|
নাম্নী
শামলী
সে যেন গ্রামের নদী
বহে নিরবধি
মৃদুমন্দ কলকলে ;
তরঙ্গের ভঙ্গি নাই, আবর্তের ঘূর্ণি নাই জলে ;
নুয়ে-পড়া তটতরু ঘনচ্ছায়া-ঘেরে
ছোটো করে রাখে আকাশেরে ।
জগৎ সামান্য তার, তারি ধূলি- ' পরে
বনফুল ফোটে অগোচরে,
মধু তার নিজ মূল্য নাহি জানে,
মধুকর তারে না বাখানে ।
গৃহকোণে ছোটো দীপ জ্বালায় নেবায়,
দিন কাটে সহজ সেবায় ।
স্নান সাঙ্গ করি এলোচুলে
অপরাজিতার
ফুলে
প্রভাতে নীরব নিবেদনে
স্তব করে একমনে ।
মধ্যদিনে বাতায়নতলে
চেয়ে দেখে নিম্নে
দিঘিজলে
শৈবালের ঘন স্তর,
পতঙ্গের খেলা তারি 'পর ।
আবছায়া কল্পনায়
ভাষাহীন ভাবনায়
মন তার ভরে
মধ্যাহ্নের অব্যক্ত মর্মরে ।
সায়াহ্নের শান্তিখানি নিয়ে ঘোমটায়
নদীপথে যায়
ঘট-কাঁখে
বেণুবীথিকার বাঁকে বাঁকে
ধীর পায়ে
চলি —
নাম কি শামলী ।
কাজলী
প্রচ্ছন্ন দাক্ষিণ্যভারে চিত্ত তার নত
স্তম্ভিত মেঘের মতো,
তৃষ্ণাহরা
আষাঢ়ের আত্মদান-প্রত্যাশায় ভরা ।
সে যেন গো তমালের
ছায়াখানি,
অবগুণ্ঠনের তলে পথ-চাওয়া আতিথ্যের বাণী ।
যে-পথিক একদিন আসিবে দুয়ারে
ক্লিষ্ট ক্লান্তিভারে,
সেই অজানার লাগি গৃহকোণে আনতনয়ন
বুনিছে শয়ন ।
সে যেন গো কাকচক্ষু স্বচ্ছ দিঘিজল
অচঞ্চল
কানায়-কানায়-ভরা,
শীতল অতল-মাঝে প্রসন্ন কিরণ দেয় ধরা ।
কালো চক্ষুপল্লবের কাছে
থমকিয়া আছে
স্তব্ধ ছায়া পাতি
হাসির খেলার সাথী
সুগভীর স্নিগ্ধ অশ্রুবারি ;
যেন তাহা দেবতারি
করুণা-অঞ্জলি —
নাম কি কাজলী ।
হেঁয়ালি
যারে সে বেসেছে ভালো তারে সে কাঁদায় ।
নূতন ধাঁধায়
ক্ষণে ক্ষণে চমকিয়া দেয় তারে,
কেবলই আলো-আঁধারে
সংশয় বাধায় ;
ছল-করা অভিমানে বৃথা সে সাধায় ।
সে কি শরতের মায়া
উড়ো মেঘে নিয়ে আসে বৃষ্টিভরা ছায়া ।
অনুকূল চাহনির
তলে
কী বিদ্যুৎ ঝলে ।
কেন দয়িতের
মিনতিকে
অভাবিত উচ্চ হাস্যে উড়াইয়া দেয় দিকে দিকে ।
তার পরে আপনার নির্দয়
লীলায়
আপনি সে ব্যথা পায়,
ফিরে যে গিয়েছে তারে ফিরায়ে ডাকিতে কাঁদে প্রাণ ;
আপনার অভিমানে
করে খানখান ।
কেন তার চিত্তাকাশে সারা বেলা
পাগল হাওয়ার এই এলোমেলো খেলা ।
আপনি সে পারে না বুঝিতে
যেদিকে চলিতে চায় কেন তার চলে বিপরীতে ।
গভীর অন্তরে
যেন আপনার অগোচরে
আপনার সাথে তার কী আছে বিরোধ,
অন্যেরে আঘাত করে আত্মঘাতী ক্রোধ ;
মুহূর্তেই বিগলিত
করুণায়
অপমানিতের
পায়
প্রাণমন দেয় ঢালি —
নাম কি হেঁয়ালি ।
খেয়ালী
মধ্যাহ্নে
বিজন বাতায়নে
সুদূর গগনে
কী দেখে সে ধানের খেতের
পরপারে —
নিরালা নদীর পথে দিগন্তে সবুজ অন্ধকারে
