জীবনস্মৃতি গ্রন্থ পরিচয়
গ্রন্থ পরিচিতি
রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড
(বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক মুদ্রণানুসারে)
'মৃত্যুশোক' পরিচ্ছেদে মাতার মৃত্যুর যে স্মৃতিচিত্র রবীন্দ্রনাথ আঁকিয়াছেন তাহার
পরিপূরকরূপে সৌদামিনীদেবীর 'পিতৃস্মৃতি' হইতে সংকলিত হইল:
'যে ব্রাহ্মমুহূর্তে মাতার মৃত্যু হইয়াছিল পিতা তাহার পূর্বদিন সন্ধ্যার সময় হিমালয়
হইতে বাড়ি ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। তাহার পূর্বে মা ক্ষণে ক্ষণে চেতনা হারাইতেছিলেন।
পিতা আসিয়াছেন শুনিয়া বলিলেন, "বসতে চৌকি দাও।' পিতা সম্মুখে আসিয়া বসিলেন। মা
বলিলেন, 'আমি তবে চললেম।' আর কিছুই বলিতে পারিলেন না। আমাদের মনে হইল, স্বামীর নিকট
হইতে বিদায় লইবার জন্য এ পর্যন্ত তিনি আপনাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছিলেন। মার মৃত্যুর
পরে মৃতদেহ শ্মশানে লইয়া যাইবার সময় পিতা দাঁড়াইয়া থাকিয়া ফুল চন্দন অভ্র দিয়া
শয্যা সাজাইয়া দিয়া বলিলেন, 'ছয় বৎসরের সময় এনেছিলেম, আজ বিদায় দিলেম।"
―পিতৃস্মৃতি, প্রবাসী ফাল্গুন ১৩১৮, পৃ ৪৬৩
অপিচ, রবীন্দ্রনাথ, ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ’, পৃ ১৫২-৫৩
উক্ত পরিচ্ছেদে ৪২৩ পৃষ্ঠায় 'চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয়' উল্লেখ
করা হইয়াছে তাহা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী কাদম্বরীদেবীর মৃত্যু (বৈশাখ ১২৯১)। এই
প্রসঙ্গে ১৩২৪ সালের ৮ আষাঢ় তারিখে শ্রীযুক্ত অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীকে লিখিত কবির
একটি পত্রের কিয়দাংশ উদ্ধৃত হইল:
'এক সময়ে যখন আমার বয়স তোমারই মতো ছিল আমি যে নিদারুণ শোক পেয়েছিলুম সে ঠিক তোমারই
মতো। আমার যে-পরমাত্মীয় আত্মহত্যা করে মরেন শিশুকাল থেকে আমার জীবনের পূর্ণ নির্ভর
ছিলেন তিনি। তাই তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে আমার পায়ের নীচে থেকে যেন পৃথিবী সরে গেল,
আমার আকাশ থেকে আলো নিভে গেল। আমার জগৎ শূন্য হল, আমার জীবনের সাধ চলে গেল। সেই
শূন্যতার কুহক কোনোদিন ঘুচবে, এমন কথা আমি মনে করতে পারি নি। কিন্তু তার পরে সেই
প্রচণ্ড বেদনা থেকেই আমার জীবন মুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশলাভ করলে। আমি ক্রমে
বুঝতে পারলুম, জীবন মৃত্যুর জানলার ভিতর থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না।
মৃত্যুর আকাশে জীবনের যে বিরাট মুক্তরূপ প্রকাশ পায় প্রথমে তা বড়ো দুঃসহ। কিন্তু
তার পরে তার ঔদার্য মনকে আনন্দ দিতে থাকে। তখন ব্যক্তিগত জীবনের সুখদুঃখ অনন্ত
সৃষ্টির ক্ষেত্রে হালকা হয়ে দেখা দেয়।
―কবিতা, কার্তিক ১৩৪৮
অপিচ, চিঠিপত্র একাদশ খণ্ড, পৃ ৮
রবীন্দ্রনাথের 'পুষ্পাঞ্জলি'-নামক সমসাময়িক রচনাটিতে সেই বেদনার সদ্য প্রকাশ রহিয়াছে; রবীন্দ্রসদনে রক্ষিত পাণ্ডুলিপির সহিত মিলাইয়া এ স্থলে তাহা সংকলিত হইল:
পুষ্পাঞ্জলি
প্রভাতে
সূর্যদেব, তুমি কোন্ দেশ অন্ধকার করিয়া এখানে উদিত হইলে? কোন্খানে সন্ধ্যা হইল? এ দিকে তুমি জুঁইফুলগুলি ফুটাইলে কোন্খানে রজনীগন্ধা ফুটিতেছে? প্রভাতের কোন্ পরপারে সন্ধ্যার মেঘের ছায়া অতি কোমল লাবণ্যে গাছগুলির উপরে পড়িয়াছে! এখানে আমাদিগকে জাগাইতে আসিয়াছ, সেখানে কাহাদিগকে ঘুম পাড়াইয়া আসিলে? সেখানকার বালিকারা ঘরে দীপ জ্বালাইয়া ঘরের দুয়ারটি খুলিয়া সন্ধ্যালোকে দাঁড়াইয়া কি তাহাদের পিতার জন্য অপেক্ষা করিতেছে? সেখানে তো মা আছে―তাহারা কি তাহাদের ছোটো ছোটো শিশুগুলিকে চাঁদের আলোতে শুয়াইয়া, মুখের