ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
[সবুজ পত্র পত্রিকার মাঘ-ফাল্গুন ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]
স্বর্গের
অধিকারে মানুষ বাধা পাবে না,
এই তার পণ। তাই,
কঠিন সন্ধানে অমর হবার মন্ত্র সে শিখে নিয়েছে। এখন একলা বনের মধ্যে
সেই মন্ত্র সে সাধনা করে।
বনের ধারে ছিল এক কাঠকুড়নি মেয়ে। সে মাঝে মাঝে আঁচলে ক’রে
তার জন্যে ফল নিয়ে আসে,
আর পাতার
পাত্রে আনে ঝরনার জল।
ক্রমে তপস্যা এত কঠোর হল যে,
ফল সে আর ছোঁয় না,
পাখিতে এসে ঠুকরে খেয়ে যায়।
আরও কিছু দিন গেল। তখন ঝরনার জল পাতার পাত্রেই শুকিয়ে যায়,
মুখে ওঠে না।
কাঠকুড়নি মেয়ে বলে,
“এখন আমি করব কী! আমার
সেবা যে বৃথা হতে চলল।”
তার পর থেকে ফুল তুলে সে তপস্বীর পায়ের কাছে রেখে যায়,
তপস্বী জানতেও পারে না।
মধ্যাহ্নে রোদ যখন প্রখর হয় সে আপন আঁচলটি তুলে ধ’রে
ছায়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু,
তপস্বীর কাছে রোদও যা ছায়াও তা।
কৃষ্ণপক্ষের রাতে অন্ধকার যখন ঘন হয় কাঠকুড়নি সেখানে জেগে বসে থাকে। তাপসের কোনো
ভয়ের কারণ নেই,
তবু সে পাহারা দেয়।
২
একদিন এমন ছিল
যখন এই কাঠকুড়নির সঙ্গে দেখা হলে নবীন তপস্বী স্নেহ করে জিজ্ঞাসা করত,
“কেমন আছ।”
কাঠকুড়নি বলত, “আমার
ভালোই কী আর মন্দই কী। কিন্তু,
তোমাকে দেখবার লোক কি
কেউ নেই। তোমার মা,
তোমার বোন?”
সে বলত,
“আছে সবাই,
কিন্তু আমাকে দেখে হবে কী। তারা কি আমায় চিরদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে।”
কাঠকুড়নি বলত, “প্রাণ
থাকে না বলেই তো প্রাণের জন্যে এত দরদ।”
তাপস বলত, “আমি
খুঁজি চিরদিন বাঁচবার পথ। মানুষকে আমি অমর করব।”
এই বলে সে কত কী বলে যেত;
তার নিজের সঙ্গে নিজের
কথা,
সে কথার মানে
বুঝবে কে।
কাঠকুড়নি বুঝত না,
কিন্তু আকাশে নবমেঘের ডাকে ময়ূরীর যেমন হয় তেমনি তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠত।
তার পরে আরো কিছু দিন যায়। তপস্বী মৌন হয়ে এল,
মেয়েকে কোনো কথা বলে না।
তার পরে আরও কিছু দিন যায়। তপস্বীর চোখ বুজে এল,
মেয়েটির দিকে চেয়ে দেখে না।
মেয়ের মনে হল,
সে আর ঐ তাপসের মাঝখানে যেন তপস্যার লক্ষ যোজন ক্রোশের দূরত্ব।
হাজার হাজার বছরেও এতটা বিচ্ছেদ পার হয়ে একটুখানি কাছে আসবার আশা নেই।
