ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী

রচনাবলী সূচি
 

লিপিকা

 



কৃতঘ্ন শোক
[ভারতী পত্রিকার কার্তিক ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]


 

ভোরবেলায় সে বিদায় নিলে।

আমার মন আমাকে বোঝাতে বসল, “সবই মায়া।”

আমি রাগ করে বললেম, “এই তো টেবিলে সেলাইয়ের বাক্স, ছাতে ফুলগাছের টব, খাটের উপর নাম-লেখা হাতপাখাখানি— সবই তো সত্য।”

মন বললে, “তবু ভেবে দেখো—”

আমি বললেম, “থামো তুমি। ঐ দেখো-না গল্পের বইখানি, মাঝের পাতায় একটি চুলের কাঁটা, সবটা পড়া শেষ হয় নি; এও যদি মায়া হয়, সে এর চেয়েও বেশি মায়া হল কেন।”

মন চুপ করলে। বন্ধু এসে বললেন, “যা ভালো তা সত্য, তা কখনো যায় না; সমস্ত জগৎ তাকে রত্নের মতো বুকের হারে গেঁধে রাখে।”

আমি রাগ করে বললেম, “কী করে জানলে। দেহ কি ভালো নয়। সে দেহ গেল কোন্‌খানে।”

ছোটো ছেলে যেমন রাগ করে মাকে মারে তেমনি করেই বিশ্বে আমার যা-কিছু আশ্রয় সমস্তকেই মারতে লাগলেম। বললেম. “সংসার বিশ্বাসঘাতক।”

হঠাৎ চমকে উঠলেম। মনে হল কে বললে, “অকৃতজ্ঞ!”

জানালার বাইরে দেখি ঝাউগাছের আড়ালে তৃতীয়ার চাঁদ উঠেছে, যে গেছে যেন তারই হাসির লুকোচুরি। তারা-ছিটিয়ে-দেওয়া অন্ধকারের ভিতর থেকে একটি ভর্ৎসনা এল, “ধরা দিয়েছিলেম সেটাই কি ফাঁকি, আর আড়াল পড়েছে এইটেকেই এত জোরে বিশ্বাস?”


 

সতেরো বছর
[ভারতী পত্রিকার কার্তিক ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]

আমি তার সতেরো বছরের জানা।

কত আসাযাওয়া, কত দেখাদেখি, কত বলাবলি; তারই আশেপাশে কত স্বপ্ন, কত অনুমান, কত ইশারা; তারই সঙ্গে সঙ্গে কখনো বা ভোরের ভাঙা ঘুমে শুকতারার আলো, কখনো বা আষাঢ়ের ভরসন্ধ্যায় চামেলিফুলের গন্ধ, কখনো বা বসন্তের শেষ প্রহরে ক্লান্ত নহবতের পিলুবারোয়াঁ; সতেরো বছর ধরে এই-সব গাঁথা পড়েছিল তার মনে।

আর, তারই সঙ্গে মিলিয়ে সে আমার নাম ধরে ডাকাত। ঐ নামে যে মানুষ সাড়া দিত সে তো একা বিধাতার রচনা নয়। সে যে তারই সতেরো বছরের জানা দিয়ে গড়া; কখনো আদরে কখনো অনাদরে, কখনো কাজে কখনো অকাজে, কখনো সবার সামনে কখনো একলা আড়ালে, কেবল একটি লোকের মনে মনে জানা দিয়ে গড়া সেই মানুষ।

তার পরে আরো সতেরো বছর যায়। কিন্তু এর দিনগুলি, এর রাতগুলি, সেই নামের রাখিবন্ধনে আর তো এক হয়ে মেলে না, এরা ছড়িয়ে পড়ে।

তাই এরা রোজ আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “আমরা থাকব কোথায়। আমাদের ডেকে নিয়ে ঘিরে রাখবে কে।”

আমি তার কোনো জবাব দিতে পারি নে, চুপ করে বসে থাকি আর ভাবি। আর, ওরা বাতাসে উড়ে চলে যায়। বলে, “আমরা খুঁজতে বেরোলেম।”

“কাকে।”

কাকে সে এরা জানে না। তাই কখনো যায় এ দিকে, কখনো যায় ও দিকে; সন্ধ্যাবেলাকার খাপছাড়া মেঘের মতো অন্ধকারে পাড়ি দেয়, আর দেখতে পাই নে।


 প্রথম শোক
[সবুজ পত্র পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশের সময় নাম ছিল 'কথিকা']
 

বনের ছায়াতে যে পথটি ছিল সে আজ ঘাসে ঢাকা।

সেই নির্জনে হঠাৎ পিছন থেকে কে বলে উঠল, “আমাকে চিনতে পার না?

আমি ফিরে তার মুখের দিকে তাকালেম। বললেম, “মনে পড়ছে, কিন্তু ঠিক নাম করতে পারছি নে।”

সে বললে, “আমি তোমার সেই অনেক কালের, সেই পঁচিশ বছর বয়সের শোক।”

তার চোখের কোণে একটু ছল্‌‍ছলে আভা দেখা দিলে, যেন দিঘির জলে চাঁদের রেখা।

অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেম। বললেম, “সেদিন তোমাকে শ্রাবণের মেঘের মতো কালো দেখেছি, আজ যে দেখি আশ্বিনের সোনার প্রতিমা। সেদিনকার সব চোখের জল কি হারিয়ে ফেলেছ।”