পানে চাহিয়া চুমো খাইয়া, বুকে চাপিয়া ধরিয়া ঘুম পাড়াইতেছে? কত শত সেখানে কুটির গাছপালার মধ্যে, নদীর ধারে, পর্বতের উপত্যকায়, মাঠের পাশে, অরণ্যের প্রান্তে আপনার আপনার স্নেহ প্রেম সুখ দুঃখ বুকের মধ্যে লইয়া সন্ধ্যাচ্ছায়ায় বিশ্রাম ভোগ করিতেছে! সেখানে আমাদের কোন্ অজ্ঞাত একটি পাখি এই সময়ে গাছের ডালে বসিয়া ডাকে; সেখানকার লোকের প্রাণের সুখদুঃখের সহিত প্রতি সন্ধ্যাবেলায় এই পাখির গান মিশিয়া যায়। তাহাদের দেশে যে-সকল কবিরা বহুকাল পূর্বে বাস করিত, যাহারা আর নাই, লোকে যাহাদের গান জানে কিন্তু নাম জানে না, তাহারাও কোন্ সন্ধ্যাবেলায় কোন্-এক নদীর ধারে ঘাসের 'পরে শুইয়া এই পাখির গান শুনিত ও গান গাহিত! সে হয়তো আজ বহুদিনের কথা―কিন্তু তখনকার প্রেমিকেরাও তো সহসা এই পাখির স্বর শুনিয়া পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়াছিল, বিরহীরা এই পাখির গান শুনিয়া সন্ধ্যাবেলায় নিশ্বাস ফেলিয়াছিল! কিন্তু তাহারা তাহাদের সে-সমস্ত সুখদুঃখ লইয়া একেবারে চলিয়া গিয়াছে। তাহারাও যখন জীবনের খেলা খেলিত, ঠিক আমাদের মতো করিয়াই খেলিত, এমনি করিয়াই কাঁদিত; তাহারা ছায়া ছিল না, মায়া ছিল না, কাহিনী ছিল না। তাহাদের গায়েও বাতাস ঠিক এমনি জীবন্ত ভাবেই লাগিত― তাহারা তাহাদের বাগান হইতে ফুল তুলিত; তাহারা এক কালে বালক বালিকা ছিল―যখন মা-বাপের কোলে বসিয়া হাসিত তখন মনে হইত না তাহারাও বড়ো হইবে। কিন্তু তবুও তাহারা আজিকার এই চারি দিকের জীবময় লোকারণ্যের মধ্যে কেমন করিয়া একেবারে 'নাই' হইয়া গেল! বাগানে এই-যে বহুবৃদ্ধ বকুলগাছটি দেখিতেছি―একদিন কোন্ সকালবেলায় কী সাধ করিয়া কে একজন ইহা রোপণ করিতেছিল―সে জানিত সে ফুল তুলিবে, সে মালা গাঁথিবে; সেই মানুষটি শুধু নাই, সেই সাধটি শুধু নাই, কেবল ফুল ফুটিতেছে আর ঝরিয়া পড়িতেছে। আমি যখন ফুল সংগ্রহ করিতেছি তখন কি জানি কাহার আশার ধন কুড়াইতেছি, কাহার যত্নের ধনে মালা গাঁথিতেছি! হায় হায়, সে যদি আসিয়া দেখে, সে যাহাদিগকে যত্ন করিত, সে যাহাদিগকে রাখিয়া গিয়াছে, তাহারা আর তাহার নাম করে না, তাহারা আর তাহাকে স্মরণ করাইয়া দেয় না― যেন তাহারা আপনিই হইয়াছে, আপনিই আছে, এমনি ভান করে―যেন তাহাদের সহিত কাহারো যোগ ছিল না।
...
কিন্তু এই বুঝি এ জগতের নিয়ম। আর এ নিয়মের অর্থও বুঝি আছে! যতদিনকাজে কাজ করিবে ততদিন প্রকৃতি তোমাকে মাথায় করিয়া রাখিবে। ততদিন ফুল তোমার জন্যই ফুটে, আকাশের সমস্ত জ্যোতিষ্ক তোমার জন্যই আলো ধরিয়া থাকে, সমস্ত পৃথিবীকে তোমারই বলিয়া মনে হয়। কিন্তু সেই তোমা দ্বারা আর কোনো কাজ পাওয়া যায় না, যেই তুমি মৃত হইলে, অমনি সে তাড়াতাড়ি তোমাকে সরাইয়া ফেলে― তোমাকে চোখের আড়াল করিয়া দেয়― তোমাকে এই জগৎ-দৃশ্যের নেপথ্যে দূর করিয়া দেয়। খরতর কালস্রোতের মধ্যে তোমাকে খড়কুটার মতো ঝাঁটাইয়া ফেলে, তুমি হুহু করিয়া ভাসিয়া যাও, দিনদুই বাদে তোমার আর একেবারে নাগাল পাওয়া যায় না। এমন না হইলে মৃতেরাই এ জগৎ অধিকার করিয়া থাকিত, জীবিতদের এখানে স্থান থাকিত না। কারণ, মৃতই অসংখ্য, জীবিত নিতান্ত অল্প। এত মৃত অধিবাসীর জন্য আমাদের হৃদয়েও স্থান নাই। কাজেই অকর্মণ্য হইলে যত শীঘ্র সম্ভব প্রকৃতি জগৎ হইতে আমাদিগকে একেবারে পরিষ্কার করিয়া ফেলে। আমাদের চিরজীবনের কাজের, চিরজীবনের ভালোবাসার এই পুরস্কার। কিন্তু পুরস্কার পাইবে কে বলিয়াছিল! এই তো চিরদিন হইয়া আসিতেছিল, এই তো চিরদিন হইবে―তাই যদি সত্য হয়, তবে এই অতিশয় কঠিন নিয়মের মধ্যে আমি থাকিতে চাই না। আমি সেই বিস্মৃতদের মধ্যে যাইতে চাই― তাহাদের জন্য আমার প্রাণ আকুল হইয়া উঠিয়াছে। তাহারা