ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
পায়ে চলার পথ
[প্রবাসী পত্রিকার আশ্বিন ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
এই তো পায়ে চলার পথ।
এসেছে বনের মধ্যে দিয়ে মাঠে,
মাঠের মধ্যে দিয়ে নদীর
ধারে,
খেয়াঘাটের পাশে বটগাছের তলায়।
তার পরে ও পারের ভাঙা
ঘাট থেকে বেঁকে চলে গেছে গ্রামের মধ্যে;
তার পরে তিসির খেতের ধার
দিয়ে,
আমবাগানের ছায়া দিয়ে,
পদ্মদিঘির পাড় দিয়ে,
রথতলার পাশ দিয়ে কোন্
গাঁয়ে গিয়ে পৌঁচেছে জানি নে।
এই পথে কত মানুষ কেউ বা আমার পাশ দিয়ে চলে গেছে, কেউ বা সঙ্গ নিয়েছে, কাউকে বা দূর থেকে দেখা গেল; কারো বা ঘোমটা আছে, কারো বা নেই; কেউ বা জল ভরতে চলেছে, কেউ বা জল নিয়ে ফিরে এল।
২
এখন দিন গিয়েছে,
অন্ধকার হয়ে আসে।
একদিন এই পথকে মনে হয়েছিল আমারই পথ,
একান্তই আমার;
এখন দেখছি,
কেবল একটিবার মাত্র এই
পথ দিয়ে চলার হুকুম নিয়ে এসেছি,
আর নয়।
নেবুতলা উজিয়ে সেই পুকুরপাড়,
দ্বাদশ দেউলের ঘাট,
নদীর চর,
গোয়ালবাড়ি,
ধানের গোলা পেরিয়ে— সেই
চেনা চাউনি,
চেনা কথা,
চেনা মুখের মহলে আর
একটিবারও ফিরে গিয়ে বলা হবে না,
“এই-যে!” এ পথ যে চলার
পথ,
ফেরার পথ নয়।
আজ ধূসর সন্ধ্যায় একবার পিছন ফিরে তাকালুম;
দেখলুম,
এই পথটি বহুবিস্মৃত
পদচিহ্নের পদাবলী,
ভৈরবীর সুরে বাঁধা।
যত কাল যত পথিক চলে গেছে তাদের জীবনের সমস্ত কথাকেই এই পথ আপনার একটিমাত্র
ধূলিরেখায় সংক্ষিপ্ত করে এঁকেছে;
সেই একটি রেখা চলেছে
সূর্যোদয়ের দিক থেকে সূর্যাস্তের দিকে,
এক সোনার সিংহদ্বার থেকে
আর-এক সোনার সিংহদ্বারে।
৩
“ওগো পায়ে চলার পথ,
অনেক কালের অনেক কথাকে
তোমার ধূলিবন্ধনে বেঁধে নীরব করে রেখো না।
আমি তোমার ধুলোয় কান
পেতে আছি,
আমাকে কানে কানে বলো।”
পথ নিশীথের কালো পর্দার তর্জনী বাড়িয়ে চুপ ক’রে থাকে।
“ওগো পায়ে চলার পথ,
এত পথিকের এত ভাবনা,
এত ইচ্ছা,
সে-সব গেল কোথায়!”
বোবা পথ কথা কয় না।
কেবল সূর্যোদয়ের দিক
থেকে সূর্যাস্ত অবধি ইশারা মেলে রাখে।
“ওগো পায়ে চলার পথ,
তোমার বুকের উপর
যে-সমস্ত চরণপাত একদিন পুষ্পবৃষ্টির মতো পড়েছিল আজ তারা কি কোথাও নেই?”
পথ কি নিজের শেষকে জানে,
যেখানে লুপ্ত ফুল আর
স্তব্ধ গান পৌঁছল,
যেখানে তারার
আলোয় অনির্বাণ বেদনার দেয়ালি-উৎসব!