তা নাই-বা রইল আশা। তবু ওর কান্না আসে;
মনে মনে বলে, দিনে
একবার যদি বলেন ‘কেমন
আছ’
তা হলে সেই কথাটুকুতে দিন কেটে
যায়,
এক বেলা যদি
একটু ফল আর জল গ্রহণ করেন তা হলে অন্নজল ওর নিজের মুখে রোচে।
৩
এ দিকে
ইন্দ্রলোকে খবর পৌঁছল,
মানুষ মর্ত্যকে লঙ্ঘন
করে স্বর্গ পেতে চায়—
এত বড়ো
স্পর্ধা।
ইন্দ্র প্রকাশ্যে রাগ দেখালেন,
গোপনে ভয় পেলেন। বললেন,
“দৈত্য স্বর্গ জয় করতে
চেয়েছিল বাহুবলে,
তার সঙ্গে লড়াই চলেছিল;
মানুষ স্বর্গ নিতে চায়
দুঃখের বলে,
তার কাছে কি হার
মানতে হবে।”
মেনকাকে মহেন্দ্র বললেন,
“যাও,
তপস্যা ভঙ্গ করো গে।”
মেনকা বললেন, “সুররাজ,
স্বর্গের অস্ত্রে মর্তের
মানুষকে যদি পরাস্ত করেন তবে তাতে স্বর্গের পরাভব। মানবের মরণবাণ কি মানবীর হাতে
নেই।”
ইন্দ্র বললেন,
“সে কথা সত্য।”
৪
ফাল্গুনমাসে দক্ষিণহাওয়ার দোলা লাগতেই মর্মরিত মাধবীলতা প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। তেমনি ঐ কাঠকুড়নির উপরে একদিন নন্দনবনের হাওয়া এসে লাগল, আর তার দেহমন একটা কোন্ উৎসুক মাধুর্যের উন্মেষে উন্মেষে ব্যথিত হয়ে উঠল। তার মনের ভাবনাগুলি চাকছাড়া মৌমাছির মতো উড়তে লাগল, কোথা তারা মধুগন্ধ পেয়েছে।
ঠিক সেই সময়ে সাধনার একটা পালা শেষ হল। এইবার তাকে যেতে হবে নির্জন গিরিগুহায়। তাই সে চোখ মেলল।
সামনে দেখে সেই কাঠকুড়নি মেয়েটি খোঁপায় পরেছে একটি অশোকের মঞ্জরী, আর তার গায়ের কাপড়খানি কুসুম্ভফুলে রঙ করা। যেন তাকে চেনা যায় অথচ চেনা যায় না। যেন সে এমন একটি জানা সুর যার পদগুলি মনে পড়ছে না। যেন সে এমন একটি ছবি যা কেবল রেখায় টানা ছিল, চিত্রকর কোন্ খেয়ালে কখন এক সময়ে তাতে রঙ লাগিয়েছে।
তাপস আসন ছেড়ে
উঠল। বললে,
“আমি দূর দেশে যাব।”
কাঠকুড়নি জিজ্ঞাসা করলে,
“কেন,
প্রভু।”
তপস্বী বললে,
“তপস্যা সম্পূর্ণ করবার জন্যে।”
কাঠকুড়নি হাত জোড় করে বললে,
“দর্শনের পুণ্য হতে
আমাকে কেন বঞ্চিত করবে।”
তপস্বী আবার আসনে বসল,
অনেকক্ষণ ভাবল,
আর কিছু বলল না।
৫
তার অনুরোধ
যেমনি রাখা হল অমনি মেয়েটির বুকের এক ধার থেকে আর এক ধারে বারে বারে যেন বজ্রসূচি
বিঁধতে লাগল।
সে ভাবলে, ‘আমি
অতি সামান্য তবু আমার
কথায় কেন বাধা ঘটবে।’
সেই রাতে পাতার বিছানায় একলা জেগে ব’সে
