ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
[বঙ্গবাণী পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৯ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।]
রাজপুত্রের বয়স
কুড়ি পার হয়ে যায়,
দেশবিদেশ থেকে বিবাহের সম্বন্ধ আসে।
ঘটক বললে,
“বাহ্লীকরাজের মেয়ে রূপসী বটে,
যেন সাদা গোলাপের পুষ্পবৃষ্টি।”
রাজপুত্র মুখ ফিরিয়ে থাকে,
জবাব করে না।
দূত এসে বললে,
“গান্ধাররাজের মেয়ের অঙ্গে অঙ্গে লাবণ্য ফেটে পড়ছে,
যেন দ্রাক্ষালতায় আঙুরের গুচ্ছ।”
রাজপুত্র শিকারের ছলে বনে চলে যায়। দিন যায়,
সপ্তাহ যায়,
ফিরে আসে না।
দূত এসে বললে,
“কাম্বোজের রাজকন্যাকে দেখে এলেম;
ভোরবেলাকার
দিগন্ত-রেখাটির মতো বাঁকা চোখের পল্লব,
শিশিরে
স্নিগ্ধ,
আলোতে উজ্জ্বল।”
রাজপুত্র ভর্তৃহরির কাব্য পড়তে লাগল,
পুঁথি থেকে চোখ তুলল না।
রাজা বললে, “এর
কারণ?
ডাকো
দেখি মন্ত্রীর পুত্রকে।”
মন্ত্রীর পুত্র এল। রাজা বললে,
“তুমি তো আমার ছেলের
মিতা,
সত্য করে বলো,
বিবাহে তার মন নেই কেন।”
মন্ত্রীর পুত্র বললে,
‘মহারাজ,
যখন থেকে তোমার ছেলে
পরীস্থানের কাহিনী শুনেছে সেই অবধি তার কামনা,
সে পরী বিয়ে করব।’
২
রাজার হুকুম হল,
পরীস্থান কোথায় খবর চাই।
বড়ো বড়ো পণ্ডিত ডাকা হল,
যেখানে যত পুঁথি আছে
তারা সব খুলে দেখলে। মাথা নেড়ে বললে,
পুঁথির কোনো পাতায় পরীস্থানের কোনো ইশারা মেলে না।
তখন রাজসভায় সওদাগরদের ডাক পড়ল। তারা বললে, “সমুদ্র পার হয়ে কত দ্বীপেই ঘুরলেম— এলাদ্বীপে, মরীচদ্বীপে, লবঙ্গলতার দেশে। আমরা গিয়েছি মলয়দ্বীপে চন্দন আনতে, মৃগনাভির সন্ধানে গিয়েছি কৈলাসে দেবদারুবনে। কোথাও পরীস্থানের কোনো ঠিকানা পাই নি।”
রাজা বললে,
“ডাকো মন্ত্রীর পুত্রকে।”
মন্ত্রীর পুত্র এল। রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করলে,
“পরীস্থানের কাহিনী রাজপুত্র কার কাছে শুনেছে।”
মন্ত্রীর পুত্র বললে,
“সেই যে আছে নবীন পাগলা,
বাঁশি হাতে বনে বনে ঘুরে
বেড়ায়,
শিকার করতে গিয়ে রাজপুত্র তারই
কাছে পরীস্থানের গল্প শোনে।”
রাজা বললে, “আচ্ছা,
ডাকো তাকে।”
নবীন পাগলা এক
মুঠো বনের ফুল ভেট দিয়ে রাজার সামনে দাঁড়াল। রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করলে,
“পরীস্থানের খবর তুমি কোথায় পেলে।”
সে বললে,
“সেখানে তো আমার সদাই যাওয়া-আসা।”
রাজা জিজ্ঞাসা করলে,
“কোথায় সে জায়গা।”
পাগলা বললে, “তোমার
রাজ্যের সীমানায় চিত্রগিরি পাহাড়ের তলে,
কাম্যক-সরোবরের ধারে।”
রাজা জিজ্ঞাসা করলে,
“সেইখানে পরী দেখা যায়?”
পাগলা বললে, “দেখা যায়, কিন্তু চেনা যায় না। তারা ছদ্মবেশে থাকে। কখনো কখনো যখন চলে যায় পরিচয় দিয়ে যায়, আর ধরবার পথ থাকে না।”
রাজা জিজ্ঞাসা
করলে,
“তুমি
তাদের চেন কী উপায়ে।”
পাগলা বললে, “কখনো
বা একটা সুর শুনে, কখনো বা
একটা আলো দেখে।”
রাজা বিরক্ত হয়ে বললে,
“এর আগাগোড়া সমস্তই
পাগলামি,
একে তাড়িয়ে
দাও।”
৩
পাগলার কথা
রাজপুত্রের মনে গিয়ে বাজল।
ফাল্গুনমাসে তখন ডালে ডালে শালফুলে ঠেলাঠেলি,
আর শিরীষফুলে বনের প্রান্ত শিউরে উঠেছে। রাজপুত্র চিত্রগিরিতে একা চলে গেল।
সবাই জিজ্ঞাসা করলে,
“কোথায় যাচ্ছ।”
সে কোনো জবাব করলে না।
গুহার ভিতর দিয়ে একটি ঝরনা ঝরে আসে, সেটি গিয়ে মিলেছে কাম্যকসরোবরে; গ্রামের লোক তাকে বলে উদাসঝোরা। সেই ঝরনাতলায় একটি পোড়ো মন্দিরে রাজপুত্র বাসা নিলে।
এক মাস কেটে গেল। গাছে গাছে যে কচিপাতা উঠেছিল তাদের রঙ ঘন হয়ে আসে, আর ঝরাফুলে বনপথ ছেয়ে যায়। এমন সময় একদিন ভোরের স্বপ্নে রাজপুত্রের কানে একটি বাঁশির সুর এল। জেগে উঠেই রাজপুত্র বললে, “আজ পাব দেখা।”
৪
তখনি ঘোড়ায় চড়ে ঝরনাধারার তীর বেয়ে চলল, পৌঁছল কাম্যকসরোবরের ধারে। দেখে, সেখানে পাহাড়েদের এক মেয়ে পদ্মবনের ধারে বসে আছে। ঘড়ায় তার জল ভরা, কিন্তু ঘাটের থেকে সে ওঠে না। কালো মেয়ে কানের উপর কালো চুলে একটি শিরীষফুল পরেছে, গোধূলিতে যেন প্রথম তারা।
রাজপুত্র ঘোড়া থেকে নেমে তাকে বললে, “তোমার ঐ কানের শিরীষফুলটি আমাকে দেবে?”
