জীবনস্মৃতি গ্রন্থ পরিচয়
গ্রন্থ পরিচিতি
রবীন্দ্ররচনাবলী সপ্তদশ খণ্ড (বিশ্বভারতী, ভাদ্র ১৩৯৩ : ১৯০৮ শক মুদ্রণানুসারে)


 [আগের পাঠ]

    এই শোকের ভিতর দিয়া রবীন্দ্রনাথ জীবন ও মৃত্যু উভয়েরই গভীরতর পরিচয় লাভ করিয়াছেন। শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যথার্থই বলিয়াছেন যে, “মাতা সারদা দেবীর মৃত্যুর পর... তিনিই [কাদম্বরীদেবী] মাতৃহীন শিশুদের মাতৃস্থান, বন্ধুস্থান গ্রহণ করিয়াছিলেন।” [রবীন্দ্র-জীবনী ১ (বৈশাখ ১৩৭৭), পৃ ১৯৪]
    প্রসঙ্গক্রমে এখানে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে 'পুস্পাঞ্জলি'তে যে-শোকবেদনার প্রকাশ দেখা যায়, তাহাই বহু বৎসর পরে লিপিকা গ্রন্থের কয়েকটি রচনায় পরিচ্ছন্ন কাব্যরূপ লাভ করিয়াছে। কবি বলিয়াছেন, "যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি। ['প্রথম শোক', লিপিকা ('কথিকা'
সবুজপত্র, আষাঢ় ১৩২৬)]
    ‘বর্ষা ও শরৎ’ পরিচ্ছেদে উল্লিখিত বর্ষাস্মৃতি প্রসঙ্গে ‘বালক’ পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষার চিঠি’ রচনাটির কিয়দংশ উদ্‌ধৃত হইল। বলা বাহুল্য এই স্মৃতিচিত্রটি ‘জীবনস্মৃতি’র বহু পূর্বের রচনা।
    ছেলেবেলায় যেমন বর্ষা দেখতেম, তেমন ঘনিয়ে বর্ষাও এখন হয় না। বর্ষার তেমন সমারোহ নেই যেন, এখন যেন ইকনমিতে মন দিয়েছে
নমো নমো করে জল ছিটিয়ে চলে যায়কেবল খানিকটা কাদা, খানিকটা অসুবিধে মাত্রএকখানা ছেঁড়া ছাতা ও চিনেবাজারের জুতোয়া বর্ষা কাটানো যায় কিন্তু আগেকার মতো সে বজ্র বিদ্যুৎ বৃষ্টি বাতাসের মাতামাতি দেখি নে। আগেকার বর্ষায় একটা নৃত্য ও গান ছিল, একটা ছন্দ ও তাল ছিল এখন যেন প্রকৃতির বর্ষার মধ্যেও বয়স প্রবেশ করেছে, হিসাবকিতাব ও ভাবনা ঢুকেছে, শ্লেষ্মা শঙ্কা ও সাবধানের প্রাদুর্ভাব হয়েছে। লোকে বলছে, সে আমারই বয়সের দোষ।
    তা হবে! সকল বয়সেরই একটা কাল আছে, আমার সে বয়স গেছে হয়তো। যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্ধক্যের যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা।...বর্ষাকাল ঘরে থাকবার কাল, কল্পনা করবার কাল, গল্প শোনবার কাল, ভাই বোনে মিলে খেলা করবার কাল।... বর্ষাকাল বালকের কাল-বর্ষাকালে তরুলতার শ্যামল কোমলতার মতো আমাদের স্বাভাবিক শৈশব স্ফুর্তি পেয়ে ওঠে-বর্ষার দিনে আমাদের ছেলেবেলার কথাই মনে পড়ে।
    তাই মনে পড়ে, বর্ষার দিন আমাদের দীর্ঘ বারান্দায় আমরা ছুটে বেড়াতাম
বাতাসে দুম্‌দাম্ করে দরজা পড়ত, প্রকাণ্ড তেঁতুলগাছ তার সমস্ত অন্ধকার নিয়ে নড়ত, উঠোনে একহাঁটু জল দাঁড়াত, ছাতের উপরকার চারটে টিনের নল থেকে স্থূল জলধারা উঠোনের জলের উপর প্রচণ্ড শব্দে পড়ত ও ফেনিয়ে উঠত, চারটে জলধারাকে দিক্‌হস্তীর শুঁড় বলে মনে হত। তখন আমাদের পুকুরের ধারের কেয়াগাছে ফুল ফুটত (এখন সে গাছ আর নেই)। বৃষ্টিতে ক্রমে পুকুরের ঘাটের এক-এক সিঁড়ি যখন অদৃশ্য হয়ে যেত ও অবশেষে পুকুর ভেসে গিয়ে বাগানে জল দাঁড়াত বাগানের মাঝে মাঝে বেলফুলের গাছের ঝাঁকড়া মাথাগুলো জলের উপর জেগে থাকত এবং পুকুরের বড়ো বড়ো মাছ পালিয়ে এসে বাগানের জলমগ্ন গাছের মধ্যে খেলিয়ে বেড়াত, তখন হাঁটুর কাপড় তুলে কল্পনায় বাগানময় জলে দাপাদাপি করে বেড়াতেম। বর্ষার দিনে ইস্কুলের কথা মনে হলে প্রাণ কী অন্ধকার হয়েই যেত, এবং বর্ষাকালের সন্ধ্যেবেলায় যখন বারান্দা থেকে সহসা গলির মোড়ে মাস্টারমহাশয়ের ছাতা দেখা দিত তখন যা মনে হত তা যদি মাস্টারমশায় টের পেতেন তা হলে