হয়তো আমাকে ভুলে নাই, তাহারা হয়তো আমাকে চাহিতেছে। এক কালে এ জগৎ তাহাদেরই আপনার রাজ্য ছিল― কিন্তু তাহাদেরই আপনার দেশ হইতে তাহাদিগকে সকলে নির্বাসিত করিয়া দিতেছে। কেহ তাহাদের চিহ্নও রাখিতে চাহিতেছে না! আমি তাহাদের জন্য স্থান করিয়া রাখিয়াছি, তাহারা আমার কাছে থাকুক! বিস্মৃতিই যদি আমাদের অনন্তকালের বাসা হয় আর স্মৃতি যদি কেবলমাত্র দুদিনের হয় তবে সেই আমাদের স্বদেশেই যাই-না কেন। সেখানে আমার শৈশবের সহচর আছে; সে আমার জীবনের খেলাঘর এখান হইতে ভাঙিয়া লইয়া গেছে― যাবার সময় সে আমার কাছে কাঁদিয়া গেছে―যাবার সময় সে আমাকে তাহার শেষ ভালোবাসা দিয়া গেছে। এই মৃত্যুর দেশে, এই জগতের মধ্যাহ্নকিরণে কি তাহার সেই ভালোবাসার উপহার প্রতি মুহূর্তেই শুকাইয়া ফেলিব! আমার সঙ্গে তাহার যখন দেখা হইবে তখন কি তাহার আজীবনের এত ভালোবাসার পরিণামস্বরূপ আর কিছুই থাকিবে না, আর কিছুই তাহার কাছে লইয়া যাইতে পারিব না― কেবল কতকগুলি নীরস স্মৃতির শুষ্ক মালা! সেগুলি দেখিয়া কি তাহার চোখে জল আসিবে না!
...
হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত, আগে তোমাকে যেমন গান শুনাইতাম, এখন তোমাকে তেমন শুনাইতে পারি না কেন? এ-সব লেখা যে আমি তোমার জন্য লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অনন্তের পথে চলিতে চলিতে যখন দৈবাৎ তোমাতে আমাতে দেখা হইবে তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পার, তাই প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া আমার এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছ না! এমন একদিন আসিবে যখন এই পৃথিবীতে আমার কথার একটিও কাহারো মনে থাকিবে না― কিন্তু ইহার একটি-দুটি কথা ভালোবাসিয়া তুমিও কি মনে রাখিবে না! যে-সব লেখা তুমি এত ভালোবাসিয়া শুনিতে, তোমার সঙ্গেই যাহাদের বিশেষ যোগ, একটু আড়াল হইয়াছ বলিয়াই তোমার সঙ্গে আর কি তাহাদের কোনো সম্বন্ধ নাই! এত পরিচিত লেখার একটি অক্ষরও মনে থাকিবে না? তুমি আর-এক দেশে আর-এক নূতন কবির কবিতা শুনিতেছ?
...
আমরা যাহাদের ভালোবাসি তাহারা আছে বলিয়াই যেন এই জ্যোৎস্নারাত্রির একটা অর্থ আছে― বাগানের এই ফুলগাছগুলিকে এমনিতরো দেখিতে হইয়াছে, নহিলে তাহারা যেন আর-একরকম দেখিতে হইত! তাই যখন একজন প্রিয়ব্যক্তি চলিয়া যায় তখন সমস্ত পৃথিবীর উপর দিয়া যেন একটা করুর বাতাস বহিয়া যায়― মনে আশ্চর্য বোধ হয়, তবুও কেন পৃথিবী উপরকার সমস্ত গাছপালা একেবারে শুকাইয়া গেল না! যদিও তাহারা থাকে তবু তাহাদের থাকিবার একটা যেন কারণ খুঁজিয়া পাই না! জগতের সমুদয় সৌন্দর্য যেন আমাদের প্রিয়ব্যক্তিকে তাহাদের মাঝখানে বসাইয়া রাখিবার জন্য। তাহারা আমাদের ভালোবাসার সিংহাসন। আমাদের ভালোবাসার চারি দিকে তাহারা জড়াইয়া উঠে, লতাইয়া উঠে, ফুটিয়া উঠে। এক-একদিন কী মাহেন্দ্রক্ষণে প্রিয়তমের মুখ দেখিয়া আমাদের হৃদয়ের প্রেম তরঙ্গিত হইয়া উঠে, প্রভাতে চরি দিকে চাহিয়া দেখি সৌন্দর্যসাগরেও তাহারই এক তালে আজ তরঙ্ উঠিয়াছে-কত বিচিত্র বর্ণ, কত বিচিত্র গন্ধ, কত বিচিত্র গান! কাল যেন জগতে এত মহোৎসব ছিল না। অনেক দিনের পরে সহসা যেন সূর্যোদয় হইল। হৃদয়ও যখন আলো দিতে লাগিল সমস্ত জগৎও তাহার সৌন্দর্যচ্ছটা উদ্ভাসিত করিয়া দিল। সমস্ত জগতের সহিত হৃদয়ের এক অপূর্ব মিলন হইল। একজনের সহিত যখন আমাদের মিলন হয়, তখন সে মিলন আমরা কেবল তাহারই মধ্যে বদ্ধ করিয়া রাখিতে পারি না, অলক্ষ্যে অদৃশ্যে সে মিলন বিস্তৃত হইয়া জগতের মধ্যে গিয়া পৌঁছায়। সূচ্যগ্র ভূমির জন্যও যখন আলো জ্বালা হয়, তখন সে আলো সমস্ত ঘরকে আলো না করিয়া থাকিতে পারে না।
...