[ভারতী পত্রিকার আশ্বিন ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশের সময় রচনাটির নাম ছিল‒ অক্ষমতা]
রোজই থাকে
সমস্ত দিন কাজ,
আর চার দিকে লোকজন। রোজই মনে হয়, সেদিনকার
কাজে, সেদিনকার আলাপে সেদিনকার সব
কথা দিনের শেষে বুঝি একেবারে শেষ করে দেওয়া হয়। ভিতরে কোন্ কথাটি যে বাকি রয়ে গেল
তা বুঝে নেবার সময় পাওয়া যায় না।
আজ সকাল বেলা মেঘের স্তবকে স্তবকে আকাশের বুক ভেরে উঠেছে। আজও সমস্ত দিনের কাজ আছে সামনে, আর লোক আছে চার দিকে। কিন্তু, আজ মনে হচ্ছে, ভিতরে যা-কিছু আছে বাইরে তা সমস্ত শেষ করে দেওয়া যায় না।
মানুষ সমুদ্র পার হল, পর্বত ডিঙিয়ে গেল, পাতালপুরীতে সিঁধ কেটে মণিমানিক চুরি করে আনলে, কিন্তু একজনের অন্তরের কথা আর-একজনকে চুকিয়ে দিয়ে ফেলা, এ কিছুতেই পারলে না।
আজ মেঘলা দিনের সকালে সেই আমার বন্দী কথাটাই মনের মধ্যে পাখা ঝাপটে মরছে। ভিতরের মানুষ বলছে, “আমার চিরদিনের সেই আর-একজনটি কোথায়, যে আমার হৃদয়ের শ্রাবণমেঘকে ফতুর ক’রে তার সকল বৃষ্টি কেড়ে নেবে!”
আজ মেঘলা দিনের সকালে শুনতে পাচ্ছি, সেই ভিতরের কথাটা কেবলই বন্ধ দরজার শিকল নাড়ছে। ভাবছি, “কী করি। কে আছে যার ডাকে কাজের বেড়া ডিঙিয়ে এখনই আমার বাণী সুরের প্রদীপ হাতে বিশ্বের অভিসারে বেরিয়ে পড়বে। কে আছে যার চোখের একটি ইশারায় আমার সব ছড়ানো ব্যথা এক মুহূর্তে এক আনন্দে গাঁথা হবে, এক আলোতে জ্বলে উঠবে। আমার কাছে ঠিক সুরটি লাগিয়ে চাইতে পারে যে আমি তাকেই কেবল দিতে পারি। সেই আমার সর্বনেশে ভিখারী রাস্তার কোন্ মোড়ে!”
আমার ভিতরমহলের ব্যথা আজ গেরুয়াবসন পরেছে। পথে বাহির হতে চায়, সকল কাজের বাহিরের পথে, যে পথ একটিমাত্র সরল তারের একতারার মতো, কোন্ মনের মানুষের চলায় চলায় বাজছে!
বাণী
[সবুজপত্র পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৬ সংখ্যায়
প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশের সময় রচনাটির নাম ছিল‒
কথিকা]
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে আকাশের মেঘ নামে, মাটির কাছে ধরা দেবে ব’লে। তেমনি কোথা থেকে মেয়েরা আসে পৃথিবীতে বাঁধা পড়তে।
তাদের জন্য অল্প জায়গার জগৎ, অল্প মানুষের। ঐটুকুর মধ্যে আপনার সবটাকে ধরানো চাই— আপনার সব কথা, সব ব্যথা, সব ভাবনা। তাই তাদের মাথায় কাপড়, হাতে কাঁকন, আঙিনায় বেড়া। মেয়েরা হল সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী।
কিন্তু, কোন দেবতার কৌতুকহাস্যের মতো অপরিমিত চঞ্চলতা নিয়ে আমাদের পাড়ায় ঐ ছোটো মেয়েটির জন্ম। মা তাকে রেগে বলে “দস্যি”, বাপ তাকে হেসে বলে “পাগলি”।
সে পলাতকা ঝরনার জল, শাসনের পাথর ডিঙিয়ে চলে। তার মনটি যেন বেণুবনের উপরডালের পাতা, কেবলই ঝির্ ঝির্ করে কাঁপছে।
২
আজ দেখি, সেই দুরন্ত মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙে ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে, বাদলশেষের ইন্দ্রধনুটি বললেই হয়। তার বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ আজ অচঞ্চল, তমালের ডালে বৃষ্টির দিনে ডানাভেজা পাখির মতো।
ওকে এমন স্তব্ধ কখনো দেখি নি। মনে হল, নদী যেন চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থমকে সরোবর হয়েছে।
৩
