ফাল্গুনী
ফাল্গুনী' নাটকের সূচি
সূচনা
রাজোদ্যান
চুপ, চুপ, চুপ কর্ তোরা।
কেন, কী হয়েছে।
মহারাজের মন খারাপ হয়েছে।
সর্বনাশ!
কে রে। কে বাজায় বাঁশি।
কেন ভাই, কী হয়েছে।
মহারাজের মন খারাপ হয়েছে।
সর্বনাশ!
ছেলেগুলো দাপাদাপি করছে কার।
আমাদের মণ্ডলদের।
মণ্ডলকে সাবধান করে দে। ছেলেগুলোকে ঠেকাক।
মন্ত্রী কোথায় গেলেন।
এই যে এখানেই আছি।
খবর পেয়েছেন কি।
কী বলো দেখি।
মহারাজের মন খারাপ হয়েছে।
কিন্তু প্রত্যন্তবিভাগ থেকে যুদ্ধের সংবাদ এসেছে যে।
যুদ্ধ চলুক কিন্তু তার সংবাদটা এখন চলবে না।
চীন-সম্রাটের দূত অপেক্ষা করছেন।
অপেক্ষা করতে দোষ নেই কিন্তু সাক্ষাৎ পাবেন না।
ঐ-যে মহারাজ আসছেন।
জয় হোক মহারাজের!
মহারাজ, সভায় যাবার সময় হল।
যাবার সময় হল বৈকি, কিন্তু সভায় যাবার নয়।
সে কি কথা মহারাজ!
সভা ভাঙবার ঘণ্টা বেজেছে শুনতে পেয়েছি।
কই, আমরা তো কেউ–
তোমরা শুনবে কী করে। ঘণ্টা একেবারে আমারই কানের কাছে বাজিয়েছে।
এতবড়ো স্পর্ধা কার হতে পারে।
মন্ত্রী, এখনো বাজাচ্ছে।
মহারাজ, দাসের স্থূলবুদ্ধি মাপ করবেন, বুঝতে পারলুম না।
এই চেয়ে দেখো–
মহারাজের চুল–
ওখানে একজন ঘণ্টা-বাজিয়েকে দেখতে পাচ্ছ না?
দাসের সঙ্গে পরিহাস?
পরিহাস আমার নয় মন্ত্রী, যিনি পৃথিবীসুদ্ধ জীবের কানে ধরে পরিহাস করেন এ তাঁরই। গত রজনীতে আমার গলায় মল্লিকার মালা পরাবার সময় মহিষী চমকে উঠে বললেন, এ কী মহারাজ, আপনার কানের কাছে দুটো পাকাচুল দেখছি যে!
মহারাজ, এজন্য খেদ করবেন না– রাজবৈদ্য আছেন, তিনি–
এ বংশের প্রথম রাজা ইক্ষ্বাকুরও রাজবৈদ্য ছিলেন, তিনি কি করতে পেরেছিলেন। –মন্ত্রী, যমরাজ আমার কানের কাছে তাঁর নিমন্ত্রণপত্র ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছেন। মহিষী এ দুটো চুল তুলে ফেলতে চেয়েছিলেন, আমি বললুম, কী হবে রানী। যমের পত্রই যেন সরালুম কিন্তু যমের পত্রলিখককে তো সরানো যায় না। অতএব এ পত্র শিরোধার্য করাই গেল। এখন তা হলে–
যে আজ্ঞা, এখন তা হলে রাজকার্যের আয়োজন–
কিসের রাজকার্য। রাজকার্যের সময় নেই–শ্রুতিভূষণকে ডেকে আনো।
সেনাপতি বিজয়বর্মা–
না, বিজয়বর্মা না শ্রুতিভূষণ।
মহারাজ, এ দিকে চীন-সম্রাটের দূত–
তাঁর চেয়ে বড়ো সম্রাটের দূত অপেক্ষা করছেন–ডাকো শ্রুতিভূষণকে।
মহারাজ, প্রত্যন্তসীমার সংবাদ–
মন্ত্রী, প্রত্যন্ততম সীমার সংবাদ এসেছে, ডাকো শ্রুতিভূষণকে।
মহারাজের শ্বশুর–
আমি যাঁর কথা বলছি তিনি আমার শ্বশুর নন। ডাকো শ্রুতিভূষণকে।
আমাদের কবিশেখর তাঁর কল্পমঞ্জরী কাব্য নিয়ে–
নিয়ে তিনি তাঁর কল্পদ্রুমের শাখায় প্রশাখায় আনন্দে সঞ্চরণ করুন, ডাকো শ্রুতিভূষণকে।
যে আদেশ, তাঁকে ডাকতে পাঠাচ্ছি।
বোলো, সঙ্গে যেন তাঁর বৈরাগ্যবারিধি পুঁথিটা আনেন।
প্রতিহারী, বাইরে ঐ কারা গোল করছে, বারণ করো, আমি একটু শান্তি চাই।
