জীবনস্মৃতি গ্রন্থ পরিচয়
গ্রন্থ পরিচিতি
রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড
(বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক মুদ্রণানুসারে)
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বাল্মীকিপ্রতিভা
যেদিন সাধারণের সমক্ষে প্রথম অভিনীত হয় সেদিন দর্শকের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র, গুরুদাস
বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজকৃষ্ণ রায় উপস্থিত ছিলেন। অভিনয়দর্শনে মুগ্ধ হইয়া রাজকৃষ্ণ রায়
‘বালিকা-প্রতিভা’ নামে যে কবিতাটি লেখেন (‘অবসরসরোজিনী’ গ্রন্থে সংকলিত) সেই কবিতার
পাদটীকায় অভিনয়ের সঠিক তারিখ জানা যায়-১৬ ফাল্গুন ১২৮৭ শনিবার।
[তথ্য শ্রীসুকুমার সেনের সৌজন্যে প্রাপ্ত]
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-প্রণীত 'বাল্মীকির জয়' গ্রন্থের সমালোচনা-প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র
এই অভিনয়ের উল্লেখ করিয়া লিখিয়াছিলেন:
'যাহারা বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বাল্মীকি-প্রতিভা' পড়িয়াছেন বা তাহার অভিনয়
দেখিয়াছেন তাঁহারা কবিতার জন্মবৃত্তান্ত কখনো ভুলিতে পারিবেন না। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
এই পরিচ্ছেদে ['বাল্মীকির জয়' গ্রন্থে যে স্থলে বাল্মীকি কবি হইলেন] রবীন্দ্রনাথবাবুর অনুগমন করিয়াছেন।’
―বঙ্গদর্শন, আশ্বিন ১২৮৮
বাল্মীকিপ্রতিভার এই প্রথম অভিনয়-দর্শনে স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নিম্নের
কবিতাটি রচনা করেন:
উঠ বঙ্গভূমি, মাতঃ, ঘুমায়ে থেকো না আর,
অজ্ঞানতিমিরে তব সুপ্রভাত হল হেরো।
উঠেছে নবীন রবি, নব জগতের ছবি,
নব 'বাল্মীকি-প্রতিভা' দেখাইতে পুনর্বার।
হেরো তাহে প্রাণ ভ'রে, সুখতৃষ্ণা যাবে দূরে,
ঘুচিবে মনের ভ্রান্তি, পাবে শান্তি অনিবার।
'মণিময় ধুলিরাশি' খোঁজ যাহা দিবানিশি,
ও ভাবে মজিলে
মন খুঁজিতে চাবে না আর॥
রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশদ্বর্ষপূর্তি উৎসবে টাউনহলে 'কবিসম্বর্দ্ধনা' সভায় (১৪ মাঘ
১৩১৮) কবিতাটি গুরুদাসবাবু নিজে পাঠ করিয়াছিলেন।
'গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ’ পরিচ্ছেদে উল্লিখিত দ্বিতীয় বার বিলাত-যাত্রার প্রস্তাব
সম্পর্কে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নিম্নোদ্ধৃত পত্রখানি প্রণিধানযোগ্য:
প্রাণাধিক রবি―
আগামী সেপ্টেম্বর মাসে ইংলণ্ডে যাওয়া স্থির করিয়াছ এবং লিখিয়াছ যে, আমি 'বারিস্টার
হইব'। তোমার এই কথার উপরে এবং তোমার শুভবুদ্ধির উপরে নির্ভর করিয়া তোমাকে ইংলণ্ডে
যাইতে অনুমতি দিলাম। তুমি সৎপথে থাকিয়া কৃতকার্য হইয়া দেশেতে যথাসময়ে ফিরিয়া আসিব,
এই আশা অবলম্বন করিয়া থাকিলাম। সত্যেন্দ্র পাঠাবস্থাতে যতদিন ইংলণ্ডে ছিলেন