যে গেছে, সে সমস্ত জগৎ হইতে তাহার
লাবণ্যচ্ছায়া তুলিয়া লইয়া গেছে। [রবীন্দ্রসদনের
পাণহডুলিপিতে পাওয়া যায়]
যখন আমাদের প্রিয়বিয়োগ হয় তখন সমস্ত জগতের প্রতি আমাদের বিষম সন্দেহ উপস্থিত হয়,
অথচ সন্দেহ করিবার কোনো কারণ দেখিতে পাই না বলিয়া হৃদয়ের মধ্যে কেমন আঘাত লাগে;
যেমন নিতান্ত কোনো অভূতপূর্ব ঘটনা দেখিলে আমাদের সহসা সন্দেহ হয় আমরা স্বপ্ন
দেখিতেছি। আমাদের হাতের কাছে যে-জিনিস থাকে তাহা ভালো করিয়া স্পর্শ করিয়া দেখি
এ-সমস্ত সত্য কিনা; তেমনি আমাদের প্রিয়জন যখন চলিয়া যায় তখন আমরা জগৎকে চারি দিকে
স্পর্শ করিয়া দেখি―
ইহারাও সব ছায় কিনা, মায়া কিনা, ইহারাও এখনই চারি দিক হইতে
মিলাইয়া যাইবে কিনা। কিন্তু যখন দেখি ইহারা অচল রহিয়াছে তখন জগৎকে যেন তুলনায় আরো
দ্বিগুণ কঠিন বলিয়া মনে হয়। দেখিতে পাই যে, তখন যে-ফুলেরা বলিত ‘সে না থাকিলে ফুটিব
না,’ যে-জ্যোৎস্না বলিত ‘সে না থাকিলে উঠিব না’ তাহারাও আজ ঠিক তেমনি করিয়াই
ফুটিতেছে, তেমনি করিয়াই উঠিতেছে। তাহারা তখন যতখানি সত্য ছিল, এখনো ঠিক ততখানি
সত্যই আছে-এক চুলও ইতস্তত হয় নাই।―এইজন্য সে যে নাই, এই কথাটাই অত্যন্ত বেশি করিয়া
মনে হয়, কারণ, সে ছাড়া আর-সমস্তই অতিশয় আছে।
...
আমাকে যাহারা চেনে সকলেই তো আমর নাম ধরিয়া ডাকে, কিন্তু সকলেই কিছু একই ব্যক্তিকে
ডাকে না, এবং সকলকেই কিছু একই ব্যক্তি সাড়া দেয় ন। এক-একজনে আমার এক-একটা অংশকে
ডাকে মাত্র, আমাকে তাহারা ততটুকু বলিয়াই জানে। এইজন্য আমরা যাহাকে ভালোবাসি তাহার
একটা নূতন নামকরণ করিতে চাই; কারণ, সকলের-সে ও আমার-সে বিস্তর প্রভেদ। আমার যে গেছে
সে আমাকে কতদিন হইতে জানিত―আমাকে কত প্রভাতে, কত দ্বিপ্রহরে, কত সন্ধ্যাবেলায় সে
দেখিয়াছে! কত বসন্তে, কত বর্ষায়, কত শরতে আমি তাহার কাছে ছিলাম! সে আমাকে কত স্নেহ
করিয়াছে, আমার সঙ্গে কত খেলা করিয়াছে, আমাকে কত শতসহস্র বিশেষ ঘটনার মধ্যে খুব কাছে
থাকিয়া দেখিয়াছে। যে আমাকে সে জানিত সে সেই সতেরো বৎসরের খেলাধুলা, সতেরো বৎসরের
সুখ দুঃখ, সতেরো বৎসরের বসন্ত বর্ষা। সে আমাকে যখন ডাকিত তখন আমার এই ক্ষুদ্র
জীবনের অধিকাংশই, আমার এই সতেরো বৎসর তাহার সমস্ত খেলাধুলা লইয়া তাহাকে সাড়া দিত।
ইহাকে সে ছাড়া আর-কেহ জানিত না, জানে না। সে চলিয়া গেছে, এখন আর ইহাকে কেহ ডাকে না,
এ আর কাহারো ডাকে সাড়া দেয় না। তাঁহার সেই বিশেষ কণ্ঠস্বর, তাঁহার সেই অতি পরিচিত
সুমধুর স্নেহের আহ্বান ছাড়া জগতে এ আর-কিছুই চেনে না। বহির্জগতের সহিত এই ব্যক্তির
আর কোনো সম্বন্ধই রহিল না―সেখান হইতে এ একেবারেই পালাইয়া আসিল―এ-জয়ের মতো আমার হৃদয়
কবরের অতি গুপ্ত অন্ধকারের মধ্যে ইহার জীবিত সমাধি হইল।
আমি কেবল ভাবিতেছি, এমন তো আরো সতেরো বৎসর যাইতে পারে। আবার তো কত নূতন ঘটনা ঘটিবে,
কিন্তু তাহার সহিত তাঁহার তো কোনো সম্পর্কই থাকিবে না! কত নূতন সুখ আসিবে কিন্তু
তাহার জন্য তিনি তো হাসিবেন না―
কত নূতন দুঃখ আসিবে কিন্তু তাহার জন্য তিনি তো
কাঁদিবেন না। কত শত দিন রাত্রি একে একে আসিবে কিন্তু তাহারা একেবারেই তিনি-হীন হইয়া
আসিবে! আমার সম্পর্কীয় যাহা-কিছু তাহার প্রতি তাঁহার বিশেষ স্নেহ আর-এক মুহূর্তের
জন্যও পাইব না। মনে হয়―তাঁহারও কত নূতন সুখ দুঃখ ঘটিবে, তাহার সহিত আমার কোনো যোগ
নাই। যদি অনেক দিন পরে সহসা দেখা হয়, তখন তঁহার নিকটে আমার অনেকটা অজানা, আমার নিকট
তাঁহার অনেকটা অপরিচিত। অথচ আমরা উভয়েই নিতান্ত আপনার লোক!