নাগপত্তনে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে, প্রজারা সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে।
আমার তো সময় নেই মন্ত্রী, আমি শান্তি চাই।
তারা বলছে তাদের সময় আরো অনেক অল্প– তারা মৃত্যুর দ্বার প্রায় লঙ্ঘন করেছে– তারা ক্ষুধাশান্তি চায়।
ক্ষুধাশান্তি! এ সংসারে কি ক্ষুধার শান্তি আছে। ক্ষুধানলের শান্তি চিতানলে।
তা হলে মহারাজ ঐ হতভাগ্যদের–
ঐ হতভাগ্যদের প্রতি এই হতভাগ্যের উপদেশ এই যে, কাল-ধীবরের জাল ছিন্ন করবার জন্য ছটফট করা বৃথা, আজই হোক কালই হোক সে টেনে তুলবেই।
অতএব–
অতএব শ্রুতিভূষণকে প্রয়োজন এবং তাঁর বৈরাগ্যবারিধি পুঁথি।
প্রজারা তা হলে দুর্ভিক্ষ–
দেখো মন্ত্রী, ভিক্ষা তো অন্নের নয়, ভিক্ষা আয়ুর। সেই ভিক্ষায় জগৎ জুড়ে দুর্ভিক্ষ– কী রাজার কী প্রজার– কে কাকে রক্ষা করবে।
অতএব–
অতএব শ্মশানেশ্বর শিব যেখানে ডমরুধ্বনি করছেন সেইখানেই সকলের সব প্রার্থনা ছাইচাপা পড়বে– তবে কেন মিছে গলা ভাঙা। এই যে শ্রুতিভূষণ, প্রণাম।
শুভমস্তু।
শ্রুতিভূষণমশায়, মহারাজকে একটু বুঝিয়ে বলবেন যে অবসাদগ্রস্ত নিরুৎসাহকে লক্ষ্মী পরিহার করেন।
শ্রুতিভূষণ, মন্ত্রী আপনাকে কী বলছেন।
উনি বলছেন লক্ষ্মীর স্বভাবসম্বন্ধে মহারাজকে কিছু উপদেশ দিতে।
আপনার উপদেশ কী।
বৈরাগ্যবারিধিতে একটি চৌপদী আছে–
যে পদ্মে লক্ষ্মীর বাস, দিন-অবসানে
সেই পদ্ম মুদে দল সকলেই জানে।
গৃহ যার ফুটে আর মুদে পুনঃপুনঃ
সে লক্ষ্মীরে ত্যাগ করো, শুন মূঢ় শুন।
অহো, আপনার উপদেশের এক ফুৎকারেই আশা-প্রদীপের জ্বলন্ত শিখা নির্বাপিত হয়ে যায়। আমাদের আচার্য বলেছেন না–
দন্তং গলিতং পলিতং মুণ্ডং
তদপি ন মুঞ্চতি আশাভাণ্ডং।
মহারাজ, আশার কথা যদি তুললেন তবে বারিধি থেকে আর-একটি চৌপদী শোনাই–
শৃঙ্খল বাঁধিয়া রাখে এই জানি সবে,
আশার শৃঙ্খল কিন্তু অদ্ভুত এ ভবে।
সে যাহারে বাঁধে সেই ঘুরে মরে পাকে,
সে-বন্ধন ছাড়ে যারে স্থির হয়ে থাকে।
হায় হায় অমূল্য আপনার বাণী! শ্রুতিভূষণকে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা এখনি--ও কি মন্ত্রী, আবার কারা গোল করছে।
সেই দুর্ভিক্ষগ্রস্ত প্রজারা।
ওদের এখনি শান্ত হতে বলো।
তা হলে মহারাজ, শ্রুতিভূষণকে ওদের কাছে পাঠিয়ে দিন- না– আমরা ততক্ষণ যুদ্ধের পরামর্শটা–
না না যুদ্ধ পরে হবে, শ্রুতিভূষণকে ছাড়তে পারছি নে।
মহারাজ, স্বর্ণমুদ্রা দেবার কথা বলছিলেন কিন্তু সে দান যে ক্ষয় হয়ে যাবে।বৈরাগ্যবারিধি লিখছেন–
স্বর্ণদান করে যেই করে দুঃখ দান
যত স্বর্ণ ক্ষয় হয় ব্যথা পায় প্রাণ।
শত দাও, লক্ষ দাও, হয়ে যায় শেষ,
শূন্য ভাণ্ড ভরি শুধু থাকে মনঃক্লেশ।
আহা শরীর রোমাঞ্চিত হল। প্রভু কি তা হলে–
না, আমি সহস্র মুদ্রা চাই নে।
দিন দিন, একটু পদধূলি দিন। সহস্র মুদ্রা চান না! এতবড়ো কথা!
