশ করিবার জন্য বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। জ্যোতিদাদাও তরুণবয়স হইতে অবিশ্রাম বঙ্গভাষার পুষ্টিসাধন করিয়া আসিতেছেন। আমাদের পরিবারে পিতৃদেবকে ইংরাজি পত্র লেখা একেবারে নিষিদ্ধ। শুনিয়াছি নূতন আত্মীয়তাপাশেবদ্ধ কেহ তাঁহাকে একবার ইংরাজি পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহা ফেরত আসিয়াছিল। আমরা আপনা-আপনির মধ্যে কেহ কাহাকে এবং পারৎপক্ষে কোনো বাঙালিকে ইংরাজিভাষায় পত্র লিখি না
আমাদের এই আচরণটিকে যে বিশেষভাবে লিপিবব্ধ করিবার যোগ্য বলিয়া জ্ঞান করিলাম, আশা করি, একদা অদূর ভবিষ্যতে তাহা অত্যন্ত অদ্ভুত ও বিস্ময়াবহ বলিয়াই গণ্য হইবে।
    'আমাদের পিতামহ ইংরাজ রাজপুরুষদিগকে বেলগাছির বাগানে নিমন্ত্রণ করিয়া সর্বদা ভোজ দিতেন, এ কথা সকলেই জানেন
কিন্তু শুনিয়াছি তিনি পিতাকে নিষেধ করিয়া গিয়াছিলেন যে, ইংরাজকে যেন খানা দেওয়া না হয়। তাহার পর হইতে ইংরাজের সহিত সংশ্রব আর আমাদের নাই; এবং পিতামহের আমল হইতে আজ পর্যন্ত সরকারের নিকট হইতে খেতাব-লোলুপতার উপসর্গ আমাদের পরিবারে দেখা দেয় নাই।'

    'হিন্দুমেলার উৎপত্তি সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসুর একটি উক্তি উদ্ধারযোগ্য:
    'আমি ইংরাজি ১৮৬৬ সালে
'Prospectus of a Society for the promotion of National Feeling among the Educated Natives of Bengal' আখ্যা দিয়া ইংরাজিতে একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করি। তাহার অনুবাদ 'জাতীয় গৌরবেচ্ছা সঞ্চারিণী সভা সংস্থাপনের প্রস্তাব' নামে এই গ্রন্থে (১২৮৯) সন্নিবিষ্ট হইল।...এই প্রস্তাব দ্বারা উদ্‌বুদ্ধ হইয়া বন্ধবর শ্রীযুক্ত নবগোপাল মিত্র মহাশয় হিন্দুমেলা ও জাতীয় সভা সংস্থাপন করেন।'

বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম খণ্ডের ভূমিকা

    এ বিষয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিতে (পৃ ১২৭-২৮) পাওয়া যায়:
    'এই সময়েই [১৮৬৭] শ্রীযুক্ত নবগোপাল মিত্র মহাশয়ের উদ্‌যোগে ও শ্রীযুক্ত গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের আনুকূল্য ও উৎসাহে 'হিন্দুমেলা' প্রতিষ্ঠিত হইল। শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক মহাশয়েরা হইলেন মেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। শ্রীযুক্ত শিশিরকুমার ঘোষ এবং মনোমোহন বসুও এই মেলায় খুব উৎসাহী ছিলেন এবং হিন্দুমেলাই বঙ্গদেশে, যদি সমগ্র ভারতবর্ষে নাও হয়, সর্বপ্রথম জাতীয় শিল্পপ্রদর্শনীর
(National Industrial Exhibition-এর) পত্তন করিল।'

    'মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর' গ্রন্থে (পৃ ৪৬৯) অজিতকুমার চক্রবর্তী বলেন:
    'গণেন্দ্রঠাকুর এই হিন্দুমেলার সম্পাদক ও নবগোপাল মিত্র সহকারী সম্পাদক হন।... মেলার উৎসাহদাতাদের মধ্যে দুর্গাচরণ লাহা, কৃষ্ণদাস পাল, পণ্ডিত জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন, পণ্ডিত ভারতচন্দ্র শিরোমণি, রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর প্রভৃতির নাম দেখিতে পাওয়া যায়।'
    'হিন্দুমালায় গাছের তলায় দাঁড়াইয়া' যে কবিতা পাঠের উল্লেখ (পৃ ৩৪৯) এই পরিচ্ছেদে আছে উহা হিন্দুমেলায় রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক পঠিত (১৮৭৭) দ্বিতীয় কবিতা। ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে পার্শীবাগানে অনুষ্ঠিত হিন্দুমেলায় তিনি স্বরচিত কবিতা প্রথম পাঠ করেন। জীবনস্মৃতিতে এই কবিতাপাঠের উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ করেন নাই। সেই বৎসরের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখের 'অমৃত বাজার পত্রিকা'য় কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর-সংযুক্ত হইয়া 'হিন্দুমেলায় উপহার' নামে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কবিতাটির সন্ধান সমসাময়িক কোনো পত্রিকায় পাওয়া যায় নাই। এই সম্পর্কে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র-গ্রন্থ-পরিচয় পুস্তিকার পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।