তার নিজেকে নিজের ভয় করতে লাগল।
তার পরদিন সকালে সে ফল এনে দাঁড়াল,
তাপস হাত পেতে নিলে। পাতার পাত্রে জল এনে দিতেই তাপস জল পান করলে। সুখে তার মন ভরে
উঠল।
কিন্তু তার পরেই নদীর ধারে শিরীষগাছের ছায়ায় তার চোখের জল আর থামতে চায় না। কী
ভাবলে কী জানি।
পরদিন সকালে কাঠকুড়নি তাপসকে প্রণাম করে বললে,
“প্রভু,
আশীর্বাদ চাই।”
তপস্বী জিজ্ঞাসা করলে,
“কেন।”
মেয়েটি বললে,
“আমি বহুদূর দেশে যাব।”
তপস্বী বললে, “যাও,
তোমার সাধনা সিদ্ধ হোক।”
৬
একদিন তপস্যা
পূর্ণ হল।
ইন্দ্র এসে বললেন,
“স্বর্গের অধিকার তুমি লাভ করেছে।”
তপস্বী বললে,
“তা হলে আর স্বর্গে প্রয়োজন নেই।”
ইন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন,
“কী চাও।”
তপস্বী বললে,
“এই বনের কাঠকুড়নিকে।”
প্রথম চিঠি
[শান্তিনিকেতন পত্রিকার
বৈশাখ ১৩২৯ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
বধূর সঙ্গে তার
প্রথম মিলন,
আর তার পরেই সে এই প্রথম এসেছে প্রবাসে।
চলে যখন আসে তখন বধূর লুকিয়ে কান্নাটি ঘরের আয়নার মধ্যে দিয়ে চকিতে ওর চোখে পড়ল।
মন বললে, ‘ফিরি,
দুটো কথা বলে আসি।’
কিন্তু,
সেটুকু সময় ছিল না।
সে দূরে আসবে ব’লে
একজনের দুটি চোখ বয়ে জল পড়ে,
তার
জীবনে এমন সে আর-কখনো দেখে নি।
পথে চলবার সময় তার কাছে পড়ন্ত রুদ্দুরে পৃথিবী প্রেমের ব্যথায় ভরা হয়ে দেখা দিল। সেই অসীম ব্যথার ভাণ্ডারে তার মতো একটি মানুষেরও নিমন্ত্রণ আছে, এই কথা মনে করে বিস্ময়ে তার বুক ভরে উঠল।
যেখানে সে কাজ করতে এসেছে সে পাহাড়। সেখানে দেবদারুর ছায়া বেয়ে বাঁকা পথ নীরব মিনতির মতো পাহাড়কে জড়িয়ে ধরে, আর ছোটো ছোটো ঝরনা কাকে যেন আড়ালে আড়ালে খুঁজে বেড়ায় লুকিয়ে-চুরিয়ে।
আয়নার মধ্যে যে ছবিটি দেখে এসেছিল আজ প্রকৃতির মধ্যে প্রবাসী সেই ছবিরই আভাস দেখে, নববধূর গোপন ব্যাকুলতার ছবি।
২
আজ দেশ থেকে তার
স্ত্রীর প্রথম চিঠি এল।
লিখেছে,
“তুমি কবে ফিরে আসবে।
এসো এসো,
শীঘ্র এসো। তোমার দুটি পায়ে
পড়ি।”
এই আসা-যাওয়ার সংসারে তারও চলে যাওয়া আর তারও ফিরে আসার যে এত দাম ছিল,
এ কথা কে জানত। সেই দুটি
আতুর চোখের চাউনির সামনে সে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখলে,
আর তার মন বিস্ময়ে ভরে উঠল।
