ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
সুয়োরানীর সাধ
[পার্বণী পত্রিকার
আশ্বিন ১৩২৭ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
সুয়োরানীর বুঝি
মরণকাল এল।
তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে,
তার কিছুই ভালো লাগছে
না। বদ্দি বড়ি নিয়ে এল। মধু দিয়ে মেড়ে বললে,
“খাও।”
সে ঠেলে ফেলে দিলে।
রাজার কানে খবর গেল। রাজা তাড়াতাড়ি সভা ছেড়ে এল। পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলে,
“তোমার কী হয়েছে,
কী চাই।”
সে গুমরে উঠে বললে,
“তোমরা সবাই যাও;
একবার আমার স্যাঙাৎনিকে ডেকে দাও।”
স্যাঙাৎনি এল। রানী তার হাত ধরে বললে,
“সই,
বসো। কথা আছে।”
স্যাঙাৎনি বললে,
“প্রকাশ করে বলো।”
সুয়োরানী বললে, “আমার
সাতমহলা বাড়ির এক ধারে তিনটে মহল ছিল দুয়োরানীর। তার পরে হল দুটো,
তার পরে হল একটা। তার পরে রাজবাড়ি থেকে সে বের হয়ে গেল।
তার পরে দুয়োরানীর কথা আমার মনে রইল না।
তার পরে একদিন দোলযাত্রা। নাটমন্দিরে যাচ্ছি ময়ূরপংখি চ’ড়ে।
আগে লোক,
পিছে লশ্কর। ডাইনে বাজে বাঁশি,
বাঁয়ে বাজে মৃদঙ্গ।
এমনসময় পথের
পাশে,
নদীর ধারে, ঘাটের
উপরটিতে দেখি একখানি কুঁড়েঘর,
চাঁপাগাছের ছায়ায়। বেড়া
বেয়ে অপরাজিতার ফুল ফুটেছে,
দুয়োরের সামনে চালের গুঁড়ো দিয়ে
শঙ্খচক্রের আলপনা। আমার ছত্রধারিণীকে শুধোলেম,
‘আহা,
ঘরখানি কার।’ সে বললে,
দুয়োরানীর।
তার পরে ঘরে ফিরে এসে সন্ধ্যার সময় বসে আছি,
ঘরে প্রদীপ জ্বালি নি,
মুখে কথা নেই।
রাজা এসে বললে, ‘তোমার
কী হয়েছে,
কী চাই।’
আমি বললেম, ‘এ ঘরে
আমি থাকব না।’
রাজা বললে, ‘আমি
তোমার কোঠাবাড়ি বানিয়ে দেব গজদন্তের দেওয়াল দিয়ে। শঙ্খের গুড়োয় মেঝেটি হবে দুধের
ফেনার মতো সাদা,
মুক্তোর ঝিনুক দিয়ে তার কিনারে
এঁকে দেব পদ্মের মালা।’
আমি বললেম, ‘আমার
বড়ো সাধ গিয়েছে,
কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকি তোমার
বাহির-বাগানের একটি ধারে।’
রাজা বললে, ‘আচ্ছা
বেশ,
তার আর ভাবনা কী।’
কুঁড়েঘর বানিয়ে দিলে। সে ঘর যেন তুলে-আনা বনফুল। যেমনি তৈরি হল অমনি যেন মুষড়ে গেল।
বাস করতে গেলেম,
কেবল লজ্জা পেলেম।
তার পরে একদিন
স্নানযাত্রা।
নদীতে নাইতে গেছি। সঙ্গে একশো সাত জন সঙ্গিনী। জলের মধ্যে পাল্কি নামিয়ে দিলে,
স্নান হল।
পথে ফিরে আসছি, পাল্কির
দরজা একটু ফাঁক করে দেখি,
ও কোন্ ঘরের বউ গা। যেন
নির্মাল্যের ফুল। হাতে সাদা শাঁখা,
পরনে লালপেড়ে শাড়ি।
স্নানের পর ঘড়ায় ক’রে
জল তুলে আনছে,
সকালের আলো তার
ভিজে চুলে আর ভিজে ঘড়ার উপর ঝিকিয়ে উঠছে।
ছত্রধারিণীকে শুধোলেম,
‘মেয়েটি কে, কোন্
দেবমন্দিরে তপস্যা করে।’
ছত্রধারিণী হেসে বললে,
‘চিনতে পারলে না? ঐ তো
দুয়োরানী।’
তার পরে ঘরে ফিরে একলা বসে আছি,
মুখে কথা নেই। রাজা এসে
বললে, ‘তোমার
কী হয়েছে, কী চাই।’
আমি বললেম, ‘আমার
বড়ো সাধ,
রোজ সকালে নদীতে নেয়ে মাটির
ঘড়ায় জল তুলে আনব বকুলতলার রাস্তা দিয়ে।’
রাজা বললে, ‘আচ্ছা
বেশ,
তার আর ভাবনা কী।’
রাস্তায় রাস্তায় পাহারা বসল,
লোকজন গেল সরে।
সাদা শাঁখা পরলেম আর লালপেড়ে শাড়ি। নদীতে স্নান সেরে ঘড়ায় করে জল তুলে আনলেম।
দুয়োরের কাছে এসে মনের দুঃখে ঘড়া আছড়ে ভাঙলেম। যা ভেবেছিলেম তা হল না,
শুধু লজ্জা পেলেম।
তার পরে সেদিন
রাসযাত্রা।
মধুবনে জ্যোৎস্নারাতে তাঁবু পড়ল। সমস্ত রাত নাচ হল,
গান হল।
পরদিন সকালে
হাতির উপর হাওদা চড়ল। পর্দার আড়ালে বসে ঘরে ফিরছি,
এমনসময় দেখি,
বনের পথ দিয়ে কে চলেছে,
তার নবীন বয়েস। চূড়ায়
তার বনফুলের মালা। হাতে তার ডালি;
তাতে শালুক ফুল,
তাতে বনের ফল,
তাতে খেতের শাক।
ছত্রধারিণীকে শুধোলেম,
‘কোন্ ভাগ্যবতীর ছেলে পথ
আলো করেছে।’
ছত্রধারিণী বললে,
‘জান না?