‘বর্ষার চিঠি,’ বালক, শ্রাবণ ১২৯২, পৃ ১৯৬-৯৮

    জীবনের টুকরা স্মৃতিকথা রবীন্দ্রসাহিত্যের নানাস্থানে ছড়ানো আছে। উহার মধ্যে চিঠিপত্রাদি বাদে শেষ দিকের রচনালিপিকা (প্রথমাংশ), সে, ছড়ার ছবি, আকাশপ্রদীপ, ছেলেবেলা, গল্পসল্প, এই কয়খানি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
    'জীবনস্মৃতি' সম্পাদনকার্যে শ্রীমতী ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী ও শ্রীযুক্ত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আমাদের বিশেষ সাহায্য করিয়াছেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু পত্র এবং জ্ঞানদানন্দিনীদেবীর আত্মচরিতের পাণ্ডুলিপি আমরা ইন্দিরাদেবীর সৌজন্যে ব্যবহার করিতে পাইয়াছি। এই কার্যে ব্যবহৃত অন্যান্য নানা গ্রন্থের মধ্যে এই গ্রন্থগুলি উল্লেখযোগ্য:
    শ্রীমন্মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী [তৃতীয় সংস্করণ, ১৯২৭]
                                                                  
শ্রীসতীশচন্দ্র চক্রবর্তী-সম্পাদিত
    মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পত্রাবলী                        
শ্রীপ্রিয়নাথ শাস্ত্রী-প্রকাশিত
    মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৯১৬]                    
শ্রীঅজিতকুমার চক্রবর্তী
    বঙ্গভাষার লেখক [১৩১১]                              
শ্রীহরিমোহন মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত
    জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি [ফাল্গুন ১৩২৬]    
শ্রীবসন্তকুমার চট্টপাধ্যায়
    জ্যোতিরিন্দ্রনাথ [১৩৩৪]                               
শ্রীমন্মথনাথ ঘোষ
    রবীন্দ্র-জীবনী, প্রথম খণ্ড [১৩৪০]                     
শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
    রবীন্দ্রকথা [১৩৪৮]                                     
শ্রীখগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়-সংকলিত
    সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা, খণ্ড ২২ [মাঘ ১৩৪৯]
                                                                
শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীসজনীকান্ত দাস
    সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা, খণ্ড ২,৫,১২,১৮,২১,২৫ [১৩৪৬-৫০]
    বাংলা সাময়িক পত্র [১৮১৮-৬৭]
    বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস [দ্বিতীয় সংস্করণ]
    রবীন্দ্র-গ্রন্থ-পরিচয় [১৩৪৯, পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৫০]
                                                                
শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
    সম্পাদনকার্যে ব্যবহৃত সাময়িক পত্রাদির উল্লেখ যথাস্থানে করা হইয়াছে।
    বর্তমান ‘জীবনস্মৃতি’র পাদটীকায় ‘পাণ্ডলিপি’ বলিতে প্রথম পাণ্ডুলিপি বুঝাইতেছে।

    নর্মাল স্কুলে বালক রবীন্দ্রনাথ যে ইংরেজি গীতিকবিতা ‘বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ হইবার প্রথমেই গ্যালারিতে সকল ছেলে’র সহিত সমস্বরে আবৃতি করিতেন, যাহার ‘ধুয়া’ অংশটি রবীন্দ্রনাথ অনুমানপূর্বক ঠিকই সংকলন করিয়াছেন (কেবল merrily শব্দটি আবৃত্তির ঝোঁকে তিনবার বলা হইত, দ্রষ্টব্য পৃ ২৮১) সেটির সম্পর্কে ‘দেশ’ পত্রে শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সেন-লিখিত ‘রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য (২৫ বৈশাখ ১৩৫৮, প্রবন্ধের ‘২’ অংশ, পৃ ৯-১১)। আমেরিকান মহিলা কবি
Eliza Lee Cabot Follen (১৭৮৭-১৮৬০)-লিখিত উক্ত কবিতার প্রথম স্তবক মাত্র এ স্থলে উদ্‌ধৃত হইল

        
   A SCHOOL SONG

            Children go
            To and fro
            In a merry, pretty row;
            Footsteps light,
            Faces bright,
            ’Tis a happy sight,
            Swiftly turning round and round,
            Follow me,
            Full of glee,
            Singing merrily.


    'ঘরের পড়া'র প্রসঙ্গে কুমারসম্ভবের অংশবিশেষের এবং ম্যাক্‌বেথ 'সমস্ত বইটার' বাংলা তর্জমার কথা জানা যায়। ইহা উল্লেখযোগ্য যে, কুমারসম্ভবের অনূদিত ‘মদনভস্ম’ অংশের তিনটি পাঠ আজ পর্যন্ত পাওয়া গিয়াছে; মিলাইয়া বিচার করিতে হইলে দ্রষ্টব্য-)(১) সম্পাদকের বৈঠক, ভারতী মাঘ ১২৮৪, অথবা রবীন্দ্র-গ্রন্থ-পরিচয় (১৩৫০), পৃ ৮২-৮৫। (২) বিশ্বভারতী পত্রিকা বৈশাখ ১৩৫০, পৃ ৫৮৫-৯১ (৩) রবীন্দ্র প্রতিভা গ্রন্থ (ভাদ্র ১৩৬৮) পৃ ২৪৯-৫৫, অথবা বর্তমান গ্রন্থের ৪৬৬ পৃষ্ঠার ১ পাদটীকায় উল্লিখিত উত্তরসূরী ত্রৈমাসিক পত্র।
    ম্যাক্‌বেথ নাটকের ডাকিনীদের কথোপকথনটুকু যেমন রবীন্দ্র গ্রন্থ-পরিচয়ে তেমনি স্বতন্ত্র ভাবে মুদ্রিত বিস্তৃত-গ্রন্থপরিচয়-যুক্ত জীবনস্মৃতি গ্রন্থেও সংকলিত হইয়া আসিতেছে।