কিছুদিন আগে রৌদ্রের শাসন ছিল প্রখর;
দিগন্তের মুখ বিবর্ণ;
গাছের পাতাগুলো শুকনো,
হলদে,
হতাশ্বাস।
এমন সময় হঠাৎ কালো আলুথালু পাগলা মেঘ আকাশের কোণে কোণে তাঁবু ফেললে।
সূর্যাস্তের একটা
রক্তরশ্মি খাপের ভিতর থেকে তলোয়ারের মতো বেরিয়ে এল।
অর্ধেক রাত্রে দেখি, দরজাগুলো খড়্ খড়্ শব্দে কাঁপছে।
সমস্ত শহরের ঘুমটাকে
ঝড়ের হাওয়া ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে দিলে।
উঠে দেখি,
গলির আলোটা ঘন বৃষ্টির
মধ্যে মাতালের ঘোলা চোখের মতো দেখতে।
আর,
গির্জের ঘড়ির শব্দ এল
যেন বৃষ্টির শব্দের চাদর মুড়ি দিয়ে।
সকালবেলায় জলের ধারা আরও ঘনিয়ে এল, রৌদ্র আর উঠল না।
৪
এই বাদলায় আমাদের পাড়ার মেয়েটি বারান্দায় রেলিঙ ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে।
তার বোন এসে তাকে বললে,
“মা ডাকছে।”
সে কেবল সবেগে মাথা নাড়ল,
তার বেণী উঠল দুলে;
কাগজের নৌকো নিয়ে তার
ভাই তার হাত ধরে টানলে।
সে হাত ছিনিয়ে নিলে।
তবু তার ভাই খেলার জন্যে
টানাটানি করতে লাগল।
তাকে এক থাপড় বসিয়ে দিলে।
৫
বৃষ্টি পড়ছে।
অন্ধকার আরো ঘন হয়ে এল।
মেয়েটি স্থির দাঁড়িয়ে।
আদিযুগে সৃষ্টির মুখে প্রথম কথা জেগেছিল জলের ভাষায়,
হাওয়ার কণ্ঠে।
লক্ষকোটি বছর পার হয়ে
সেই স্মরণবিস্মরণের অতীত কথা আজ বাদলার কলস্বরে ঐ মেয়েটিকে এসে ডাক দিলে।
ও তাই সকল বেড়ার বাইরে
চলে গিয়ে হারিয়ে গেল।
কত বড়ো কাল,
কত বড়ো জগৎ,
পৃথিবীতে কত যুগের কত জীবলীলা! সেই সুদূর, সেই বিরাট,
আজ এই দুরন্ত মেয়েটির
মুখের দিকে তাকালো মেঘের ছায়ায়,
বৃষ্টির কলশব্দে।
ও তাই বড়ো বড়ো চোখ মেলে নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল,
যেন অনন্তকালেরই প্রতিমা।
মেঘদূত
[প্রবাসী পত্রিকার কার্তিক ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]
মিলনের প্রথম দিনে বাঁশি কী বলেছিল।
সে বলেছিল,
“সেই মানুষ আমার কাছে এল
যে মানুষ আমার দূরের।”
আর, বাঁশি বলেছিল,
“ধরলেও যাকে ধরা যায় না
তাকে ধরেছি,
পেলেও সকল পাওয়াকে যে ছাড়িয়ে
যায় তাকে পাওয়া গেল।”
তার পরে রোজ বাঁশি বাজে না কেন?
কেননা,
আধখানা কথা ভুলেছি।
শুধু মনে রইল,
সে কাছে;
কিন্তু সে যে দূরেও তা
খেয়াল রইল না।
প্রেমের সে আধখানায় মিলন সেইটেই
দেখি,
যে আধখানায় বিরহ সে চোখে পড়ে না,
তাই দূরের চিরতৃপ্তিহীন
দেখাটা আর দেখা যায় না;
কাছের পর্দা আড়াল করেছে।
দুই মানুষের মাঝে যে অসীম আকাশ সেখানে সব চুপ, সেখানে কথা চলে না। সেই মস্ত চুপকে বাঁশির সুর দিয়ে ভরিয়ে দিতে হয়। অনন্ত আকাশের ফাঁক না পেলে বাঁশি বাজে না।
সেই আমাদের মাঝের আকাশটি আঁধিতে ঢেকেছে, প্রতি দিনের কাজে কর্মে কথায় ভরে গিয়েছে, প্রতি দিনের ভয়ভাবনা—কৃপণতায়।
২
এক-একদিন জ্যোত্স্নারাত্রে হাওয়া দেয়;
বিছানার ’পরে জেগে বসে
বুক ব্যথিয়ে ওঠে;
মনে পড়ে,
এই পাশের লোকটিকে তো
হারিয়েছি।
এই বিরহ মিটবে কেমন করে,
আমার অনন্তের সঙ্গে তার
অনন্তের বিরহ।
দিনের শেষে কাজের থেকে ফিরে এসে যার সঙ্গে কথা বলি সে কে।
সে তো সংসারের হাজার
লোকের মধ্যে একজন;
তাকে তো জানা হয়েছে,
চেনা হয়েছে,
সে তো ফুরিয়ে গেছে।
কিন্তু,
ওর মধ্যে কোথায় সেই আমার
অফুরান একজন,
সেই আমার একটিমাত্র।
ওকে আবার নূতন করে খুঁজে
পাই কোন্ কূলহারা কামনার ধারে?