ঐ তো দুয়োরানীর ছেলে। ওর
মার জন্য নিয়ে চলেছে শালুক ফুল, বনের ফল,
খেতের শাক।’
তার পরে ঘরে ফিরে একলা বসে আছি,
মুখে কথা নেই।
রাজা এসে বললে, ‘তোমার
কী হয়েছে,
কী চাই।’
আমি বললেম, ‘আমার
বড়ো সাধ,
রোজ খাব শালুক ফুল,
বনের ফল,
খেতের শাক; আমার
ছেলে নিজের হাতে তুলে আনবে।’
রাজা বললে, ‘আচ্ছা
বেশ,
তার আর ভাবনা কী।’
সোনার পালঙ্কে বসে আছি,
ছেলে ডালি নিয়ে এল। তার
সর্বাঙ্গে ঘাম,
তার মুখে রাগ। ডালি পড়ে রইল,
লজ্জা পেলেম।
তার পরে আমার কী হল জানি।
একলা বসে থাকি, মুখে
কথা নেই। রাজা রোজ এসে আমাকে শুধোয়,
‘তোমার কী হয়েছে, কী চাই।’
সুয়োরানী হয়েও
কী চাই সে কথা লজ্জায় কাউকে বলতে পারি নে। তাই তোমাকে ডেকেছি,
স্যাঙাৎনি। আমার শেষ
কথাটি বলি তোমার কানে, ‘ঐ
দুয়োরানীর দুঃখ আমি চাই।’
স্যাঙাৎনি গালে হাত দিয়ে বললে,
“কেন বলো তো।”
সুয়োরানী বললে, “ওর ঐ
বাঁশের বাঁশিতে সুর বাজল,
কিন্তু আমার সোনার বাঁশি কেবল
বয়েই বেড়ালেম,
আগলে বেড়ালেম,
বাজাতে পারলেম না।”
বিদূষক
[ভারতী পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৭ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
কাঞ্চীর রাজা
কর্ণাট জয় করতে গেলেন। তিনি হলেন জয়ী। চন্দনে,
হাতির দাঁতে,
আর সোনামানিকে হাতি বোঝাই হল।
দেশে ফেরবার পথে বলেশ্বরীর মন্দির বলির রক্তে ভাসিয়ে দিয়ে রাজা পুজো দিলেন।
পুজো দিয়ে চলে আসছেন—
গায়ে রক্তবস্ত্র,
গলায় জবার মালা, কপালে
রক্তচন্দনের তিলক;
সঙ্গে কেবল মন্ত্রী আর বিদূষক।
এক জায়গায় দেখলেন,
পথের ধারে আমবাগানে ছেলেরা খেলা করছে।
রাজা তাঁর দুই সঙ্গীকে বললেন,
“দেখে আসি, ওরা কী
খেলছে।”
২
ছেলেরা দুই সারি
পুতুল সাজিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছে।
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন,
“কার সঙ্গে কার যুদ্ধ।”
তারা বললে, ‘কর্ণাটের
সঙ্গে কাঞ্চীর।’
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন,
“কার জিত,
কার হার।”
ছেলেরা বুক ফুলিয়ে বললে,
“কর্ণাটের জিত,
কাঞ্চীর হার।”
মন্ত্রীর মুখ গম্ভীর হল,
রাজার চক্ষু রক্তবর্ণ,
বিদূষক হা হা ক’রে
হেসে উঠল।
৩
রাজা যখন তাঁর
সৈন্য নিয়ে ফিরে এলেন,
তখনো ছেলেরা খেলছে।
রাজা হুকুম করলেন,
“এক-একটা ছেলেকে গাছের
সঙ্গে বাঁধো,
আর লাগাও বেত।”
গ্রাম থেকে তাদের মা-বাপ ছুটে এল। বললে,
“ওরা অবোধ, ওরা
খেলা করছিল,
ওদের মাপ করো।”
রাজা সেনাপতিকে ডেকে বললেন,
“এই গ্রামকে শিক্ষা দেবে,
কাঞ্চীর রাজাকে কোনোদিন যেন ভুলতে না পারে।”
এই বলে শিবিরে চলে গেলেন।
৪
সন্ধেবেলায়
সেনাপতি রাজার সম্মুখে এসে দাঁড়াল। প্রণাম করে বললে,
“মহারাজ,
শৃগাল কুকুর ছাড়া এ
গ্রামের কারো মুখে শব্দ শুনতে পাবে না।”
মন্ত্রী বললে,
“মহারাজের মান রক্ষা হল।”
পুরোহিত বললে,
“বিশ্বেশ্বরী মহারাজের সহায়।”
বিদূষক বললে, “মহারাজ,
এবার আমাকে বিদায় দিন।”
রাজা বললেন,
“কেন!”
