ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া
 


 

             সাগরিকা
সাগরজলে সিনান করি সজল এলোচুলে
        বসিয়াছিলে উপল-উপকূলে ।
              শিথিল পীতবাস
মাটির'পরে কুটিলরেখা লুটিল চারি পাশ ।
নিরাবরণ বক্ষে তব, নিরাভরণ দেহে
চিকন সোনা-লিখন উষা আঁকিয়া দিল স্নেহে ।
মকরচূড় মুকুটখানি পরি ললাট- ' পরে
        ধনুকবাণ ধরি দখিন করে,
             দাঁড়ানু রাজবেশী —
      কহিনু, ‘ আমি এসেছি পরদেশী । '

চমকি ত্রাসে দাঁড়ালে উঠি শিলা-আসন ফেলে,
        শুধালে, ‘ কেন এলে । '
        কহিনু আমি, ‘ রেখো না ভয় মনে,
পূজার ফুল তুলিতে চাহি তোমার ফুলবনে । '
          চলিলে সাথে, হাসিলে অনুকূল,
তুলিনু যূথী, তুলিনু জাতী, তুলিনু চাঁপাফুল ।
দুজনে মিলি সাজায়ে ডালি বসিনু একাসনে,
         নটরাজেরে পূজিনু একমনে ।
কুহেলি গেল, আকাশে আলো দিল-যে পরকাশি
        ধূর্জটির মুখের পানে পার্বতীর হাসি ।

সন্ধ্যাতারা উঠিল যবে গিরিশিখর- ' পরে
           একেলা ছিলে ঘরে ।
কটিতে ছিল নীল দুকূল, মালতীমালা মাথে,
       কাঁকন দুটি ছিল দুখানি হাতে ।
       চলিতে পথে বাজায়ে দিনু বাঁশি,
      ‘ অতিথি আমি ', কহিনু দ্বারে আসি ।
তরাসভরে চকিতকরে প্রদীপখানি জ্বেলে
      চাহিলে মুখে, কহিলে, ‘ কেন এলে । '
      কহিনু আমি, ‘ রেখো না ভয় মনে,
তনু দেহটি সাজাব তব আমার আভরণে । '
          চাহিলে হাসিমুখে,
আধোচাঁদের কনকমালা দোলানু তব বুকে ।
মকরচূড় মুকুটখানি কবরী তব ঘিরে
         পরায়ে দিনু শিরে ।
          জ্বালায়ে বাতি মাতিল সখীদল,
তোমার দেহে রতনসাজ করিল ঝলমল ।
মধুর হল বিধুর হল মাধবী নিশীথিনী,
আমার তালে তোমার নাচে মিলিল রিনিঝিনি ।
        পূর্ণচাঁদ হাসে আকাশ-কোলে,
আলোকছায়া শিবশিবানী সাগরজলে দোলে ।

         ফুরালো দিন কখন নাহি জানি,
সন্ধ্যাবেলা ভাসিল জলে আবার তরীখানি ।
         সহসা বায়ু বহিল প্রতিকূলে,
প্রলয় এল সাগরতলে দারুণ ঢেউ তুলে ।
             লবণজলে ভরি
আঁধার রাতে ডুবাল মোর রতনভরা তরী ।
আবার ভাঙা ভাগ্য নিয়ে দাঁড়ানু দ্বারে এসে
        ভূষণহীন মলিন দীন বেশে ।
দেখিনু আমি নটরাজের দেউলদ্বার খুলি
তেমনি করে রয়েছে ভরে ডালিতে ফুলগুলি ।
      হেরিনু রাতে, উতল উৎসবে
             তরল কলরবে
আলোর নাচ নাচায় চাঁদ সাগরজলে যবে,
       নীরব তব নম্র নত মুখে
আমারি আঁকা পত্রলেখা, আমারি মালা বুকে ।
         দেখিনু চুপে চুপে
আমারি বাঁধা মৃদঙ্গের ছন্দ রূপে রূপে
        অঙ্গে তব হিল্লোলিয়া দোলে
        ললিতগীতকলিত কল্লোলে ।
 

       মিনতি মম শুন হে সুন্দরী,
আরেক বার সমুখে এসো প্রদীপখানি ধরি ।
এবার মোর মকরচূড় মুকুট নাহি মাথে,
       ধনুকবাণ নাহি আমার হাতে ;
এবার আমি আনি নি ডালি দখিন সমীরণে
        সাগরকূলে তোমরা ফুলবনে ।
           এনেছি শুধু বীণা,
দেখো তো চেয়ে আমারে তুমি চিনিতে পার কি না ।
 

মায়ার জাহাজ
১ অক্টোবর ১৮২৭