    এই পরিচ্ছেদে 'জ্যোতিদাদার উদ্‌যোগে' স্থাপিত যে-স্বাদেশিকসভার (সঞ্জীবনী সভা) কথা বলা হইয়াছে তাহার বিশদ বিবরণ নিম্নে উদ্‌ধৃত হইল:
    'সভার অধ্যক্ষ ছিলেন বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বসু। কিশোর রবীন্দ্রনাথও এই সভার সভ্য ছিলেন। পরে নবগোপালবাবুকেও সভ্যশ্রেণীভুক্ত করা হইয়াছিল। সভার আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল ভাঙা ছোটো টেবিল একখানি, কয়েকখানি ভাঙা চেয়ার ও আধখানা ছোটো টানাপাখা
তারও আবার এক দিক ঝুলিয়া পড়িয়াছিল।
    'জাতীয় হিতকর ও উন্নতিকর সমস্ত কার্যই এই সভায় অনুষ্ঠিত হইবে, ইহাই সভার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। যেদিন নূতন কোনো সভ্য এই সভায় দীক্ষিত হইতেন সেদিন অধ্যক্ষমহাশয় লাল পট্টবস্ত্র পরিয়া সভায় আসিতেন। সভার নিয়মাবলী অনেকই ছিল, তাহার মধ্যে প্রধান ছিল মন্ত্রগুপ্তি; অর্থাৎ এ সভায় যাহা কথিত হইবে, যাহা কৃত হইবে এবং যাহা শ্রুত হইবে, তাহা অ-সভ্যদের নিকট কখনও প্রকাশ করিবার কাহারও অধিকার ছিল না।
    'আদি-ব্রাহ্মসমাজ পুস্তকাগার হইতে লাল-রেশমে-জড়ানো বেদমন্ত্রের একখানা পুঁথি এই সভায় আনিয়া রাখা হইয়াছিল। টেবিলের দুই পাশে দুইটি মড়ার মাথা থাকিত তাহার দুইটি চক্ষুকোটরে দুইটি মোমবাতি বসানো ছিল। মড়ার মাথাটি মৃত-ভারতের সাংকেতিক চিহ্ন। বাতি দুইটি জ্বালাইবার অর্থ এই যে, মৃত-ভারতে প্রাণসঞ্চার করিতে হইবে ও তাহার জ্ঞানচক্ষু ফুটাইয়া তুলিতে হইবে। এ ব্যাপারের ইহাই মূল কল্পনা। সভার প্রারম্ভে বেদমন্ত্র গীত হইত-সংগচ্চধ্বম্ সংবদধ্বম্। সকলে সমস্বরে এই বেদমন্ত্র গান করার পর তবে সভার কার্য (অর্থাৎ কিনা গল্পগুজব) আরম্ভ হইত। কার্যবিবরণী জ্যোতিবাবুর উদ্‌ভাবিত এক গুপ্তভাষায় লিখিত হইত। এই গুপ্তভাষায় 'সঞ্জীবনী সভা'কে 'হামচুপামূ হাফ্' বলা হইত।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পৃ ১৬৬-৬৭