মহারাজ, এই সহস্র মুদ্রা অক্ষয় হয়ে যাতে মহারাজের পুণ্যফলকে অসীম করে আমি এমন-কিছু চাই। গোধনসমেত আপনার ঐ কাঞ্চনপুর জনপদটি যদি ব্রক্ষ্ণত্র দান করেন কেবলমাত্র ঐটুকুতেই আমি সন্তুষ্ট থাকব; কারণ বৈরাগ্যবারিধি বলছেন–
বুঝেছি শ্রুতিভূষণ, এর জন্যে আর বৈরাগ্যবারিধির প্রমাণ দরকার নেই। মন্ত্রী, কাঞ্চনপুর জনপদটি শ্রুতিভূষণের বংশে চিরন্তন– আবার কী, বারবার কেন চীৎকার করছে।
চীৎকারটা বারবার করছে বটে কিন্তু কারণটা একই রয়ে গেছে। ওরা সেই মহারাজের দুর্ভিক্ষকাতর প্রজা।
মহারাজ, ব্রাক্ষ্ণণী মহারাজকে বলতে বলেছেন তিনি তাঁর সর্বাঙ্গে মহারাজের যশোঝংকার ধ্বনিত করতে চান কিন্তু আভরণের অভাববশত শব্দ বড়োই ক্ষীণ হয়ে বাজছে।
মন্ত্রী!
মহারাজ!
ব্রাক্ষ্ণণীর আভরণের অভাবমোচন করতে যেন বিলম্ব না হয়।
আর মন্ত্রীমশায়কে বলে দিন, আমরা সর্বদাই পরমার্থচিন্তায় রত, বৎসরে বৎসরে গৃহসংস্কারের চিন্তায় মন দিতে হলে চিত্তবিক্ষেপ হয়। অতএব রাজশিল্পী যদি আমার গৃহটি সুদৃঢ় করে নির্মাণ করে দেয় তা হলে তার তলদেশে শান্তমনে বৈরাগ্যসাধন করতে পারি।
মন্ত্রী, রাজশিল্পীকে যথাবিধি আদেশ করে দাও।
মহারাজ, এ বৎসর রাজকোষে ধনাভাব।
সে তো প্রতি বৎসরেই শুনে আসছি। মন্ত্রী, তোমাদের উপর ভার ধন বৃদ্ধি করবার, আর আমার উপর ভার অভাব বৃদ্ধি করবার। এই দুইয়ে মিলে সন্ধি করে হয় ধনাভাব।
মহারাজ, মন্ত্রীকে দোষ দিতে পারি নে। উনি দেখছেন আপনার অর্থ, আর আমরা দেখছি আপনার পরমার্থ, সুতরাং উনি যেখানে দেখতে পাচ্ছেন, অভাব আমরা সেখানে দেখতে পাচ্ছি ধন। বৈরাগ্যবারিধিতে লিখছেন–
রাজকোষ পূর্ণ হয়ে তবু শূন্যমাত্র,
যোগ্য হাতে যাহা পড়ে লভে সৎপাত্র।
পাত্র নাই ধন আছে, থেকেও না থাকা,
পাত্র হাতে ধন, সেই রাজকোষ পাকা।
আহা হা! আপনাদের সঙ্গ অমূল্য।
কিন্তু মহারাজের সঙ্গ কত মূল্যবান, শ্রুতিভূষণমশায় তা বেশ জানেন। তা হলে আসুন শ্রুতিভূষণ, বৈরাগ্যসাধনের ফর্দ যা দিলেন সেটা সংগ্রহ করা যাক।
চলুন তবে চলুন, বিলম্বে কাজ নেই। মন্ত্রী এই সামান্য বিষয় নিয়ে যখন এত অধীর হয়েছেন তখন ওঁকে শান্ত করে এখনি আবার ফিরে আসছি।
আমার সর্বদা ভয় হয় পাছে আপনি রাজাশ্রয় ছেড়ে অরণ্যে চলে যান।
মহারাজ, মনটা মুক্ত থাকলে কিছুই ত্যাগ করতে হয় না--এই রাজগৃহে যতক্ষণ আমার সন্তোষ আছে ততক্ষণ এই আমার অরণ্য। এক্ষণে তবে আসি। মন্ত্রী, চলো চলো।
ঐ যে কবিশেখর আসছে– আমার তপস্যা ভাঙলে বুঝি! ওকে ভয় করি। ওরে পাকাচুল কান ঢেকে থাক্ রে, কবির বাণী যেন প্রবেশপথ না পায়।