যেখানে কাঁঠাল
জাম নারিকেল বেত
প্রসারিয়া চলেছে সংকেত
অজানা গ্রামের,
সুখ দুঃখ জন্ম মৃত্যু অখ্যাত নামের ।
অপরাহ্নে ছাদে বসি
এলোচুল বুকে পড়ে খসি,
গ্রন্থ নিয়ে
হাতে
উদাস হয়েছে মন সে যে কোন্ কবিকল্পনাতে ।
সুদূরের বেদনায়
অতীতের অশ্রুবাষ্প হৃদয়ে
ঘনায় ।
বীরের কাহিনী
না-দেখা জনের লাগি তারে যেন করে বিরহিণী ।
পূর্ণিমানিশীথে
স্রোতে-ভাসা একা তরী
যবে সকরুণ সারিগীতে
ছায়াঘন তীরে তীরে সুপ্তিতে সুরের ছবি আঁকে
উৎসুক আকাঙ্ক্ষা জেগে থাকে
নিষুপ্ত প্রহরে,
অহৈতুক বারিবিন্দু ঝরে
আঁখিকোণে ;
যুগান্তরপার হতে কোন্ পুরাণের কথা শোনে ।
ইচ্ছা করে সেই রাতে
লিপিখানি লেখে ভূর্জপাতে
লেখনীতে ভরি লয়ে দুঃখে-গলা কাজলের কালি —
নাম কি খেয়ালী ।
কাকলী
কলছন্দে পূর্ণ তার
প্রাণ —
নিত্য বহমান
ভাষার কল্লোলে
জাগাইয়া তোলে
চারি ধারে
প্রত্যহের জড়তারে ;
সংগীতে তরঙ্গ তুলি
হাসিতে
ফেনিল তার ছোটো দিনগুলি ।
আঁখি তার কথা কয়, বাহুভঙ্গি কত কথা
বলে,
চরণ যখন চলে
কথা কয়ে যায় —
যে কথাটি অরণ্যের পাতায়
পাতায় ;
যে কথাটি ঢেউ তোলে
আশ্বিনে ধানের খেতে, প্রান্ত হতে প্রান্তে যায় চলে ;
যে কথাটি নিশীথতিমিরে,
তারায় তারায় কাঁপে অধীর মির্মিরে ;
যে কথাটি মহুয়ার
বনে
মধুপগুঞ্জনে
সারাবেলা
উঠিছে চঞ্চলি —
নাম কি কাকলী ।
পিয়ালী
চাহনি তাহার, সব কোলাহল হ ' লে সারা
সন্ধ্যার তিমিরে ভাসা তারা ।
মৌনখানি সুমধুর মিনতিরে
লতায়ে লতায়ে যেন মনের চৌদিকে দেয় ঘিরে ;
নির্বাক চাহিয়া থাকে,
নাহি পায় ভেবে
কেমন করিয়া কী-যে দেবে ।
দুয়ারবাহিরে
আসে ধীরে,
ক্ষণেক নীরব থেকে চলে যায় ফিরে ।
নাও
যদি কয় কথা
মনে যেন ভরি দেয় সুস্নিগ্ধ
মমতা ।
পায়ের চলায়
কিছু যেন দান করে ধূলির তলায় ।
তারে কিছু করিলে
জিজ্ঞাসা
কিছু বলে, কিছু তবু বাকি থাকে ভাষা ।
নিঃশব্দে
খুলিয়া দ্বার
অঞ্চলে
আড়াল করি সে যেন কাহার
আনিয়াছে সৌভাগ্যের থালি —
নাম কি পিয়ালী ।
দিয়ালী
জনতার মাঝে
দেখিতে পাই নে তারে, থাকে তুচ্ছ সাজে ।
ললাটে ঘোমটা টানি
দিবসে লুকায়ে রাখে
নয়নের বাণী ।
রজনীর অন্ধকার
তুলে দেয় আবরণ
তার ।
রাজরানীবেশে
অনায়াসগৌরবের সিংহাসনে বসে মৃদু হেসে ।
বক্ষে হার ঝলমলে,
সীমন্তে অলকে জ্বলে
মাণিক্যের সিঁথি ।
কী যেন বিস্মৃতি
সহসা ঘুচিয়া যায়, টুটে দীনতার ছদ্মসীমা,
মনে পড়ে আপন মহিমা ।
ভক্তেরে সে দেয় পুরস্কার
বরমাল্য তার
আপন সহস্র দীপ জ্বালি —
নাম কি দিয়ালী ।
নাগরী
ব্যঙ্গসুনিপুণা,
শ্লেষবাণসন্ধানদারুণা!