ওর সঙ্গে আবার একবার কথা বলি সময়ের কোন্ ফাঁকে,
বনমল্লিকার গন্ধে নিবিড়
কোন্ কর্মহীন সন্ধ্যার অন্ধকারে?
৩
এমন সময় নববর্ষা ছায়া-উত্তরীয় উড়িয়ে পূর্বদিগন্তে এসে উপস্থিত।
উজ্জয়িনীর কবির কথা মনে
পড়ে গেল।
মনে হল,
প্রিয়ার কাছে দূত পাঠাই।
আমার গান চলুক উড়ে,
পাশে থাকার সুন্দর
দুর্গম নির্বাসন পার হয়ে যাক।
কিন্তু,
তা হলে তাকে যেতে হবে
কালের উজান-পথ বেয়ে বাঁশির ব্যথায় ভরা আমাদের প্রথম মিলনের দিনে,
সেই আমাদের যে দিনটি
বিশ্বের চিরবর্ষা ও চিরবসন্তের সকল গন্ধে সকল ক্রন্দনে জড়িয়ে রয়ে গেল,
কেতকীবনের দীর্ঘশ্বাসে
আর শালমঞ্জরীর উতলা আত্মনিবেদনে।
নির্জন দিঘির ধারে নারিকেলবনের মর্মরমুখরিত বর্ষার আপন কথাটিকেই আমার কথা করে নিয়ে
প্রিয়ার কানে পৌঁছিয়ে দিক,
যেখানে সে তার এলোচুলে
গ্রন্থি দিয়ে,
আঁচল কোমরে বেঁধে সংসারের কাজে
ব্যস্ত।
৪
বহু দূরের অসীম আকাশ আজ বনরাজিনীলা পৃথিবীর শিয়রের কাছে নত হয়ে পড়ল।
কানে কানে বললে,
“আমি তোমারই।”
পৃথিবী বললে,
“সে কেমন করে হবে।
তুমি যে অসীম,
আমি যে ছোটো।”
আকাশ বললে,
“আমি তো চার দিকে আমার
মেঘের সীমা টেনে দিয়েছি।”
পৃথিবী বললে,
“তোমার যে কত
জ্যোতিষ্কের সম্পদ,
আমার তো আলোর সম্পদ নেই।”
আকাশ বললে,
“আজ আমি আমার চন্দ্র
সূর্য তারা সব হারিয়ে ফেলে এসেছি,
আজ আমার একমাত্র তুমি আছ।”
পৃথিবী বললে,
“আমার অশ্রুভরা হৃদয়
হাওয়ায় হাওয়ায় চঞ্চল হয়ে কাঁপে,
তুমি যে অবিচলিত।”
আকাশ বললে,
“আমার অশ্রুও আজ চঞ্চল
হয়েছে,
দেখতে কি পাও নি। আমার বক্ষ আজ
শ্যামল হল তোমার ঐ শ্যামল হৃদয়টির মতো!”