ততদিন... টাকা করিয়া প্রতি মাসে পাইতেন। তোমার জন্য মাসে...টাকা নির্ধারিত করিয়া
দিলাম। ইহাতে যত পাউণ্ড হয় তাহাতেই তথাকার তোমার যাবদীয় খরচ নির্বাহ করিয়া লইবে।
বারে প্রবেশের ফী এবং বার্ষিক চেম্বার ফী আবশ্যকমতে পাইবে। তুমি এবার ইংলণ্ডে গেলে
প্রতিমাসে ন্যূনকল্পে একখানা করিয়া আমাকে পত্র লিখিবে। তোমার থাকার জন্য ও পড়ার
জন্য সেখানে যাইয়া যেমন যেমন ব্যবস্থা করিবে তাহার বিবরণ আমাকে লিখিবে। গতবারে
সত্যেন্দ্র তোমার সঙ্গে ছিলেন, এবারে মনে করিবে আমি তোমার সঙ্গে আছি। ইতি ৮ ভাদ্র
৫১। [৫১ ব্রাহ্ম সংবৎ, বাংলা ১২৩৬ সাল হইতে গণনারম্ভ।]
―পত্রসংখ্যা ১৩৬, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী, প্রিয়নাথ শাস্ত্রী-প্রকাশিত
'গঙ্গাতীর' পরিচ্ছেদের সূচনাংশের পাঠ প্রথম পাণ্ডুলিপিতে এরূপ দেখা যায়:
'আরও তো অনেক জায়গায় ঘুরিয়াছি―
ভালো জিনিস, প্রশংসার জিনিস অনেক দেখিয়াছি, কিন্তু
সেখানে তো আমার এই মা'র মতো আমাকে কেহ অন্ন পরিবেশন করে নাই। আমার কড়ি যে হাটে চলে
না সেখানে কেবল সকল জিনিসে চোখ বুলাইয়া ঘুরিয়া দিনযাপন করিয়া কী করিব! যে বিলাতে
যাইতেছিলাম সেখানকার জীবনের উদ্দীপনাকে কোনোমতেই আমার হৃদয় গ্রহণ করিতে পারে নাই।
আমি আর-একবার বিলাতে যাইবার সময় পত্রে লিখিয়াছিলাম―
'নিচেকার ডেকে বিদ্যুতের প্রখর আলোক, আমোদপ্রমোদের উচ্ছ্বাস, মেলামেশার ধুম,
গানবাজনা এবং কখনো কখনো ঘূর্ণীনৃত্যের উৎকট উন্মত্ততা। এদিকে আকাশের পূর্বপ্রান্তে
ধীরে ধীরে চন্দ্র উঠছে, তারাগুলি ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে, সমুদ্র প্রশান্ত ও বাতাস
মৃদু হয়ে এসেছে; অপার সমুদ্রতল থেকে অসীম নক্ষত্রলোক পর্যন্ত এক অখণ্ড নিস্তব্ধতা,
এক অনির্বচনীয় শান্তি নীরব উপাসনার মতো ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। আমার মনে হতে লাগল,
যথার্থ সুখ কাকে বলে এরা ঠিক জানে না। সুখকে চাবকে চাবকে যতক্ষণ মত্ততার সীমায় না
নিয়ে যেতে পারে ততক্ষণ এদের যথেষ্ঠ হয় না। প্রচণ্ড জীবন ওদের যেন অভিশাপের মতো
নিশিদিন তাড়া করেছে; ওরা একটা মস্ত লোহার রেলগাড়ির মতো চোখ রাঙিয়ে, পৃথিবী কাঁপিয়ে,
হাঁপিয়ে, ধুঁইয়ে, জ্ব’লে, ছুটে প্রকৃতির দুই ধারের সৌন্দর্যের মাঝখান দিয়ে হুস্ করে
বেরিয়ে চলে যায়। কর্ম ব'লে একটা জিনিস আছে বটে কিন্তু তারই কাছে আমাদের মানবজীবনের
সমস্ত স্বাধীনতা বিকিয়ে দেবার জন্যেই আমরা জন্মগ্রহণ করি নি―সৌন্দর্য
আছে, আমাদের অন্তঃকরণ আছে, সে দুটো খুব উঁচু জিনিস।'
'আমি বৈলাতিক কর্মশীলতার বিরুদ্ধে উপদেশ দিতেছি না। আমি নিজের কথা বলিতেছি। আমার
পক্ষে বাংলাদেশের এই আকাশভরা আলো, এই দক্ষিণের বাতাস, এই গঙ্গার প্রবাহ, এই রাজকীয়
আলস্য, এই আকাশের নীল ও পৃথিবীর সবুজের মাঝখানকার দিগন্তপ্রসারিত উদার অবকাশের