যে হরিণী ভয় জানে না এ বুঝি সেই হরিণী। ঘাড় বেঁকিয়ে একবার সে রাজপুত্রের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। তখন তার কালো চোখের উপর একটা কিসের ছায়া আরও ঘন কালো হয়ে নেমে এল— ঘুমের উপর যেন স্বপ্ন, দিগন্তে যেন প্রথম শ্রাবণের সঞ্চার।
মেয়েটি কান থেকে
ফুল খসিয়ে রাজপুত্রের হাতে দিয়ে বললে,
“এই নাও।”
রাজপুত্র তাকে জিজ্ঞাসা করলে,
“তুমি কোন্ পরী আমাকে সত্য করে বলো।”
শুনে একবার মুখে দেখা দিল বিস্ময়,
তার পরেই আশ্বিনমেঘের
আচমকা বৃষ্টির মতো তার হাসির উপর হাসি,
সে আর থামতে চায় না।
রাজপুত্র মনে ভাবল,
“স্বপ্ন বুঝি ফলল—
এই হাসির সুর যেন সেই বাঁশির সুরের সঙ্গে মেলে।”
রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে দুই হাত বাড়িয়ে দিলে;
বললে,
“এসো।”
সে তার হাত ধরে ঘোড়ায় উঠে পড়ল,
একটুও ভাবল না। তার জলভরা ঘড়া ঘাটে রইল পড়ে।
শিরীষের ডাল থেকে কোকিল ডেকে উঠল,
কুহু কুহু কুহু কুহু।
রাজপুত্র মেয়েটিকে কানে কানে জিজ্ঞাসা করলে,
“তোমার নাম কী।”
সে বললে,
“আমার নাম কাজরী।”
উদাসঝোরার ধারে দুজনে গেল সেই পোড়ো মন্দিরে। রাজপুত্র বললে,
“এবার তোমার ছদ্মবেশ
ফেলে দাও।”
সে বললে,
“আমরা বনের মেয়ে,
আমরা তো ছদ্মবেশ জানি
নে।”
রাজপুত্র বললে, “আমি যে
তোমার পরীর মূর্তি দেখতে চাই।”
পরীর মূর্তি! আবার সেই হাসি,
হাসির উপর হাসি।
রাজপুত্র ভাবলে,
“এর হাসির সুর এই ঝরনার সুরের
সঙ্গে মেলে,
এ আমার এই ঝরনার পরী।”
৫
রাজার কানে খবর
গেল,
রাজপুত্রের সঙ্গে পরীর বিয়ে
হয়েছে। রাজবাড়ি থেকে ঘোড়া এল,
হাতি এল,
চতুর্দোলা এল।
কাজরী জিজ্ঞাসা করলে,
“এসব কেন!”
রাজপুত্র বললে,
“তোমাকে রাজবাড়িতে যেতে হবে।”
তখন তার চোখ ছল্ছলিয়ে এল। মনে পড়ে গেল, তার ঘড়া পড়ে আছে সেই জলের ধারে; মনে পড়ে গেল, তার ঘরের আঙিনায় শুকোবার জন্যে ঘাসের বীজ মেলে দিয়ে এসেছে; মনে পড়ল, তার বাপ আর ভাই শিকারে চলে গিয়েছিল, তাদের ফেরবার সময় হয়েছে; আর মনে পড়ল, তার বিয়েতে একদিন যৌতুক দেবে ব’লে তার মা গাছতলায় তাঁত পেতে কাপড় বুনছে, আর গুন্গুন্ করে গান গাইছে। সে বললে, ‘না, আমি যাব না।’
কিন্তু ঢাক ঢোল
বেজে উঠল;
বাজল বাঁশি, কাঁসি,
দামামা—ওর
কথা শোনা গেল না।
চতুর্দোলা থেকে কাজরী যখন রাজবাড়িতে নামল,
রাজমহিষী কপাল চাপড়ে
বললে,
“এ কেমনতরো
পরী।”
রাজার মেয়ে বললে,
“ছি,
ছি,
কী লজ্জা।”
মহিষীর দাসী বললে,
“পরীর বেশটাই বা কী রকম।”
রাজপুত্র বললে, “চুপ
করো,
তোমাদের ঘরে পরী ছদ্মবেশে
এসেছে।”
৬
দিনের পর দিন যায়। রাজপুত্র জ্যোৎস্নারাত্রে বিছানায় জেগে উঠে চেয়ে দেখে, কাজরীর ছদ্মবেশ একটু কোথাও খসে পড়েছে কি না। দেখে যে, কালো মেয়ের কালো চুল এলিয়ে গেছে, আর তার দেহখানি যেন কালো পাথরে নিখুঁত করে খোদা একটি প্রতিমা। রাজপুত্র চুপ করে বসে ভাবে, ‘পরী কোথায় লুকিয়ে রইল, শেষরাতে অন্ধকারের আড়ালে উষার মতো।’
রাজপুত্র ঘরের লোকের কাছে লজ্জা পেলে। একদিন মনে একটু রাগও হল। কাজরী সকালবেলায় বিছানা ছেড়ে যখন উঠতে যায় রাজপুত্র শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে বললে, “আজ তোমাকে ছাড়ব না— নিজরূপ প্রকাশ করো, আমি দেখি।”
এমনি কথাই শুনে
বনে যে হাসি হেসেছিল সে হাসি আর বেরোল না। দেখতে দেখতে দুই চোখ জলে ভরে এল।
রাজপুত্র বললে,
“তুমি কি আমায় চিরদিন ফাঁকি দেবে।”
সে বললে,
“না,
আর নয়।”
রাজপুত্র বললে, “তবে
এইবার কার্তিকী পূর্ণিমায় পরীকে যেন সবাই দেখে।”
৭
পূর্ণিমার চাঁদ
এখন মাঝগগনে। রাজবাড়ির নহবতে মাঝরাতের সুরে ঝিমি ঝিমি তান লাগে।
রাজপুত্র বরসজ্জা প’রে
হাতে বরণমালা নিয়ে মহলে ঢুকল;
পরীবৌয়ের সঙ্গে আজ হবে তার শুভদৃষ্টি।
শয়নঘরে বিছানায় সাদা আস্তরণ,
তার উপরসাদা কুন্দফুল
রাশ-করা;
আর উপরে জানলা
বেয়ে জ্যোৎস্না পড়েছে।
আর,
কাজরী?
সে কোথাও নেই।
তিন প্রহরের বাঁশি বাজল। চাঁদ পশ্চিমে হেলেছে। একে একে কুটুম্বে ঘর ভরে গেল।
পরী কই?
রাজপুত্র বললে, “চলে
গিয়ে পরী আপন পরিচয় দিয়ে যায়,
আর তখন তাকে পাওয়া যায় না।”
প্রাণমন
[সবুজ পত্র পত্রিকার
ফাল্গুন ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশের সময় নাম ছিল 'আমার কথা']
আমার জানলার
সামনে রাঙা মাটির রাস্তা।
ওখান দিয়ে বোঝাই নিয়ে গোরুর গাড়ি চলে;
সাঁওতাল মেয়ে খড়ের আঁটি
মাথায় করে হাটে যায়,
সন্ধ্যাবেলায়
কলহাস্যে ঘরে ফেরে।
কিন্তু,
মানুষের চলাচলের পথে আজ আমার মন নেই।
জীবনের যে ভাগটা অস্থির, নানা ভাবনায় উদ্বিগ্ন, নানা চেষ্টায় চঞ্চল, সেটা আজ ঢাকা পড়ে গেছে। শরীর আজ রুগ্ণ, মন আজ নিরাসক্ত। ঢেউয়ের সমুদ্র বাহিরতলের সমুদ্র; ভিতরতলে যেখানে পৃথিবীর গভীর গর্ভশয্যা ঢেউ সেখানকার কথা গোলমাল করে ভুলিয়ে দেয়। ঢেউ যখন থামে তখন সমুদ্র আপন গোচরের সঙ্গে অগোচরের, গভীরতলের সঙ্গে উপরিতলের অখণ্ড ঐক্যে স্তব্ধ হয়ে বিরাজ করে।
তেমনি আমার সচেষ্ট প্রাণ যখনি ছুটি পেল, তখনি গভীর প্রাণের মধ্যে স্থান পেলুম যেখানে বিশ্বের আদিকালের লীলাক্ষেত্র।
পথ-চলা পথিক যত দিন ছিলুম তত দিন পথের ধারের ঐ বটগাছটার দিকে তাকাবার সময় পাই নি; আজ পথ ছেড়ে জানলায় এসেছি, আজ ওর সঙ্গে মোকাবিলা শুরু হল।
আমার মুখের দিকে
চেয়ে চেয়ে ক্ষণে ক্ষণে ও যেন অস্থির হয়ে ওঠে। যেন বলতে চায়,
“বুঝতে পারছ না?”