অনুগ্রহবর্ষণের মাঝে
বিদ্রূপবিদ্যুৎঘাত অকস্মাৎ মর্মে এসে বাজে ।
সে যেন তুফান
যাহারে চঞ্চল করে সে তরীকে করে খানখান
অট্টহাস্য
আঘাতিয়া এপাশে ওপাশে ;
প্রশ্রয়ের বীথিকায় ঘাসে ঘাসে
রেখেছে সে কণ্টক-অঙ্কুর বুনে বুনে ;
অদৃশ্য আগুনে
কুঞ্জ তার বেড়িয়াছে ;
যারা আসে কাছে
সব থেকে তারা দূরে রয়
;
মোহমন্ত্রে যে হৃদয়
করে জয়
তারি'পরে অবজ্ঞায়
দারুণ নির্দয় ।
আপন তপস্যা লয়ে যে পুরুষ নিশ্চল সদাই,
যে উহারে ফিরে চাহে নাই,
জানি সেই উদাসীন
একদিন
জিনিয়াছে ওরে ;
জ্বালাময়ী তারি পায়ে দীপ্ত দীপ দিল অর্ঘ্য ভরে ।
বিদুষী
নিয়েছে বিদ্যা শুধু চিত্তে নয়,
আপন রূপের সাথে ছন্দ তারে দিল অঙ্গময় ;
বুদ্ধি তার ললাটিকা,
চক্ষুর তারায় বুদ্ধি
জ্বলে দীপশিখা ;
বিদ্যা দিয়ে রচে নাই পণ্ডিতের স্থূল অহংকার,
বিদ্যারে করেছে অলংকার ।
প্রসাধনসাধনে চতুরা —
জানে সে ঢালিতে সুরা
ভূষণভঙ্গিতে,
অলক্তের আরক্ত ইঙ্গিতে ।
জাদুকরী বচনে চলনে ;
গোপন সে নাহি করে আপন ছলনে ;
অকপট মিথ্যারে সে নানা রসে করিয়া মধুর
নিন্দা তার করি দেয় দূর ;
জ্যোৎস্নার মতন
গোপনেও নহে সে গোপন ।
আঁধার-আলোরি কোলে রয়েছে জাগরি —
নাম কি নাগরী ।
সাগরী
বাহিরে সে দুরন্ত আবেগে
উচ্ছলিয়া উঠে জেগে —
উচ্চহাস্যতরঙ্গ সে হানে
সূর্যচন্দ্র-পানে ।
পাঠায় অস্থির চোখ —
আলোকের
উত্তরে আলোক ।
কভু অন্ধকারপুঞ্জে দেখা দেয় ঝঞ্ঝার ভ্রূকুটি,
ক্ষণে ক্ষণে
আন্দোলনে
প্রচণ্ড অধৈর্যবেগে তটের মর্যাদা ফেলে টুটি ।
গভীর অন্তর তার
নিস্তব্ধ গম্ভীর,
কোথা তল, কোথা তীর ;
অগাধ তপস্যা যেন রেখেছে সঞ্চিত করি —
নাম কি সাগরী ।
জয়তী
যেন তার চক্ষু-মাঝে
উদ্যত বিরাজে
মহেশের তপোবনে নন্দীর
তর্জনী ।
ইন্দ্রের অশনি
মৌনে তার ঢাকা ;
প্রাণ তার অরুণের পাখা
মেলিল দিনের বক্ষে তীব্র অতৃপ্তিতে
দুঃসহ দীপ্তিতে ।
সাধক দাঁড়ায় তার কাছে,
সহসা সংশয় লাগে যোগ্যতা কি আছে ;
দুঃসাধ্যসাধন-তরে
পথ খুঁজে মরে ।
তুচ্ছতারে দাহে তার
অবজ্ঞাদহন ;
এনেছে সে করিয়া বহন
ইন্দ্রাণীর গাঁথা
মাল্য ; দিবে কণ্ঠে তার
কার্মুকে যে দিয়েছে টংকার,
কাপট্যেরে হানিয়াছে, সত্যে যার ঋণী বসুমতী —
নাম কি জয়তী ।
ঝামরী
সে যেন
খসিয়া-পড়া তারা,
মর্তের প্রদীপে নিল মৃত্তিকার কারা ।
নগরে জনতামরু,