মহারাজ, আপনার এই কবিকে নাকি বিদায় করতে চান।
কবিত্ব যে বিদায়-সংবাদ পাঠালে, এখন কবিকে রেখে হবে কী।
সংবাদটা কোথায় পৌঁছল।
ঠিক আমার কানের উপর। চেয়ে দেখো।
পাকাচুল? ওটাকে আপনি ভাবছেন কী।
যৌবনের শ্যামকে মুছে ফেলে সাদা করার চেষ্টা।
কারিকরের মতলব বোঝেন নি। ঐ সাদা ভূমিকার উপরে আবার নূতন রঙ লাগবে।
কই, রঙের আভাস তো দেখি নে।
সেটা গোপনে আছে। সাদার প্রাণের মধ্যে সব রঙেরই বাসা।
চুপ চুপ, চুপ করো, কবি চুপ করো।
মহারাজ, এ যৌবন ম্লান যদি হল তো হোক- না। আরেক যৌবনলক্ষ্মী আসছেন, মহারাজের কেশে তিনি তাঁর শুভ্র মল্লিকার মালা পাঠিয়ে দিয়েছেন– নেপথ্যে সেই মিলনের আয়োজন চলছে।
আরে, আরে, তুমি দেখছি বিপদ বাধাবে কবি। যাও যাও তুমি যাও– ওরে, শ্রুতিভূষণকে দৌড়ে ডেকে নিয়ে আয়।
তাঁকে কেন মহারাজ!
বৈরাগ্য সাধন করব।
সেই খবর শুনেই তো ছুটে এসেছি, এ সাধনায় আমিই ত আপনার সহচর।
তুমি!
হাঁ মহারাজ, আমরাই তো পৃথিবীতে আছি মানুষের আসক্তি মোচন করবার জন্য।
বুঝতে পারলুম না।
এতদিন কাব্য শুনিয়ে এলুম তবু বুঝতে পারলেন না? আমাদের কথার মধ্যে বৈরাগ্য, সুরের মধ্যে বৈরাগ্য, ছন্দের মধ্যে বৈরাগ্য। সেইজন্যই তো লক্ষ্মী আমাদের ছাড়েন, আমরাও লক্ষ্মীকে ছাড়বার জন্যে যৌবনের কানে মন্ত্র দিয়ে বেড়াই।
তোমাদের মন্ত্রটা কী।
আমাদের মন্ত্র এই যে, ওরে ভাই ঘরের কোণে তোদের থলি-থালি আঁকড়ে বসে থাকিস নে--বেরিয়ে পড়্ প্রাণের সদর রাস্তায় ওরে যৌবনের বৈরাগীর দল।
সংসারের পথটাই বুঝি তোমার বৈরাগ্যের পথ হল?
তা নয়তো কী মহারাজ! সংসারে যে কেবলই সরা, কেবলই চলা; তারই সঙ্গে সঙ্গে যে-লোক একতারা বাজিয়ে নৃত্য করতে করতে কেবলই সরে, কেবলই চলে, সে-ই তো বৈরাগী, সে-ই তো পথিক, সে-ই তো কবি-বাউলের চেলা।
তা হলে শান্তি পাব কী করে।
শান্তির উপরে তো আমাদের একটুও আসক্তি নেই, আমরা যে বৈরাগী।
কিন্তু ধ্রুব সম্পদটি তো পাওয়া চাই।
ধ্রুব সম্পদে আমাদের একটুও লোভ নেই, আমরা যে বৈরাগী।
সে কী কথা। –বিপদ বাধাবে দেখছি। ওরে শ্রুতিভূষণকে ডাক্।
আমরা অধ্রুব মন্ত্রের বৈরাগী। আমরা কেবলই ছাড়তে ছাড়তে পাই, তাই ধ্রুবটাকে মানি নে।
এ তোমার কিরকম কথা।
পাহাড়ের গুহা ছেড়ে যে-নদী বেরিয়ে পড়েছে তার বৈরাগ্য কি দেখেন নি মহারাজ। সে অনায়াসে আপনাকে ঢেলে দিতে দিতেই আপনাকে পায়। নদীর পক্ষে ধ্রুব হচ্ছে বালির মরুভূমি– তার মধ্যে সেঁধলেই বেচারা গেল। তার দেওয়া যেমনি ঘোচে অমনি তার পাওয়াও ঘোচে।
ঐ শোনো কবিশেখর, কান্না শোনো। ঐ তো তোমার সংসার!