কোনো কথাটি না বলে সে একটু হাসলে; বুঝলেম, সবটুকু রয়ে গেছে ঐ হাসিতে। বর্ষার মেঘ শরতে শিউলিফুলের হাসি শিখে নিয়েছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলেম, “আমার সেই পঁচিশ বছরের যৌবনকে কি আজও তোমার কাছে রেখে দিয়েছ।”

সে বললে, “এই দেখো-না আমার গলার হার।”

দেখলেম, সেদিনকার বসন্তের মালার একটি পাপড়িও খসে নি।

আমি বললেম, “আমার আর তো সব জীর্ণ হয়ে গেল, কিন্তু তোমার গলায় আমার সেই পঁচিশ বছরের যৌবন আজও তো ম্লান হয় নি।”

আস্তে আস্তে সেই মালাটি নিয়ে সে আমার গলায় পরিয়ে দিলে। বললে, “মনে আছে? সেদিন বলেছিলে, তুমি সান্ত্বনা চাও না, তুমি শোককেই চাও।”

লজ্জিত হয়ে বললেম, “বলেছিলেম। কিন্তু, তার পরে অনেক দিন হয়ে গেল, তার পরে কখন ভুলে গেলেম।”

সে বললে, “যে অন্তর্যামীর বর, তিনি তো ভোলেন নি। আমি সেই অবধি ছায়াতলে গোপনে বসে আছি। আমাকে বরণ করে নাও।”

আমি তার হাতখানি আমার হাতে তুলে নিয়ে বললেম, “এ কী তোমার অপরূপ মূর্তি।”

সে বললে, “যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি।”


 প্রশ্ন
[ভারতী পত্রিকার আশ্বিন ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]

 

শ্মাশান হতে বাপ ফিরে এল।

তখন সাত বছরের ছেলেটিগা খোলা, গলায় সোনার তাবিজ একলা গলির উপরকার জানলার ধারে।

কী ভাবছে তা সে আপনি জানে না।

সকালের রৌদ্র সামনের বাড়ির নিম গাছটির আগডালে দেখা দিয়েছে; কাঁচাআমওয়ালা গলির মধ্যে এসে হাঁক দিয়ে দিয়ে ফিরে গেল।

বাবা এসে খোকাকে কোলে নিলে; খোকা জিজ্ঞাসা করলে, “মা কোথায়।”

বাবা উপরের দিকে মাথা তুলে বললে, “স্বর্গে।”

সে রাত্রে শোকে শ্রান্ত বাপ, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্ষণে ক্ষণে গুমরে উঠছে।

দুয়ারে লণ্ঠনের মিট্‌‍মিটে আলো, দেয়ালের গায়ে একজোড়া টিকটিকি।

সামনে খোলা ছাদ, কখন খোকা সেইখানে এসে দাঁড়াল।

চারি দিকে আলো-নেবানো বাড়িগুলো যেন দৈত্যপুরীর পাহারাওয়ালা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমচ্ছে।

উলঙ্গ গায়ে খোকা আকাশের দিকে তাকিয়ে।

তার দিশাহারা মন কাকে জিজ্ঞাসা করছে, “কোথায় স্বর্গের রাস্তা।”

আকাশে তার কোনো সাড়া নেই; কেবল তারায় তারায় বোবা অন্ধকারের চোখের জল।


 


 গল্প
[প্রবাসী পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৭ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশের সময় নাম ছিল 'গল্প বল']

ছেলেটির যেমনি কথা ফুটল অমনি সে বললে, “গল্প বলো।”

দিদিমা বলতে শুরু করলেন, “এক রাজপুত্তুর, কোটালের পুত্তুর, সদাগরের পুত্তুর

গুরুমশায় হেঁকে বললেন, “তিন-চারে বারো।”

কিন্তু তখন তার চেয়ে বড়ো হাঁক দিয়েছে রাক্ষসটা “হাঁউ মাউ খাঁউ” নামতার হুংকার ছেলেটার কানে পৌঁছয় না।

যারা হিতৈষী তারা ছেলেকে ঘরে বন্ধ করে গম্ভীর স্বরে বললে, “তিন-চারে বারো এটা হল সত্য; আর রাজপুত্তুর, কোটালের পুত্তুর, সওদাগরের পুত্তুর, ওটা হল মিথ্যে, অতএব

ছেলেটির মন তখন সেই মানসচিত্রের সমুদ্র পেরিয়ে গেছে মানচিত্রে যার ঠিকানা মেলে না; তিন-চারে বারো তার পিছে পিছে পাড়ি দিতে যায়, কিন্তু সেখানে ধারাপাতের হালে পানি পায় না।

হিতৈষী মনে করে, নিছক দুষ্টমি, বেতের চোটে শোধন করা চাই।

দিদিমা গুরুমশায়ের গতিক দেখে চুপ। কিন্তু আপদ বিদায় হতে চায় না, এক যায় তো আর আসে। কথক এসে আসন জুড়ে বসলেন। তিনি শুরু করে দিলেন এক রাজপুত্রের বনবাসের কথা।

যখন রাক্ষসীর নাক কাটা চলছে তখন হিতৈষী বললেন, “ইতিহাসে এর কোনো প্রমাণ নেই; যার প্রমাণ পথে ঘাটে সে হচ্ছে, তিন-চারে বারো।”

ততক্ষণে হনুমান লাফ দিয়েছে আকাশে, অত ঊর্ধ্বে ইতিহাস তার সঙ্গে কিছুতেই পাল্লা দিতে পারে না। পাঠশালা থেকে ইস্কুলে, ইস্কুল থেকে কলেজে ছেলের মনকে পুটপাকে শোধন করা চলতে লাগল। কিন্তু যতই চোলাই করা যাক, ঐ কথাটুকু কিছুতেই মরতে চায় না “গল্প বলো”।