সে যেন তাহারি মাঝে পথপ্রান্তে সঙ্গিহীন তরু,
তারে ঢেকে আছে নিতি
অরণ্যের
সুগভীর স্মৃতি ।
সে যেন অকালে-ফোটা কুবলয়,
শিশিরে কুণ্ঠিত হয়ে রয় ।
মন পাখা মেলিবারে চায়,
চারি দিকে ঠেকে যায়,
জানে না কিসের বাধা তার ;
অদৃষ্টের মায়াদুর্গদ্বার
কোন্ রাজপুত্র এসে
মন্ত্রবলে ভেঙে দেবে শেষে ।
আকাশে আলোতে
নিমন্ত্রণ আসে যেন কোথা হতে,
পথ রুদ্ধ চারি ধারে —
মুখ ফুটে বলিতে না পারে
অলক্ষ্য কী আচ্ছাদনে কেন সে আবৃতা ।
সে
যেন অশোকবনে-সীতা,
চারি দিকে যারা আছে কেহ তার নহেক স্বকীয় ;
কে তারে
পাঠাবে অঙ্গুরীয়
বিচ্ছেদের
অতল সমুদ্র-পারে ।
আঁখি তুলে
তাই বারে বারে
চেয়ে দেখে নিরুত্তর নিঃশব্দ গগনে ।
কোন্ দেব
নিত্যনির্বাসনে
পাঠাল তাহারে!
স্বর্গের বীণার
তারে
সংগীতে কি
করেছিল ভুল ।
মহেন্দ্রের-দেওয়া ফুল
নৃত্যকালে খসে গেলে অন্যমনে দলেছিল কভু ?
আজও তবু
মন্দারের গন্ধ যেন আছে তার বিষাদে জড়ানো,
অধরে রয়েছে তার ম্লান —
সন্ধ্যার গোলাপ-সম —
মাঝখানে-ভেঙে-যাওয়া অমরার গীতি অনুপম ।
অদৃশ্য যে অশ্রুধারা
আবিষ্ট করেছে তার
চক্ষুতারা,
তাহা দিব্য বেদনার করুণানির্ঝরী —
নাম কি ঝামরী ।
মুরতি
যে শক্তির নিত্যলীলা নানা বর্ণে আঁকা,
যে গুণী
প্রজাপতির পাখা
যুগ যুগ ধ্যান করি একদা কী খনে
রচিল অপূর্ব চিত্রে
বিচিত্র লিখনে —
এই নারী
রচনা তাহারি ।
এ
শুধু কালের খেলা
এর দেহ কী আলস্যে বিধাতা
একেলা
রচিলেন সন্ধ্যাকালে
আপনার অর্থহীন ক্ষণিক খেয়ালে
—
যে-লগনে
কর্মহীন ক্লান্তক্ষণে
মেঘের মহিমামায়া মুহূর্তেই মুগ্ধ করি আঁখি
অন্ধরাত্রে বিনা ক্ষোভে যায় মুখ ঢাকি ।
শরতে নদীর জলে যে-ভঙ্গিমা,
বৈশাখে দাড়িম্ববনে যে-রাগরঙ্গিমা
যৌবনের দাপে
অবজ্ঞাকটাক্ষ হানে মধ্যাহ্নের তাপে,
শ্রাবণের বন্যাতলে হারা
ভেসে-যাওয়া শৈবালের যে নৃত্যের ধারা,
মাঘশেষে অশ্বত্থের কচি
পাতাগুলি
যে চাঞ্চল্যে উঠে দুলি,
হেমন্তের
প্রভাতবাতাসে
শিশিরে যে ঝিলিমিলি ঘাসে ঘাসে,
প্রথম আষাঢ়দিনে গুরু গুরু রবে
ময়ূরের পুচ্ছপুঞ্জ উল্লসিয়া উঠে যে গৌরবে
তাই
দিয়ে রচিত সুন্দরী —
লতা যেন নারী হয়ে দিল চক্ষু
ভরি ।
রঙিন বুদ্বুদ সে কি, ইন্দ্রধনুবুঝি,
অন্তর না পাই খুঁজি —
সকলি বাহির,
চিত্ত অগভীর ।
কারো পথ
চেয়ে নাহি থাকে,