...
কোথায় নহবৎ বসিয়াছে! সকাল হইতে না হইতেই বিবাহের বাঁশি বাজিয়া উঠিয়াছে। আগে বিছানা
হইতে নূতন ঘুম ভাঙিয়া যখন এই বাঁশি শুনিতে পাইতাম তখন জগৎকে কী উৎসবময় বলিয়া মনে
হইত। বাঁশিতে কেবল আনন্দের কণ্ঠস্বটুকু মাত্র দূর হইতে শুনিতে পাইতাম, বাকিটুকু কী
মোহময় আকারে কল্পনায় উদিত হইত! কত সুখ, কত হাসি, কত হাস্যপরিহাস, কত মধুময় লজ্জা,
আত্মীয় পরিজনের আনন্দ―আপনার লোকদের সঙ্গে কত সুখের সম্বন্ধে জড়িত হওয়া, ভালোবাসার
লোকের মুখের দিকে চাওয়া, ছেলেদের কোলে করা, পরিহাসের লোকদের সহিত স্নেহময় মধুর
পরিহাস করা, এমন কত কী দৃশ্য সূর্যালোকে চোখের সমুখে দেখিতাম! এখন আর তাহা হয় না!
আজি ওই বাঁশি শুনিয়া প্রাণের এক জায়গা কোথায় হাহাকার করিতেছে। এখন কেবলই মনে হয়,
বাঁশি বাজাইয়া যে-সকল উৎসব আরম্ভ হয় সে-সব উৎসবও কখন একদিন শেষ হইয়া যায়। তখন আর
বাঁশি বাজে না! বাপমায়ের যে স্নেহের ধনটি কাঁদিয়া অবশেষে কঠিন পৃথিবী হইতে নিশ্বস
ফেলিয়া চলিয়া যায়―একদিন সকালে মধুর সূর্যের আলোতে তাহার বিবাহেও বাঁশি বাজিয়াছিল।
তখন সে ছেলেমানুষ ছিল, মনে কোনো দুঃখ ছিল না, কিছুই সে জানিত না! বাঁশির গানের
মধ্যে, হাসির মধ্যে, লোকজনের আনন্দের মধ্যে, চারি দিকে ফুলের মালা ও দীপের আলোর
মধ্যে, সেই ছোটো মেয়েটি গলায় হার পরিয়া, পায়ে দুগাছি মল পরিয়া বিরাজ করিতেছিল। অল্প
বয়সে খুব বৃহৎ খেলা খেলিতে যেরূপ আনন্দ হয় তাহার সেইরূপ আনন্দ হইতেছিল। কে জানিত সে
কী খেলা খেলিতে আরম্ভ করিল! সেদিনও প্রভাত এমনি মধুর ছিল!
দেখিতে দেখিতে কত লোক তাহার নিতান্ত আত্মীয় হইল, তাহার প্রাণের খুব কাছাকাছি বাস
করিতে লাগিল, পরের সুখ দুঃখ লইয়া সে নিজের সুখ দুঃখ রচনা করিতে লাগিল। সে তাহার
কোমল হৃদয়খানি লইয়া দুঃখের সময় সান্ত্বনা করিত, কোমল হাত দুখানি লইয়া রোগের সময়
সেবা করিত। সেদিন বাঁশি বাজাইয়া আসিল, সে আজ গেল কী করিয়া! সে কেন চোখের জল ফেলিল!
সে তাহার গভীর হৃদয়ের অতৃপ্তি, তাহার আজন্মকালের দুরাশা, শ্মশানের চিতার মধ্যে
বিসর্জন দিয়া গেল কোথায়! সে-কেন বলিকাই রহিল না, তাহার ভাইবোনদের সঙ্গে চিরদিন খেলা
করিল না! সে আপনার সাধের জিনিস সকল ফেলিয়া আপনার ঘর ছাড়িয়া, আপনার বড়ো ভালোবাসার
লোকদের প্রতি একবার ফিরিয়া না চাহিয়া যে-কোলে ছেলেরা খেলা করিত, যে-হাতে সে রোগীর
সেবা করিত, সেই স্নেহ মাখানো কোল, সেই কোমল হাত, সেই সুন্দর দেহ সত্য সত্যই একেবারে
ছাই করিয়া চলিয়া গেল!