 

এর থেকে দেখা যায়, শুধু শিশুবয়সে নয়, সকল বয়সেই মানুষ গল্পপোষ্য জীব। তাই পৃথিবী জুড়ে মানুষের ঘরে ঘরে, যুগে যুগে, মুখে মুখে, লেখায় লেখায়, গল্প যা জমে উঠেছে তা মানুষের সকল সঞ্চয়কেই ছাড়িয়ে গেছে।

হিতৈষী একটা কথা ভালো করে ভেবে দেখে না, গল্পরচনার নেশাই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সবশেষের নেশা; তাঁকে শোধন করতে না পারলে মানুষকে শোধন করার আশা করা যায় না।

একদিন তিনি তাঁর কারখানাঘরে আগুন থেকে জল, জল থেকে মাটি গড়তে লেগে গিয়েছিলেন। সৃষ্টি তখন গলদ্‌‍ঘর্ম, বাষ্পভারাকুল। ধাতুপাথরের পিণ্ডগুলো তখন থাকে থাকে গাঁথা হচ্ছে; চার দিকে মালমসলা ছড়ানো আর দমাদম পিটনি। সেদিন বিধাতাকে দেখলে কোনোমতে মনে করা যেতে পারত না যে, তাঁর মধ্যে কোথাও কিছু ছেলেমানুষি আছে। তখনকার কাণ্ডকারখানা যাকে বলে সারবান

তার পরে কখন শুরু হল প্রাণের পত্তন। জাগল ঘাস, উঠল গাছ, ছুটল পশু, উড়ল পাখি। কেউ বা মাটিতে বাঁধা থেকে আকাশে অঞ্জলি পেতে দাঁড়াল, কেউ বা ছাড়া পেয়ে পৃথিবীময় আপনাকে বহুধা বিস্তার করে চলল, কেউ বা জলের যবনিকাতলে নিঃশব্দ নৃত্যে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে ব্যস্ত, কেউ বা আকাশে ডানা মেলে সূর্যালোকের বেদীতলে গানের অর্ঘ্যরচনায় উৎসুক। এখন থেকেই ধরা পড়তে লাগল বিধাতার মনের চাঞ্চল্য।

এমন করে বহু যুগ কেটে যায়। হঠাৎ এক সময়ে কোন্ খেয়ালে সৃষ্টিকর্তার কারখানায় উনপঞ্চাশ পবনের তলব পড়ল। তাদের সব কটাকে নিয়ে তিনি মানুষ গড়লেন। এত দিন পরে আরম্ভ হল তাঁর গল্পের পালা। বহুকাল কেটেছে তাঁর বিজ্ঞানে, কারুশিল্পে; এইবার তাঁর শুরু হল সাহিত্য।

মানুষকে তিনি গল্পে গল্পে ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন। পশুপাখির জীবন হল আহার নিদ্রা সন্তানপালন; মানুষের জীবন হল গল্প। কত বেদনা, কত ঘটনা; সুখদুঃখ রাগবিরাগ ভালোমন্দের কত ঘাতপ্রতিঘাত। ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার, একের সঙ্গে দশের, সাধনার সঙ্গে স্বভাবের, কামনার সঙ্গে ঘটনার সংঘাতে কত আবর্তন। নদী যেমন জলস্রোতের ধারা, মানুষ তেমনি গল্পের প্রবাহ। তাই পরস্পর দেখা হতেই প্রশ্ন এই, “কী হল হে, কী খবর, তার পরে?” এই তার পরের সঙ্গে তার পরেবোনা হয়ে পৃথিবী জুড়ে মানুষের গল্প গাঁথা হচ্ছে। তাকেই বলি জীবনের কাহিনী, তাকেই বলি মানুষের ইতিহাস।

বিধাতার-রচা ইতিহাস আর মানুষের-রচা কাহিনী, এই দুইয়ে মিলে মানুষের সংসার। মানুষের পক্ষে কেবল-যে অশোকের গল্প, আকবরের গল্পই সত্য তা নয়; যে রাজপুত্র সাত-সমুদ্র-পারে সাত-রাজার-ধন মানিকের সন্ধানে চলে সেও সত্য; আর সেই ভক্তিবিমুগ্ধ হনুমানের সরল বীরত্বের কথাও সত্য যে হনুমান গন্ধমাদনকে উৎপাটিত করে আনতে সংশয় বোধ করে না। এই মানুষের পক্ষে আরঞ্জেব যেমন সত্য দুর্যোধনও তেমনি সত্য। কোন্‌‍টার প্রমাণ বেশি, কোন্‌‍টার প্রমাণ কম, সে হিসাবে নয়; কেবল গল্প হিসাবে কোন্‌‍টা খাঁটি, সেইটেই তার পক্ষে সবচেয়ে সত্য।

মানুষ বিধাতার সাহিত্যলোকেই মানুষ; সুতরাং না সে বস্তুতে গড়া, না তত্ত্বে অনেক চেষ্টা করে হিতৈষী কোনোমতেই এই কথা মানুষকে ভোলাতে পারলে না। অবশেষে হয়রান হয়ে হিতকথার সঙ্গে গল্পের সন্ধিস্থাপন করতে সে চেষ্টা করে, কিন্তু চিরকালের স্বভাবদোষে কিছুতে জোড়া মেলাতে পারে না। তখন গল্পও যায় কেটে, হিতকথাও পড়ে খসে, আবর্জনা জমে ওঠে।


মীনু
[ভারতী পত্রিকার কর্তিক ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]

 