কারে-না-পাওয়ার দুঃখ মনে নাহি রাখে ।
মুগ্ধ প্রাণ-উপহার
অনায়াসে নেয়, আর অনায়াসে ভোলে দায় তার ।
ভুবনে যেখানে যত নয়নের আনন্দলহরী
তাই দেখা
দিতে এল নারীমূর্তি ধরি ।
সরস্বতী রচিলেন মন তার কোন্ অবসরে
রাগহীন
বাণীহীন গুঞ্জনের স্বরে ;
অমৃতে-মাটিতে-মেশা সৃজনের এ কোন্ সুরতি —
নাম কি মুরতি ।
মালিনী
হাসিমুখ নিয়ে যায় ঘরে ঘরে,
সখীদের অবকাশ মধু দিয়ে ভরে ।
প্রসন্নতা তার অন্তহীন
রাত্রিদিন
গভীর কী উৎস হতে
উচ্ছলিছে আলোঝলা কথাবলা স্রোতে ।
মর্তের ম্লানতা তারে
পারে নি তো স্পর্শ করিবারে ।
প্রভাতে সে দেখা দিলে মনে হয় যেন সূর্যমুখী
রক্তারুণ উল্লাসে কৌতুকী ।
মধ্যাহ্নের স্থলপদ্ম অমলিন রাগে
প্রফুল্ল
সে সূর্যের সোহাগে,
সায়াহ্নের জুঁই সে-যে,
গন্ধে যার প্রদোষের শূন্যতায় বাঁশি ওঠে বেজে ।
মৈত্রীসুধাময় চোখে
মাধুরী মিশায়ে দেয় সন্ধ্যাদীপালোকে ।
রজনীগন্ধা সে রাতে, দেয় পরকাশি
আনন্দহিল্লোল রাশি রাশি ;
সঙ্গহীন আঁধারের নৈরাশ্যক্ষালিনী —
নাম কি মালিনী ।
করুণী
তরুলতা
যে ভাষায় কয় কথা
সে
ভাষা সে জানে —
তৃণ তার পদক্ষেপ দয়া বলি মানে ।
পুষ্পপল্লবের'পরে তার আঁখি
অদৃশ্য প্রাণের হর্ষ দিয়ে যায় রাখি ।
স্নেহ তার আকাশের আলোর মতন
কাননের অন্তরবেদন
দূর করিবার লাগি
নিত্য আছে জাগি ।
শিশু হতে শিশুতর
গাছগুলি বোবা প্রাণে ভর-ভর ;
বাতাসে
বৃষ্টিতে
চঞ্চলিয়া জাগে তারা অর্থহীন গীতে,
ধরণীর যে গভীরে
চিররসধারা
সেইখানে তারা
কাঙাল প্রসারি ধরে তৃষিত অঞ্জলি,
বিশ্বের করুণারাশি শাখায় শাখায় উঠে ফলি —
সে তরুলতারই মতো স্নিগ্ধ প্রাণ তার ;
শ্যামল উদার
সেবা যত্ন সরল
শান্তিতে
ঘনচ্ছায়া বিস্তারিয়া আছে চারি ভিতে ;
তাহার মমতা
সকল প্রাণীর'পরে বিছায়েছে স্নেহের সমতা ;
পশু পাখি
তার আপনার ;
জীববৎসলার
স্নেহ ঝরে শিশু- ' পরে, বনে যেন নত মেঘভার
ঢালে বারিধার ।
তরুণ প্রাণের'পরে করুণায় নিত্য সে তরুণী —
নাম কি করুণী ।
প্রতিমা
চতুর্দশী
এল নেমে,
পূর্ণিমার প্রান্তে এসে গেল থেমে ।
অপূর্ণের ঈষৎ
আভাসে
আপন বলিতে তারে মর্তভূমি শঙ্কা নাহি বাসে ।
এ ধরার
নির্বাসনে
কুণ্ঠার গুণ্ঠন নাই, ভীরুতা নাইকো তার মনে,
সংসারজনতা-মাঝে
আপনাতে আপনি
বিরাজে ।
দুঃখে শোকে অবিচল, ধৈর্য তার প্রফুল্লতা-ভরা,
সকল উদ্বেগভারহরা ।
রোগ