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলি,
“বুঝেছি,
সব বুঝেছি;
তুমি অমন ব্যাকুল হোয়ো না।”
কিছুক্ষণের জন্যে আবার শান্ত বয়ে যায়। আবার দেখি,
ভারি ব্যস্ত হয়ে ওঠে;
আবার সেই থর্থর্ ঝর্ঝর্ ঝল্মল্।
আবার ওকে ঠাণ্ডা করে বলি, ‘হাঁ হাঁ, ঐ কথাই বটে; আমি তোমারই খেলার সাথি, লক্ষহাজার বছর ধরে এই মাটির খেলাঘরে আমিও গণ্ডূষে গণ্ডূষে তোমারই মতো সূর্যালোক পান করেছি, ধরণীর স্তন্যরসে আমিও তোমার অংশী ছিলেম।’
তখন ওর ভিতর দিয়ে হঠাৎ হাওয়ার শব্দ শুনি; ও বলতে থাকে, “হাঁ, হাঁ, হাঁ।”
যে ভাষা রক্তের মর্মরে আমার হৃৎপিণ্ডে বাজে, যা আলো-অন্ধকারের নিঃশব্দ আবর্তন ধ্বনি, সেই ভাষা ওর পত্রমর্মরে আমার কাছে এসে পৌঁছয়। সেই ভাষা বিশ্বজগতের সরকারি ভাষা।
তার মূল বাণীটি
হচ্ছে,
“আছি,
আছি;
আমি আছি,
আমরা আছি।”
সে ভারি খুশির কথা। সেই খুশিতে বিশ্বের অণু পরমাণু থর্থর্ করে কাঁপছে।
ঐ বটগাছের সঙ্গে আমার আজ সেই এক ভাষায় সেই এক খুশির কথা চলছে।
ও আমাকে বলছে, “আছ হে
বটে?”
আমি সাড়া দিয়ে বলছি,
“আছি হে মিতা।”
এমনি করে ‘আছি’তে
এক তালে করতালি বাজছে।
২
ঐ বটগাছটার সঙ্গে যখন আমার আলাপ শুরু হল তখন বসন্তে ওর পাতাগুলো কচি ছিল; তার নানা ফাঁক দিয়ে আকাশের পলাতক আলো ঘাসের উপর এসে পৃথিবীর ছায়ার সঙ্গে গোপনে গলাগলি করত।
তার পরে আষাঢ়ের বর্ষা নামল; ওরও পাতার রঙ মেঘের মতো গম্ভীর হয়ে এসেছে। আজ সেই পাতার রাশ প্রবীণের পাকা বুদ্ধির মতো নিবিড়, তার কোনো ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো প্রবেশ করবার পথ পায় না। তখন গাছটি ছিল গরিবের মেয়েটির মতো; আজ সে ধনীঘরের গৃহিণী, যেন পর্যাপ্ত পরিতৃপ্তির চেহারা।
আজ সকালে সে তার মরকতমণির বিশনলী হার ঝল্মলিয়ে আমাকে বললে, “মাথার উপর অমনতরো ইঁটপাথর মুড়ি দিয়ে বসে আছ কেন। আমার মতো একেবারে ভরপুর বাইরে এসো-না।”
আমি বললেম,
“মানুষকে যে ভিতর বাহির দুই বাঁচিয়ে চলতে হয়।”
গাছ নড়েচড়ে বলে উঠল,
“বুঝতে পারলেম না।”
আমি বললেম, “আমাদের
দুটো জগৎ,
ভিতরের আর
বাইরের।”
গাছ বললে,
“সর্বনাশ! ভিতরেরটা আছে কোথায়।”
“আমার আপনারই ঘেরের মধ্যে।”
“সেখানে কর কী।”
“সৃষ্টি করি।”
“সৃষ্টি আবার ঘেরের মধ্যে! তোমার কথা বোঝবার জো নেই।”
আমি বললেম, “যেমন তীরের মধ্যে বাঁধা প’ড়ে হয় নদী, তেমনি ঘেরের মধ্যে ধরা প’ড়েই তো সৃষ্টি। একই জিনিস ঘেরের মধ্যে আটকা প’ড়ে কোথাও হীরের টুকরো, কোথাও বটের গাছ।”
গাছ বললে,
“তোমার ঘেরটা কী রকম শুনি।”
আমি বললেম,
“সেইটি আমার মন। তার মধ্যে যা ধরা পড়ছে তাই নানা সৃষ্টি হয়ে উঠছে।”
গাছ বললে,
“তোমার সেই বেড়াঘেরা সৃষ্টিটা আমাদের চন্দ্রসূর্যের পাশে কতটুকুই বা
দেখায়।”
আমি বললেম,
“চন্দ্রসূর্যকে দিয়ে তাকে তো মাপা যায় না,
চন্দ্রসূর্য যে বাইরের
জিনিস।”
“তা হলে মাপবে কী দিয়ে।”
“সুখ দিয়ে,
বিশেষত দুঃখ দিয়ে।”
গাছ বললে, “এই পুবে হাওয়া আমার কানে কানে কথা কয়, আমার প্রাণে প্রাণে তার সাড়া জাগে। কিন্তু, তুমি যে কিসের কথা বললে আমি কিছুই বুঝলেম না।”
আমি বললেম, “বোঝাই কী করে। তোমার ঐ পুবে হাওয়াকে আমাদের বেড়ার মধ্যে ধ’রে বীণার তারে যেমনি বেঁধে ফেলেছি, অমনি সেই হাওয়া এক সৃষ্টি থেকে একেবারে আর-এক সৃষ্টিতে এসে পৌঁছয়। এই সৃষ্টি কোন আকাশে যে স্থান পায়, কোন্ বিরাট চিত্তের স্মরণাকাশে, তা আমিও ঠিক জানি নে। মনে হয়, যেন বেদনার একটা আকাশ আছে। সে আকাশ মাপের আকাশ নয়।”
“আর,
ওর কাল?”
“ওর কালও ঘটনার কাল নয়,
বেদনার কাল। তাই সে কাল সংখ্যার অতীত।”
“দুই আকাশ দুই কালের জীব তুমি,
তুমি অদ্ভুত। তোমার
ভিতরের কথা কিচ্ছুই বুঝলেম না।’
“নাই বা বুঝলে।”
“আমার বাইরের কথা তুমিই কি ঠিক বোঝ।”
“তোমার বাইরের কথা আমার ভিতরে এসে যে কথা হয়ে ওঠে তাকে যদি বোঝা বল তো সে বোঝা, যদি গান বল তো গান, কল্পনা বল তো কল্পনা।”
৩
গাছ তার সমস্ত ডালগুলো তুলে আমাকে বললে, “একটু থামো। তুমি বড়ো বেশি ভাব’, আর বড়ো বেশি বক।”
শুনে আমার মনে হল, এ কথা সত্যি। আমি বললেম, “চুপ করবার জন্যেই তোমার কাছে আসি, কিন্তু অভ্যাসদোষ চুপ করে করেও বকি; কেউ কেউ যেমন ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও চলে।’
কাগজটা
পেন্সিলটা টেনে ফেলে দিলেম,
রইলেম ওর দিকে অনিমেষ তাকিয়ে। ওর চিকন পাতাগুলো ওস্তাদের আঙুলের মতো আলোকবীণায়
দ্রুত তালে ঘা দিতে লাগল।
হঠাৎ আমার মন বলে উঠল,
“এই তুমি যা দেখছ আর এই
আমি যা ভাবছি,
এর মাঝখানের
যোগটা কোথায়।”
আমি তাকে ধমক দিয়ে বললেম,
“আবার তোমার প্রশ্ন?
চুপ করো।”
চুপ করে রইলেম,
একদৃষ্টে চেয়ে দেখলেম। বেলা কেটে গেল।
গাছ বললে, “কেমন,
সব বুঝেছ?”