ভোরেবেলায় উঠে চিঠিখানি নিয়ে দেবদারুর ছায়ায় সেই বাঁকা পথে সে বেড়াতে বেরোল। চিঠির পরশ তার হাতে লাগে আর কানে যেন সে শুনতে পায়, “তোমাকে না দেখতে পেয়ে আমার জগতের সমস্ত আকাশ কান্নায় ভেসে গেল।”
মনে মনে ভাবতে লাগল, ‘এত কান্নার মূল্য কি আমার মধ্যে আছে।’
৩
এমন সময় সূর্য উঠল পূর্বদিকের নীল পাহাড়ের শিখরে। দেবদারুর শিশিরভেজা পাতার ঝালরের ভিতর দিয়ে আলো ঝিল্মিল্ করে উঠল। হঠাৎ চারটি বিদেশিনী মেয়ে দুই কুকুর সঙ্গে নিয়ে রাস্তার বাঁকের মুখে তার সামনে এসে পড়ল। কী জানি কী ছিল তার মুখে, কিম্বা তার সাজে, কিম্বা তার চালচলনে— বড়ো মেয়েদুটি কৌতুকে মুখ একটুখানি বাঁকিয়ে চলে গেল। ছোটো মেয়েদুটি হাসি চাপবার চেষ্টা করলে, চাপতে পারলে না; দুজনে দুজনকে ঠেলাঠেলি করে খিল্খিল্ করে হেসে ছুটে গেল।
কঠিন কৌতুকের হাসিতে ঝরনাগুলিরও সুর ফিরে গেল। তারা হাততালি দিয়ে উঠল। প্রবাসী মাথা হেঁট করে চলে আর ভাবে, ‘আমার দেখার মূল্য কি এই হাসি।’
সেদিন রাস্তায় চলা তার আর হল না। বাসায় ফিরে গেল, একলা ঘরে বসে চিঠিখানি খুলে পড়লে, “তুমি কবে ফিরে আসবে। এসো, এসো, শীঘ্র এসো, তোমার দুটি পায়ে পড়ি।”
রথযাত্রা
[আঙুর পত্রিকার
বৈশাখ ১৩২৭ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
রথযাত্রার দিন কাছে।
তাই রানী রাজাকে বললে,
“চলো,
রথ দেখতে যাই।”
রাজা বললে,
“আচ্ছা।”
ঘোড়াশাল থেকে ঘোড়া বেরোল, হাতিশাল থেকে হাতি। ময়ূরপংখি যায় সারে সারে, আর বল্লম হাতে সারে সারে সিপাইসান্ত্রি। দাসদাসী দলে দলে পিছে পিছে চলল।
কেবল বাকি রইল
একজন। রাজবাড়ির ঝাঁটার কাঠি কুড়িয়ে আনা তার কাজ।
সর্দার এসে দয়া করে তাকে বললে,
“ওরে,
তুই যাবি তো আয়।”
সে হাত জোড় করে বললে,
“আমার যাওয়া ঘটবে না।”
রাজার কানে কথা উঠল,
সবাই সঙ্গে যায়,
কেবল সেই দুঃখীটা যায় না।
রাজা দয়া করে মন্ত্রীকে বললে,
“ওকেও ডেকে নিয়ো।”
রাস্তার ধারে তার বাড়ি। হাতি যখন সেইখানে পৌঁছল মন্ত্রী তাকে ডেকে বললে,
“ওরে দুঃখী,
ঠাকুর দেখবি চল্।”
সে হাত জোড় করে বলল,
“কত চলব। ঠাকুরের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছই এমন সাধ্য কি আমার আছে।”
মন্ত্রী বললে, “ভয় কী
রে তোর,
রাজার সঙ্গে চলবি।”
সে বললে,
“সর্বনাশ! রাজার পথ কি
আমার পথ!”
মন্ত্রী বললে, “তবে
তোর উপায়?