মীনু পশ্চিমে মানুষ হয়েছে। ছেলেবেলায় ইঁদারার ধারে তুঁতের গাছে লুকিয়ে ফল পাড়তে যেত; আর অড়রখেতে যে বুড়ো মালী ঘাস নিড়োত তার সঙ্গে ওর ছিল ভাব।

বড়ো হয়ে জৌনপুরে হল ওর বিয়ে। একটি ছেলে হয়ে মারা গেল, তার পরে ডাক্তার বললে, “এও বাঁচে কি না-বাঁচে।

তখন তাকে কলকাতায় নিয়ে এল।

ওর অল্প বয়েস। কাঁচা ফলটির মতো ওর কাঁচা প্রাণ পৃথিবীর বোঁটা শক্ত করে আঁকড়ে ছিল। যা-কিছু কচি, যা-কিছু সবুজ, যা-কিছু সজীব, তার পরেই ওর বড়ো টান।

আঙিনায় তার আট-দশ হাত জমি, সেইটুকুতে তার বাগান।

এই বাগানটি ছিল যেন তার কোলের ছেলে। তারই বেড়ার পরে যে ঝুমকোলতা লাগিয়েছিল। এইবার সেই লতায় কুঁড়ির আভাস দিতেই সে চলে এসেছে।

পাড়ার সমস্ত পোষা এবং না-পোষা কুকুরের অন্ন আর আদর ওরই বাড়িতে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে যেটিকে সে ভালোবাসত তার নাক ছিল খাঁদা, তার নাম ছিল ভোঁতা।

তারই গলায় পরাবে বলে মীনু রঙিন পুঁতির মালা গাঁথতে বসেছিল। সেটা শেষ হল না। যার কুকুর সে বললে, “বউদিদি, এটিকে তুমি নিয়ে যাও।

মীনুর স্বামী বললে, “বড়ো হাঙ্গাম, কাজ নেই।

 

কলকাতার বাসায় দোতলার ঘরে মীনু শুয়ে থাকে। হিন্দুস্থানি দাই কাছে বসে কত কী বকে; সে খানিক শোনে, খানিক শোনে না।

একদিন সাররাত মীনুর ঘুম ছিল না। ভোরের আঁধার একটু যেই ফিকে হল সে দেখতে পেলে, তার জানলার নিচেকার গোলকচাঁপার গাছটি ফুলে ভরে উঠেছে। তার একটু মৃদুগন্ধ মীনুর জানলার কাছটিতে এসে যেন জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি কেমন আছ।

ওদের বাসা আর পাশের বাড়িটার অল্প একটুখানি ফাঁকের মধ্যে ঐ রৌদ্রের কাঙাল গাছটি, বিশ্বপ্রকৃতির এই হাবা ছেলে, কেমন করে এসে পড়ে যেন বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ক্লান্ত মীনু বেলায় উঠত। উঠেই সেই গাছটির দিকে চেয়ে দেখত, সেদিনের মতো আর তো তেমন ফুল দেখা যায় না। দাইকে বলত, “আহা দাই, মাথা খা, এই গাছের তলাটি খুঁড়ে দিয়ে রোজ একটু জল দিস।

এই গাছে কেন-যে কদিন ফুল দেখা যায় নি, একটু পরেই বোঝা গেল।

সকালের আলো তখন আধফোটা পদ্মের মতো সবে জাগছে, এমন সময় সাজি হাতে পূজারি ব্রাহ্মণ গাছটাকে ঝাঁকানি দিতে লাগল, যেন খাজনা আদায়ের জন্যে বর্গির পেয়াদা।

মীনু দাইকে বললে, “শীঘ্র ঐ ঠাকুরকে একবার ডেকে আন্‌‍।

ব্রাহ্মণ আসতেই মীনু তাকে প্রণাম করে বললে, “ঠাকুর, ফুল নিচ্ছ কার জন্যে।

ব্রাহ্মণ বললে, “দেবতার জন্যে।

মীনু বললে, “দেবতা তো ঐ ফুল স্বয়ং আমাকে পাঠিয়েছেন।

তোমাকে!

হাঁ, আমাকে। তিনি যা দিয়েছেন সে তো ফিরিয়ে নেবেন বলে দেন নি।

ব্রাহ্মণ বিরক্ত হয়ে চলে গেল।

পরের দিন ভোরে আবার সে যখন গাছ নাড়া দিতে শুরু করলে তখন মীনু তার দাইকে বললে, “ও দাই, এ তো আমি চোখে দেখতে পারি নে। পাশের ঘরের জানলার কাছে আমার বিছানা করে দে।

 

পাশের ঘরের জানলার সামনে রায়চৌধুরীদের চৌতলা বাড়ি। মীনু তার স্বামীকে ডাকিয়ে এনে বললে, “ঐ দেখো, দেখো, ওদের কী সুন্দর ছেলেটি। ওকে একটিবার আমার কোলে এনে দাও-না।

স্বামী বললে, “গরিবের ঘরে ছেলে পাঠাবে কেন।

মীনু বললে, “শোনো একবার! ছোটো ছেলের বেলায় কি ধনী-গরিবের ভেদ আছে। সবার কোলেই ওদের রাজসিংহাসন।

স্বামী ফিরে এসে খবর দিলে, “দরোয়ান বললে, বাবুর সঙ্গে দেখা হবে না।

পরের দিন বিকেলে মীনু দাইকে ডেকে বললে, “ঐ চেয়ে দেখ্‌‍, বাগানে একলা বসে খেলছে। দৌড়ে যা, ওর হাতে এই সন্দেশটি দিয়ে আয়।

সন্ধ্যাবেলায় স্বামী এসে বললে, “ওরা রাগ করেছে।

কেন, কী হয়েছে?”