আমি বললেম,
“বুঝেছি।”
৪
সেদিন তো চুপ
করেই কাটল।
পরদিনে আমার মন আমাকে জিজ্ঞাসা করলে,
“কাল গাছটার দিকে তাকিয়ে
তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলে ’বুঝেছি’,
কী বুঝেছ বলো তো।”
আমি বললেম, “নিজের মধ্যে মানুষের প্রাণটা নানা ভাবনায় ঘোলা হয়ে গেছে। তাই, প্রাণের বিশুদ্ধ রূপটি দেখতে হলে চাইতে হয় ঐ ঘাসের দিকে, ঐ গাছের দিকে।”
“কী রকম দেখলে।”
“দেখলেম, এই প্রাণের আপনাতে আপনার কী আনন্দ। নিজেকে নিয়ে পাতায় পাতায়, ফুলে ফুলে, ফলে ফলে, কত যত্নে সে কত ছাঁটই ছেঁটেছে, কত রঙই লাগিয়েছে, কত গন্ধ, কত রস। তাই ঐ বটের দিকে তাকিয়ে নীরবে বলছিলেম— ওগো বনস্পতি, জন্মমাত্রই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ যে আনন্দধ্বনি করে উঠেছিল সেই ধ্বনি তোমার শাখায় শাখায়। সেই আদিযুগের সরল হাসিটি তোমার পাতায় পাতায় ঝল্মল্ করছে। আমার মধ্যে সেই প্রথম প্রাণ আজ চঞ্চল হল। ভাবনার বেড়ার মধ্যে সে বন্দী হয়ে বসে ছিল; তুমি তাকে ডাক দিয়ে বলেছ, ওরে আয়-না রে আলোর মধ্যে, হাওয়ার মধ্যে; আর আমারই মতো নিয়ে আয় তোর রূপের তূলি, রঙের বাটি, রসের পেয়ালা।”
মন আমার খানিক ক্ষণ চুপ করে রইল। তার পরে কিছু বিমর্ষ হয়ে বললে, “তুমি ঐ প্রাণের কথাটাই নিয়ে কিছু বাড়াবাড়ি করে থাক, আমি যে-সব উপকরণ জড়ো করছি তার কথা এমন সাজিয়ে সাজিয়ে বল না কেন।”
“তার কথা আর কইব কী। সে নিজেই নিজের টংকারে ঝংকারে হুংকারে ক্রেংকারে আকাশ কাঁপিয়ে রেখেছে। তার ভারে, তার জটিলতায়, তার জঞ্জালে পৃথিবীর বক্ষ ব্যথিত হয়ে উঠল। ভেবে পাই নে, এর অন্ত কোথায়। থাকের উপরে আর কত থাক উঠবে, গাঁঠের উপরে আর কত গাঁঠ পড়বে। এই প্রশ্নেরই জবাব ছিল ঐ গাছের পাতায়।”
“বটে? কী জবাব শুনি।”
“সে বলছে, প্রাণ যতক্ষণ নেই ততক্ষণ সমস্তই কেবল স্তূপ, সমস্তই কেবল ভার। প্রাণের পরশ লাগবা মাত্রই উপকরণের সঙ্গে উপকরণ আপনি মিলে গিয়ে অখণ্ড সুন্দর হয়ে ওঠে। সেই সুন্দরকেই দেখো এই বনবিহারী। তারই বাঁশি তো বাজছে বটের ছায়ায়।’’
৫
তখন কবেকার কোন্
ভোররাত্রি।
প্রাণ আপন সুপ্তিশয্যা ছাড়ল;
সেই প্রথম পথে বাহির হল
অজানার উদ্দেশে,
অসাড় জগতের
তেপান্তর মাঠে।
তখনো তার দেহে ক্লান্তি নেই,
মনে চিন্তা নেই; তার
রাজপুত্তুরের সাজে না লেগেছে ধুলো,
না ধরেছে ছিদ্র।
সেই অক্লান্ত নিশ্চিন্ত অম্লান প্রাণটিকে দেখলেম এই আষাঢ়ের সকালে, ঐ বটগাছটিতে। সে তার শাখা নেড়ে আমাকে বললে, “নমস্কার।”
আমি বললেম,
“রাজপুত্তুর,
মরুদৈত্যটার
সঙ্গে লড়াই চলছে কেমন বলো তো।”
সে বললে,
“বেশ চলছে,
একবার চার দিকে তাকিয়ে দেখো-না।”
তাকিয়ে দেখি, উত্তরের মাঠ ঘাসে ঢাকা, পুবের মাঠে আউশ ধানের অঙ্কুর, দক্ষিণে বাঁধের ধারে তালের সার; পশ্চিমে শালে তালে মহুয়ায়, আমে জামে খেজুরে, এমনি জটলা করেছে যে দিগন্ত দেখা যায় না।
আমি বললেম, “রাজপুত্তুর, ধন্য তুমি। তুমি কোমল, তুমি কিশোর, আর দৈত্যটা হল যেমন প্রবীণ তেমনি কঠোর; তুমি ছোটো, তোমার তূণ ছোটো, তোমার তীর ছোটো, আর ও হল বিপুল, ওর বর্ম মোটা, ওর গদা মস্ত। তুব তো দেখি, দিকে দিকে তোমার ধ্বজা উড়ল, দৈত্যটার পিঠের উপর তুমি পা রেখেছ; পাথর মানছে হার, ধুলো দাসখত লিখে দিচ্ছে।”
বট বললে, “তুমি এত সমারোহ কোথায় দেখলে।”
আমি বললেম, “তোমার লড়াইকে দেখি শান্তির রূপে, তোমার কর্মকে দেখি বিশ্রামের বেশে, তোমার জয়কে দেখি নম্রতার মূর্তিতে। সেইজন্যেই তো তোমার ছায়ায় সাধক এসে বসেছে ঐ সহজ যুদ্ধজয়ের মন্ত্র আর ঐ সহজ অধিকারের সন্ধিটি শেখবার জন্যে। প্রাণ যে কেমন ক’রে কাজ করে, অরণ্যে অরণ্যে তারই পাঠশালা খুলেছ। তাই যারা ক্লান্ত তারা তোমার ছায়ায় আসে, যারা আর্ত তারা তোমার বাণী খোঁজে।”
আমার স্তব শুনে বটের ভিতরকার প্রাণপুরুষ বুঝি খুশি হল; সে বলে উঠল, “আমি বেরিয়েছি মরুদৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে; কিন্তু আমার এক ছোটো ভাই আছে, সে যে কোন্ লড়াইয়ে কোথায় চলে গেল আমি তার আর নাগাল পাই নে। কিছুক্ষণ আগে তারই কথা কি তুমি বলছিলে।”
“হ্যাঁ,
তাকেই আমরা নাম দিয়েছি—
মন।”
“সে আমার চেয়ে চঞ্চল। কিছুতে তার সন্তোষ নেই। সেই অশান্তটার খবর আমাকে দিতে পার?”
আমি বললেম, “কিছু কিছু পারি বই কি। তুমি লড়ছ বাঁচবার জন্যে, সে লড়ছে পাবার জন্যে, আরও দূরে আর-একটা লড়াই চলছে ছাড়বার জন্যে। তোমার লড়াই অসাড়ের সঙ্গে, তার লড়াই অভাবের সঙ্গে, আরও একটা লড়াই আছে সঞ্চয়ের সঙ্গে। লড়াই জটিল হয়ে উঠল, ব্যূহের মধ্যে যে প্রবেশ করছে ব্যূহ থেকে বেরোবার পথ সে খুঁজে পাচ্ছে না। হার জিত অনিশ্চিত বলে ধাঁদা লাগল। এই দ্বিধার মধ্যে তোমার ঐ সবুজ পতাকা যোদ্ধাদের আশ্বাস দিচ্ছে। বলছে, ‘জয়, প্রাণের জয়।’ গানের তান বেড়ে বেড়ে চলেছে, কোন্ সপ্তক থেকে কোন্ সপ্তকে চড়ল তার ঠিকানা নেই। এই স্বর সংকটের মধ্যে তোমার তম্বুরাটি সরল তারে বলছে, ‘ভয় নেই, ভয় নেই।’ বলছে, ‘এই তো মূল সুর আমি বেঁধে রেখেছি, এই আদি প্রাণের সুর। সকল উন্মত্ত তানই এই সুরে সুন্দরের ধুয়োয় এসে মিলবে আনন্দের গানে। সকল পাওয়া, সকল দেওয়া ফুলের মতো ফুটবে, ফলের মতো ফলবে।’ ”
আগমনী
[আগমনী পত্রিকার
মহালয়া ১৩২৬ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
আয়োজন চলেইছে।
তার মাঝে একটুও ফাঁক পাওয়া যায় না যে ভেবে দেখি,
কিসের আয়োজন।
তবুও কাজের ভিড়ের মধ্যে মনকে এক-একবার ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করি,
“কেউ আসবে বুঝি?”