মধ্যে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ তৃষ্ণার জল ও ক্ষুধার অন্নের মতোই আবশ্যক ছিল। যদিও খুব
বেশিদিনের কথা নহে তবু ইতিমধ্যে সময়ের অনেক পরিবর্তন হইয়া গেছে। আমাদের
তরুচ্ছায়াপ্রচ্ছন্ন গঙ্গাতটের নীড়গুলির মধ্যে কলকারখানা ঊর্ধ্বফণা সাপের মতো প্রবেশ
করিয়া সোঁ সোঁ শব্দে কালো নিশ্বাস ফুঁসিতেছে। এখন খর মধ্যাহ্নে আমাদের মনের মধ্যেও
বাংলাদেশের স্নিগ্ধচ্ছায়া খর্বতম হইয়া আসিয়াছে―
এখন দেশে কোথাও অবসর নাই। হয়তো সে
ভালোই―
কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ভালো এমন কথাও জোর করিয়া বলিবার সময় হয় নাই।
‘বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিবার পরবর্তী জীবন সম্বন্ধে আর-একখানি পুরাতন চিঠি হইতে'
উদ্ধৃত করিয়া দিই―
'যৌবনের আরম্ভ-সময়ে বাংলাদেশে ফিরে এলেম। সেই ছাদ, সেই চাঁদ, সেই দক্ষিণে বাতাস,
সেই নিজের মনের বিজন স্বপ্ন, সেই ধীরে ধীরে ক্রমে ক্রমে চারি দিক থেকে প্রসারিত
সহস্র বন্ধন, সেই সুদীর্ঘ অবসর, কর্মহীন কল্পনা, আপন মনে সৌন্দর্যের মরীচিকা রচনা,
নিষ্ফল দুরাশা, অন্তরের নিগূঢ় বেদনা, আত্মপীড়ক অলস কবিত্ব―
এই সমস্ত নাগপাশের দ্বারা
জড়িত বেষ্টিত হয়ে চুপ করে পড়ে আছি। আজ আমার চার দিকে নবজীবনের প্রবলতা ও চঞ্চলতা
দেখে মনে হচ্ছে, আমারও হয়তো এরকম হতে পারত। কিন্তু আমরা সেই বহুকাল পূর্বে
জন্মেছিলেম―তিনজন বালক―তখন পৃথিবী আর-একরকম ছিল। এখনকার চেয়ে অনেক বেশি অশিক্ষিত,
সরল অনেক বেশি কাঁচা ছিল। পৃথিবী আজকালকার ছেলের কাছে
Kindergaiten
–এর কর্ত্রীর
মতো―কোনো ভুল খবর দেয় না, পদে পদে সত্যকার শিক্ষাই দেয়―কিন্তু
আমাদের সময়ে সে ছেলে-ভোলাবার গল্প বলত, নানা অদ্ভুত সংস্কার জন্মিয়ে দিত, এবং চারি
দিকের গাছপালা প্রকৃতির মুখশ্রী কোনো এক প্রাচীন বিধাতৃমাতার বৃহৎ রূপকথা রচনারই
মতো বোধ হত, নীতিকথা বা বিজ্ঞানপাঠ বলে ভ্রম হত না।'
'এই উপলক্ষে এখানে আর-একটি চিঠি উদ্ধৃত করিয়া দিব। এ চিঠি অনেকদিন পরে আমার ৩২ বছর
বয়সে গোরাই নদী হইতে লেখা, কিন্তু দেখিতেছি সুর সেই একই রকমের আছে। এই চিঠিগুলিতে
পত্রলেখকের অকৃত্রিম আত্মপরিচয়, অন্তত বিশেষ সময়ের বিশেষ মনের ভাব প্রকাশ পাইবে।
ইহার মধ্যে যে-ভাবটুকু আছে তাহা পাঠকের পক্ষে যদি অহিতকর হয় তবে তাঁহারা সাবধান
হইবেন―এখানে আমি শিক্ষকতা পরিতেছি না।–
"আমি প্রায় রোজই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনো
জন্মগ্রহণ করব। যদি করি আর কি কখনো এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায় এই নিস্তব্ধ গোরাই
নদীটির উপরে বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে...পড়ে থাকতে
পারব। হয়তো আর-কোনো জন্মে এমন একটি সন্ধ্যেবেলা আর কখনো ফিরে পাব না। তখন কোথায়
দৃশ্যপরিবর্তন হবে, আর কিরকম মন নিয়েই বা জন্মাব। এমন সন্ধ্যা হয়তো অনেক পেতেও পারি