সে এই ব’লে আকাশ-পৃথিবীর মাঝখানকার চিরবিরহটাকে চোখের জলের গান দিয়ে ভরিয়ে দিলে।
৫
সেই আকাশ-পৃথিবীর বিবাহমন্ত্রগুঞ্জন নিয়ে নববর্ষা নামুক আমাদের বিচ্ছেদের ’পরে। প্রিয়ার মধ্যে যা অনির্বচনীয় তাই হঠাৎ-বেজে-ওঠা বীণার তারের মতো চকিত হয়ে উঠুক। সে আপন সিঁথির ’পরে তুলে দিক দূর বনান্তের রঙটির মতো তার নীলাঞ্চল। তার কালো চোখের চাহনিতে মেঘমল্লারের সব মিড়গুলি আর্ত হয়ে উঠুক। সার্থক হোক বকুলমালা তার বেণীর বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে উঠে।
যখন ঝিল্লীর ঝংকারে বেণুবনের অন্ধকার থর্থর্ করছে, যখন বাদল-হাওয়ায় দীপশিখা কেঁপে কেঁপে নিবে গেল, তখন সে তার অতি কাছের ঐ সংসারটাকে ছেড়ে দিয়ে আসুক, ভিজে ঘাসের গন্ধে ভরা বনপথ দিয়ে, আমার নিভৃত হৃদয়ের নিশীথরাত্রে।
বাঁশি
[সবুজপত্র পত্রিকার কার্তিক ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
বাঁশির বাণী চিরদিনের বাণী— শিবের জটা থেকে গঙ্গার ধারা, প্রতি দিনের মাটির বুক বেয়ে চলেছে; অমরাবতীর শিশু নেমে এল মর্ত্যের ধূলি নিয়ে স্বর্গ-স্বর্গ খেলতে।
পথের ধারে দাঁড়িয়ে বাঁশি শুনি আর মন যে কেমন করে বুঝতে পারি নে। সেই ব্যথাকে চেনা সুখদুঃখের সঙ্গে মেলাতে যাই, মেলে না। দেখি, চেনা হাসির চেয়ে সে উজ্জ্বল, চেনা চোখের জলের চেয়ে সে গভীর।
আর, মনে হতে থাকে, চেনাটা সত্য নয়, অচেনাই সত্য। মন এমন সৃষ্টিছাড়া ভাব ভাবে কী করে। কথায় তার কোনো জবাব নেই।
আজ ভোরবেলাতেই উঠে শুনি, বিয়েবাড়িতে বাঁশি বাজছে।
বিয়ের এই প্রথম দিনের সুরের সঙ্গে প্রতি দিনের সুরের মিল কোথায়। গোপন অতৃপ্তি, গভীর নৈরাশ্য; অবহেলা, অপমান, অবসাদ; তুচ্ছ কামনার কার্পণ্য, কুশ্রী নীরসতার কলহ, ক্ষমাহীন ক্ষুদ্রতার সংঘাত, অভ্যস্ত জীবনযাত্রার ধূলিলিপ্ত দারিদ্র্য— বাঁশির দৈববাণীতে এ-সব বার্তার আভাস কোথায়।
গানের সুর সংসারের উপর থেকে এই-সমস্ত চেনা কথার পর্দা এক টানে ছিঁড়ে ফেলে দিলে। চিরদিনকার বর-কনের শুভদৃষ্টি হচ্ছে কোন্ রক্তাংশুকের সলজ্জ অবগুণ্ঠনতলে, তাই তার তানে তানে প্রকাশ হয়ে পড়ল।
যখন সেখানকার মালাবদলের গান বাঁশিতে বেজে উঠল তখন এখানকার এই কনেটির দিকে চেয়ে দেখলেম; তার গলায় সোনার হার, তার পায়ে দুগাছি মল, সে যেন কান্নার সরোবরে আনন্দের পদ্মটির উপরে দাঁড়িয়ে।
সুরের ভিতর দিয়ে তাকে সংসারের মানুষ ব’লে আর চেনা গেল না। সেই চেনা ঘরের মেয়ে অচিন ঘরের বউ হয়ে দেখা দিলে।
বাঁশি বলে, এই কথাই সত্য।
সন্ধ্যা ও প্রভাত
[মানসী ও মর্মবাণী পত্রিকার কার্তিক ১৩২৬
সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]
এখানে নামল সন্ধ্যা। সূর্যদেব, কোন্ দেশে, কোন্ সমুদ্রপারে, তোমার প্রভাত হল।
অন্ধকারে এখানে কেঁপে উঠছে রজনীগন্ধা, বাসরঘরের দ্বারের কাছে অবগুণ্ঠিতা নববধূর মতো; কোন্খানে ফুটল ভোরবেলাকার কনকচাঁপা।