মন বলে,
“রোসো। আমাকে জায়গা দখল
করতে হবে,
জিনিসপত্র জোগাতে হবে,
ঘরবাড়ি গড়তে হবে,
এখন আমাকে বাজে প্রশ্ন
জিজ্ঞাসা কোরো না।”
চুপচাপ করে আবার খাটতে বসি। ভাবি,
জায়গা-দখল সারা হবে,
জিনিসপত্র-সংগ্রহ শেষ
হবে,
ঘরবাড়ি-গড়া বাকি থাকবে না,
তখন শেষ জবাব মিলবে।
জায়গা বেড়ে চলছে,
জিনিসপত্র কম হল না,
ইমারতের সাতটা মহল সারা
হল। আমি বললেম,
“এইবার আমার কথার একটা জবাব
দাও।”
মন বলে,
“আরে রোসো,
আমার সময় নেই।”
আমি বললেম, “কেন,
আরও জায়গা চাই?
আরও ঘর?
আরও সরঞ্জাম?”
মন বললে,
“চাই বই কি।”
আমি বললেম,”এখনো
যথেষ্ট হয় নি?”
মন বললে,
“এতটুকুতে ধরবে কেন।”
আমি জিজ্ঞাসা করলেম,
“কী ধরবে। কাকে ধরবে।”
মন বললে,
“সে-সব কথা পরে হবে।”
তবু আমি প্রশ্ন করলেম,
“সে বুঝি মস্ত বড়ো?”
মন উত্তর করলে,
“বড়ো বই কি।”
এত বড়ো ঘরেও তাকে কুলোবে না, এত মস্ত জায়গায়! আবার উঠে-পড়ে লাগলেম। দিনে আহার নেই, রাত্রে নিদ্রা নেই। যে দেখলে সেই বাহবা দিলে; বললে, “কাজের লোক বটে।”
এক-একবার কেমন আমার সন্দেহ হতে লাগল, বুঝি মন বাঁদরটা আসল কথার জবাব জানে না। সেইজন্যেই কেবল কাজ চাপা দিয়ে জবাবটাকে সে ঢাকা দেয়। মাঝে মাঝে এক-একবার ইচ্ছা হয়, কাজ বন্ধ করে কান পেতে শুনি পথ দিয়ে কেউ আসছে কি না। ইচ্ছা হয়, আর ঘর না বাড়িয়ে ঘরে আলো জ্বালি, আর সাজ সরঞ্জাম না জুটিয়ে ফুল-ফোটার বেলা থাকতে একটা মালা গেঁথে রাখি।
কিন্তু, ভরসা হয় না। কারণ, আমার প্রধান মন্ত্রী হল মন। সে দিনরাত তার দাঁড়িপাল্লা আর মাপকাঠি নিয়ে ওজন-দরে আর গজের মাপে সমস্ত জিনিস যাচাই করছে। সে কেবলই বলছে, “আরও না হলে চলবে না।”
“কেন চলবে না?”
“সে যে মস্ত বড়ো।”
“কে মস্ত বড়ো?”
বাস্,
চুপ। আর কথা নেই।
যখন তাকে চেপে ধরি “অমন করে এড়িয়ে গেলে চলবে না, একটা জবাব দিতেই হবে” তখন সে রেগে উঠে বলে, “জবাব দিতেই হবে, এমন কী কথা। যার উদ্দেশ মেলে না, যার খবর পাই নে, যার মানে বোঝবার জো নেই, তুমি সেই কথা নিয়েই কেবল আমার কাজ কামাই করে দাও। আর, আমার এই দিকটাতে তাকাও দেখি। কত মামলা, কত লড়াই; লাঠিসড়কি-পাইক-বরকন্দাজে পাড়া জুড়ে গেল; মিস্ত্রিতে মজুরে ইঁটকাঠ-চুন-সুরকিতে কোথাও পা ফেলবার জো কী। সমস্তই স্পষ্ট; এর মধ্যে আন্দাজ নেই, ইশারা নেই। তবে এ-সমস্ত পেরিয়েও আবার প্রশ্ন কেন।”
শুনে তখন ভাবি, মনটাই সেয়ানা, আমিই অবুঝ। আবার ঝুড়িতে করে ইঁট বয়ে আনি, চুনের সঙ্গে সুরকি মেশাতে থাকি।
২
এমনি করেই দিন যায়। আমার ভূমি দিগন্ত পেরিয়ে গেল, ইমারতে পাঁচতলা সারা হয়ে ছ’তলার ছাদ পিটোনো চলছে। এমন সময়ে একদিন বাদলের মেঘ কেটে গেল; কালো মেঘ হল সাদা; কৈলাসের শিখর থেকে ভৈরোঁর তান নিয়ে ছুটির হাওয়া বইল, মানস-সরোবরের পদ্মগন্ধে দিনরাত্রির দণ্ডপ্রহরগুলোকে মৌমাছির মতো উতলা করে দিলে। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, সমস্ত আকাশ হেসে উঠেছে আমার ছয়তলা ঐ বাড়িটার উদ্ধত ভারাগুলোর দিকে চেয়ে।
আমি তো ব্যাকুল
হয়ে পড়লেম;
যাকে দেখি তাকেই
জিজ্ঞাসা করি,
“ওগো,
কোন্ হাওয়াখানা থেকে আজ নহবত বাজছে বলো তো।”
তারা বলে, “ছাড়ো, আমার কাজ আছে।”
একটা খ্যাপা পথের ধারে গাছের গুড়তে হেলান দিয়ে,
মাথায় কুন্দফুলের মালা
জড়িয়ে চুপ করে বসে ছিল। সে বললে,
“আগমনীর সুর এসে পৌঁছল।”
আমি যে কী বুঝলেম জানি নে;
বলে উঠলেম,
“তবে আর দেরি নেই।”
সে হেসে বললে, “না,
এল ব’লে।”
তখনি খাতাঞ্জিখানায় এসে মনকে বললেম,
“এবার কাজ বন্ধ করো।”
মন বললে,
“সে কী কথা। লোকে যে
বলবে অকর্মণ্য।”
আমি বললেম,
“বলুক গে।”
মন বললে,
“তোমার হল কী! কিছু খবর
পেয়েছ নাকি?”
আমি বললেম, “হাঁ,
খবর এসেছে।”
“কী খবর?”
মুশকিল,
স্পষ্ট করে জবাব দিতে
পারি নে। কিন্তু,
খবর এসেছে।
মানস-সরোবরের তীর থেকে আলোকের পথ বেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস এসে পৌঁছল।
মন মাথা নেড়ে বললে,
“মস্ত বড়ো রথের চুড়ো
কোথায়,
আর মস্ত ভারি সমারোহ?
কিছু তো দেখি নে,
শুনি নে।”
বলতে বলতে আকাশে
কে যেন পরশমণি ছুঁইয়ে দিলে। সোনার আলোয় চার দিক ঝল্মল্ করে উঠল। কোথা থেকে একটা
রব উঠে গেল,
“দূত এসেছে।”
আমি মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে দূতের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করলেম,
“আসছেন নাকি।”
চার দিক থেকে জবাব এল,
“হাঁ,
আসছেন।”
মন ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল,
“কী করি! সবেমাত্র আমার
ছয়তলা বাড়ির ছাদ পিটোনো চলছে;
আর,
সাজ সরঞ্জাম সব তো এসে
পৌঁছল না।”
উত্তর শোনা গেল, “আরে
ভাঙো ভাঙো,
তোমার ছতলা বাড়ি
ভাঙো।”
মন বললে,
“কেন!”