ওরা বলেছে, দাই যদি ওদের বাগানে যায় তো পুলিসে ধরিয়ে দেবে।

এক মুহূর্তে মীনুর দুই চোখ জলে ভেসে গেল। সে বললে, “আমি দেখেছি, দেখেছি, ওর হাত থেকে ওরা আমার সন্দেশ ছিনিয়ে নিলে। নিয়ে ওকে মারলে। এখানে আমি বাঁচব না। আমাকে নিয়ে যাও।


নামের খেলা
[মোসলেম ভারত পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]
 

প্রথম বয়সেই সে কবিতা লিখতে শুরু করে।

বহু যত্নে খাতায় সোনালি কালির কিনারা টেনে, তারই গায়ে লতা এঁকে, মাঝখানে লাল কালি দিয়ে কবিতাগুলি লিখে রাখত। আর, খুব সমারোহে মলাটের উপর লিখত, শ্রীকেদারনাথ ঘোষ।

একে একে লেখাগুলিকে কাগজে পাঠাতে লাগল। কোথাও ছাপা হল না।

মনে মনে সে স্থির করলে যখন হাতে টাকা জমবে তখন নিজে কাগজ বের করবে।

বাপের মৃত্যুর পর গুরুজনেরা বার বার বললে, “একটা কোনো কাজের চেষ্টা করো, কেবল লেখা নিয়ে সময় নষ্ট কোরো না।

সে একটুখানি হাসলে আর লিখতে লাগল। একটি দুটি তিনটি বই সে পরে পরে ছাপালে।

এই নিয়ে খুব আন্দোলন হবে আশা করেছিল। হল না।

 

আন্দোলন হল একটি পাঠকের মনে। সে হচ্ছে তার ছোটো ভাগ্নেটি।

নতুন ক খ শিখে সে যে বই হাতে পায় চেঁচিয়ে পড়ে।

একদিন একখানা বই নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মামার কাছে ছুটে এল। বললে, “দেখো দেখো, মামা, এ যে তোমারই নাম।

মামা একটুখানি হাসলে, আর আদর করে খোকার গাল টিপে দিলে।

মামা তার বাক্স খুলে আর-একখানি বই বের করে বললে, “আচ্ছা, এটা পড়্ দেখি।

ভাগ্নে একটি একটি অক্ষর বানান করে করে মামার নাম পড়ল। বাক্স থেকে আরও একটা বই বেরোল, সেটাতেও পড়ে দেখে মামার নাম।

পরে পরে যখন তিনটি বইয়ে মামার নাম দেখলে তখন সে আর অল্পে সন্তুষ্ট হতে চাইল না। দুই হাত ফাঁক করে জিজ্ঞেস করলে, “তোমার নাম আরও অনেক অনেক অনেক বইয়ে আছে একশোটা, চব্বিশটা, সাতটা বইয়ে?”

মামা চোখ টিপে বললে, “ক্রমে দেখতে পাবি।

ভাগ্নে বই তিনটে নিয়ে লাফাতে লাফাতে বাড়ির বুড়ি ঝিকে দেখাতে নিয়ে গেল।

 

ইতিমধ্যে মামা একখানা নাটক লিখেছে। ছত্রপতি শিবাজি তার নায়ক।

বন্ধুরা বললে, “এ নাটক নিশ্চয় থিয়েটারে চলবে।

সে মনে মনে স্পষ্ট দেখতে লাগল, রাস্তায় রাস্তায় গলিতে গলিতে তার নিজের নামে আর নাটকের নামে যেন শহরের গায়ে উল্কি পরিয়ে দিয়েছে।

আজ রবিবার। তার থিয়েটারবিলাসী বন্ধু থিয়েটারওয়ালাদের কাছে অভিমত আনতে গেছে। তার সে পথ চেয়ে রইল।

রবিবারে তার ভাগ্নেরও ছুটি। আজ সকাল থেকে সে এক খেলা বের করেছে, অন্যমনস্ক হয়ে মামা তা লক্ষ্য করে নি।

ওদের ইস্কুলের পাশে ছাপাখানা আছে। সেখান থেকে ভাগ্নে নিজের নামের কয়েকটা সীসের অক্ষর জুটিয়ে এনেছে। তার কোনোটা ছোটো, কোনোটা বড়ো।

যে-কোনো বই পায় এই সীসের অক্ষরে কালি লাগিয়ে তাতে নিজের নাম ছাপাচ্ছে। মামাকে আশ্চর্য করে দিতে হবে।

 

আশ্চর্য করে দিলে। মামা এক সময়ে বসবার ঘরে এসে দেখে, ছেলেটি ভারি ব্যস্ত।

কী কানাই, কী করছিস।

ভাগ্নে খুব আগ্রহ করেই দেখালে সে কী করছে। কেবল তিনটিমাত্র বই নয়, অন্তত পঁচিশখানা বইয়ে ছাপার অক্ষরে কানাইয়ের নাম।

এ কী কাণ্ড। পড়াশুনোর নাম নেই, ছোঁড়াটার কেবল খেলা। আর, এ কী রকম খেলা।

কানাইয়ের বহু দুঃখে জোটানো নামের অক্ষরগুলি হাত থেকে সে ছিনিয়ে নিলে।

কানাই শোকে চীৎকার করে কাঁদে, তার পরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, তার পরে থেকে থেকে দমকায় দমকায় কেঁদে ওঠে কিছুতেই সান্ত্বনা মানে না।

বুড়ি ঝি ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলে, “কী হয়েছে, বাবা।