জাগল কে। নিবিয়ে দিল সন্ধ্যায়-জ্বালানো দীপ, ফেলে দিল রাত্রে-গাঁথা সেঁউতিফুলের মালা।
এখানে একে একে দরজায় আগল পড়ল, সেখানে জানলা গেল খুলে। এখানে নৌকো ঘাটে বাঁধা, মাঝি ঘুমিয়ে; সেখানে পালে লেগেছে হাওয়া।
ওরা পান্থশালা থেকে বেরিয়ে পড়েছে, পুবের দিকে মুখ করে চলেছে; ওদের কপালে লেগেছে সকালের আলো, ওদের পারানির কড়ি এখনো ফুরোয় নি; ওদের জন্যে পথের ধারের জানলায় জানলায় কালো চোখের করুণ কামনা অনিমেষ চেয়ে আছে; রাস্তা ওদের সামনে নিমন্ত্রণের রাঙা চিঠি খুলে ধরলে, বললে, “তোমাদের জন্যে সব প্রস্তুত।”
ওদের হৃৎপিণ্ডের রক্তের তালে তালে জয়ভেরী বেজে উঠল।
এখানে সবাই ধূসর আলোয় দিনের শেষ খেয়া পার হল।
পান্থশালার আঙিনায় এরা কাঁথা বিছিয়েছে; কেউ বা একলা, কারো বা সঙ্গী ক্লান্ত; সামনের পথে কী আছে অন্ধকারে দেখা গেল না, পিছনের পথে কী ছিল কানে কানে বলাবলি করছে; বলতে বলতে কথা বেধে যায়, তার পরে চুপ করে থাকে; তার পরে আঙিনা থেকে উপরে চেয়ে দেখে, আকাশে উঠেছে সপ্তর্ষি।
সূর্যদেব, তোমার বামে এই সন্ধ্যা, তোমার দক্ষিণে ঐ প্রভাত, এদের তুমি মিলিয়ে দাও। এর ছায়া ওর আলোটিকে একবার কোলে তুলে নিয়ে চুম্বন করুক, এর পূরবী ওর বিভাসকে আশীর্বাদ করে চলে যাক।
পুরোনো বাড়ি
[মানসী ও মর্মবাণী পত্রিকার আশ্বিন ১৩২৬
সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]
অনেক কালের ধনী গরিব হয়ে গেছে, তাদেরই ঐ বাড়ি।
দিনে দিনে ওর উপরে দুঃসময়ের আঁচড় পড়ছে।
দেয়াল থেকে বালি খসে পড়ে, ভাঙা মেঝে নখ দিয়ে খুঁড়ে চড়ুইপাখি ধুলোয় পাখা ঝাপট দেয়, চণ্ডীমণ্ডপে পায়রাগুলো বাদলের ছিন্ন মেঘের মতো দল বাঁধল।
উত্তর দিকের এক পাল্লা দরজা কবে ভেঙে পড়েছে কেউ খবর নিলে না। বাকি দরজাটা, শোকাতুরা বিধবার মতো, বাতাসে ক্ষণে ক্ষণে আছাড় খেয়ে পড়ে— কেউ তাকিয়ে দেখে না।
তিন মহল বাড়ি। কেবল পাঁচটি ঘরে মানুষের বাস, বাকি সব বন্ধ। যেন পঁচাশি বছরের বুড়ো, তার জীবনের সবখানি জুড়ে সেকালের কুলুপ-লাগানো স্মৃতি, কেবল একখানিতে একালের চলাচল।
বালি-ধসা ইঁট-বের-করা বাড়িটা তালি-দেওয়া-কাঁথা-পরা উদাসীন পাগলার মতো রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে; আপনাকেও দেখে না, অন্যকেও না।
২
একদিন ভোররাত্রে ঐ দিকে মেয়ের গলায় কান্না উঠল। শুনি, বাড়ির যেটি শেষ ছেলে, শখের যাত্রায় রাধিকা সেজে যার দিন চলত, সে আজ আঠারো বছরে মারা গেল।
কদিন মেয়েরা কাঁদল, তার পরে তাদের আর খবর নেই।
তার পরে সকল দরজাতেই তালা পড়ল।
কেবল উত্তর দিকের সেই একখানা অনাথা দরজা ভাঙেও না, বন্ধও হয় না; ব্যথিত হৃৎপিণ্ডের মতো বাতাসে ধড়াস ধড়াস করে আছাড় খায়।
৩
একদিন সেই বাড়িতে বিকেলে ছেলেদের গোলমাল শোনা গেল।
দেখি, বারান্দা থেকে লালপেড়ে শাড়ি ঝুলছে।
অনেক দিন পরে বাড়ির এক অংশে ভাড়াটে এসেছে। তার মাইনে অল্প, ছেলে-মেয়ে বিস্তর। শ্রান্ত মা বিরক্ত হয়ে তাদের মারে, তারা মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে।