কিন্তু সেদিনকার সকালবেলার মধুর বাঁশি কি এত কথা বলিয়াছিল! এমন রোজই কোনো-না কোনো
জায়গায় বাঁশি তো বাজিতেছেই। কিন্তু এই বাঁশি বাজাইয়া কত হৃদয় দলন হইতেছে, কত জীবন
মরুভূমি হইয়া যাইতেছে, কত কোমল হৃদয় আমরণকাল অসহায়ভাবে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে
নূতন নূতন আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হইয়া যাইতেছে-অথচ একটি কথা বলিতেছে না, কেবল চোখে
তাহাদের কাতরতা, এবং হৃদয়ের মধ্যে চিরপ্রচ্ছন্ন তুষের আগুন। সবই যে দুঃখের তাহা
নহে, কিন্তু সকলেরই তো পরিণাম আছে। পরিণামের অর্থ-উৎসবের প্রদীপ নিবিয়া যাওয়া,
বিসর্জনের পর মর্মভেদী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলা! পরিণামের অর্থ-সূর্যালোক এক মুহূর্তের
মধ্যে একেবরে ম্লান হইয়া যাওয়া-সহসা জগতের চারি দিক সুখহীন, শান্তিহীন, প্রাণহীন,
উদ্দেশ্যহীন মরুভূমি হইয়া যাওয়া! পরিণামের অর্থ-হৃদয়ের মধ্যে কিছুতেই বলিতেছে না
যে, সমস্তই শেষ হইয়া গেছে, অথচ চারি দিকেই তাহার প্রমাণ পাওয়া; প্রতি মুহূর্তে
প্রতি নূতন ঘটনায় অতি প্রচণ্ড আঘাতে নূতন করিয়া অনুভব করা যে, আর হইবে না, আর
ফিরিবে না, আর নয়, আর কিছুতেই নয়! সেই অতি নিষ্ঠুর কঠিন বজ্রপাষাণময় ‘নয়’-নামক
প্রকাণ্ড লৌহদ্বারের সম্মুখে মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও সে একতিল উদ্ঘাটিত হয় না!
মানুষে মানুষে চিরদিনের মিলন যে কী গুরুতর ব্যাপার তাহা সহসা
সকলের মনে হয় না। তাহা চিরদিনের বিচ্ছেদের চেয়ে বেশি গুরুতর বলিয়া মনে হয়। আমরা
অন্ধভাবে জগতের চারি দিক হইতে গড়াইয়া আসিতেছি, কে কোথায় আসিয়া পড়িতেছি তাহার ঠিকানা
নাই। যে যেখানকার নয় সে হয়তো সেইখানেই রহিয়া গেল। এ জীবনে আর তাহার নিষ্কৃতি নাই।
যাহা বসস্থান হওয়া উচিত ছিল তাহই কারাগার হইয়া দাঁড়াইল। আমরা সচেতন জড়পিণ্ডের মতো
অহর্নিশি যে গড়াইয়া-চলিতেছি-আমরা কি জানিতে পারিতেছি পদে পদে কত হৃদয়ের কত স্থান
মাড়াইয়া চলিতেছি, আশে-পাশের কত আশা কত সুখ দলন করিয়া চলিতেছি! সকল সময়ে তাহাদের
বিলাপটুকুও শুনিতে পাই না, শুনিলেও সকল সময়ে অনুভব করিতে পারি না। সারাদিন আঘাত তো
করিতেছিই, আঘাত তো সহিতেছিই, কিছুতেই বাঁচাইয়া চলিতে পারিতেছি না। তাহার কারণ, আমরা
পরস্পরকে ভালো করিয়া বুঝিতে পারি না-দেখিতে পাই না-কোন্খানে যে কাহার ঘাড়ে আসিয়া
পড়িলাম জানিতেই পারি না। আমরা শৈলশিখরচ্যুত পাষাণখণ্ডের মতো। আমাদের পথে পড়িয়া
দুর্ভাগা ফুল পিষ্ট হইতেছে, লতা ছিন্ন হইতেছে, তৃণ শুষ্ক হইতেছে-আবার, হয়তো আমরা
কাহার সুখের কুটিরের উপর অভিশাপের মতো পড়িয়া তাহার সুখের সংসার ছারখার করিয়া
দিতেছি। ইহার কোনো উপায় দেখাযায় না। সকলেরই কিছু-না-কিছু ভার আছেই, সকলেই জগৎকে
কিছু-না-কিছু পীড়া দেয়ই। যতক্ষণ তাহারা দৈবক্রমে তাহাদের ভারসহনক্ষম স্থানে
তিষ্ঠিয়া থাকে ততক্ষণ সমস্ত কুশল, কিন্তু সময়ে সময়ে তাহারা এমন স্থানে আসিয়া পৌছায়
যেখানে তাহাদের ভার আর সয় না! যাহার উপর পা দেয় সেও ভাঙিয়া যায়, আর অনেক সময় যে পা
দেয় সেও পড়িয়া যায়। [ইহার পাণ্ডুলিপিতে অতিরিক্ত খানিকটা পাঠ দেখা যায়]
...