বিদূষক বললে, “আমি
মারতেও পারি নে,
কাটতেও পারি নে,
বিধাতার প্রসাদে আমি কেবল হাসতে পারি। মহারাজের সভায় থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব।”
ঘোড়া
[সবুজ পত্র পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশের সময় নাম ছিল 'কথিকা']
সৃষ্টির কাজ প্রায় শেষ হয়ে যখন ছুটির ঘণ্টা বাজে ব’লে, হেনকালে ব্রহ্মার মাথায় একটা ভাবোদয় হল।
ভাণ্ডারীকে ডেকে বললেন, “ওহে ভাণ্ডারী, আমার কারখানাঘরে কিছু কিছু পঞ্চভূতের জোগাড় করে আনো, আর-একটা নতুন প্রাণী সৃষ্টি করব।”
ভাণ্ডারী হাত জোড় করে বললে, “পিতামহ, আপনি যখন উৎসাহ করে হাতি গড়লেন, তিমি গড়লেন, অজগর সর্প গড়লেন, সিংহ-ব্যাঘ্র গড়লেন, তখন হিসাবের দিকে আদৌ খেয়াল করলেন না। যতগুলো ভারী আর কড়া জাতের ভূত ছিল সব প্রায় নিকাশ হয়ে এল। ক্ষিতি অপ্ তেজ তলায় এসে ঠেকেছে। থাকবার মধ্যে আছে মরুৎ ব্যোম, তা সে যত চাই।”
চতুর্মুখ কিছুক্ষণ ধরে চারজোড়া গোঁফে তা দিয়ে বললেন, “আচ্ছা ভালো, ভাণ্ডারে যা আছে তাই নিয়ে এসো, দেখা যাক।”
এবারে প্রাণীটিকে গড়বার বেলা ব্রহ্মা ক্ষিতি-অপ-তেজটাকে খুব হাতে রেখে খরচ করলেন। তাকে না দিলেন শিঙ, না দিলেন নখ; আর দাঁত যা দিলেন তাতে চিবনো চলে, কামড়ানো চলে না। তেজের ভাণ্ড থেকে কিছু খরচ করলেন বটে, তাতে প্রাণীটা যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো কোনো কাজে লাগবার মতো হল কিন্তু তার লড়াইয়ের শখ রইল না। এই প্রাণীটি হচ্ছে ঘোড়া। এ ডিম পাড়ে না তবু বাজারে তার ডিম নিয়ে একটা গুজব আছে, তাই একে দ্বিজ বলা চলে।
আর যাই হোক, সৃষ্টিকর্তা এর গড়নের মধ্যে মরুৎ আর ব্যোম একেবারে ঠেসে দিলেন। ফল হল এই যে, এর মনটা প্রায় ষোলো-আনা গেল মুক্তির দিকে। এ হাওয়ার আগে ছুটতে চায়, অসীম আকাশকে পেরিয়ে যাবে ব’লে পণ ক’রে বসে। অন্য সকল প্রাণী কারণ উপস্থিত হলে দৌড়য়; এ দৌড়য় বিনা কারণে; যেন তার নিজেই নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার একান্ত শখ। কিছু কাড়তে চায় না, কাউকে মারতে চায় না, কেবলই পালাতে চায়— পালাতে পালাতে একেবারে বুঁদ হয়ে যাবে, ঝিম হয়ে যাবে, ভোঁ হয়ে যাবে, তার পরে ‘না’ হয়ে যাবে, এই তার মতলব। জ্ঞানীরা বলেন, ধাতের মধ্যে মরুৎব্যোম যখন ক্ষিতি-অপ-তেজকে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে ওঠে তখন এইরকমই ঘটে।