একটা আধাবয়সি দাসী সমস্ত দিন খাটে, আর গৃহিণীর সঙ্গে ঝগড়া করে; বলে ‘চললুম’, কিন্তু যায় না।
৪
বাড়ির এই ভাগটায় রোজ একটু-আধটু মেরামত চলছে।
ফাটা সাসির উপর কাগজ আঁটা হল; বারান্দায় রেলিঙের ফাঁকগুলোতে বাঁখারি বেঁধে দিলে; শোবার ঘরে ভাঙা জানলা ইঁট দিয়ে ঠেকিয়ে রাখলে; দেয়ালে চুনকাম হল, কিন্তু কালো ছাপগুলোর আভাস ঢাকা পড়ল না।
ছাদে আলসের ’পরে গামলায় একটা রোগা পাতাবাহারের গাছ হঠাৎ দেখা দিয়ে আকাশের কাছে লজ্জা পেলে। তার পাশেই ভিত ভেদ করে অশথ গাছটি সিধে দাঁড়িয়ে; তার পাতাগুলো এদের দেখে যেন খিল্খিল্ করে হাসতে লাগল।
মস্ত ধনের মস্ত দারিদ্র্য। তাকে ছোটো হাতের ছোটো কৌশলে ঢাকা দিতে গিয়ে তার আবরু গেল।
কেবল উত্তর দিকের উজাড় ঘরটির দিকে কেউ তাকায় নি। তার সেই জোড়ভাঙা দরজা আজও কেবল বাতাসে আছড়ে পড়ছে, হতভাগার বুক-চাপড়ানির মতো।
গলি
[সবুজপত্র পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২৬ সংখ্যায়
প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশের সময় রচনাটির নাম ছিল‒
কথিকা]]
আমাদের এই শানবাঁধানো গলি, বারে বারে ডাইনে বাঁয়ে এঁকে বেঁকে একদিন কী যেন খুঁজতে বেরিয়েছিল। কিন্তু, সে যে দিকেই যায় ঠেকে যায়। এ দিকে বাড়ি, ও দিকে বাড়ি, সামনে বাড়ি।
উপরের দিকে যেটুকু নজর চলে তাতে সে একখানি আকাশের রেখা দেখতে পায়— ঠিক তার নিজেরই মতো সরু, তার নিজেরই মতো বাঁকা।
সেই ছাঁটা আকাশটাকে জিজ্ঞাসা করে, “বলো তো দিদি, তুমি কোন্ নীল শহরের গলি।”
দুপুরবেলায় কেবল একটুখনের জন্যে সে সূর্যকে দেখে আর মনে মনে বলে, “কিচ্ছুই বোঝা গেল না।”
বর্ষামেঘের ছায়া দুইসার বাড়ির মধ্যে ঘন হয়ে ওঠে, কে যেন গলির খাতা থেকে তার আলোটাকে পেন্সিলের আঁচড় দিয়ে কেটে দিয়েছে। বৃষ্টির ধারা শানের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলে, বর্ষা ডমরু বাজিয়ে যেন সাপ খেলাতে থাকে। পিছল হয়, পথিকদের ছাতায় ছাতায় বেধে যায়, ছাদের উপর থেকে ছাতার উপরে হঠাৎ নালার জল লাফিয়ে প’ড়ে চমকিয়ে দিতে থাকে।
গলিটা অভিভূত হয়ে বলে, “ছিল খট্খটে শুকনো, কোনো বালাই ছিল না। কিন্তু, কেন অকারণে এই ধারাবাহী উৎপাত।”
ফাল্গুনে দক্ষিণের হাওয়াকে গলির মধ্যে লক্ষ্ণীছাড়ার মতো দেখতে হয়; ধুলো আর ছেঁড়া কাগজগুলো এলোমেলো উড়তে থাকে। গলি হতবুদ্ধি হয়ে বলে, “এ কোন্ পাগলা দেবতার মাতলামি!”
তার ধারে ধারে প্রতিদিন যে-সব আবর্জনা এসে জমে— মাছের আঁশ, চুলোর ছাই, তরকারির খোসা, মরা ইঁদুর, সে জানে এই-সব হচ্ছে বাস্তব। কোনোদিন ভুলেও ভাবে না, “এ সমস্ত কেন।”
অথচ, শরতের রোদ্দুর যখন উপরের বারান্দায় আড় হয়ে পড়ে, যখন পুজোর নহবত ভৈরবীতে বাজে, তখন ক্ষণকালের জন্যে তার মনে হয়, “এই শানবাঁধা লাইনের বাইরে মস্ত একটা-কিছু আছে বা!”