কানাই বললে, “আমার নাম।

মা এসে বললে, “কী রে কানাই, কী হয়েছে।

কানাই রুদ্ধকণ্ঠে বললে, “আমার নাম।

ঝি লুকিয়ে তার হাতে আস্ত একটি ক্ষীরপুলি এনে দিলে; মাটিতে ফেলে দিয়ে সে বললে, “আমার নাম।

মা এসে বললে, “কানাই, এই নে তোর সেই রেলগাড়িটা।

কানাই রেলগাড়ি ঠেলে ফেলে বললে, “আমার নাম।

 

থিয়েটার থেকে বন্ধু এল।

মামা দরজার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে, “কী হল।

বন্ধু বললে, “ওরা রাজি হল না।

অনেক ক্ষণ চুপ করে থেকে মামা বললে, “আমার সর্বস্ব যায় সেও ভালো, আমি নিজে থিয়েটার খুলব।

বন্ধু বললে, “আজ ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাবে না?”

ও বললে, “না, আমার জ্বরভাব।

বিকেলে মা এসে বললে, “খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

ও বললে, “খিদে নেই।

সন্ধের সময় স্ত্রী এসে বললে, “তোমার সেই নতুন লেখাটা শোনাবে না?”

ও বললে, “মাথা ধরেছে।

ভাগ্নে এসে বললে, “আমার নাম ফিরিয়ে দাও।

মামা ঠাস্ করে তার গালে এক চড় কষিয়ে দিলে।


ভুল স্বর্গ
[প্রবাসী পত্রিকার কর্তিক ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]


লোকটি নেহাত বেকার ছিল।
তার কোনো কাজ ছিল না
, কেবল শখ ছিল নানা রকমের
ছোটো ছোটো কাঠের চৌকোয় মাটি ঢেলে তার উপরে সে ছোটো ছোটো ঝিনুক সাজাতদূর থেকে দেখে মনে হত যেন একটা এলোমেলো ছবি, তার মধ্যে পাখির ঝাঁক; কিম্বা এবড়ো-খেবড়ো মাঠ, সেখানে গোরু চরছে, কিম্বা উঁচুনিচু পাহাড়, তার গা দিয়ে ওটা বুঝি ঝরনা হবে, কিম্বা পায়ে-চলা পথ
বাড়ির লোকের কাছে তার লাঞ্ছনার সীমা ছিল নামাঝে মাঝে পণ করত পাগলামি ছেড়ে দেবে, কিন্তু পাগলামি তাকে ছাড়ত না

কোনো কোনো ছেলে আছে সারা বছর পড়ায় ফাঁকি দেয়, অথচ পরীক্ষায় খামকা পাস করে ফেলে এর সেই দশা হল
সমস্ত জীবনটা অকাজে গেল, অথচ মৃত্যুর পরে খবর পেলে যে, তার স্বর্গে যাওয়া মঞ্জুর
কিন্তু, নিয়তি স্বর্গের পথেও মানুষের সঙ্গ ছাড়ে নাদূতগুলো মার্কা ভুল করে তাকে কেজো লোকের স্বর্গে রেখে এল
এই স্বর্গে আর সবই আছে, কেবল অবকাশ নেই
এখানে পুরুষরা বলছে, “হাঁফ ছাড়বার সময় কোথা?” মেয়েরা বলছে, “চললুম, ভাই, কাজ রয়েছে পড়ে” সবাই বলে, “সময়ের মূল্য আছে” কেউ বলে না, “সময় অমূল্য” “আর তো পারা যায় না” ব’লে সবাই আক্ষেপ করে, আর ভারি খুশি হয়“খেটে খেটে হয়রান হলুম” এই নালিশটাই সেখানকার সংগীত

এ বেচারা কোথাও ফাঁক পায় না, কোথাও খাপ খায় নারাস্তায় অন্যমনস্ক হয়ে চলে, তাতে ব্যস্ত লোকের পথ আটক করেচাদরটি পেতে যেখানেই আরাম ক’রে বসতে চায়, শুনতে পায়, সেখানেই ফসলের খেত, বীজ পোঁতা হয়ে গেছেকেবলই উঠে যেতে হয়, সরে যেতে হয়

ভারি এক ব্যস্ত মেয়ে স্বর্গের উৎস থেকে রোজ জল নিতে আসে
পথের উপর দিয়ে সে চলে যায় যেন সেতারের দ্রুত তালের গতের মতো

তাড়াতাড়ি সে এলো-খোঁপা বেঁধে নিয়েছেতবু দু-চারটে দুরন্ত অলক কপালের উপর ঝুঁকে প’ড়ে তার চোখের কালো তারা দেখবে ব’লে উঁকি মারছে
স্বর্গীয় বেকার মানুষটি এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, চঞ্চল ঝরনার ধারে তমালগাছটির মতো স্থির
জানলা থেকে ভিক্ষুককে দেখে রাজকন্যার যেমন দয়া হয়, এ’কে দেখে মেয়েটির তেমনি দয়া হল
“আহা, তোমার হাতে বুঝি কাজ নেই?
নিশ্বাস ছেড়ে বেকার বললে, “কাজ করব তার সময় নেই
মেয়েটি ওর কথা কিছুই বুঝতে পারলে না
বললে, “আমার হাত থেকে কিছু কাজ নিতে চাও?
বেকার বললে
, “তোমার হাত থেকেই কাজ নেব ব’লে দাঁড়িয়ে আছি
“কী কাজ দেব
?
“তুমি যে ঘড়া কাঁখে করে জল তুলে নিয়ে যাও তারই একটি যদি আমাকে দিতে পারো।”
“ঘড়া নিয়ে কী হবে। জল তুলবে
?
“না, আমি তার গায়ে চিত্র করব
মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বললে
, “আমার সময় নেই, আমি চললুম
কিন্তু, বেকার লোকের সঙ্গে কাজের লোক পারবে কেন। রোজ ওদের উৎসতলায় দেখা হয় আর রোজ সেই একই কথা,
“তোমার কাঁখের একটি ঘড়া দাও, তাতে চিত্র করব