ব্রহ্মা বড়ো খুশি হলেন। বাসার জন্যে তিনি অন্য জন্তুর কাউকে দিলেন বন, কাউকে দিলেন গুহা, কিন্তু এর দৌড় দেখতে ভালোবাসেন ব’লে একে দিলেন খোলা মাঠ।
মাঠের ধারে থাকে মানুষ। কাড়াকুড়ি করে সে যা-কিছু জমায় সমস্তই মস্ত বোঝা হয়ে ওঠে। তাই যখন মাঠের মধ্যে ঘোড়াটাকে ছুটতে দেখে মনে মনে ভাবে, ‘এটাকে কোনো গতিকে বাঁধতে পারলে আমাদের হাট করার বড়ো সুবিধে।’
ফাঁস লাগিয়ে ধরলে একদিন ঘোড়াটাকে। তার পিঠে দিলে জিন, মুখে দিলে কাঁটা-লাগাম। ঘাড়ে তার লাগায় চাবুক আর কাঁখে মারে জুতোর শেল। তা ছাড়া আছে দলা-মলা।
মাঠে ছেড়ে রাখলে হাতছাড়া হবে, তাই ঘোড়াটার চারি দিকে পাঁচিল তুলে দিলে। বাঘের ছিল বন, তার বনই রইল; সিংহের ছিল গুহা, কেউ কাড়ল না। কিন্তু, ঘোড়ার ছিল খোলা মাঠ, সে এসে ঠেকল আস্তাবলে। প্রাণীটাকে মরুৎব্যোম মুক্তির দিকে অত্যন্ত উসকে দিলে, কিন্তু বন্ধন থেকে বাঁচাতে পারলে না।
যখন অসহ্য হল তখন ঘোড়া তার দেয়ালটার ’পরে লাথি চালাতে লাগল। তার পা যতটা জখম হল দেয়াল ততটা হল না; তবু, চুন বালি খ’সে দেয়ালের সৌন্দর্য নষ্ট হতে লাগল।
এতে মানুষের মনে বড়ো রাগ হল। বললে, “একেই বলে অকৃতজ্ঞতা। দানাপানি খাওয়াই, মোটা মাইনের সইস আনিয়ে আট প্রহর ওর পিছনে খাড়া রাখি, তবু মন পাই নে।”
মন পাবার জন্যে সইসগুলো এমনি উঠে-পড়ে ডাণ্ডা চালালে যে, ওর আর লাথি চলল না। মানুষ তার পাড়াপড়শিকে ডেকে বললে, “আমার এই বাহনটির মতো এমন ভক্ত বাহন আর নেই।”
তারা তারিফ করে বললে, “তাই তো, একেবারে জলের মতো ঠাণ্ডা। তোমারই ধর্মের মতো ঠাণ্ডা।”
একে তো গোড়া থেকেই ওর উপযুক্ত দাঁত নেই, নখ নেই, শিঙ নেই, তার পরে দেয়ালে এবং তদভাবে শূন্যে লাথি ছোঁড়াও বন্ধ। তাই মনটাকে খোলসা করবার জন্যে আকাশে মাথা তুলে সে চিঁহি চিঁহি করতে লাগল। তাতে মানুষের ঘুম ভেঙে যায় আর পাড়াপড়শিরাও ভাবে, আওয়াজটা তো ঠিক ভক্তিগদ্গদ শোনাচ্ছে না। মুখ বন্ধ করবার অনেকরকম যন্ত্র বেরোল। কিন্তু, দম বন্ধ না করলে মুখ তো একেবারে বন্ধ হয় না। তাই চাপা আওয়াজ মুমূর্ষুর খাবির মতো মাঝে মাঝে বেরোতে থাকে।
একদিন সেই আওয়াজ গেল ব্রহ্মার কানে। তিনি ধ্যান ভেঙে একবার পৃথিবীর খোলা মাঠের দিকে তাকালেন। সেখানে ঘোড়ার চিহ্ন নেই।
পিতামহ যমকে
ডেকে বললেন,
“নিশ্চয় তোমারই কীর্তি!