এ দিকে বেলা বেড়ে যায়; ব্যস্ত গৃহিণীর আঁচলটার মতো বাড়িগুলোর কাঁধের উপর থেকে রোদ্দুরখানা গলির ধারে খসে পড়ে; ঘড়িতে ন’টা বাজে; ঝি কোমরে ঝুড়ি করে বাজার নিয়ে আসে; রান্নার গন্ধে আর ধোঁয়ায় গলি ভরে যায়; যারা আপিসে যায় তারা ব্যস্ত হতে থাকে।
গলি তখন আবার ভাবে, “এই শানবাঁধা লাইনের মধ্যেই সব সত্য। আর, যাকে মনে ভাবছি মস্ত একটা-কিছু সে মস্ত একটা স্বপ্ন।”
[প্রবাসী পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
গাড়িতে ওঠবার সময় একটুখানি মুখ ফিরিয়ে সে আমাকে তার শেষ চাউনিটি দিয়ে গেছে।
এই মস্ত সংসারে ঐটুকুকে আমি রাখি কোন্খানে।
দণ্ড পল মুহূর্ত অহরহ পা ফেলবে না, এমন একটু জায়গা আমি পাই কোথায়।
মেঘের সকল সোনার রঙ যে সন্ধ্যায় মিলিয়ে যায় এই চাউনি কি সেই সন্ধ্যায় মিলিয়ে যাবে। নাগকেশরের সকল সোনালি রেণু যে বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় এও কি সেই বৃষ্টিতেই ধুয়ে যাবে।
সংসারের হাজার জিনিসের মাঝখানে ছড়িয়ে থাকলে এ থাকবে কেন— হাজার কথার আবর্জনায়, হাজার বেদনার স্তূপে।
তার ঐ এক চকিতের দান সংসারের আর-সমস্তকে ছাড়িয়ে আমারই হাতে এসে পৌঁচেছে। একে আমি রাখব গানে গেঁথে, ছন্দে বেঁধে; আমি একে রাখব সৌন্দর্যের অমরাবতীতে।
পৃথিবীর রাজার প্রতাপ, ধনীর ঐশ্বর্য হয়েছে মরবারই জন্যে। কিন্তু, চোখের জলে কি সেই অমৃত নেই যাতে এই নিমেষের চাউনিকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
গানের সুর বললে, “আচ্ছা, আমাকে দাও। আমি রাজার প্রতাপকে স্পর্শ করি নে, ধনীর ঐশ্বর্যকেও না, কিন্তু ঐ ছোটো জিনিসগুলিই আমার চিরদিনের ধন; ঐগুলি দিয়েই আমি অসীমের গলার হার গাঁথি।”
একটি দিন
[প্রবাসী পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
মনে পড়ছে সেই দুপুরবেলাটি। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টিধারা ক্লান্ত হয়ে আসে, আবার দমকা হাওয়া তাকে মাতিয়ে তোলে।
ঘরে অন্ধকার, কাজে মন যায় না। যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বর্ষার গানে মল্লারের সুর লাগালেম।
পাশের ঘর থেকে একবার সে কেবল দুয়ার পর্যন্ত এল। আবার ফিরে গেল। আবার একবার বাইরে এসে দাঁড়ালো। তার পরে ধীরে ধীরে ভিতরে এসে বসল। হাতে তার সেলাইয়ের কাজ ছিল, মাথা নিচু ক’রে সেলাই করতে লাগল। তার পরে সেলাই বন্ধ ক’রে জানলার বাইরে ঝাপসা গাছগুলোর দিকে চেয়ে রইল।
বৃষ্টি ধরে এল, আমার গান থামল। সে উঠে চুল বাঁধতে গেল।
এইটুকু ছাড়া আর কিছুই না। বৃষ্টিতে গানেতে অকাজে আঁধারে জড়ানো কেবল সেই একটি দুপুরবেলা।
ইতিহাসে রাজাবাদশার কথা, যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনী, সস্তা হয়ে ছড়াছড়ি যায়। কিন্তু, একটি দুপুরবেলার ছোটো একটু কথার টুকরো দুর্লভ রত্নের মতো কালের কৌটোর মধ্যে লুকোনো রইল, দুটি লোক তার খবর জানে।