উত্তর এল,
“আজ আগমনী যে। তোমার ইমারতটা বুক ফুলিয়ে পথ আটকেছে।”
মন অবাক হয়ে রইল।
আবার শুনি,
“ঝেঁটিয়ে ফেলো তোমার সাজ সরঞ্জাম।”
মন বললে,
“কেন!”
“তোমার সরঞ্জাম যে ভিড় করে জায়গা জুড়েছে।”
যাক গে। কাজের
দিনে বসে বসে ছতলা বাড়ি গাঁথলেম,
ছুটির দিনে একে একে
সব-কটা তলা ধূলিসাৎ করতে হল। কাজের দিনে সাজ-সরঞ্জাম হাটে হাটে জড়ো করা গেল,
ছুটির দিনে সমস্ত বিদায় করেছি।
কিন্তু,
মস্ত বড়ো রথের চুড়ো
কোথায়,
আর মস্ত ভারি সমারোহ?
মন চার দিকে তাকিয়ে দেখলে।
কী দেখতে পেলে?
শরৎ প্রভাতের শুকতারা।
কেবল ঐটুকু?
হাঁ,
ঐটুকু।
আর দেখতে পেলে শিউলিবনের শিউলিফুল।
কেবল ঐটুকু?
হাঁ,
ঐটুকু।
আর দেখা দিল লেজ দুলিয়ে ভোরবেলাকার একটি দোয়েল পাখি।
আর কী?
আর,
একটি শিশু,
সে খিল্খিল্ করে হাসতে হাসতে মায়ের কোল থেকে ছুটে পালিয়ে এল বাইরের আলোতে।
“তুমি যে বললে আগমনী,
সে কি এরই জন্যে।”
“হাঁ,
এরই জন্যেই তো প্রতিদিন আকাশে
বাঁশি বাজে,
ভোরের বেলায় আলো
হয়।”
“এরই জন্যে এত জায়গা চাই?”
“হাঁ গো,
তোমার রাজার জন্যে
সাতমহলা বাড়ি,
তোমার প্রভুর জন্যে ঘরভরা
সরঞ্জাম। আর,
এদের জন্যে সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী।”
“আর,
মস্ত-বড়ো?”
“মস্ত বড়ো এইটুকুর মধ্যেই থাকেন।”
“ঐ শিশু তোমাকে কী বর দেবে।”
“ঐ তো বিধাতার বর নিয়ে আসে। সমস্ত পৃথিবীর আশা নিয়ে,
অভয় নিয়ে,
আনন্দ নিয়ে। ওরই গোপন
তূণে লুকোনো থাকে
ব্রহ্মাস্ত্র,
ওরই হৃদয়ের মধ্যে ঢাকা আছে
শক্তিশেল।”
মন আমাকে জিজ্ঞসা করলে,
“হাঁ গো কবি, কিছু
দেখতে পেলে,
কিছু বুঝতে পারলে?”
আমি বললেম,
“সেইজন্যেই ছুটি নিয়েছি। এত দিন সময় ছিল না,
তাই দেখতে পাই নি,
বুঝতে পারি নি।”
স্বর্গ-মর্ত
[সবুজ পত্র পত্রিকার
ফাল্গুন ১৩২৫ সংখ্যায় প্রথম
প্রকাশিত হয়েছিল।]
গান
মাটির প্রদীপখানি আছে
মাটির ঘরের কোলে,
সন্ধ্যাতারা তাকায় তারই
আলো দেখবে ব’লে।
সেই আলোটি
নিমেষহত
প্রিয়ার ব্যাকুল চাওয়ার মতো,
সেই আলোটি মায়ের প্রাণের
ভয়ের মতো দোলে॥
সেই আলোটি নেবে
জ্বলে
শ্যামল ধরার হৃদয়তলে,
সেই আলোটি চপল হাওয়ায়
ব্যথায় কাঁপে পলে পলে।
নামল সন্ধ্যাতারার বাণী
আকাশ হতে আশিস আনি,
অমর শিখা আকুল হল
মর্ত শিখায় উঠতে জ্বলে॥
ইন্দ্র। সুরগুরো, একদিন দৈত্যদের হাতে আমরা স্বর্গ হারিয়েছিলুম। তখন দেবে মানবে মিলে আমরা স্বর্গের জন্যে লড়াই করেছি, এবং স্বর্গকে উদ্ধার করেছি, কিন্তু এখন আমাদের বিপদ তার চেয়ে অনেক বেশি। সে কথা চিন্তা করে দেখবেন।
বৃহস্পতি। মহেন্দ্র, আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে। স্বর্গের কী বিপদ আশঙ্কা করছেন।
ইন্দ্র। স্বর্গ নেই।
বৃহস্পতি। নেই? সে কী কথা। তা হলে আমরা আছি কোথায়।
ইন্দ্র। আমরা আমাদের অভ্যাসের উপর আছি, স্বর্গ যে কখন ক্রমে ক্ষীণ হয়ে, ছায়া হয়ে, লুপ্ত হয়ে গেছে, তা জানতেও পারি নি।
কার্তিকেয়। কেন দেবরাজ, স্বর্গের সমস্ত সমারোহ, সমস্ত অনুষ্ঠানই তো চলছে।
ইন্দ্র। অনুষ্ঠান ও সমারোহ বেড়ে উঠেছে, দিনশেষে সূর্যাস্তের সমারোহের মতো, তার পশ্চাতে অন্ধকার। তুমি তো জান দেবসেনাপতি, স্বর্গ এত মিথ্যা হয়েছে যে, সকলপ্রকার বিপদের ভয় পর্যন্ত তার চলে গেছে। দৈত্যেরা যে কত যুগযুগান্তর তাকে আক্রমণ করে নি তা মনে পড়ে না। আক্রমণ করবার যে কিছুই নেই। মাঝে মাঝে স্বর্গের যখন পরাভব হ’ত তখনও স্বর্গ ছিল, কিন্তু যখন থেকে—
কার্তিকেয়। আপনার কথা যেন কিছু কিছু বুঝতে পারছি।
বৃহস্পতি। স্বপ্ন থেকে জাগবা মাত্রই যেমন বোঝা যায়, স্বপ্ন দেখছিলুম, ইন্দ্রের কথা শুনেই তেমনি মনে হচ্ছে, একটা যেন মায়ার মধ্যে ছিলুম, কিন্তু তবু এখনও সম্পূর্ণ ঘোর ভাঙে নি।
কার্তিকেয়। আমার কী রকম বোধ হচ্ছে বলব? তূণের মধ্যে শর আছে, সেই শরের ভার বহন করছি, সেই শরের দিকেই মন বদ্ধ আছে, ভাবছি সমস্তই ঠিক আছে। এমন সময়ে কে যেন বললে, একবার তোমার চার দিকে তাকিয়ে দেখো। চেয়ে দেখি, শর আছে কিন্তু লক্ষ্য করবার কিছুই নেই। স্বর্গের লক্ষ্য চলে গেছে।
বৃহস্পতি। কেন এমন হল তার কারণ তো জানা চাই।
ইন্দ্র। যে মাটির থেকে রস টেনে স্বর্গ আপনার ফুল ফুটিয়েছিল সেই মাটির সঙ্গে তার সম্বন্ধ ছিন্ন হয়ে গেছে।
বৃহস্পতি। মাটি আপনি কাকে বলছেন।
ইন্দ্র। পৃথিবীকে। মনে তো আছে, একদিন মানুষ স্বর্গে এসে দেবতার কাজে যোগ দিয়েছে এবং দেবতা পৃথিবীতে নেমে মানুষের যুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। তখন স্বর্গ মর্ত উভয়েই সত্য হয়ে উঠেছিল, তাই সেই যুগকে সত্যযুগ বলত। সেই পৃথিবীর সঙ্গে যোগ না থাকলে স্বর্গ আপনার অমৃতে আপনি কি বাঁচতে পারে।
কার্তিকেয়। আর, পৃথিবীও যে যায়, দেবরাজ। মানুষ এমনি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যাচ্ছে যে, সে আপনার শৌর্যকে আর বিশ্বাস করে না, কেবল বস্তুর উপরেই তার ভরসা। বস্তু নিয়ে মারামারি কাটাকাটি পড়ে গেছে। স্বর্গের টান যে ছিন্ন হয়েছে, তাই আত্মা বস্তু ভেদ করে আলোকের দিকে উঠতে পারছে না।