আমার ঘোড়াটিকে নিয়েছ।”
যম বললেন,
“সৃষ্টিকর্তা,
আমাকেই তোমার যত
সন্দেহ। একবার মানুষের পাড়ার দিকে তাকিয়ে দেখো।”
ব্রহ্মা দেখেন, অতি
ছোটো জায়গা,
চার দিকে পাঁচিল তোলা;
তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ক্ষীণস্বরে ঘোড়াটি চিঁহি চিঁহি করছে।
হৃদয় তাঁর বিচলিত হল। মানুষকে বললেন, “আমার এই জীবকে যদি মুক্তি না দাও তবে বাঘের মতো ওর নখদন্ত বানিয়ে দেব, ও তোমার কোনো কাজে লাগবে না।”
মানুষ বললে, “ছি ছি, তাতে হিংস্রতার বড়ো প্রশ্রয় দেওয়া হবে। কিন্তু, যাই বল, পিতামহ, তোমার এই প্রাণীটি মুক্তির যোগ্যই নয়। ওর হিতের জন্যেই অনেক খরচে আস্তাবল বানিয়েছি। খাসা আস্তাবল।”
ব্রহ্মা জেদ করে বললেন, “ওকে ছেড়ে দিতেই হবে।”
মানুষ বললে “আচ্ছা, ছেড়ে দেব। কিন্তু, সাত দিনের মেয়াদে; তার পরে যদি বল, তোমার মাঠের চেয়ে আমার আস্তাবল ওর পক্ষে ভালো নয়, তা হলে নাকে খত দিতে রাজি আছি।”
মানুষ করলে কী, ঘোড়াটাকে মাঠে দিলে ছেড়ে; কিন্তু, তার সামনের দুটো পায়ে কষে রশি বাঁধল। তখন ঘোড়া এমনি চলতে লাগল যে, ব্যাঙের চাল তার চেয়ে সুন্দর।
ব্রহ্মা থাকেন সুদূর স্বর্গে; তিনি ঘোড়াটার চাল দেখতে পান, তার হাঁটুর বাঁধন দেখতে পান না। তিনি নিজের কীর্তির এই ভাঁড়ের মতো চালচলন দেখে লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন। বললেন, “ভুল করেছি তো।”
মানুষ হাত জোড় করে বললে, “এখন এটাকে নিয়ে করি কী। আপনার ব্রহ্মলোকে যদি মাঠ থাকে তো বরঞ্চ সেইখানে রওনা করে দিই।”
ব্রহ্মা ব্যাকুল
হয়ে বললেন,
“যাও যাও,
ফিরে নিয়ে যাও তোমার আস্তাবলে।”
মানুষ বললে, “আদিদেব,
মানুষের পক্ষে এ যে এক বিষম বোঝা।”
ব্রহ্মা বললেন,
“সেই তো মানুষের মনুষ্যত্ব।”
কর্তার ভূত
[প্রবাসী পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
বুড়ো কর্তার
মরণকালে দেশসুদ্ধ সবাই বলে উঠল,
“তুমি গেলে আমাদের কী দশা হবে।”
শুনে তারও মনে দুঃখ হল। ভাবলে,
“আমি গেলে এদের ঠাণ্ডা রাখবে কে।”
তা ব’লে
মরণ তো এড়াবার জো নেই। তবু দেবতা দয়া করে বললেন,
“ভাবনা কী। লোকটা ভূত
হয়েই এদের ঘাড়ে চেপে থাক্-না। মানুষের মৃত্যু আছে, ভূতের
তো মৃত্যু নেই।”
২
দেশের লোক ভারি
নিশ্চিন্ত হল।
কেননা ভবিষ্যৎকে মানলেই তার জন্যে যত ভাবনা,
ভূতকে মানলে কোনো ভাবনাই
নেই;
সকল ভাবনা ভূতের মাথায় চাপে।
অথচ তার মাথা নেই,
সুতরাং কারো
জন্যে মাথাব্যথাও নেই।
তবু স্বভাবদোষে যারা নিজের ভাবনা নিজে ভাবতে যায় তারা খায় ভূতের কানমলা। সেই কানমলা না যায় ছাড়ানো, তার থেকে না যায় পালানো, তার বিরুদ্ধে না চলে নালিশ, তার সম্বন্ধে না আছে বিচার।
দেশসুদ্ধ লোক ভূতগ্রস্ত হয়ে চোখ বুজে চলে। দেশের তত্ত্বজ্ঞানীরা বলেন, “এই চোখ বুজে চলাই হচ্ছে জগতের সবচেয়ে আদিম চলা। একেই বলে অদৃষ্টের চালে চলা। সৃষ্টির প্রথম চক্ষুহীন কীটাণুরা এই চলা চলত; ঘাসের মধ্যে, গাছের মধ্যে, আজও এই চলার আভাস প্রচলিত।”
শুনে ভূতগ্রস্ত দেশ আপন আদিম আভিজাত্য অনুভব করে। তাতে অত্যন্ত আনন্দ পায়।
ভূতের নায়েব ভুতুড়ে জেলখানার দারোগা। সেই জেলখানার দেয়াল চোখে দেখা যায় না। এইজন্যে ভেবে পাওয়া যায় না, সেটাকে ফুটো করে কী উপায়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব।