হার মানতে হল
, ঘড়া দিলে
সেইটিকে ঘিরে ঘিরে বেকার আঁকতে লাগল কত রঙের পাক, কত রেখার ঘের
আঁকা শেষ হলে মেয়েটি ঘড়া তুলে ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেভুরু বাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “এর মানে?
বেকার লোকটি বললে
, “এর কোনো মানে নেই
ঘড়া নিয়ে মেয়েটি বাড়ি গেল

সবার চোখের আড়ালে বসে সেটিকে সে নানা আলোতে নানা রকমে হেলিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেরাত্রে থেকে থেকে বিছানা ছেড়ে উঠে দীপ জ্বেলে চুপ করে বসে সেই চিত্রটা দেখতে লাগলতার বয়সে এই সে প্রথম এমন কিছু দেখেছে যার কোনো মানে নেই
তার পরদিন যখন সে উৎসতলায় এল তখন তার দুটি পায়ের ব্যস্ততায় একটু যেন বাধা পড়েছেপা দুটি যেন চলতে চলতে আন্‌মনা হয়ে ভাবছে— যা ভাবছে তার কোনো মানে নেই
সেদিনও বেকার মানুষ এক পাশে দাঁড়িয়ে
মেয়েটি বললে, “কী চাও?
সে বললে
, “তোমার হাত থেকে আরো কাজ চাই
“কী কাজ দেব
?'
“যদি রাজি হও
, রঙিন সুতো বুনে বুনে তোমার বেণী বাঁধবার দড়ি তৈরি করে দেব
“কী হবে?
“কিছুই হবে না

নানা রঙের নানা-কাজ করা দড়ি তৈরি হল
এখন থেকে আয়না হাতে নিয়ে বেণী বাঁধতে মেয়ের অনেক সময় লাগেকাজ পড়ে থাকে, বেলা বয়ে যায়

এ দিকে দেখতে দেখতে কেজো স্বর্গে কাজের মধ্যে বড়ো বড়ো ফাঁক পড়তে লাগলকান্নায় আর গানে সেই ফাঁক ভরে উঠল
স্বর্গীয় প্রবীণেরা বড়ো চিন্তিত হলসভা ডাকলেতারা বললে, “এখানকার ইতিহাসে কখনো এমন ঘটে নি
স্বর্গের দূত এসে অপরাধ স্বীকার করলেসে বললে, “আমি ভুল লোককে ভুল স্বর্গে এনেছি
ভুল লোকটিকে সভায় আনা হলতার রঙিন পাগড়ি আর কোমরবন্ধের বাহার দেখেই সবাই বুঝলে, বিষম ভুল হয়েছে সভাপতি তাকে বললে, “তোমাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে
সে তার রঙের ঝুলি আর তুলি কোমরে বেঁধে হাঁফ ছেড়ে বললে
, “তবে চললুম
মেয়েটি এসে বললে
, “আমিও যাব
প্রবীণ সভাপতি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল
এই সে প্রথম দেখলে এমন-একটা কাণ্ড যার কোনো মানে নেই


রাজপুত্তুর
[প্রবাসী পত্রিকার কর্তিক ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]

রাজপুত্তুর চলেছে নিজের রাজ্য ছেড়ে, সাত রাজার রাজ্য পেরিয়ে, যে দেশে কোনো রাজার রাজ্য নেই সেই দেশে।
সে হল যে কালের কথা সে কালের আরম্ভও নেই
, শেষও নেই।
শহরে গ্রামে আর-সকলে হাটবাজার করে
, ঘর করে, ঝগড়া করে; যে আমাদের চিরকালের রাজপুত্তুর সে রাজ্য ছেড়ে ছেড়ে চলে যায়।
কেন যায়।

কুয়োর জল কুয়োতেই থাকে, খাল বিলের জল খাল বিলের মধ্যেই শান্ত। কিন্তু, গিরিশিখরের জল গিরিশিখরে ধরে না, মেঘের জল মেঘের বাঁধন মানে না। রাজপুত্তুরকে তার রাজ্যটুকুর মধ্যে ঠেকিয়ে রাখবে কে। তেপান্তর মাঠ দেখে সে ফেরে না, সাতসমুদ্র তেরোনদী পার হয়ে যায়।
মানুষ বারে বারে শিশু হয়ে জন্মায় আর বারে বারে নতুন ক
রে এই পুরাতন কাহিনীটি শোনে। সন্ধ্যাপ্রদীপের আলো স্থির হয়ে থাকে, ছেলেরা চুপ করে গালে হাত দিয়ে ভাবে, ‘আমরা সেই রাজপুত্তুর।
তেপান্তর মাঠ যদি বা ফুরোয়, সামনে সমুদ্র। তারই মাঝখানে দ্বীপ, সেখানে দৈত্যপুরীতে রাজকন্যা বাঁধা আছে।

পৃথিবীতে আর-সকলে টাকা খুঁজছে, নাম খুঁজছে, আরাম খুঁজছে, আর যে আমাদের রাজপুত্তুর সে দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছে। তুফান উঠল, নৌকো মিলল না, তবু সে পথ খুঁজছে।

