|
বোধন
মাঘের সূর্য উত্তরায়ণে
পার হয়ে এল চলি,
তার পানে হায় শেষ চাওয়া চায়
করুণ কুন্দকলি ।
উত্তর বায় একতারা তার
তীব্র নিখাদে দিল ঝংকার,
শিথিল যা ছিল তারে ঝরাইল —
গেল তারে দলি দলি ।
শীতের রথের ঘূর্ণিধূলিতে
গোধূলিরে করে ম্লান ' ।
তাহারি আড়ালে নবীন কালের
কে আসিছে সে কি জানো ।
বনে বনে তাই আশ্বাসবাণী
করে কানাকানি ‘ কে আসে কী জানি ',
বলে মর্মরে ‘ অতিথির তরে
অর্ঘ্য সাজায়ে আনো ' ।
নির্মম শীত তারি আয়োজনে
এসেছিল বনপারে ।
মার্জিয়া দিল শ্রান্তি ক্লান্তি,
মার্জনা নাহি কারে ।
ম্লান চেতনার আবর্জনায়
পান্থের পথে বিঘ্ন ঘনায়,
নবযৌবনদূতরূপী শীত
দূর করি দিল তারে ।
ভরা পাত্রটি শূন্য করে সে
ভরিতে নূতন করি ।
অপব্যয়ের ভয় নাহি তার
পূর্ণের দান স্মরি
।
অলস ভোগের গ্লানি সে ঘুচায়,
মৃত্যুর স্নানে কালিমা মুছায়,
চিরপুরাতনে করে উজ্জ্বল
নূতন চেতনা ভরি ।
নিত্যকালের মায়াবী আসিছে
নব পরিচয় দিতে ।
নবীন রূপের অপরূপ জাদু
আনিবে সে ধরণীতে ।
লক্ষ্মীর দান নিমেষে উজাড়ি
নির্ভয় মনে দূরে দেয় পাড়ি,
নব বর সেজে চাহে লক্ষ্মীরে
ফিরে জয় করে নিতে ।
বাঁধন ছেঁড়ার সাধন তাহার,
সৃষ্টি তাহার খেলা ।
দস্যুর মতো ভেঙেচুরে দেয়
চিরাভ্যাসের মেলা ।
মূল্যহীনেরে সোনা করিবার
পরশপাথর হাতে আছে তার,
তাই তো প্রাচীন সঞ্চিত ধনে
উদ্ধত অবহেলা ।
বলো ‘ জয় জয় ', বলো ‘ নাহি ভয় ' ;
কালের প্রয়াণপথে
আসে নির্দয় নবযৌবন
ভাঙনের মহারথে ।
চিরন্তনের চঞ্চলতায়
কাঁপন লাগুক লতায় লতায়,
থরথর করি উঠুক পরান
প্রান্তরে পর্বতে ।
বার্তা ব্যাপিল পাতায় পাতায় —
‘ করো ত্বরা, করো ত্বরা ।
সাজাক পলাশ আরতিপাত্র
রক্তপ্রদীপে ভরা ।
দাড়িম্ববন প্রচুর পরাগে
হোক প্রগল্ভ রক্তিমরাগে,
মাধবিকা হোক সুরভিসোহাগে
মধুপের মনোহরা । '
কে বাঁধে শিথিল বীণার তন্ত্র
কঠোর যতন-ভরে —
ঝংকারি উঠে অপরিচিতার
জয়সংগীতস্বরে ।
নগ্ন শিমুলে কার ভাণ্ডার
রক্ত দুকূল দিল উপহার,
দ্বিধা না রহিল বকুলের আর
রিক্ত হবার তরে ।
দেখিতে দেখিতে কী হতে কী হল
শূন্য কে দিল ভরি।
প্রাণবন্যায় উঠিল ফেনায়ে
মাধুরীর মঞ্জরি ।
ফাগুনের আলো সোনার কাঠিতে
কী মায়া লাগালো, তাই তো মাটিতে
নবজীবনের বিপুল ব্যথায়
জাগে শ্যামাসুন্দরী ।
[ শান্তিনিকেতন ]
দোলপূর্ণিমা [২২ ফাল্গুন] ১৩৩৪
|