ওরা মহারাজের দুর্ভিক্ষকাতর প্রজা।
আমার প্রজা? বল কী কবি। সংসারের প্রজা ওরা। এ দুঃখ কি আমি সৃষ্টি করেছি। তোমার কবিত্বমন্ত্রের বৈরাগীরা এ দুঃখের কী প্রতিকার করতে পারে বলো তো।
মহারাজ,এ দুঃখকে তো আমরাই বহন করতে পারি। আমরা যে নিজেকে ঢেলে দিয়ে বয়ে চলেছি। নদী কেমন ক'রে ভার বহন করে দেখেছেন তো? মাটির পাকা রাস্তাই হল যাকে বলেন ধ্রুব, তাই তো ভারকে কেবলই সে ভারী করে তোলে; বোঝা তার উপর দিয়ে আর্তনাদ করতে করতে চলে, আর তারও বুক ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। নদী আনন্দে বয়ে চলে, তাই তো সে আপনার ভার লাঘব করেছে ব'লেই বিশ্বের ভার লাঘব করে। আমরা ডাক দিয়েছি সকলের সব সুখ-দুঃখকে চলার লীলায় বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে। আমাদের বৈরাগীর ডাক। আমাদের বৈরাগীর সর্দার যিনি, তিনি এই সংসারের পথ দিয়ে নেচে চলেছেন, তাই তো বসে থাকতে পারি নে–
পথ দিয়ে কে যায় গো চলে
ডাক দিয়ে সে যায়।
আমার ঘরে থাকাই দায়।
পথের হাওয়ায় কী সুর বাজে,
বাজে আমার বুকের মাঝে,
বাজে বেদনায়।
আমার ঘরে থাকাই দায়।
পূর্ণিমাতে সাগর হতে
ছুটে এল বান,
আমার লাগল প্রাণে টান।
আপন মনে মেলে আঁখি
আর কেন বা পড়ে থাকি
কিসের ভাবনায়।
আমার ঘরে থাকাই দায়॥
যাক গে শ্রুতিভূষণ। ওহে কবিশেখর, আমার কী মুশকিল হয়েছে জানো। তোমার কথা আমি এক বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারি নে অথচ তোমার সুরটা আমার বুকে নিয়ে বাজে। আর শ্রুতিভূষণের ঠিক তার উলটো। তার কথাগুলো খুবই স্পষ্ট বোঝা যায় হে– ব্যাকরণের সঙ্গেও মেলে– কিন্তু সুরটা– সে কী আর বলব।
মহারাজ, আমাদের কথা তো বোঝবার জন্যে হয় নি, বাজবার জন্যে হয়েছে।
এখন তোমার কাজটা কী বলো তো কবি।
মহারাজ, ঐ যে তোমার দরজার বাইরে কান্না উঠেছে ঐ কান্নার মাঝখান দিয়ে এখন ছুটতে হবে।
ওহে কবি, বল কী তুমি। এ-সমস্ত কেজো লোকের কাজ, দুর্ভিক্ষের মধ্যে তোমরা কী করবে।
কেজো লোকেরা কাজ বেসুরো করে ফেলে, তাই সুর বাঁধবার জন্যে আমাদের ছুটে আসতে হয়।
ওহে, কবি, আর-একটু স্পষ্ট ভাষায় কথা কও।
মহারাজ, ওরা কর্তব্যকে ভালোবাসে ব'লে কাজ করে, আমরা প্রাণকে ভালোবাসি ব'লে কাজ করি– এইজন্যে ওরা আমাদের গাল দেয়, বলে নিষ্কর্মা, আমরা ওদের গাল দিই, বলি নির্জীব।
কিন্তু জিতটা হল কার।
আমাদের, মহারাজ, আমাদের।
তার প্রমাণ?
