ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া

 


 

         

               বোধন
মাঘের সূর্য উত্তরায়ণে
       পার হয়ে এল চলি,
তার পানে হায় শেষ চাওয়া চায়
        করুণ কুন্দকলি ।
উত্তর বায় একতারা তার
তীব্র নিখাদে দিল ঝংকার,
শিথিল যা ছিল তারে ঝরাইল —
        গেল তারে দলি দলি ।

শীতের রথের ঘূর্ণিধূলিতে
       গোধূলিরে করে ম্লান ' ।
তাহারি আড়ালে নবীন কালের
       কে আসিছে সে কি জানো ।
বনে বনে তাই আশ্বাসবাণী
করে কানাকানি ‘ কে আসে কী জানি ',
বলে মর্মরে ‘ অতিথির তরে
        অর্ঘ্য সাজায়ে আনো ' ।

নির্মম শীত তারি আয়োজনে
       এসেছিল বনপারে ।
মার্জিয়া দিল শ্রান্তি ক্লান্তি,
       মার্জনা নাহি কারে ।
ম্লান চেতনার আবর্জনায়
পান্থের পথে বিঘ্ন ঘনায়,
নবযৌবনদূতরূপী শীত
     দূর করি দিল তারে ।

ভরা পাত্রটি শূন্য করে সে
     ভরিতে নূতন করি ।
অপব্যয়ের ভয় নাহি তার

    পূর্ণের দান স্মরি ।
অলস ভোগের গ্লানি সে ঘুচায়,
মৃত্যুর স্নানে কালিমা মুছায়,
চিরপুরাতনে করে উজ্জ্বল
     নূতন চেতনা ভরি ।

নিত্যকালের মায়াবী আসিছে
     নব পরিচয় দিতে ।
নবীন রূপের অপরূপ জাদু
     আনিবে সে ধরণীতে ।
লক্ষ্মীর দান নিমেষে উজাড়ি
নির্ভয় মনে দূরে দেয় পাড়ি,
নব বর সেজে চাহে লক্ষ্মীরে
     ফিরে জয় করে নিতে ।

 

বাঁধন ছেঁড়ার সাধন তাহার,
    সৃষ্টি তাহার খেলা ।
দস্যুর মতো ভেঙেচুরে দেয়
    চিরাভ্যাসের মেলা ।
মূল্যহীনেরে সোনা করিবার
পরশপাথর হাতে আছে তার,
তাই তো প্রাচীন সঞ্চিত ধনে
    উদ্ধত অবহেলা ।

বলো ‘ জয় জয় ', বলো ‘ নাহি ভয় ' ;
      কালের প্রয়াণপথে
আসে নির্দয় নবযৌবন
     ভাঙনের মহারথে ।
চিরন্তনের চঞ্চলতায়
কাঁপন লাগুক লতায় লতায়,
থরথর করি উঠুক পরান
     প্রান্তরে পর্বতে ।

 

বার্তা ব্যাপিল পাতায় পাতায় —
    ‘ করো ত্বরা, করো ত্বরা ।
সাজাক পলাশ আরতিপাত্র
    রক্তপ্রদীপে ভরা ।
দাড়িম্ববন প্রচুর পরাগে
হোক প্রগল্‌ভ রক্তিমরাগে,
মাধবিকা হোক সুরভিসোহাগে
    মধুপের মনোহরা । '

কে বাঁধে শিথিল বীণার তন্ত্র
    কঠোর যতন-ভরে —
ঝংকারি উঠে অপরিচিতার
    জয়সংগীতস্বরে ।
নগ্ন শিমুলে কার ভাণ্ডার
রক্ত দুকূল দিল উপহার,
দ্বিধা না রহিল বকুলের আর
    রিক্ত হবার তরে ।

দেখিতে দেখিতে কী হতে কী হল
    শূন্য কে দিল ভরি।
প্রাণবন্যায় উঠিল ফেনায়ে
    মাধুরীর মঞ্জরি ।
ফাগুনের আলো সোনার কাঠিতে
কী মায়া লাগালো, তাই তো মাটিতে
নবজীবনের বিপুল ব্যথায়
   জাগে শ্যামাসুন্দরী ।

  [ শান্তিনিকেতন ]
  দোলপূর্ণিমা [২২ ফাল্গুন] ১৩৩৪