এই জেলখানায় যে ঘানি নিরন্তর ঘোরাতে হয় তার থেকে এক ছটাক তেল বেরোয় না যা হাটে বিকোতে পারে, বেরোবার মধ্যে বেরিয়ে যায় মানুষের তেজ। সেই তেজ বেরিয়ে গেলে মানুষ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তাতে করে ভূতের রাজত্বে আর কিচ্ছুই না থাক্— অন্ন হোক, বস্ত্র হোক, স্বাস্থ্য হোক— শান্তি থাকে।
কত-যে শান্তি তার একটা দৃষ্টান্ত এই যে, অন্য সব দেশে ভূতের বাড়াবাড়ি হলেই মানুষ অস্থির হয়ে ওঝার খোঁজ করে। এখানে সে চিন্তাই নেই। কেননা ওঝাকেই আগেভাগে ভূতে পেয়ে বসেছে।
৩
এই ভাবেই দিন চলত, ভূতশাসনতন্ত্র নিয়ে কারো মনে দ্বিধা জাগত না; চিরকালই গর্ব করতে পারত যে, এদের ভবিষ্যৎটা পোষা ভেড়ার মতো ভূতের খোঁটায় বাঁধা, সে ভবিষ্যৎ ভ্যা’ও করে না, ম্যা’ও করে না, চুপ করে পড়ে থাকে মাটিতে, যেন একেবারে চিরকালের মতো মাটি।
কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল। সেটা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে ভূতে পায় নি। তাই অন্য সব দেশে যত ঘানি ঘোরে তার থেকে তেল বেরোয় তাদের ভবিষ্যতের রথচক্রটাকে সচল করে রাখবার জন্যে, বুকের রক্ত পিষে ভূতের খর্পরে ঢেলে দেবার জন্যে নয়। কাজেই মানুষ সেখানে একেবারে জুড়িয়ে যায় নি। তারা ভয়ংকর সজাগ আছে।
৪
এ দিকে দিব্যি
ঠাণ্ডায় ভূতের রাজ্য জুড়ে
‘খোকা
ঘুমোলো,
পাড়া জুড়োলো’।
সেটা খোকার পক্ষে আরামের,
খোকার অভিভাবকের পক্ষেও;
আর পাড়ার কথা তো বলাই আছে।
কিন্তু, ‘বর্গি
এল দেশে’।
নইলে ছন্দ মেলে না,
ইতিহাসের পদটা খোঁড়া হয়েই থাকে।
দেশে যত শিরোমণি চূড়ামণি আছে সবাইকে জিজ্ঞাসা করা গেল,
“এমন হল কেন।”
তারা এক বাক্যে শিখা নেড়ে বললে,
“এটা ভূতের দোষ নয়,
ভুতুড়ে দেশের দোষ নয়,
একমাত্র বর্গিরই দোষ। বর্গি আসে কেন।”
শুনে সকলেই বললে,
“তা তো বটেই।”
অত্যন্ত সান্ত্বনা বোধ করলে।
দোষ যারই থাক্, খিড়কির আনাচে-কানাচে ঘোরে ভূতের পেয়াদা, আর সদরের রাস্তায়-ঘাটে ঘোরে অভূতের পেয়াদা; ঘরে গেরস্তর টেঁকা দায়, ঘর থেকে বেরোবারও পথ নেই। এক দিক থেকে এ হাঁকে, “খাজনা দাও।” আর-এক দিক থেকে ও হাঁকে, “খাজনা দাও।”
এখন কথাটা দাঁড়িয়েছে, ‘খাজনা দেব কিসে’।
এতকাল উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিম থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে নানা জাতের বুলবুলি এসে বেবাক ধান খেয়ে গেল, কারো হুঁস ছিল না। জগতে যারা হুঁশিয়ার এরা তাদের কাছে ঘেঁষতে চায় না, পাছে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। কিন্তু, তারা অকস্মাৎ এদের অত্যন্ত কাছে ঘেঁষে, এবং প্রায়শ্চিতও করে না। শিরোমণি-চূড়ামণির দল পুঁথি খুলে বলেন, “বেহুঁশ যারা তারাই পবিত্র, হুঁশিয়ার যারা তারাই অশুচি, অতএব হুঁশিয়ারদের প্রতি উদাসীন থেকো, প্রবুদ্ধমিব সুপ্তঃ।”
শুনে সকলের অত্যন্ত আনন্দ হয়।
৫
কিন্তু,
তৎসত্ত্বেও এ প্রশ্নকে
ঠেকানো যায় না, ‘খাজনা
দেব কিসে’।
শ্মশান থেকে মশান থেকে ঝোড়ো হাওয়ায় হাহা ক’রে
তার উত্তর আসে,
“আব্রু দিয়ে,
ইজ্জত দিয়ে,
ইমান দিয়ে, বুকের
রক্ত দিয়ে।”
প্রশ্নমাত্রেরই দোষ এই যে,
যখন আসে একা আসে না। তাই
আরো একটা প্রশ্ন উঠে পড়েছে,
“ভূতের শাসনটাই কি অনন্তকাল
চলবে।”
শুনে ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি আর মাসতুতো-পিসতুতোর দল কানে হাত দিয়ে বলে, “কী সর্বনাশ। এমন প্রশ্ন তো বাপের জন্মে শুনি নি। তা হলে সনাতন ঘুমের কী হবে— সেই আদিমতম, সকল জাগরণের চেয়ে প্রাচীনতম ঘুমের?”
