|
বিদায়
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও ।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন ।
ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল —
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহুদূরে
।
মনে হয় অজস্র
মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়,
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম ।
ফিরিবার পথ
নাহি ;
দূর হতে যদি
দেখ চাহি
পারিবে না চিনিতে আমায় ।
হে বন্ধু, বিদায় ।
কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে,
বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
ঝরা বকুলের
কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
তোমার প্রাণের
প্রান্তে ; বিস্মৃতপ্রদোষে
হয়তো দিবে সে
জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা-স্বপ্নের মুরতি ।
তবু সে তো স্বপ্ন
নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
সে
আমার প্রেম ।
তারে
আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে ।
পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই
ভেসে
কালের যাত্রায় ।
হে বন্ধু, বিদায় ।
তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত-মুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা ।
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লানস্পর্শ লেগে ;
তৃষার্ত
আবেগবেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে ।
তোমার মানসভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,
তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে ।
আজও তুমি নিজে
হয়তো বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন ।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায় ।
হে বন্ধু, বিদায় ।
মোর লাগি করিয়ো না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক ।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই ।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে ।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ-রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম
ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি ।
তোমারে যা দিয়েছিনু, তার
পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার ।
হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম ।
ওগো তুমি নিরুপম,
হে
ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায় ।
হে বন্ধু, বিদায় ।
ব্যালাব্রুয়ি। বাঙ্গালোর
২৫ জুন ১৯২৮
প্রণতি
কত ধৈর্য ধরি
ছিলে কাছে দিবসশর্বরী ।
তব পদ-অঙ্কনগুলিরে
কতবার দিয়ে গেছ মোর ভাগ্যপথের ধূলিরে ।
আজ যবে
দূরে যেতে হবে
তোমারে করিয়া যাব দান
তব
জয়গান ।
কতবার ব্যর্থ আয়োজনে
এ জীবনে
হোমাগ্নি উঠে নি জ্বলি,
শূন্যে গেছে চলি
হতাশ্বাস ধূমের কুণ্ডলী ।
কতবার ক্ষণিকের শিখা
আঁকিয়াছে ক্ষীণ টিকা
নিশ্চেতন নিশীথের ভালে ।
লুপ্ত হয়ে গেছে তাহা চিহ্নহীন কালে ।
এবার তোমার আগমন
হোমহুতাশন
জ্বেলেছে গৌরবে ।
যজ্ঞ মোর ধন্য হবে ।
আমার আহুতি দিনশেষে
করিলাম সমর্পণ তোমার উদ্দেশে ।
লহো এ প্রণাম —
জীবনের পূর্ণ পরিণাম ।
এ
প্রণতি ' -পরে
স্পর্শ রাখো স্নেহভরে ।
তোমার ঐশ্বর্য-মাঝে
সিংহাসন যেথায় বিরাজে
করিয়ো আহ্বান,
সেথা এ প্রণতি মোর পায় যেন স্থান ।
বাঙ্গালোর
আষাঢ় ১৩৩৫ |