বৃহস্পতি। এখন উদ্ধারের উপায় কী।
ইন্দ্র। পৃথিবীর সঙ্গে স্বর্গের আবার যোগসাধন করতে হবে।
বৃহস্পতি। কিন্তু, দেবতারা যে পথ দিয়ে পৃথিবীতে যেতেন, অনেক দিন হল, সে পথের চিহ্ন লোপ হয়ে গেছে। আমি মনে করেছিলুম, ভালোই হয়েছে। ভেবেছিলুম, এইবার প্রমাণ হয়ে যাবে, স্বর্গ নিরপেক্ষ, নিরবলম্ব, আপনাতেই আপনি সম্পূর্ণ।
ইন্দ্র। একদিন সকলেরই সেই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রেমেই স্বর্গ বাঁচে, নইলে স্বর্গ শুকিয়ে যায়। অমৃতের অভিমানে সেই কথা ভুলেছিলুম ব’লেই পৃথিবীতে দেবতার যাবার পথের চিহ্ন লোপ পেয়েছিল।
কার্তিকেয়। দৈত্যদের পরাভবের পর থেকে আমরা আটঘাট বেঁধে স্বর্গকে সুরক্ষিত করে তুলেছি। তার পর থেকে স্বর্গের ঐশ্বর্য স্বর্গের মধ্যেই জমে আসছে; বাহিরে তার আর প্রয়োগ নেই, তার আর ক্ষয় নেই। যুগ যুগ হতে অব্যাঘাতে তার এতই উন্নতি হয়ে এসেছে যে, বাহিরের অন্য সমস্ত-কিছু থেকে স্বর্গ বহু দূরে চলে গেছে। স্বর্গ তাই আজ একলা।
ইন্দ্র। উন্নতিই হোক আর দুর্গতিই হোক, যাতেই চার দিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ আনে তাতেই ব্যর্থতা আনে। ক্ষুদ্র থেকে মহৎ যখন সুদূরে চলে যায় তখন তার মহত্ত্ব নিরর্থক হয়ে আপনাকে আপনি ভারগ্রস্ত করে মাত্র। স্বর্গের আলো আজ আপনার মাটির প্রদীপের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলেয়ার আলো হয়ে উঠেছে, লোকালয়ের আয়ত্তের অতীত হয়ে সে নিজেরও আয়ত্তের অতীত হয়েছে; নির্বাপণের শাস্তির চেয়ে তার এই শাস্তি গুরুতর। দেবলোক আপনাকে অতি বিশুদ্ধ রাখতে গিয়ে আপন শুচিতার উচ্চ প্রাচীরে নিজেকে বন্দী করেছে, সেই দুর্গম প্রাচীর ভেঙে গঙ্গার ধারার মতো মলিন মর্তের মধ্যে তাকে প্রবাহিত করে দিয়ে তবে তার বন্ধনমোচন হবে। তার সেই স্বাতন্ত্র্যের বেষ্টন বিদীর্ণ করবার জন্যেই আমার মন আজ এমন বিচলিত হয়ে উঠেছে। স্বর্গকে আমি ঘিরতে দেব না, বৃহস্পতি; মলিনের সঙ্গে, পতিতের সঙ্গে, অজ্ঞানীর সঙ্গে, দুঃখীর সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিতে হবে।
বৃহস্পতি। তা হলে আপনি কী করতে চান।
ইন্দ্র। আমি পৃথিবীতে যাব।
বৃহস্পতি। সেই যাবার পথটাই বন্ধ, সেই নিয়েই তো দুঃখ।
ইন্দ্র। দেবতার স্বরূপে সেখানে আর যেতে পারব না, মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করব। নক্ষত্র যেমন খ’সে প’ড়ে তার আকাশের আলো আকাশে নিবিয়ে দিয়ে, মাটি হয়ে মাটিকে আলিঙ্গন করে, আমি তেমনি করে পৃথিবীতে যাব।
বৃহস্পতি। আপনার জন্মাবার উপযুক্ত বংশ পৃথিবীতে এখন কোথায়।
কার্তিকেয়। বৈশ্য এখন রাজা, ক্ষত্রিয় এখন বৈশ্যের সেবায় লড়াই করছে, ব্রাহ্মণ এখন বৈশ্যের দাস।
ইন্দ্র। কোথায় জন্মাব সে তো আমার ইচ্ছার উপরে নেই, যেখানে আমাকে আকর্ষণ করে নেবে সেইখানেই আমার স্থান হবে।
বৃহস্পতি। আপনি যে ইন্দ্র সেই স্মৃতি কেমন করে—
ইন্দ্র। সেই স্মৃতি লোপ করে দিয়ে তবেই আমি মর্তবাসী হয়ে মর্তের সাধনা করতে পারব।
কার্তিকেয়। এতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব ভুলেই ছিলুম, আজ আপনার কথায় হঠাৎ মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। সেই তন্বী শ্যামা ধরণী সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের পথ ধরে স্বর্গের দিকে কী উৎসুক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে। সেই ভীরুর ভয় ভাঙিয়ে দিতে কী আনন্দ। সেই ব্যথিতার মনে আশার সঞ্চার করতে কী গৌরব। সেই চন্দ্রকান্তমণিকিরীটিণী নীলাম্বরী সুন্দরী কেমন করে ভুলে গিয়েছে যে সে রানী। তাকে আবার মনে করিয়ে দিতে হবে যে, সে দেবতার সাধনার ধন, সে স্বর্গের চিরদয়িতা।
ইন্দ্র। আমি সেখানে গিয়ে তার দক্ষিণসমীরণে এই কথাটি রেখে আসতে চাই যে, তারই বিরহে স্বর্গের অমৃতে স্বাদ চলে গেছে এবং নন্দনের পারিজাত ম্লান; তাকে বেষ্টন ক’রে ধ’রে যে সমুদ্র রয়েছে সেই তো স্বর্গের অশ্রু, তারই বিচ্ছেদক্রন্দনকেই তো সে মর্তে অনন্ত করে রেখেছে।
কার্তিকেয়। দেবরাজ, যদি অনুমতি করেন তা হলে আমরাও পৃথিবীতে যাই।
বৃহস্পতি। সেখানে মৃত্যুর অবগুণ্ঠনের ভিতর দিয়ে অমৃতের জ্যোতিকে একবার দেখে আসি।
কার্তিকেয়। বৈকুণ্ঠের লক্ষ্ণী তাঁর মাটির ঘরটিতে যে নিত্যনূতন লীলা বিস্তার করেছেন আমরা তার রস থেকে কেন বঞ্চিত হব। আমি যে বুঝতে পারছি, আমাকে পৃথিবীর দরকার আছে; আমি নেই ব’লেই তো সেখানে মানুষ স্বার্থের জন্যে নির্লজ্জ হয়ে যুদ্ধ করছে, ধর্মের জন্যে নয়।
বৃহস্পতি। আর, আমি নেই বলেই তো মানুষ কেবল ব্যবহারের জন্যে জ্ঞানের সাধনা করছে, মুক্তির জন্যে নয়।
ইন্দ্র। তোমরা সেখানে যাবে, আমি তো তারই উপায় করতে চলেছি; সময় হলেই তোমরা পরিণত ফলের মতো আপন মাধুর্যভাবে সহজেই মর্তে স্খলিত হয়ে পড়বে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করো।
