|
বরণ
পুরাণে বলেছে
একদিন নিয়েছিল বেছে
স্বয়ম্বরসভাঙ্গনে দময়ন্তী সতী
নল-নরপতি
ছদ্মবেশী দেবতার মাঝে ।
অর্ঘ্যহারা দেবতারা চলে গেল লাজে ।
দেবমূর্তি চিনেছে সেদিন,
তারা যে ফেলে না ছায়া, তারা অমলিন ।
সেদিন স্বর্গের ধৈর্য গেল টুটি,
ইন্দ্রলোক করিল ভ্রূকুটি ।
তাই শুনে কত দিন একা বসে বসে
ভেবেছিনু বালিকাবয়সে,
আমি হব স্বয়ম্বরা বিশ্বসভাতলে,
দেবতারই গলে
দিব মালা তপস্বিনী,
মানবের মাঝখানে একদিন লব তারে চিনি ।
তারি লাগি সর্ব দেহে মনে
দিনে দিনে বরমাল্য গাঁথিব যতনে ।
কঠিন সে পণ,
ভাবি নি কেমনে তারে করিব সাধন ।
মানুষ-যে দেশে দেশে
কত ফেরে দেবতার ছদ্মবেশে ;
ললাটে তিলক কারো লেখা,
দেখিতে দেখিতে ওঠে কালো হয়ে তার স্বর্ণরেখা ।
কারো-বা কটিতে বাঁধা শরশূন্য তূণ,
কেহ করে বজ্রধ্বনি, নাহি তাহে বজ্রের আগুন ।
বাতায়নে বসে থাকি,
কতদিন কী দেখিয়া আশ্বাসে চমকি উঠে আঁখি ;
চেয়ে চেয়ে দ্বিধা লাগে শেষে
বৃষ্টি হতে হতে দেখি শিলা পড়ে এসে ।
একদিন রৌদ্রের বেলায়
মধ্যাহ্নের জনতার মুখর মেলায়
রাজপথ-পাশে
দাঁড়াইনু — দেখিলাম যারা যায় আসে
তাহাদের কায়া
সম্মুখে ফেলিয়া চলে দীর্ঘতর ছায়া ।
শুনিলাম স্পর্ধাতীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর
ছিন্ন করে দিতে চাহে দেবতার অখণ্ড অম্বর ।
উজ্জ্বল সজ্জায়
দীন অঙ্গ সমাচ্ছন্ন ধনের লজ্জায় ।
ছুটে চলে অশ্বরথ,
তার চেয়ে আড়ম্বরে সঙ্গে ওড়ে ধূলির পর্বত ।
যখন সেদিন সেই ঊর্ধ্বশ্বাস লুব্ধ ঠেলাঠেলি
নানা শব্দে উঠিছে উদ্বেলি
তুমি দেখি পথপ্রান্তে একা হাস্যমুখে
নিঃশব্দ কৌতুকে
চেয়ে আছ — হৃদয় আছিল জনস্রোতে,
মন ছিল দূরে সবা হতে ।
তুমি যেন মহাকালসমুদ্রের তটে
নিত্যের নিশ্চল চিত্তপটে
দেখেছিলে চঞ্চলের চলমান ছবি,
শুনেছিলে ভৈরবের ধ্যান-মাঝে উমার ভৈরবী ।
বহে গেল জনতার ঢেউ,
কে-যে তুমি কোথা আছ দেখে নাই কেউ ।
একা আমি দেখেছি তোমারে —
তুমিই ফেল নি ছায়া ছায়ার মাঝারে ।
মালা হাতে গেনু ধেয়ে,
হাসিলে আমার পানে চেয়ে ।
মোর স্বয়ম্বরে
সেদিন মর্ত্যের মুখ ভ্রূকুটিল অবজ্ঞার ভরে ।
২৬ অগষ্ট ১৯২৮ |