তোর ভাগ্যে কি
রথযাত্রা দেখা ঘটবে না।”
সে বললে,
“ঘটবে বই কি। ঠাকুর তো
রথে করেই আমার দুয়ারে আসেন।”
মন্ত্রী হেসে উঠল। বললে,
“তোর দুয়ারে রথের চিহ্ন
কই।”
দুঃখী বললে,
“তাঁর রথের চিহ্ন পড়ে না।”
মন্ত্রী বললে,
“কেন বল্ তো।”
দুঃখী বললে,
“তিনি যে আসেন পুষ্পকরথে।”
মন্ত্রী বললে,
“কই রে সেই রথ।”
দুঃখী দেখিয়ে দিলে,
তার দুয়ারের দুই পাশে দুটি সূর্যমুখী ফুটে আছে।
সওগাত
[শান্তিনিকেতন পত্রিকার
পৌষ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
পুজোর পরব কাছে।
ভাণ্ডার নানা সামগ্রীতে ভরা। কত বেনারসি কাপড়,
কত সোনার অলংকার;
আর ভাণ্ড ভ’রে ক্ষীর
দই,
পাত্র ভ’রে
মিষ্টান্ন।
মা সওগাত পাঠাচ্ছেন।
বড়োছেলে বিদেশে রাজসরকারে কাজ করে; মেজোছেলে সওদাগর, ঘরে থাকে না; আর-কয়টি ছেলে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া ক’রে পৃথক পৃথক বাড়ি করেছে; কুটুম্বরা আছে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে।
কোলের ছেলেটি সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সারা দিন ধরে দেখছে, ভারে ভারে সওগাত চলেছে, সারে সারে দাসদাসী, থালাগুলি রঙবেরঙের রুমালে ঢাকা।
দিন ফুরোল। সওগাত সব চলে গেল। দিনের শেষনৈবেদ্যের সোনার ডালি নিয়ে সূর্যাস্তের শেষ আভা নক্ষত্রলোকের পথে নিরুদ্দেশ হল। ছেলে ঘরে ফিরে এসে মাকে বললে, “মা, সবাইকে তুই সওগাত দিলি, কেবল আমাকে না।”
মা হেসে বললেন, “সবাইকে
সব দেওয়া হয়ে গেছে,
এখন তোর জন্যে কী বাকি রইল এই দেখ্।”
এই বলে তার কপালে চুম্বন করলেন।
ছেলে কাঁদোকাঁদো সুরে বললে,
“সওগাত পাব না?”
“যখন দূরে যাবি তখন সওগাত পাবি।”
“আর,
যখন কাছে থাকি তখন তোর হাতের
জিনিস দিবি নে?”
মা তাকে দু হাত বাড়িয়ে কোলে নিলেন;
বললেন,
“এই তো আমার হাতের জিনিস।”
মুক্তি
[শান্তিনিকেতন পত্রিকার
পৌষ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
বিরহিণী তার ফুলবাগানের এক ধারে বেদী সাজিয়ে তার উপর মূর্তি গড়তে বসল। তার মনের মধ্যে যে মানুষটি ছিল বাইরে তারই প্রতিরূপ প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে, আর চেয়ে চেয়ে দেখে, আর ভাবে, আর চোখ দিয়ে জল পড়ে।
কিন্তু, যে রূপটি একদিন তার চিত্তপটে স্পষ্ট ছিল তার উপরে ক্রমে যেন ছায়া পড়ে আসছে। রাতের বেলাকার পদ্মের মতো স্মৃতির পাপড়িগুলি অল্প অল্প করে যেন মুদে এল।
মেয়েটি তার নিজের উপর রাগ করে, লজ্জা পায়। সাধনা তার কঠিন হল, ফল খায় আর জল খায়, আর তৃণশয্যায় পড়ে থাকে।
মূর্তিটি মনের ভিতর থেকে গড়তে গড়তে সে আর প্রতিমূর্তি রইল না। মনে হল, এ যেন কোনো বিশেষ মানুষের ছবি নয়। যতই বেশি চেষ্টা করে ততই বেশি তফাত হয়ে যায়।
মূর্তিকে তখন সে গয়না দিয়ে সাজাতে থাকে, একশো-এক পদ্মের ডালি দিয়ে পুজো করে, সন্ধেবেলায় তার সামনে গন্ধতৈলের প্রদীপ জ্বালে— সে প্রদীপ সোনার, সে তেলের অনেক দাম।
দিনে দিনে গয়না বেড়ে ওঠে, পুজোর সামগ্রীতেই বেদী ঢেকে যায়, মূর্তিকে দেখা যায় না।
২
এক ছেলে এসে
তাকে বললে,
“আমরা খেলব।”
“কোথায়।”
“ঐখানে,
যেখানে তোমার পুতুল সাজিয়েছ।”
মেয়ে তাকে হাঁকিয়ে দেয়;
বলে,
“এখানে কোনোদিন খেলা হবে না।”
আর-এক ছেলে এসে বলে,
“আমরা ফুল তুলব।”
“কোথায়।”
“ঐযে,
তোমার পুতুলের ঘরের শিয়রে যে
চাঁপাগাছ আছে ঐ গাছ থেকে।”
মেয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়;
বলে,
“এ ফুল কেউ ছুঁতে পাবে
না।”
আর-এক ছেলে এসে বলে,
“প্রদীপ ধরে আমাদের পথ
দেখিয়ে দাও।”
“প্রদীপ কোথায়?”