কার্তিকেয়। কখন টের পাব মহেন্দ্র, যে, আপনার সাধনা সার্থক হল।
বৃহস্পতি। সে কি আর চাপা থাকবে। যখন জয়শঙ্খধ্বনিতে স্বর্গলোক কেঁপে উঠবে তখনি বুঝব যে—
ইন্দ্র। না দেবগুরু, জয়ধ্বনি উঠবে না। স্বর্গের চোখে যখন করুণার অশ্রু গলে পড়বে তখনই জানবেন, পৃথিবীতে আমার জন্মলাভ সফল হল।
কার্তিকেয়। তত দিন বোধ হয় জানতে পারব না, সেখানে ধুলার আবরণে আপনি কোথায় লুকিয়ে আছেন।
বৃহস্পতি। পৃথিবীর রসই তো হল এই লুকোচুরিতে। ঐশ্বর্য সেখানে দরিদ্রবেশে দেখা দেয়, শক্তি সেখানে অক্ষমের কোলে মানুষ হয়, বীর্য সেখানে পরাভবের মাটির তলায় আপন জয়স্তম্ভের ভিত্তি খনন করে। সম্ভব সেখানে অসম্ভবের মধ্যে বাসা করে থাকে। যা দেখা দেয়, পৃথিবীতে তাকে মানতে গিয়েই ভুল হয়; যা না দেখা দেয় তারই উপর চিরদিন ভরসা রাখতে হবে।
কার্তিকেয়। কিন্তু সুররাজ, আপনার ললাটের চিরোজ্জ্বল জ্যোতি আজ ম্লান হল কেন।
বৃহস্পতি। মর্তে যে যাবেন তার গৌরবের প্রভা আজ দীপ্যমান হয়ে উঠুক।
ইন্দ্র। দেবগুরু, জন্মের যে বেদনা সেই বেদনা এখনি আমাকে পীড়িত করছে। আজ আমি দুঃখেরই অভিসারে চলেছি, তারই আহ্বানে আমার মনকে টেনেছে। শিবের সঙ্গে সতীর যেমন বিচ্ছেদ হয়েছিল, স্বর্গের আনন্দের সঙ্গে পৃথিবীর ব্যথার তেমনি বিচ্ছেদ হয়েছে; সেই বিচ্ছেদের দুঃখ এত দিন পরে আজ আমার মনে রাশীকৃত হয়ে উঠেছে। আমি চললুম সেই ব্যথাকে বুকে তুলে নেবার জন্যে। প্রেমের অমৃতে সেই ব্যথাকে আমি সৌভাগ্যবতী করে তুলব। আমাকে বিদায় দাও।
কার্তিকেয়। মহেন্দ্র, আমাদের জন্যে পথ করে দাও, আমরা সেইখানেই গিয়ে তোমার সঙ্গে মিলব। স্বর্গ আজ দুঃখের অভিযানে বাহির হোক।
বৃহস্পতি। আমারা পথের অপেক্ষাতেই রইলুম, দেবরাজ। স্বর্গ থেকে বাহির হবার পথ করে দাও, নইলে আমাদের মুক্তি নেই।
কার্তিকেয়। বাহির করো, দেবরাজ, স্বর্গের বন্ধন থেকে আমাদের বাহির করো— মৃত্যুর ভিতর দিয়ে আমাদের পথ রচনা করো।
বৃহস্পতি। তুমি স্বর্গরাজ, আজ তুমি স্বর্গের তপোভঙ্গ ক’রে জানিয়ে দাও যে, স্বর্গ পৃথিবীরই।
কার্তিকেয়। যারা স্বর্গকামনায় পৃথিবীকে ত্যাগ করবার সাধনা করেছে চিরদিন তুমি তাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করেছ, আজ স্বয়ং স্বর্গকে সেই পথে নিয়ে যেতে হবে।
ইন্দ্র। সেই বাধার ভিতর দিয়ে মুক্তিতে যাবার পথ—
বৃহস্পতি। যে মুক্তি আপন আনন্দে চিরদিনই বাধার সঙ্গে সংগ্রাম করে।
গান
পথিক হে, পথিক হে,
ঐ যে চলে, ঐ যে চলে,
সঙ্গী তোমার দলে দলে।
অন্যমনে থাকি কোণে,
চমক লাগে ক্ষণে ক্ষণে,
হঠাৎ শুনি জলে স্থলে
পায়ের ধ্বনি আকাশতলে।
পথিক হে, পথিক হে,
যেতে যেতে পথের থেকে,
আমায় তুমি যেয়ো ডেকে।
যুগে যুগে বারে বারে
এসেছিল আমার দ্বারে,
হঠাৎ যে তাই জানিতে পাই
তোমার চলা হৃদয়তলে।
সংযোজন
কথিকা
[ভারতী পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৭ সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়েছিল]
এবার মনে হল, মানুষ অন্যায়ের আগুনে আপনার সমস্ত ভাবী কালটাকে পুড়িয়ে কালো করে দিয়েছে, সেখানে বসন্ত কোনোদিন এসে আর নতুন পাতা ধরাতে পারবে না।
মানুষ অনেক দিন থেকে একখানি আসন তৈরি করছে। সেই আসনই তাকে খবর দেয় যে, তার দেবতা আসবেন, তিনি পথে বেরিয়েছেন।
যেদিন উন্মত্ত হয়ে সেই তার অনেক দিনের আসন সে ছিঁড়ে ফেলে সেদিন তার যজ্ঞস্থলীর ভগ্নবেদী বলে, “কিছুই আশা করবার নেই, কেউ আসবে না।”
তখন এত দিনের আয়োজন আবর্জনা হয়ে ওঠে। তখন চারি দিক থেকে শুনতে পাই, “জয়, পশুর জয়।”
তখন শুনি, “আজও যেমন কালও তেমনি। সময় চোখে-ঠুলি-দেওয়া বলদের মতো, চিরদিন একই ঘানিতে একই আর্তস্বর তুলছে। তাকেই বলে সৃষ্টি। সৃষ্টি হচ্ছে অন্ধের কান্না।”
মন বললে, “তবে আর কেন। এবার গান বন্ধ করা যাক। যা আছে কেবলমাত্র তারই বোঝা নিয়ে ঝগড়া চলে, যা নেই তারই আশা নিয়েই গান।”
শিশুকাল থেকে যে পথের পানে চেয়ে বারে বারে মনে আগমনীর হাওয়া লেগেছে— যে পথ দিগন্তের দিকে কান পেতেছে দেখে বুঝেছিলুম, ও পার থেকে রথ বেরোল— সেই পথের দিকে আজ তাকালেম; মনে হল, সেখানে না আছে আগন্তুকের সাড়া, না আছে কোনো ঘরের।
বীণা বললে, “দীর্ঘ পথে আমার সুরের সাথি যদি কেউ না থাকে তবে আমাকে পথের ধারে ফেলে দাও।”
তখন পথের ধারের দিকে চাইলুম। চমকে উঠে দেখি, ধুলোর মধ্যে একটি কাঁটাগাছ; তাতে একটিমাত্র ফুল ফুটেছে।
আমি বলে উঠলুম, “হায় রে হায়, ঐ তো পায়ের চিহ্ন।”
তখন দেখি, দিগন্ত পৃথিবীর কানে কানে কথা কইছে; তখন দেখি, আকাশে আকাশে প্রতিক্ষা! তখন দেখি, চাঁদের আঅলোয় তালগাছের পাতায় পাতায় কাঁপন ধরেছে; বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে দিঘির জলের সঙ্গে চাঁদের চোখে চোখে ইশারা।
পথ বললে, “ভয় নেই।”
আমার বীণা বললে, “সুর লাগাও।”