ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া
 


 

               বন্দিনী
        তুমি বনের পুব পবনের সাথি,
বাদল মেঘের পথে তোমার ডানার মাতামাতি ।
       ওগো পাখি, বাঁধনহারা পাখি,
খাঁচার কোণে এই বিজনে আপন মনে থাকি ।
        হায় অজানা, জানি না সে
        উধাও তুমি কোন্‌ আকাশে,
কোন্‌ তমালের কাননতলে মধ্যদিনের তাপে
বনচ্ছায়ার শিরায় শিরায় তোমারই সুর কাঁপে ।

     কোন্‌ রঙনে রঙিন তোমার পাখা ?
তোমার সোনার বরনখানি ভাবনাতে মোর আঁকা
     ওগো পাখি, বাঁধনহারা পাখি,
মুক্তরূপের ধ্যানের ছায়ায় মগ্ন আমার আঁখি ।
     বন্দী মনের বদ্ধ ডানা,
     চতুর্দিকে কঠোর মানা,
তোমার সাথে উড়ে চলার মিলন মাগি মনে —
শূন্যে সদাই গান ফেরে তাই অসীম অন্বেষণে ।

    গান গাওয়া মোর সেই মিলনের খেলা,
তোমার গানের ছন্দে আমার স্বপন-পাখা মেলা ।
        ওগো পাখি, বাঁধনহারা পাখি,
মনে মনে তোমায় পরাই গানের গাঁথন রাখী ।
       আজি আমার সুরের মাঝে
       দূরের ডানার শব্দ বাজে,
মেঘের পথিক গানে আমার এল প্রাণের কূলে,
বিরহেরি আকাশতলে নিল আমায় তুলে ।

     গানের হাওয়ায় নিকট মিলায় দূরে —
দূর আসে সেই হাওয়ায় প্রাণের নিকট অন্তঃপুরে ।
        ওগো পাখি, বাঁধনহারা পাখি,
তোমার গানের মরীচিকায় শূন্য যে দাও ঢাকি ।
           বাঁধনে তাই জাদু লাগে,
           বীণার তারে মূর্তি জাগে,
রাগিণীতে মুক্তি সে দেয়, ওগো আমার দূর,
তোমার দেওয়া না-শোনা গান বাঁধে যে তার সুর ।

৫ কার্তিক ১৩৩৫


           গুপ্তধন
আরো কিছুখন নাহয় বসিয়ো পাশে,
     আরো যদি কিছু কথা থাকে তাই বলো ।
শরৎ-আকাশ হেরো ম্লান হয়ে আসে,
     বাষ্প-আভাসে দিগন্ত ছলোছলো ।
জানি তুমি কিছু চেয়েছিলে দেখিবারে,
তাই তো প্রভাতে এসেছিলে মোর দ্বারে,
দিন না ফুরাতে দেখিতে পেলে কি তারে
      হে পথিক, বলো বলো —
সে মোর অগম অন্তর-পারাবারে
      রক্তকমল তরঙ্গে টলোমলো ।

দ্বিধাভরে আজও প্রবেশ কর নি ঘরে,
       বাহির-আঙনে করিলে সুরের খেলা,
জানি না কী নিয়ে যাবে-যে দেশান্তরে,
      হে অতিথি, আজি শেষবিদায়ের বেলা ।
প্রথম প্রভাতে সব কাজ তব ফেলে
যে গভীর বাণী শুনিবারে কাছে এলে,
কোনোখানে কিছু ইশারা কি তার পেলে
       হে পথিক, বলো বলো —
সে বাণী আপন গোপন প্রদীপ জ্বেলে
      রক্ত-আগুনে প্রাণে মোর জ্বলোজ্বলো ।

 

১৪ কার্তিক ১৩৩৫