হৃদয় যখন গুরুতর আঘাত লাগে তখন সে ইচ্ছাপূর্বক নিজেকে আরও যেন অধক পীড়া দিতে চায়। এমন-কি, সে তাহার আশ্রয়ের মূলে কুঠারাঘাত করিতে থাকে। যে-সকল বিশ্বাস তাহার জীবনের একমাত্র নির্ভর তাহাদের সে জলাঞ্জলি দিতে চায়! নিষ্ঠুর তর্কদিগের ভয়ে যে প্রিয় বিশ্বাসগুলিকে সযত্নে হৃদয়ের অন্তঃপুরে রাখিয়া দিত আজ অনায়াসে তাহাদিগকে তর্কে বিতর্কে ক্ষতবিক্ষত করিতে থাকে। প্রিয়বিয়োগে কেহ যদি তাহাকে সান্ত্বনা করিতে আসিয়া বলে, “এত প্রেম, এত স্নেহ, এত সহৃদয়তা, তাহার পরিণাম কি ওই খানিকটা ভস্ম! কখনোই নহে!” তখন সে যেন উদ্ধত হইয়া বলে, “আশ্চর্য কি! তেমন সুন্দর মুখখানি-কোমলতায় সৌন্দর্যে লাবণ্যে হৃদয়ের ভাবে আচ্ছন্ন সেই জীবন্ত চলন্ত দেহখানি-সেও যে আর কিছু নয়, দুইমুঠা ছাইয়ে পরিণত হইবে, এই বা কে হৃদয়ের ভিতর হইতে বিশ্বাস করিতে পারিত। বিশ্বাসের উপরে বিশ্বাস কী!” এই বলিয়া সে বুক ফাটিয়া কাঁদিতে থাকে। সে অন্ধকার জগৎ সমুদ্রের মাঝখানে নিজের নৌকাডুবি করিয়া আর কুলকিনারা দেখিতে চায় না। তাহার খানিকটা গিয়াছে বলিয়া সে আর বাকি কিছুই রাখিতে চায় না। সে বলে, তাহার সঙ্গে সমস্তটাই যাক্। কিন্তু সমস্তটা তো যায় না, আমরা নিজেই বাকি থাকি যে! তাই যদি হইল তবে কেন আমরা সহসা আপনাকে উন্মাদের মতো নিরাশ্রয় করিয়া ফেলি। হৃদয়ের এই অন্ধকারের সময় আশ্রয়কে আরো বেশি করিয়া ধরি না কেন। এ-সময়ে মনে করি না কেন, বিশ্বের নিয়ম কখনোই এত ভয়ানক ও এত নিষ্ঠুর হইতেই পারে না। সে আমাকে একেবারেই ডুবাইবে না, আমাকে আশয় দিবেই! যেখানেই হউক এক জায়গায় কিনারা আছেই, তা সে সমুদ্রের তলেই হউক আর সমুদ্রের পরেই হউক-মরিয়াই হউক আর বাঁচিয়াই হউক। মিছামিছি আর তো ভাবা যায় না।
...
তুমি বলিতেছ, প্রকৃতি আমাদিগকে প্রতারণা করিতেছে। আমাদিগকে কেবল ফাঁকি দিয়া কাজ করাইয়া লইতেছে। কাজ হইয়া গেলেই সে আমাদিগকে গলাধাক্কা দিয়া দূর করিয়া দেয়। কিন্তু এত বড়ো যাহার কারখানা, যাহার রাজ্যে এমন বিশাল মহত্ত্ব বিরাজ করিতেছে, সে কি সত্য সত্যই এই কোটি কোটি অসহায় জীবকে একেবারেই ফাঁকি দিতে পারে! সে কি এই-সমস্ত সংসারের তাপে তাপিত, অহর্নিশি কার্যতৎপর, দুঃখে ভাবনায় ভারাক্রান্ত, দীনহীন গলদ্ঘর্ম প্রাণীদিগকে মেকি টাকায় মাহিয়ানা দিয়া কাজ করাইয়া লইতেছে! সে টাকা কি কোথাও ভাঙাইতে পারা যাইবে না! এখানে না-হয় আর-কোথাও? এমন ঘোরতর নিষ্ঠুরতা ও হীন প্রবঞ্চনা কি এত বড়ো মহত্ব ও এত বড়ো স্থায়িত্বের সহিত মিশ খায়! কেবলমাত্র ফাঁকির জাল গাঁথিয়া গাঁথিয়া কি এমনতরো অসীম ব্যাপার নির্মিত হইতে পারিত। কেবলমাত্র আশ্বাসে আজম্মকাল কাজ করিয়া যদি অবশেষে হৃদয়ের শীত বস্ত্রটুকুও পৃথিবীতে ফেলিয়া পুরস্কারস্বরূপ কেবলমাত্র অতৃপ্তি ও অশ্রুজল লইয়া সকলকেই মরণের মহামেরুর মধ্যে নির্বাসিত হইতে হয়, তবে এই অভিশপ্ত রাক্ষস সংসার নিজের পাপসাগরে নিজে কোন্ কালে ডুবিয়া মরিত। কারণ, প্রকৃতির মধ্যেই ঋণ এবং পরিশোধের নিয়মের কোথাও ব্যতিক্রম নাই। কেহই এক কড়ার ঋণ রাখিয়া যাইতে পারে না, তাহার সুদসুদ্ধ শুধিয়া যাইতে হয়-এমন-কি, পিতার ঋণ পিতামহের ঋণ পর্যন্ত শুধিতে সমস্ত জীবন যাপন করিতে হয়। এমন স্থলে প্রকৃতি যে চিরকাল ধরিয়া অসংখ্য জীবের দেনদার হইয়া থাকিবে এমন সম্ভব বোধ হয় না, তাহা হইলে সে নিজের নিয়মেই নিজে মারা পড়িত।
...