প্রশ্নকারী বলে, “সে তো
বুঝলুম,
কিন্তু আধুনিকতম বুলবুলির ঝাঁক
আর উপস্থিততম বর্গির দল,
এদের কী করা যায়।”
মাসিপিসি বলে,
“বুলবুলির ঝাঁককে কৃষ্ণনাম শোনাব,
আর বর্গির দলকেও।”
অর্বাচীনেরা উদ্ধত হয়ে বলে ওঠে,
“যেমন করে পারি ভূত
ছাড়াব।”
ভূতের নায়েব চোখ পাকিয়ে বলে,
“চুপ। এখনো ঘানি অচল হয় নি।”
শুনে দেশের খোকা নিস্তব্ধ হয়,
তার পরে পাশ ফিরে শোয়।
৬
মোদ্দা কথাটা
হচ্ছে,
বুড়ো কর্তা বেঁচেও নেই,
মরেও নেই, ভূত হয়ে
আছে। দেশটাকে সে নাড়েও না,
অথচ
ছাড়েও না।
দেশের মধ্যে দুটো-একটা মানুষ,
যারা দিনের বেলা নায়েবের
ভয়ে কথা কয় না,
তারা গভীর রাত্রে হাত জোড় করে
বলে,
“কর্তা,
এখনো কি ছাড়বার সময় হয়
নি।”
কর্তা বলেন, “ওরে
অবোধ,
আমার ধরাও নেই,
ছাড়াও নেই,
তোরা ছাড়লেই আমার ছাড়া।”
তারা বলে, “ভয় করে
যে,
কর্তা।”
কর্তা বলেন,
“সেইখানেই তো ভূত।”
তোতাকাহিনী
[সবুজ পত্র পত্রিকার মাঘ ১৩২৪ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
এক-যে ছিল পাখি।
সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত,
শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত,
উড়িত,
জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে।
রাজা বলিলেন, “এমন
পাখি তো কাজে লাগে না,
অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।”
মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন,
“পাখিটাকে শিক্ষা দাও।”
২
রাজার ভাগিনাদের
উপর ভার পড়িল পাখিটাকে শিক্ষা দিবার।
পণ্ডিতেরা বসিয়া অনেক বিচার করিলেন। প্রশ্নটা এই,
উক্ত জীবের অবিদ্যার কারণ কী।
সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য
খড়কুটা দিয়া পাখি যে বাসা বাঁধে সে বাসায় বিদ্যা বেশি ধরে না। তাই সকলের আগে দরকার,
ভালো করিয়া খাঁচা বানাইয়া দেওয়া।
রাজপণ্ডিতেরা দক্ষিণা পাইয়া খুশি হইয়া বাসায় ফিরিলেন।
৩
স্যাকরা বসিল সোনার খাঁচা বানাইতে। খাঁচাটা হইল এমন আশ্চর্য যে, দেখিবার জন্য দেশবিদেশের লোক ঝুঁকিয়া পড়িল। কেহ বলে, “শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ।” কেহ বলে, “শিক্ষা যদি নাও হয়, খাঁচা তো হইল। পাখির কী কপাল।”
স্যাকরা থলি
বোঝাই করিয়া বকশিশ পাইল। খুশি হইয়া সে তখনি পাড়ি দিল বাড়ির দিকে।
পণ্ডিত বসিলেন পাখিকে বিদ্যা শিখাইতে। নস্য লইয়া বলিলেন,
“অল্প পুঁথির কর্ম নয়।”
ভাগিনা তখন পুঁথিলিখকদের তলব করিলেন। তারা পুঁথির নকল করিয়া এবং নকলের নকল করিয়া পর্বতপ্রমাণ করিয়া তুলিল। যে দেখিল সেই বলিল, “সাবাস। বিদ্যা আর ধরে না।”
লিপিকরের দল পারিতোষিক লইল বলদ বোঝাই করিয়া। তখনি ঘরের দিকে দৌড় দিল। তাদের সংসারে আর টানাটানি রহিল না।
অনেক দামের খাঁচাটার জন্য ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই। মেরামত তো লাগিয়াই আছে। তার পরে ঝাড়া মোছা পালিশ-করা ঘটা দেখিয়া সকলেই বলিল, “উন্নতি হইতেছে।”
লোক লাগিল বিস্তর এবং তাদের উপর নজর রাখিবার জন্য লোক লাগিল আরো বিস্তর। তারা মাস-মাস মুঠা-মুঠা তনখা পাইয়া সিন্ধুক বোঝাই করিল।
তারা এবং তাদের মামাতো খুড়তুতো মাসতুতো ভাইরা খুশি হইয়া কোঠাবালাখানায় গদি পাতিয়া বসিল।
৪
সংসারে অন্য
অভাব অনেক আছে,
কেবল নিন্দুক আছে
যথেষ্ট। তারা বলিল,
“খাঁচাটার উন্নতি হইতেছে,
কিন্তু পাখিটার খবর কেহ
রাখে না।”
কথাটা রাজার কানে গেল। তিনি ভাগিনাকে ডাকিয়া বলিলেন,
“ভাগিনা,
এ
কী কথা শুনি।”
ভাগিনা বলিল, “মহারাজ, সত্য কথা যদি শুনিবেন তবে ডাকুন স্যাকরাদের, পণ্ডিতদের, লিপিকরদের, ডাকুন যারা মেরামত করে এবং মেরামত তদারক করিয়া বেড়ায়। নিন্দুকগুলো খাইতে পায় না বলিয়াই মন্দ কথা বলে।”
জবাব শুনিয়া রাজা অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝিলেন, আর তখনি ভাগিনার গলায় সোনার হার চড়িল।
৫
শিক্ষা যে কী ভয়ংকর তেজে চলিতেছে, রাজার ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন। একদিন তাই পাত্র মিত্র অমাত্য লইয়া শিক্ষাশালায় তিনি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত।
দেউড়ির কাছে অমনি বাজিল শাঁখ ঘণ্টা ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া তুরী ভেরি দামামা কাঁসি বাঁশি কাঁসর খোল করতাল মৃদঙ্গ জগঝম্প। পণ্ডিতেরা গলা ছাড়িয়া, টিকি নাড়িয়া, মন্ত্রপাঠে লাগিলেন। মিস্ত্রি মজুর স্যাকরা লিপিকর তদারকনবিশ আর মামাতো পিসতুতো খুড়তুতো এবং মাসতুতো ভাই জয়ধ্বনি তুলিল।
ভাগিনা বলিল, “মহারাজ,
কাণ্ডটা দেখিতেছেন!”