“ঐ যেটা তোমার পুতুলের ঘরে জ্বাল।”
মেয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়;
বলে,
“ও প্রদীপ ওখান থেকে সরাতে পারব না।”
৩
এক ছেলের দল যায়,
আর-এক ছেলের দল আসে।
মেয়েটি শোনে তাদের কলরব,
আর দেখে তাদের নৃত্য।
ক্ষণকালের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে যায়। অমনি চমকে ওঠে,
লজ্জা পায়।
মেলার দিন কাছে এল।
পাড়ার বুড়ো এসে বললে,
“বাছা,
মেলা দেখতে যাবি নে?”
মেয়ে বললে,
“আমি কোথাও যাব না।”
সঙ্গিনী এসে বললে,
“চল্,
মেলা দেখবি চল্।”
মেয়ে বললে,
“আমার সময় নেই।”
ছোটো ছেলেটি এসে বললে,
“আমায় সঙ্গে নিয়ে মেলায়
চলো-না।”
মেয়ে বললে, “যেতে
পারব না,
এইখানে যে আমার
পুজো।”
৪
একদিন রাত্রে
ঘুমের মধ্যেও সে যেন শুনতে পেলে সমুদ্রগর্জনের মতো শব্দ। দলে দলে দেশবিদেশের লোক
চলেছে—
কেউ বা রথে,
কেউ বা পায়ে হেঁটে;
কেউ বা বোঝা পিঠে নিয়ে,
কেউ বা বোঝা ফেলে দিয়ে।
সকালে যখন সে জেগে উঠল তখন যাত্রীর গানে পাখির গান আর শোনা যায় না। ওর হঠাৎ মনে হল,
‘আমাকেও যেতে হবে।’
অমনি মনে পড়ে গেল,
‘আমার যে পুজো আছে,
আমার তো যাবার জো নেই।’
তখনি ছুটে চলল তার বাগানের দিকে যেখানে মূর্তি সাজিয়ে রেখেছে।
গিয়ে দেখে, মূর্তি
কোথায়! বেদীর উপর দিয়ে পথ হয়ে গেছে। লোকের পরে লোক চলে,
বিশ্রাম নেই।
“এইখানে যাকে বসিয়ে রেখেছিলেম সে কোথায়।”
কে তার মনের মধ্যে বলে উঠল,
‘যারা চলেছে তাদেরই
মধ্যে।’
এমন সময় ছোটো ছেলে এসে বললে,
“আমাকে হাতে ধরে নিয়ে চলো।”
“কোথায়।”
ছেলে বললে, “মেলার
মধ্যে তুমিও যাবে না?”
মেয়ে বললে, “হাঁ,
আমিও যাব।”
যে বেদীর সামনে এসে সে বসে থাকত সেই বেদীর উপর হল তার পথ, আর মূর্তির মধ্যে যে ঢেকে গিয়েছিল সকল যাত্রীর মধ্যে তাকে পেলে।