তুমি যে-ঘরটিতে রোজ সকালে বসিতে তাহারই দ্বারে স্বহস্তে যে-রজনীগন্ধার গাছ রোপণ করিয়াছিলে তাহাকে কি আর তোমার মনে আছে! তুমি যখন ছিলে তখন তাহাতে এত ফুল ফুটিত না, আজ সে কত ফুল ফুটাইয়া প্রতিদিন প্রভাতে তোমার সেই শূন্য ঘরের দিকে চাহিয়া থাকে। সে যেন মনে করে, বুঝি তাহারই ’পরে অভিমান করিয়া তুমি কোথায় চলিয়া গিয়াছ! তাই সে আজ বেশি করিয়া ফুল ফুটাইতেছে। তোমাকে বলিতেছে, “তুমি এসো, তোমাকে রোজ ফুল দিব!” হায় হায়, যখন সে দেখিতে চায় তখন সে ভালো করিয়া দেখিতে পায় না- আর যখন সে শূন্যহৃদয়ে চলিয়া যায়, এ-জন্মের মতো দেখা ফুরাইয়া যায়, তখন আর তাহাকে ফিরিয়া ডাকিলে কী হইবে! সমস্ত হৃদয় তাহার সমস্ত ভালোবাসার ডালাটি সাজাইয়া তাহাকে ডাকিতে থাকে। আমিও তোমার গৃহের শূন্য দ্বারে বসিয়া প্রতিদিন সকালে একটি একটি করিয়া রজনীগন্ধা ফুটাইতেছি-কে দেখিবে! ঝরিয়া পড়িবার সময় কাহার সদয় চরণের তলে ঝরিয়া পড়িবে! আর-সকলেই ইচ্ছা করিলে এই ফুল ছিঁড়িয়া লইয়া মালা গাঁথিতে পারে, ফেলিয়া দিতে পারে- কেবল তোমারই স্নেহের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও ইহাদের উপরে আর পড়িবে না! [পাণ্ডুলিপিতে ইহার পর একটি গান আছে― 'কেহ কারো মন বুঝে না' ইত্যাদি। গীতবিতান দ্রষ্টব্য]
...
তোমার ফুলবাগানে যখন চারি দিকেই ফুল ফুটিতেছে, তখন যে তোমাকে দেখিতে পাই না, তাহাতে তেমন আশ্চর্য নাই। কিন্তু যখন দেখি ঘরে ঘরে রোগের মূর্তি তখনো যে রোগীর শিয়রের কাছে তুমি বসিয়া নাই, এ যেন কেমন বিশ্বাস হয় না। উৎসবের সময় তুমি নাই, বিপদের সময় তুমি নাই, রোগের সময় তুমি নাই! তোমার ঘরে যে প্রতিদিন অতিথি আসিতেছে- হৃদয়ে সরল প্রীতির সহিত তাহাদিগকে কেহ যে আদর করিয়া বসিতে বলে না। তুমি যাহাকে বড়ো ভালোবাসিতে সেই ছোটো মেয়েটি যে আজ সন্ধ্যাবেলায় আসিয়াছে-তাহাকে আদর করিয়া খেতে দিবে কে। এখন আর কে কাহাকে দেখিবে! যে-অযাচিত প্রীতি-স্নেহ-সান্ত্বনায় সমস্ত সংসার অভিষিক্ত ছিল সে নির্ঝর শুষ্ক হইয়া গেল-এখন কেবল কতকগুলি স্বতন্ত্র স্বার্থপর কঠিন পাষাণখণ্ড তাহারই পথে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিল!
...
যাহারা ভালো, যাহারা ভালোবাসিতে পারে, যাহাদের হৃদয় আছে, সংসারে তাহাদের কিসের সুখ! কিছু না, কিছু না। তাহারা তাদের যন্ত্রের মতো, বীণার মতো-তাহাদের প্রত্যেক কোমল স্নায়ু, প্রত্যেক শিরা সংসারের প্রতি আঘাতে বাজিয়া উঠিতেছে। সে গান সকলেই শুনে, শুনিয়া সকলেই মুগ্ধ হয়-তাহাদের বিলাপধ্বনি রাগিণী হইয়া উঠে, শুনিয়া কেহ নিশ্বাস ফেলে না! তাই যেন হইল, কিন্তু যখন আঘাত আর সহিতে পারে না, যখন তার ছিঁড়িয়া যায়, যখন আর বাজে না, তখন কেন সকলে তাহাকে নিন্দা করে, তখন কেন কেহ বলে না ‘আহা’!-তখন কেন তাহাকে সকলে তুচ্ছ করিয়া বাহিরে ফেলিয়া দেয়। হে ঈশ্বর, এমন যন্ত্রটিকে তোমার কাছে লুকাইয়া রাখ না কেন-ইহাকে আজিও সংসারের হাটের মধ্যে ফেলিয়া রাখিয়াছ কেন-তোমার স্বর্গলোকের সংগীতের জন্য ইহাকে ডাকিয়া লও-পাষণ্ড নরাধম পাষাণ্ডহৃদয় যে ইচ্ছা সেই ঝন্ ঝন্ করিয়া চলিয়া যায়, অকাতরে তার ছিঁড়িয়া হাসিতে থাকে- খেলাচ্ছলে তাহার প্রাণের সংগীত শুনিয়া তার পরে যে যার ঘরে চলিয়া যায়, আর মনে রাখে না। এ বীণাটিকে তাহারা দেবতার অনুগ্রহ বলিয়া মনে করে না- তাহারা আপনাকেই প্রভু বলিয়া জানে-এইজন্য কখনো বা উপহাস করিয়া, কখনো বা অনাবশ্যক জ্ঞান করিয়া, এই সুমধুর সুকোমল পবিত্রতার উপরে তাহাদের কঠিন চরণের আঘাত করে-সংগীত চিরকালের জন্য নীরব হইয়া যায়।
―ভারতী, বৈশাখ ১২৯২