যদি আসে রুখে
সকরুণ শান্ত হাসি লেগে থাকে গ্লানিহীন মুখে ।
দুর্যোগ মেঘের মতো
নীচে দিয়ে বহে যায় কত
বারে বারে,
প্রভা তার মুছিতে না পারে ।
তবু তার মহিমায় কিছু আছে বাকি,
সেইখানে রাখে ঢাকি
অশ্রুজল
বিষাদ-ইঙ্গিতে-ছোঁওয়া ঈষৎ বিহ্বল ।
কণামাত্র সে-ক্ষীণতা
নাহি কহে কথা,
কেহ না দেখিতে পায়
নিত্য যারা ফিরে আছে তায় ।
অমরার অসীমতা মাটিতে নিয়েছে সীমা —
নাম কি প্রতিমা ।
নন্দিনী
প্রথম সৃষ্টির ছন্দখানি
অঙ্গে তার নক্ষত্রের নৃত্য দিল আনি ।
বর্ষা-অন্তে ইন্দ্রধনু
মর্তে নিল তনু ।
দিগ্বধূর মায়াবী অঙ্গুলি
চঞ্চল চিন্তায় তার বুলায়েছে বর্ণ-আঁকা তুলি ।
সরল তাহার হাসি, সুকুমার মুঠি
যেন শুভ্র কমলকলিকা ;
আঁখিদুটি
যেন কালো আলোকের সচকিত শিখা ।
অবসাদবন্ধভাঙা মুক্তির সে ছবি,
সে আনিয়া দেয়
চিত্তে
কলনৃত্যে
দুস্তর-প্রস্তর-ঠেলা ফেনোচ্ছল আনন্দজাহ্নবী ।
বীণার তন্ত্রের মতো গতি তার সংগীতস্পন্দিনী —
নাম কি নন্দিনী ।
২৮ শ্রাবণ ১৩৩৫
উষসী
ভোরের আগের যে প্রহরে
স্তব্ধ অন্ধকার- ' পরে
সুপ্তি-অন্তরাল হতে দূর সূর্যোদয়
বনময়
পাঠায় নূতন জাগরণী,
অতি
মৃদু শিহরণী
বাতাসের গায়ে ;
পাখির কুলায়ে
অস্পষ্ট কাকলি ওঠে আধোজাগা স্বরে,
স্তম্ভিত আগ্রহভরে
অব্যক্ত বিরাট আশা ধ্যানে মগ্ন দিকে দিগন্তরে —
ও কোন্ তরুণ প্রাণে করিয়াছে ভর,
অন্তর্গূঢ়
সে প্রহর
আত্ম-অগোচর
।
চিত্ত তার আপনার গভীর অন্তরে
নিঃশব্দে প্রতীক্ষা করে
পরিপূর্ণ সার্থকতা লাগি ।
সুপ্তি-মাঝে প্রতীক্ষিয়া আছে জাগি
নির্মল নির্ভয়
কোন্ দিব্য অভ্যুদয় ।
কোন্ সে পরমা মুক্তি, কোন্ সেই আপনার
দীপ্যমান মহা
আবিষ্কার ।
প্রভাতমহিমা ওর সম্বৃত রয়েছে নিশ্চেতনে,
তাহারি আভাস পাই মনে ।
আমি
ওই রথশব্দ শুনি,
সোনার বীণার তারে সংগীত আনিছে কোন্ গুণী ।
জাগিবে হৃদয়,
ভুবন তাহার হবে বাণীময় ;
মানসকমল একমনা
নবোদিত তপনের করিবে প্রথম অভ্যর্থনা ।
জাগিবে নূতন দিবা উজ্জ্বল উল্লাসে
বর্ণে গন্ধে গানে প্রাণে মহোৎসবে তার চারি পাশে ।
নিরুদ্ধ চেতনা হতে হবে চ্যুত
লালসা-আবেশে জড়ীভূত
স্বপ্নের
শৃঙ্খলপাশ ।
বিলুপ্ত করিবে দূরে উন্মুক্ত বাতাস
দুর্বল দীপের গাঢ় বিষতপ্ত কলুষনিশ্বাস ।
আলোকের জয়ধ্বনি উঠিবে উচ্ছ্বসি —
নাম কি উষসী ।
[শ্রাবণ
?-আশ্বিন ১৩৩৫] |