    'ভারতী' পরিচ্ছেদে 'কবিকাহিনী' কাব্য গ্রন্থাকারে প্রকাশের প্রসঙ্গে প্রথম পাণ্ডুলিপিতে আছে:
    'বঙ্গসাহিত্যে সুপ্রথিতনামা শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন ঘোষ মহাশয় তাঁহার 'বান্ধব' পত্রে এই কাব্য-সমালোচন উপলক্ষ্যে লেখককে উদয়োন্মুখ কবি বলিয়া অভ্যর্থনা করিয়াছিলেন। খ্যাত ব্যক্তির লেখনী হইতে এই আমি প্রথম খ্যাতি লাভ করিয়াছিলাম। ইহার পর ভুদেববাবু এডুকেশন গোজেটে আমার প্রভাতসংগীতের সম্বন্ধে যে অনুকূল মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহাই বোধ করি আমার শেষ লাভ। প্রথম হইতে সাধারণের নিকট হইতে বাহবা পাইয়া আমি যে রচনাকার্যে অগ্রসর হইয়াছি, এ কথা আমি স্বীকার করিতে পারিব না। সন্ধ্যাসংগীত প্রকাশের পর হইতে শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সেন মহাশয়কে আমি উৎসাহদাতা বন্ধুরূপে পাইয়াছিলাম। ইঁহার সহিত নিরন্তর সাহিত্যালোচনায় আমি যথার্থ বললাভ করিয়াছিলাম
ইঁহারই কার্পণ্যহীন উৎসাহ আমার নিজের প্রতি নিজের শ্রদ্ধাকে আশ্রয় দিয়াছিল। কিন্তু আমার রচনার আরম্ভকালে সমালোচক-সম্প্রদায় বা পাঠক-সাধারণের নিকট এ সম্বন্ধে আমি অধিক ঋণী নহি।'

প্রথম পাণ্ডুলিপি

    'আমেদাবাদ' পরিচ্ছেদে শাহিবাগ-লাইব্রেরিতে 'পুরাতন সংস্কৃত কাব্যসংগ্রহগ্রন্থ' পাঠের যে উল্লেখ রহিয়াছে (পৃ ৩৫৭) রবীন্দ্রনাথ-কর্তৃক ব্যবহৃত সেই গ্রন্থখানি বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারে রক্ষিত। উহার নামপত্রের নকল নিম্নে দেওয়া হইল:
‌    কাব্যসংগ্রহঃ। অর্থাৎ। কালিদাসাদি মহাকবিগণ। বিরচিত ত্রিপঞ্চাশৎ। উত্তম সম্পূর্ণ কাব্যানি শ্রীডাক্তার যোহন হেবর্‌লিন কর্তৃক। সমাহৃত-মূদ্রাঙ্কিতানি শ্রীরামপুরীয় চন্দ্রোদয়যন্ত্রে। ১৮৪৭।
    এই গ্রন্থের দুইটি পৃষ্ঠায়, সম্ভবত পরবর্তীকালে, রবীন্দ্রনাথ 'শৃঙ্গারশতক' ও নীতিশতক' হইতে দুইটি শ্লোকের বঙ্গানুবাদ করিয়াছিলেন। দ্রষ্টব্য 'সংস্কৃত শ্লোকদ্বয়ের বঙ্গানুবাদ', প্রবাসী, ফাল্গুন ১৩৪৮, পৃ ৪৯৯।
    এই পরিচ্ছেদে ৩৫৮ পৃষ্ঠায় 'সমস্তদিন ডিক্‌শনারি লইয়া নানা ইংরেজি বই' পড়িবার যে উল্লেখ আছে তাহারই ফলস্বরূপ সেই বৎসরের (১২৮৫) ভারতীতে প্রকাশিত নিম্নলিখিত প্রবন্ধগুলি দ্রষ্টব্য:
            স্যাক্‌সন জাতি ও অ্যাংলো স্যাক্‌সন সাহিত্য-শ্রাবণ ১২৮৫
            বিয়াত্রীচে, দান্তে ও তাঁহার কাব্য-ভাদ্র ১২৮৫
            পিত্রার্কা ও লরা- আশ্বিন ১২৮৫
            গেটে ও তাঁহার প্রণয়িনীগণ-কার্তিক ১২৮৫
            নর্মান জাতি ও অ্যাংলো-নর্মান্ সাহিত্য-ফাল্গুন ১২৮৫

    'বাল্মীকিপ্রতিভা' পরিচ্ছেদে ৩৮১ পৃষ্ঠায় 'বিদ্বজ্জনসমাগম' সাহিত্যসম্মিলনের যে উল্লেখ আছে তাহার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এ স্থলে উদ্‌ধৃত হইল:
    'এই সময়ে জোড়াসাঁকো বাড়িতে জ্যোতিবাবুরা প্রতিবৎসর একটি 'সম্মিলনী' আহ্বান করিতেন। উদ্দেশ্য-সাহিত্যসেবীদের মধ্যে যাহাতে পরস্পর আপালপরিচয় ও তাঁহাদের মধ্যে সদ্‌ভাব বর্ধিত হয়।... শ্রীযুক্ত আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ মহাশয় এই সম্মিলনের নামকরণ করিয়া দিয়াছিলেন
'বিদ্বজ্জনসমাগম'। এই সমাগমে তখন বঙ্কিমচন্দ্র, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, চন্দ্রনাথ বসু, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, কবি রাজকৃষ্ণ রায় প্রভৃতি লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যসেবীগণকে নিমন্ত্রণ করা হইত। এই উপলক্ষ্যে অনেক রচনা এবং কবিতাদিও পঠিত হইত, গীতবাদ্যের আয়োজন থাকিত, নাট্যাভিনয় প্রদর্শিত হইত এবং সর্বশেষে সকলের একত্র প্রীতিভোজনে এই সাহিত্য-মহোৎসবের পরিসমাপ্তি হইত।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পৃ ১৫৭-৫৮