এইটেই হচ্ছে মানুষের সব-গোড়াকার রূপকথা আর সব-শেষের। পৃথিবীতে যারা নতুন জন্মেছে, দিদিমার কাছে তাদের এই চিরকালের খবরটি পাওয়া চাই যে, রাজকন্যা বন্দিনী, সমুদ্র দুর্গম, দৈত্য দুর্জয়,আর ছোট মানুষটি একলা দাঁড়িয়ে পণ করছে, “বন্দিনীকে উদ্ধার করে আনব।”

বাইরে বনের অন্ধকারে বৃষ্টি পড়ে, ঝিল্লি ডাকে, আর ছোটো ছেলেটি চুপ করে গালে হাত দিয়ে ভাবে, “দৈত্যপুরীতে আমাকে পাড়ি দিতে হবে।”

সামনে এল অসীম সমুদ্র, স্বপ্নের-ঢেউ-তোলা নীল ঘুমের মতো। সেখানে রাজপুত্তুর ঘোড়ার উপর থেকে নেমে পড়ল।
কিন্তু
, যেমনি মাটিতে পা পড়া অমনি এ কী হল। এ কোন্ জাদুকরের জাদু।
এ যে শহর। ট্রাম চলেছে। আপিসমুখো গাড়ির ভিড়ে রাস্তা দুর্গম। তালপাতার বাঁশি-ওয়ালা গলির ধারে উলঙ্গ ছেলেদের লোভ দেখিয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে চলেছে।
আর
, রাজপুত্তুরের এ কী বেশ। এ কী চাল। গায়ে বোতামখোলা জামা, ধুতিটা খুব সাফ নয়, জুতোজোড়া জীর্ণ। পাড়াগাঁয়ের ছেলে, শহরে পড়ে, টিউশানি করে বাসাখরচ চালায়।
রাজকন্যা কোথায়।
তার বাসার পাশের বাড়িতেই।
চাঁপাফুলের মতো রঙ নয়
, হাসিতে তার মানিক খসে না। আকাশের তারার সঙ্গে তার তুলনা হয় না, তার তুলনা নববর্ষার ঘাসের আড়ালে যে নামহারা ফুল ফোটে তারই সঙ্গে।
মা-মরা মেয়ে বাপের আদরের ছিল। বাপ ছিল গরিব
, অপাত্রে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইল না, মেয়ের বয়স গেল বেড়ে, সকলে নিন্দে করলে।
বাপ গেছে মরে
, এখন মেয়ে এসেছে খুড়োর বাড়িতে।
পাত্রের সন্ধান মিলল। তার টাকাও বিস্তর
, বয়সও বিস্তর, আর নাতিনাতনির সংখ্যাও অল্প নয়। তার দাবরাবের সীমা ছিল না।
খুড়ো বললেন
, মেয়ের কপাল ভালো।
এমনসময় গায়ে-হলুদের দিনে মেয়েটিকে দেখা গেল না
, আর পাশের বাসার সেই ছেলেটিকে।
খবর এল
, তারা লুকিয়ে বিবাহ করেছে। তাদের জাতের মিল ছিল না, ছিল কেবল মনের মিল। সকলেই নিন্দে করলে।
লক্ষপতি তাঁর ইষ্টদেবতার কাছে সোনার সিংহাসন মানত করে বললেন
, “এ ছেলেকে কে বাঁচায়।”
ছেলেটিকে আদালতে দাঁড় করিয়ে বিচক্ষণ সব উকিল
, প্রবীণ সব সাক্ষী দেবতার কৃপায় দিনকে রাত করে তুললে। সে বড়ো আশ্চর্য।
সেইদিন ইষ্টদেবতার কাছে জোড়া পাঁঠা কাটা পড়ল
, ঢাক ঢোল বাজল, সকলেই খুশি হল। বললে, “কলিকাল বটে, কিন্তু ধর্ম এখনো জেগে আছেন।”

তার পরে অনেক কথা। জেল থেকে ছেলেটি ফিরে এল। কিন্তু, দীর্ঘ পথ আর শেষ হয় না। তেপান্তর মাঠের চেয়েও সে দীর্ঘ এবং সঙ্গীহীন। কতবার অন্ধকারে তাকে শুনতে হল, “হাঁউমাউখাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ।” মানুষকে খাবার জন্যে চারি দিকে এত লোভ।
রাস্তার শেষ নেই কিন্তু চলার শেষ আছে। একদিন সেই শমে এসে সে থামল।
সেদিন তাকে দেখবার লোক কেউ ছিল না। শিয়রে কেবল একজন দয়াময় দেবতা জেগে ছিলেন। তিনি যম।
সেই যমের সোনার কাঠি যেমনি ছোঁয়ানো অমনি এ কী কাণ্ড। শহর গেল মিলিয়ে
, স্বপ্ন গেল ভেঙে।
মুহূর্তে আবার দেখা দিল সেই রাজপুত্তুর। তার কপালে অসীমকালের রাজটিকা। দৈত্যপুরীর দ্বার সে ভাঙবে
, রাজকন্যার শিকল সে খুলবে।
যুগে যুগে শিশুরা মায়ের কোলে বসে খবর পায়
সেই ঘরছাড়া মানুষ তেপান্তর মাঠ দিয়ে কোথায় চলল। তার সামনের দিকে সাত সমুদ্রের ঢেউ গর্জন করছে।
ইতিহাসের মধ্যে তার বিচিত্র চেহারা
; ইতিহাসের পরপারে তার একই রূপ, সে রাজপুত্তুর।