কিন্তু সে-সন্ধ্যা এমন নিস্তব্ধভাবে তার সমস্ত কেশপাশ ছাড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের উপর
এত সুগভীর ভালোবাসার সঙ্গে পড়ে থাকবে না।...আশ্চর্য এই, আমার সব চেয়ে ভয় হয় পাছে
আমি য়ুরোপে গিয়ে জন্মগ্রহণ করি। কেননা, সেখানে সমস্ত চিত্তটিকে এমন উপরের দিকে
উদ্ঘাটিত রেখে পড়ে থাকবার জো নেই, এবং পড়ে থাকাও সকলে ভারি দোষের মনে করে। হয়তো
একটা কারখানায় নয়তো ব্যাঙ্কে নয়তো পার্লামেন্টে সমস্ত দেহ মন প্রাণ দিয়ে খাটতে হবে।
শহরের রাস্তা যেমন ব্যাবসাবাণিজ্য গাড়িঘোড়া চলবার জন্যে ইঁটে-বাঁধানো কঠিন, তেমনি
মনটা স্বভাবটা বিজ্নেস্ চালাবার উপযোগী পাকা করে বাঁধানো-তাতে একটি কোমল তৃণ, একটা
অনাবশ্যক লতা গজাবার ছিদ্রটুকু নেই। ভারি ছাঁটাছোঁটা গড়াপেটা আইনে-বাঁধা মজবুত
রকমের ভাব। কী জানি, তার চেয়ে আমার এই কল্পনাপ্রিয় আত্মনিমগ্ন বিস্তৃত-আকাশ-পূর্ণ
মনের ভাবটি কিছুমাত্র অগৌরবের বিষয় বলে মনে হয় না।'
এখনকার কোনো কোনো নূতন মনস্তত্ত্ব পড়িলে আভাস পাওয়া যায় যে একটা মানুষের মধ্যে যেন
অনেকগুলা মানুষ জটলা করিয়া বাস করে, তাহাদের স্বভাব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমার
মধ্যেকার যে অকেজো অদ্ভুত মানুষটা সুদীর্ঘকাল আমার উপরে কর্তৃত্ব করিয়া আসিয়াছে-যে
মানুষটা শিশুকালে বর্ষার মেঘ ঘনাইতে দেখিলে পশ্চিমের ও দক্ষিণের বারান্দাটায় অসংযত
হইয়া ছুটিয়া বেড়াইত, যে-মানুষটা বরাবর ইস্কুল পালাইয়াছে, রাত্রি জাগিয়া ছাদে
ঘুরিয়াছে, আজও বসন্তের হাওয়া বা শরতের রৌদ্র দেখা দিলে যাহার মনটা সমস্ত কাজকর্ম
ফেলিয়া দিয়া পালাই-পালাই করিতে থাকে, তাহারই জবানি কথা এই ক্ষুদ্র জীবনচরিতের মধ্যে
অনেক প্রকাশিত হইবে কিন্তু এ-কথাও বলিয়া রাখিব, আমার মধ্যে অন্য ব্যক্তিও
আছে-যথাসময়ে তাহারও পরিচয় পাওয়া যাইবে।'
―প্রথম পাণ্ডুলিপি
'রাজেন্দ্রলাল মিত্র' পরিচ্ছেদে উল্লিখিত “একটি পরিষৎ [সারস্বত সমাজ] স্থাপন" সম্পর্কে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কলিকাতা সারস্বত সম্মিলন' প্রবন্ধটি (ভারতী জ্যৈষ্ঠ ১২৮৯) এবং মন্মথনাথ ঘোষের 'জ্যোতিরিন্দ্রনাথ' গ্রন্থের 'সারস্বত সমাজ' অংশ (পৃ ১১০-২০) দ্রষ্টব্য। এই সমাজের প্রথম অধিবেশনের রবীন্দ্রনাথ-কর্তৃক-লিখিত প্রতিবেদন১ নিম্নে মুদ্রিত হইল:
সারস্বত-সমাজ
১২৮৯ সালে শ্রাবণ মাসের প্রথম রবিবার ২রা তারিখে দ্বারকানাথ ঠাকুরের গলি ৬ নম্বর
ভবনে সারস্বত সমাজের প্রথম অধিবেশন হয়।
ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্র সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন।
সারস্বত সমাজ স্থাপনের আবশ্যকতা বিষয়ে সভাপতি মহাশয় এক বক্তৃতা দেন। বঙ্গভাষার
সাহায্য করিতে হইলে কী কী কার্যে সমাজের হস্তক্ষেপ করা আবশ্যক হইবে, তাহা তিনি
ব্যাখ্যা করেন। প্রথমত, বানানের উন্নতি সাধন। বাংলা বর্ণমালায় অনাবশ্যক অক্ষর আছে