    'ভারত-সংস্কারক' সংবাদপত্রের ২৪ এপ্রিল ১৮৭৪ (১২ বৈশাখ ১২৮১ শুক্রবার) সংখ্যায় সেই সভার প্রথম অধিবেশনের নিম্নরূপ বিবরণ পাওয়া যায়:
    'আমরা গত সপ্তাহে...যে একটি বিজ্ঞাপন দিয়াছিলাম, গত শনিবার রাত্রে [৬ বৈশাখ] তাহা কার্যে পরিণত দেখিয়া আনন্দিত হইয়াছি। বাবু দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সিবিলিয়ান বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে বাংলা গ্রন্থকার ও সংবাদপত্রের সম্পাদকদিগের অনেকে তাঁহাদিগের জোড়াসাঁকোর ভবনে সমবেত হন। অন্যান্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তির মধ্যে আমরা এই কয় ব্যক্তিকে দর্শন করিলাম
রেবরণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যো, বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বাবু রাজনারায়ণ বসু, বাবু প্যারীচরণ সরকার, বাবু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যো। সর্বসুদ্ধ ন্যূনাধিক ১০০ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। নিমন্ত্রয়িতা মহাত্মারা ভদ্রোচিত অভ্যর্থনার ত্রুটি করেন নাই। সভাস্থলে একটি যুবা প্রথমে বাবু হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দীপনী কবিতামালা উচ্চ গম্ভীর স্বরে ও উপযুক্ত ভাবভঙ্গীর সহিত অনর্গল আবৃত্তি করিলেন, তাহাতে আসর বেশ গরম হইয়া উঠিল। আমরা বহুদিন বিস্মৃত একটি জাতীয় ভাব অনুভব করিলাম, এবং ইংরাজাধীনে বা স্বাধীনরাজ্যে বাস করিতেছি বোধগম্য করিতে পারিলাম না। পরে কবিরত্ন [প্যারীমোহন] মৃত অনরেবল দ্বারকানাথ মিত্রের গুণ ব্যাখ্যাপূর্বক একটি সংগীত করিয়া শ্রোতৃবর্গকে বিমোহিত করিলেন। তিনি তৎপরে স্বকৃত আর-একটি শ্রুতিমধুর গান করিলেন, তাহাতে বিলাতি দ্রব্যের সহিত এ দেশীয় দ্রব্যের বিনিময়ে ভারতের সর্বনাশ হইল বলিয়া ইংলণ্ডেশ্বরীর নিকট ক্রন্দন করা হইতেছে। অতঃপর ঠাকুর পরিবারের ছোটো ছোটো কয়েকটি বালকবালিকা চৌতাল প্রভৃতি তালে তানলয়বিশুদ্ধ সংগীত করিয়া সভাস্থবর্গকে চমৎকৃত করিল।... পরে জ্যোতিরিন্দ্রবাবু এক অঙ্ক নাটক [পুরু-বিক্রম নাটক, তৃতীয় অঙ্ক, প্রথম গর্ভাঙ্ক।] পাঠ করিলেন, তাহাতে পুরুরাজা যবনশত্রু নিপাত করিবার জন্য সৈন্যদলকে উত্তেজিত করিতেছেন এবং সৈন্যদল তাঁহার বাক্যের প্রতিধ্বনি করিয়া বীরমদে মাতিতেছে। তদনন্তর দ্বিজেন্দ্রবাবু স্বরচিত 'স্বপ্ন' বিষয়ক একটি সুন্দর কবিতা [স্বপ্নপ্রয়াণ, প্রথম সর্গ] পাঠ করিলে শিশুরা সংগীত করিতে লাগিল এবং পান, গোলাপের তোড়া, পুষ্পমালা প্রভৃতি দ্বারা নিমন্ত্রিতগণের প্রতি সমাদর প্রদর্শনপূর্বক সভাকার্য শেষ হইল।'

-'সেকালের কথা', ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪০, পৃ ১৭০-৭১