পৃথিবীতে যা-কিছু সকলের বড়ো তার প্রমাণ নেই। পৃথিবীতে যত কবি যত কবিত্ব সমস্ত যদি ধুয়ে-মুছে ফেলতে পার তা হলেই প্রমাণ হবে এতদিন কেজো লোকেরা তাদের কাজের জোরটা কোথা থেকে পাচ্ছিল, তাদের ফসলখেতের মূলের রস জুগিয়ে এসেছে কারা। মহারাজ, আপনার দরজার বাইরে ঐ-যে কান্না উঠেছে সে কান্না থামায় কারা। যারা বৈরাগ্যবারিধির তলায় ডুব মেরেছে তারা নয়, যারা বিষয়কে আঁকড়ে ধরে রয়েছে তারা নয়, যারা কাজের কৌশলে হাত পাকিয়েছে তারাও নয়, যারা কর্তব্যের শুষ্ক রুদ্রাক্ষের মালা জপছে তারাও নয়, যারা অপর্যাপ্ত প্রাণকে বুকের মধ্যে পেয়েছে ব'লেই জগতের কিছুতে যাদের উপেক্ষা নেই, জয় করে তারা, ত্যাগ করেও তারাই, বাঁচতে জানে তারা, মরতেও জানে তারা, তারা জোরের সঙ্গে দুঃখ পায়, তারা জোরের সঙ্গে দুঃখ দূর করে– সৃষ্টি করে তারাই, কেননা তাদের মন্ত্র আনন্দের মন্ত্র, সব চেয়ে বড়ো বৈরাগ্যের মন্ত্র।
ওহে কবি, তা হলে তুমি আমাকে কী করতে বল।
উঠতে বলি মহারাজ, চলতে বলি। ঐ-যে কান্না, ও-যে প্রাণের কাছে প্রাণের আহ্বান। কিছু করতে পারব কি না সে পরের কথা– কিন্তু ডাক শুনে যদি ভিতরে সাড়া না দেয়, প্রাণ যদি না দুলে ওঠে তবে অকর্তব্য হল ব'লে ভাবনা নয়, তবে ভাবনা মরেছি ব'লে।
কিন্তু মরবই যে কবিশেখর, আজ হোক আর কাল হোক।
কে বললে মহারাজ, মিথ্যা কথা। যখন দেখছি বেঁচে আছি তখন জানছি যে বাঁচবই; যে আপনার সেই বাঁচাটাকে সব দিক থেকে যাচাই করে দেখলে না সে-ই বলে মরব– সে-ই বলে "নলিনীদলগত জলমতি তরলং তদ্বৎ জীবনমতিশয় চপলং।"
কী বল হে কবি, জীবন চপল নয়?
চপল বৈকি, কিন্তু অনিত্য নয়। চপল জীবনটা চিরদিন চপলতা করতে করতেই চলবে। মহারাজ, আজ তুমি তার চপলতা বন্ধ ক'রে মরবার পালা অভিনয় আরম্ভ করতে বসেছ।
ঠিক বলছ কবি? আমরা বাঁচবই?
বাঁচবই।
যদি বাঁচবই তবে বাঁচার মতো করে বাঁচতে হবে–কী বল।
হাঁ মহারাজ।
প্রতিহারী!
কী মহারাজ।
ডাকো, ডাকো মন্ত্রীকে এখনি ডাকো।
কী মহারাজ।
মন্ত্রী, আমাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছ কেন।
ব্যস্ত ছিলুম।
কিসে।
বিজয়বর্মাকে বিদায় করে দিতে।
কী মুশকিল। বিদায় করবে কেন। যুদ্ধের পরামর্শ আছে যে।
চীনের সম্রাটের দূতের জন্যে বাহনের ব্যবস্থা।
কেন, বাহন কিসের।
মহারাজের তো দর্শন হবে না, তাই তাঁকে ফিরিয়ে দেবার–
মন্ত্রী, আশ্চর্য করলে দেখছি– রাজকার্য কি এমনি করেই চলবে। হঠাৎ তোমার হল কী।
তার পরে আমাদের কবিশেখরের বাসা ভাঙবার জন্যে লোকের সন্ধান করছিলুম– আর তো কেউ রাজি হয় না, কেবল দিঙনাগের বংশে যাঁরা অলংকারের আর ব্যাকরণ-শাস্ত্রের টোল খুলেছেন তাঁরা দলে দলে শাবল হাতে ছুটে আসছেন।
সর্বনাশ! মন্ত্রী, পাগল হলে নাকি। কবিশেখরের বাসা ভেঙে দেবে?