মহারাজ বলিলেন,
“আশ্চর্য। শব্দ কম নয়।”
ভাগিনা বলিল, “শুধু
শব্দ নয়,
পিছনে অর্থও কম
নাই।”
রাজা খুশি হইয়া দেউড়ি পার হইয়া যেই হাতিতে উঠিবেন এমন সময়, নিন্দুক ছিল ঝোপের মধ্যে গা ঢাকা দিয়া, সে বলিয়া উঠিল, “মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি।”
রাজার চমক লাগিল; বলিলেন, “ঐ যা! মনে তো ছিল না। পাখিটাকে দেখা হয় নাই।”
ফিরিয়া আসিয়া পণ্ডিতকে বলিলেন, ‘পাখিকে তোমরা কেমন শেখাও তার কায়দাটা দেখা চাই।”
দেখা হইল। দেখিয়া বড়ো খুশি। কায়দাটা পাখিটার চেয়ে এত বেশি বড়ো যে, পাখিটাকে দেখাই যায় না; মনে হয়, তাকে না দেখিলেও চলে। রাজা বুঝিলেন, আয়োজনের ত্রুটি নাই। খাঁচায় দানা নাই, পানি নাই; কেবল রাশি রাশি পুঁথি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়িয়া কলমের ডগা দিয়া পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। গান তো বন্ধই, চীৎকার করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা। দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়।
এবারে রাজা হাতিতে চড়িবার সময় কানমলা-সর্দারকে বলিয়া দিলেন, নিন্দুকের যেন আচ্ছা করিয়া কান মলিয়া দেওয়া হয়।
৬
পাখিটা দিনে দিনে ভদ্র-দস্তুর-মতো আধমরা হইয়া আসিল। অভিভাবকেরা বুঝিল, বেশ আশাজনক। তবু স্বভাবদোষে সকালবেলার আলোর দিকে পাখি চায় আর অন্যায় রকমে পাখা ঝট্পট্ করে। এমন কি, এক-একদিন দেখা যায়, সে তার রোগা ঠোঁট দিয়া খাঁচার শলা কাটিবার চেষ্টায় আছে।
কোতোয়াল বলিল,
“এ কী বেয়াদবি।”
তখন শিক্ষামহালে হাপর হাতুড়ি আগুন লইয়া কামার আসিয়া হাজির। কী দমাদ্দম পিটানি।
লোহার শিকল তৈরি হইল,
পাখির ডানাও গেল কাটা।
রাজার সম্বন্ধীরা মুখ হাঁড়ি করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল,
“এ রাজ্যে পাখিদের কেবল
যে আক্কেল নাই তা নয়,
কৃতজ্ঞতাও নাই।”
তখন পণ্ডিতেরা এক হাতে কলম,
এক হাতে সড়কি লইয়া এমনি কাণ্ড করিল যাকে বলে শিক্ষা।
কামারের পসার বাড়িয়া কামারগিন্নির গায়ে সোনাদানা চড়িল এবং কোতোয়ালের হুঁশিয়ারি
দেখিয়া রাজা তাকে শিরোপা দিলেন।
৭
পাখিটা মরিল।
কোন্কালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই। নিন্দুক লক্ষ্ণীছাড়া রটাইল,
“পাখি মরিয়াছে।”
ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন,
“ভাগিনা,
এ কী কথা শুনি।”
ভাগিনা বলিল, ‘মহারাজ,
পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।”
রাজা শুধাইলেন,
“ও কি আর লাফায়।”
ভাগিনা বলিল,
“আরে রাম!”
“আর কি ওড়ে।”
“না।”
“‘আর
কি গান গায়।”
“না।”
“‘দানা
না পাইলে আর কি চেঁচায়।”
“না।”
রাজা বলিলেন, “একবার
পাখিটাকে আনো তো,
দেখি।”
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল,
পাইক আসিল,
ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন,
সে হাঁ করিল না,
হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্
গজ্গজ্ করিতে লাগিল।
বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণহাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল
করিয়া দিল।