ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া
 


 

         প্রচ্ছন্না
বিদেশে ওই সৌধশিখর- ' পরে
      ক্ষণকালের তরে
   পথ হতে যে দেখেছিলেম, ওগো আধেক-দেখা
        মনে হল তুমি অসীম একা
    দাঁড়িয়েছিলে যেন আমার একটি বিজন খনে
                আর কিছু নাই সেথায় ত্রিভুবনে ।
       সামনে তোমার মুক্ত আকাশ, অরণ্যতল নীচে,
ক্ষণে ক্ষণে ঝাউয়ের শাখা প্রলাপ মর্মরিছে ।
            মুখ দেখা না যায়,
      পিঠের'পরে বেণীটি লুটায় ।
থামের পাশে হেলান-দেওয়া ঈষৎ দেখি আধখানি ওই দেহ,
      অসম্পূর্ণ কয়টি রেখায় কী যেন সন্দেহ ।
   বন্দিনী কি ভোগের কারাগারে,
ভাবনা তোমার উড়ে চলে দূর দিগন্তপারে ?
সোনার বরন শস্যখেতে, কোন্‌-সে নদীতীরে
     পূজারীদের চলার পথে, উচ্চচূড়া দেবতামন্দিরে
        তোমার চিরপরিচিত প্রভাত-আলোখানি,
     তারি স্মৃতি চক্ষে তোমার জল কি দিল আনি ।

          কিম্বা তুমি রাজেন্দ্রসোহাগী,
সেই বহুবল্লভের প্রেমে দ্বিধার দুঃখ হৃদয়ে রয় জাগি,
         প্রশ্ন কি তাই শুধাও নক্ষত্রেরে
সপ্তঋষির কাছে তোমার প্রণামখানি সেরে ।
           হয়তো বৃথাই সাজ, '
তৃপ্তিবিহীন চিত্ততলে তৃষ্ণা-অনল দহন করে আজও ;
      তাই কি শূন্য আকাশ-পানে চাও,
         উপেক্ষিত যৌবনেরি ধিক্কার জানাও ?

               কিংবা আছ চেয়ে
আসবে সে কোন্‌ দুঃসাহসী গোপন পন্থা বেয়ে,
            বক্ষ তোমার দোলে,
        রক্ত নাচে ত্রাসের উতরোলে ।
স্তব্ধ আছে তরুশ্রেণী মরণছায়া ঢাকা,
             শূন্যে ওড়ে অদৃশ্য কোন্‌ পাখা ।
আমি পথিক যাব-যে কোন্‌ দূরে ;
          তুমি রাজার পুরে
              মাঝে মাঝে কাজের অবসরে
         বাহির হয়ে আসবে হোথায় ওই অলিন্দ- ' পরে,
     দেখবে চেয়ে অকারণে স্তব্ধ নেত্রপাতে
               গোধূলিবেলাতে
      বনের সবুজ তরঙ্গ পারায়ে
নদীর প্রান্তরেখায় যে পথ গিয়েছে হারায়ে ।
          তোমার ইচ্ছা চলবে কল্পনাতে
    সুদূর পথে আভাসরূপী সেই অজানার সাথে
        পান্থ যে জন নিত্য চলে যায় ।
            আমি পথিক হায়,
    পিছন-পানে এই বিদেশের সুদূর সৌধশিরে
            ইচ্ছা আমার পাঠাই ফিরে ফিরে
   ছায়ায়-ঢাকা আধেক-দেখা তোমার বাতায়নে,
যে মুখ তোমার লুকিয়ে ছিল সে মুখ আঁকি মনে ।


১০ আশ্বিন ১৩৩৫


                   দর্পণ
দর্পণ লইয়া তারে কী প্রশ্ন শুধাও একমনে
হে সুন্দরী, কী সংশয় জাগে তব উদ্‌বিগ্ন নয়নে ।
নিজেরে দেখিতে চাও বাহিরে রাখিয়া আপনারে
যেন আর কারো চোখে ; আর কারো জীবনের দ্বারে
খুঁজিছ আপন স্থান । প্রেমের অর্ঘ্যের কোনো ত্রুটি
দেখ কি মুখের কোনোখানে । তাই তব আঁখিদুটি
নিজেরে কি করিছে ভর্ৎসনা । সাজায়ে লইয়া সর্বদেহে
স্বর্গের গর্বের ধন, তবে যেতে চাও তার গেহে ?
জান না কি হে রমণী, দর্পণে যা দেখিছ তা ছায়া,
পার না রচিতে কভু তাই দিয়ে চিরস্থায়ী মায়া ।
তিলোত্তমা অনুপমা সুরেন্দ্রের প্রমোদপ্রাঙ্গণে
কঙ্কণঝংকারে আর নৃত্যলোল নূপুরনিক্বণে
নাচিয়া বাহিরে চলে যায় । লয়ে আত্মনিবেদন
গৌরবে জিনিলা শচী ইন্দ্রলোকে নন্দন-আসন ।

১৫ আশ্বিন ১৩৩৫