ভয় নেই মহারাজ, বাসাটা একেবারে ভাঙতে হবে না। শ্রুতিভূষণ খবর পেয়েই স্থির করেছেন কবিশেখরের ঐ বাসাটা আজ থেকে তিনিই দখল করবেন।
কী বিপদ। সরস্বতী যে তা হলে তাঁর বীণাখানা আমার মাথার উপর আছড়ে ভেঙে ফেলবেন। না, না সে হবে না।
আর-একটা কাজ ছিল– শ্রুতিভূষণকে কাঞ্চনপুরের সেই বৃহৎ জনপদটা–
ওহো, সেই জনপদটার দানপত্র তৈরি হয়েছে বুঝি? সেটা কিন্তু আমাদের এই কবিশেখরকে–
সে কী কথা মহারাজ। আমার পুরস্কার তো জনপদ নয়– আমরা জনপদের সেবা তো কখনো করি নি–তাই ঐ পদপ্রাপ্তিটা আশাও করি নে।
আচ্ছা, তবে ওটা শ্রুতিভূষণের জন্যই থাক্।
আর, মহারাজ, দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের বিদায় করবার জন্যে সৈন্যদলকে আহ্বান করেছি।
মন্ত্রী, আজ দেখছি পদে পদে তোমার বুদ্ধির বিভ্রাট ঘটছে। দুর্ভিক্ষকাতর প্রজাদের বিদায় করবার ভালো উপায় অন্ন দিয়ে, সৈন্য দিয়ে নয়।
মহারাজ!
কী প্রতিহারী।
বৈরাগ্যবারিধি নিয়ে শ্রুতিভূষণ এসেছেন।
সর্বনাশ করলে! ফেরাও তাকে ফেরাও। মন্ত্রী, দেখো হঠাৎ যেন শ্রুতিভূষণ না এসে পড়ে। আমার দুর্বল মন,হয়তো সামলাতে পারব না, হয়তো অন্যমনস্ক হয়ে বৈরাগ্যবারিধির ডুব-জলে গিয়ে পড়ব। ওহে কবিশেখর, আমাকে কিছুমাত্র সময় দিয়ো না--প্রাণটাকে জাগিয়ে রাখো– একটা যা-হয়-কিছু করো-যেমন এই ফাল্গুনের হাওয়াটা যা-খুশি-তাই করছে তেমনিতরো। হাতে কিছু তৈরি আছে হে? একটা নাটক, কিম্বা প্রকরণ, কিম্বা রূপক, কিম্বা ভান, কিম্বা–
তৈরি আছে– কিন্তু সেটা নাটক, কি প্রকরণ, কি রূপক, কি ভান তা ঠিক বলতে পারব না।
যা রচনা করেছ তার অর্থ কি কিছু গ্রহণ করতে পারব।
না মহারাজ। রচনা তো অর্থগ্রহণ করবার জন্যে নয়।
তবে?
সেই রচনাকেই গ্রহণ করবার জন্যে। আমি তো বলেছি আমার এ-সব জিনিস বাঁশির মতো, বোঝবার জন্যে নয়, বাজবার জন্যে।
বল কী হে কবি, এর মধ্যে তত্ত্বকথা কিছুই নেই?
কিচ্ছু না।
তবে তোমার ও-রচনাটা বলছে কী।
ও বলছে, আমি আছি। শিশু জন্মাবামাত্র চেঁচিয়ে ওঠে, সেই কান্নার মানে জানেন মহারাজ? শিশু হঠাৎ শুনতে পায় জলস্থল-আকাশ তাকে চার দিক থেকে ব'লে উঠেছে– "আমি আছি।" –তারই উত্তরে ঐ প্রাণটুকু সাড়া পেয়ে ব'লে ওঠে– "আমি আছি।" আমার রচনা সেই সদ্যোজাত শিশুর কান্না, বিশ্বব্রক্ষ্ণাণ্ডের ডাকের উত্তরে প্রাণের সাড়া।
তার বেশি আর কিচ্ছু না?
কিচ্ছু না। আমার রচনার মধ্যে প্রাণ বলে উঠেছে, সুখে দুঃখে, কাজে বিশ্রামে, জন্মে মৃত্যুতে, জয়ে পরাজয়ে, লোকে লোকান্তরে জয়– এই আমি-আছির জয়, জয়– এই আনন্দময় আমি-আছির জয়।
ওহে কবি, তত্ত্ব না থাকলে আজকের দিনে তোমার এ জিনিস চলবে না।
সে কথা সত্য মহারাজ। আজকের দিনের আধুনিকেরা উপার্জন করতে চায়, উপলব্ধি করতে চায় না। ওরা বুদ্ধিমান!
তা হলে শ্রোতা কাদের ডাকা যায়। আমার রাজবিদ্যালয়ের নবীন ছাত্রদের ডাকব কি।
না মহারাজ, তারা কাব্য শুনেও তর্ক করে। নতুন-শিং-ওঠা হরিণশিশুর মতো ফুলের গাছকেও গুঁতো মেরে মেরে বেড়ায়।
তবে?