কিনা এবং শব্দবিশেষ উচ্চারণের জন্য অক্ষরবিশেষ উপযোগী কিনা, এই সমাজের সভ্যগণ তাহা
আলোচনা করিয়া স্থির করিবেন। কাহারো কাহারো মতে আমাদের বর্ণমালায় স্বরের হ্রস্ব
দীর্ঘ ভেদ নাই, এ তর্কটিও আমাদের সমাজের সমালোচ্য। এতদ্ব্যতীত ঐতিহাসিক অথবা
ভৌগোলিক নামসকল বাংলায় কিরূপে বানান করিতে [হইবে তাহা] স্থির করা আবশ্যক। আমাদের
সম্রাজ্ঞীর নামকে অনেকে ‘ভিক্টো [রিয়া’ বানান] করিয়া থাকেন, অথচ ইংরাজি
V
অক্ষরের
স্থলে অন্ত্যস্থ ‘ব’ সহজেই হইতে পারে। ইংরাজি পারিভাষিক শব্দের অনুবাদ লইয়া বাংলায়
বিস্তর [গোল] যোগ ঘটিয়া থাকে-এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া সমাজের কর্তব্য।
দৃষ্টান্তস্বরূপে উল্লেখ করা যায়-ইংরাজি isthmus
শব্দ কেহ বা 'ডমরু-মধ্য' কেহ বা
'যোজক' বলিয়া অনুবাদ করেন, উহাদের মধ্যে কোনোটাই হয়তো সার্থক হয় নাই।―অতএব এই-সকল
শব্দ নির্বাচন বা উদ্ভাবন করা সমাজের প্রধান কার্য। উপসংহারে সভাপতি কহিলেন―এই-সকল
এবং এই শ্রেণীর অন্যান্য নানাবিধ সমালোচ্য বিষয় সমাজে উপস্থিত হইবে―যদি সভ্যগণ মনের
সহিত অধ্যবসায় সহকারে সমাজের কার্যে নিযুক্ত থাকেন তাহা হইলে নিশ্চয়ই সমাজের
উদ্দেশ্য সাধিত হইবে।
পরে সভাপতিমহাশয় সমাজের নিয়মাবলী পর্যালোচনা করিবার জন্য সভায়
প্রস্তাব করেন―
স্থির হইল, বিদ্যার উন্নতি সাধন করাই এই সমাজের উদ্দেশ্য।
তৎপরে তিন চারিটি নামের মধ্য হইতে অধিকাংশ উপস্থিত সভ্যের সম্মতিক্রমে সভার নাম
স্থির হইল-সারস্বত সমাজ।
সমাজের দ্বিতীয় নিয়ম নিম্নলিখিত মতে পরিবর্তিত হইল-
যাঁহারা বঙ্গসাহিত্যে খ্যাতিলাভ করিয়াছেন এবং যাঁহারা বাংলাভাষার উন্নতি সাধনে
বিশেষ অনুরাগী, তাঁহারাই এই সমাজের সভ্য হইতে পারিবেন।
সমাজের তৃতীয় নিয়ম কাটা হইল।
[সমাজের] চতুর্থ নিয়ম নিম্নলিখিতমতে রূপান্তরিত হইল-
সমাজের মাসিক অধিবেশনে উপস্থিত সভ্যের মধ্যে অধিকাংশের ঐক্যমতে [নূ]তন সভ্য গৃহীত
হইবেন। সভ্যগ্রহণকার্যে গোপনে সভাপতিকে মত জ্ঞাত করা হইবেক।
সমাজের চতুর্বিংশ নিয়ম নিম্নলিখিত মতে রূপান্তরিত হইল-
সভ্যদিগকে বার্ষিক ৬ টাকা আগামী চাঁদা দিতে হইবেক। যে-সভ্য এককালে ১০০ টাকা দিবেন
তাঁহাকে ওই বার্ষিক চাঁদা হইবেক না।
অধিকাংশ উপস্থিত সভ্যের সম্মতিক্রমে বর্তমান বর্ষের জন্য
নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ সমাজের কর্মচারীরূপে নির্বাচিত হইলেন―
সভাপতি―
ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্র।
সহযোগী সভাপতি। শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ডাক্তার শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর।
শ্রীদ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সম্পাদক। শ্রীকৃষ্ণবিহারী সেন। শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সভাপতিকে ধন্যবাদ দিয়া সভাভঙ্গ হইল।
―রবীন্দ্রসদনের পাণ্ডুলিপি হইতে