ডাক দেবেন যাদের চুলে পাক ধরেছে।
সে কী কথা কবি।
হাঁ মহারাজ, সেই প্রৌঢ়দেরই যৌবনটি নিরাসক্ত যৌবন। তারা ভোগবতী পার হয়ে আনন্দলোকের ভাঙা দেখেতে পেয়েছে। তারা আর ফল চায় না, ফলতে চায়।
ওহে কবি,তবে তো এতদিন পরে ঠিক আমার কাব্য শোনবার বয়েস হয়েছে। বিজয়বর্মাকেও ডাকা যাক।
ডাকুন।
চীন-সম্রাটের দূতকে?
ডাকুন।
আমার শ্বশুর এসেছেন শুনছি–
তাঁকে ডাকতে পারেন– কিন্তু শ্বশুরের ছেলেগুলির সম্বন্ধে সন্দেহ আছে।
তাই বলে শ্বশুরের মেয়ের কথাটা ভুলো না কবি।
আমি ভুললেও তাঁর সম্বন্ধে ভুল হবার আশঙ্কা নেই।
আর শ্রুতিভূষণকে?
না মহারাজ, তাঁর প্রতি তো আমার কিছুমাত্র বিদ্বেষ নেই, কেন দুঃখ দিতে যাব।
কবি, তা হলে প্রস্তুত হও গে।
না মহারাজ, আমি অপ্রস্তুত হয়েই কাজ করতে চাই। বেশি বানাতে গেলেই সত্য ছাই-চাপা পড়ে।
চিত্রপট–
চিত্রপট প্রয়োজন নেই– আমার দরকার চিত্তপট– সেইখানে শুধু সুরের তুলি বুলিয়ে ছবি জাগাব।
এ নাটকে গান আছে নাকি।
হাঁ মহারাজ, গানের চাবি দিয়েই এর এক-একটি অঙ্কের দরজা খোলা হবে।
গানের বিষয়টা কী।
শীতের বস্ত্রহরণ।
এ তো কোনো পুরাণে পড়া যায় নি।
বিশ্বপুরাণে এই গীতের পালা আছে। ঋতুর নাট্যে বৎসরে শীত-বুড়োটার ছদ্মবেশ খসিয়ে তার বসন্ত-রূপ প্রকাশ করা হয়, দেখি পুরাতনটাই নূতন।
এ তো গেল গানের কথা, বাকিটা?
বাকিটা প্রাণের কথা।
সে কী রকম।
যৌবনের দল একটা বুড়োর পিছনে ছুটে চলেছে। তাকে ধরবে বলে পণ। গুহার মধ্যে ঢুকে যখন ধরলে তখন–
তখন কী দেখলে।
কী দেখলে সেটা যথাসময়ে প্রকাশ হবে।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারলুম না। তোমার গানের বিষয় আর তোমার নাট্যের বিষয়টা আলাদা নাকি।
না মহারাজ, বিশ্বের মধ্যে বসন্তের যে লীলা চলছে আমাদের প্রাণের মধ্যে যৌবনের সেই একই লীলা। বিশ্বকবির সেই গীতিকাব্য থেকেই তো ভাব চুরি করেছি।
তোমার নাটকের প্রধান পাত্র কে কে।
এক হচ্ছে সর্দার।
সে কে।
যে আমাদের কেবলই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর-একজন হচ্ছে চন্দ্রহাস।
সে কে।
যাকে আমরা ভালোবাসি– আমাদের প্রাণকে সে-ই প্রিয় করেছে।
আর কে আছে।
দাদা– প্রাণের আনন্দটাকে যে অনাবশ্যক বোধ করে, কাজটাকেই যে সার মনে করেছে।
আর কেউ আছে?
আর আছে এক অন্ধ বাউল।
অন্ধ?
হাঁ মহারাজ, চোখ দিয়ে দেখে না বলেই সে তার দেহ মন প্রাণ সমস্ত দিয়ে দেখে। তোমার নাটকের প্রধান পাত্রদের মধ্যে আর কে আছে।
আপনি আছেন।
আমি!
হাঁ মহারাজ, আপনি যদি এর ভিতরে না থেকে বাইরেই থাকেন তা হলে কবিকে গাল দিয়ে বিদায় করে ফের শ্রুতিভূষণকে নিলে বৈরাগ্যবারিধির চৌপদী ব্যাখ্যায় মন দেবেন। তা হলে মহারাজের আর মুক্তির আশা নেই। স্বয়ং বিশ্বকবি হার মানবেন--ফাল্গুনের দক্ষিণ হাওয়া দক্ষিণা না পেয়েই বিদায় হবে।
১৫ ফাল্গুন, ১৩২২