রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের গান

১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে টমাস আলভা এডিসন ফোনোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। এর প্রায় ১১ বছর পর ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের সেন্ট জেফিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ফাদার লাফোঁ-এর কল্যাণে এর উন্নতর সংস্করণ, কলকাতায় এসেছিল। এই যন্ত্রটি নিয়ে অধ্যাপক লাফোঁর প্রিয় ছাত্র জগদীশচন্দ্র বসু কিছু গবেষণা কর্ম করেন। আর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে এই যন্ত্র এসেছিল আরো কিছু পরে। তবে ঠিক কখন ঠাকুরবাড়িতে ফনোগ্রাফ এসেছিল, তার সুনির্দিষ্ট সময় পাওয়া যায় না।

খামখেয়ালি সভার প্রথম অধিবেশন হয় ২৪ মাঘ ১৩০৩ বঙ্গাব্দে [শুক্রবার ৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ]। এই সভা উপলক্ষে একটি নিমন্ত্রণপত্র রচনা করা হয়েছিল। নিমন্ত্রণকর্তা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ। এই অনুষ্ঠানের ছিল রাধিকা গোস্বামীর গান, অক্ষয় মজুমদার কর্তৃক 'বিনি পয়সার ভোজ' কবিতা আবৃত্তি। এরপরে ছিল 'ফোনোগ্রাফ যন্ত্র শ্রবণ'। এই যন্ত্রবাদনের পর ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত 'কুহেলিকা' নামক গল্পের পাঠ। এরপর ছিল গান বাজনা এবং বাঙ্গালা জলপান। অর্থাৎ এই সময়ের কাছাকাছি সময়ে ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা 'ফোনোগ্রাফ যন্ত্র'-এর সংস্পর্শে এসেছিলেন।

এই সময় আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে যখন সঙ্গীতের রেকর্ডের ক্রমেই বেড়ে চলেছিল। এই সূত্রে তৎকালীন সফল প্রসাদন- ব্যবসায়ী হেমেন্দ্রনাথ বসু রেকর্ড কোম্পানি খোলার উদ্যোগ নেন। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতীয় ভাষায় গান আবৃত্তির ৪৪টি রেকর্ড প্রকাশ করেছিলেন। এই সময় ভারতবর্ষে শব্দধারণ করার ব্যবস্থা ছিল না। তাই এই রেকর্ডগুলো প্রকাশিত হয়েছিল লণ্ডন থেকে। এই রেকর্ডগুলোর   শিল্পী তালিকায় ছিলেন ক্যাপ্টেন ভোলানাথ, হরনাম দাস এবং আহমেদ। উল্লেখ্য এই রেকর্ডগুলোর এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নাই। তবে গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ড তালিকায় এসব রেকর্ডের নাম পাওয়া যায়।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় ভাষায় গান এবং আবৃত্তি প্রকাশের
ভারতে রেকর্ড ব্যবস্থা চালু করার জন্য জে ডব্লিউ কোম্পানির পক্ষে কলকাতায় একটি অফিস খোলেন। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে গ্রামোফোন কোম্পানীর পক্ষ থেকে W Gaisberg  কলকাতা থেকে রেকর্ড প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এর ভারতীয় শিল্পীদের গানের চাহিদা বুঝে, হেমেন্দ্রনাথ বসু কলকাতাস্থ 'ধর্মতলার মার্বেল হাউসে দ্য টকিং মেশিন হল (The Talking Machine Hall) নামে রেকর্ড তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। এই রেকর্ড ছিল ফনোগ্রামের সিলিন্ডার। পরে বৌবাজার স্ট্রীটের দেলখোস হাউসে এই কারখানা স্থানন্তরিত হয়। তাঁর রেকর্ড কোম্পানির নাম ছিল এইচ.বোসেস।

১৯০৫-১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে, এইচ. বোসেস রেকর্ডে মোমের সিলিণ্ডার রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে রেকর্ডে গ্রহণ করা হয়েছিল। পরে এই রেকর্ডগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এই গানগুলো ছিল।


        ৩৫১   
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
        ৩৫২    আমরা পথে পথে যাব
        ৩৫৩    ও আমার দেশের মাটি
        ৩৫৪    বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি
        ৩৫৫     নিশিদিন ভরসা রাখিস
        ৩৫৬    এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে
        ৩৫৭     যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
        ৩৫৮    আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে
        ৩৫৯    যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক
        ৩৬০    যে তোরে পাগল বলে
        ৩৬১‌‌‌    যদি তোর ভাবনা থাকে
        ৩৬২    আপনি অবশ হলি
        ৩৬৩    তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে
        ৩৬৩    অয়ি ভুবন মোহিনী
        ৩৬৪    ঘরে মুখ মলিন দেখে

১৯০৮ থেকে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে প্যাথে-এইচ বোসের রেকর্ড থেকে রবীন্দ্রনাথ-সহ বেশ কিছু শিল্পী রবীন্দ্রনাথে গান প্রকাশিত হয়েছিল।

স্বদেশী গান প্রচারের জন্য তিনি তাঁর প্রধান শিল্পী হিসাবে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে । তাঁর তৈরি রেকর্ডে লালচাঁদ বড়াল বহু গান দিয়েছিলেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে এইচ.বসুর সিলিণ্ডার রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে প্রথম গান রেকর্ড করা হয়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি, The Bengali পত্রিকার ফনোগ্রাফ ও এইস বসুর রেকর্ডকৃত গানের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়।

রবীন্দ্রনাথের গীত গানের সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। উক্ত বিজ্ঞাপনটি এরূপ ছিল -H. Bose's Records/songs composed and sung by babu Rabindra Nath Tagore.

সিদ্ধার্থ ঘোষ যন্ত্ররসিক এইচ বোস প্রবন্ধে মার্চ ১৯০৬ এ প্রকাশিত এইচ বোস রেকর্ডস-এর ক্যাটালগের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত আটটি গান ছাড়া আরও ছটি গানের সন্ধান দিয়েছেন

পথের গান-আমরা পথে পথে যাব সারে সারে
দ্বিধা-বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি
বাউল-২, যে তোরে পাগল বলে
আপনি অবশ হলি, তবে বল্ দিবি তুই কারে
প্রয়াস-তোর আপন জনে ছড়াবে তোরে
বাউল-ঘরে মুখ মলিন দেখে

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ইন্ডাস্ট্রিয়াল এগজিবিশানে তাঁর তৈরি সম্পূর্ণ স্বদেশী সিলিন্ডার রেকর্ড স্বর্ণ পদক লাভ করে।

১৯০২ থেকে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি প্রায় ৫০০০ হাজার রেকর্ড প্রকাশ করে। এর সব রেকর্ড ইউরোপ থেকে মুদ্রিত হয়েছিল।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তাঁর কোম্পানির নামকরণ হয়, Pathe/H.Boses's Records এগুলো ছিল সাড়ে ৮ ইঞ্চি মাপের সমতল ডিস্ক।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলা গানের নতুন ধারার সূচনা হয়েছিল সবাক্ চলচ্চিত্রের ব্যবহৃত গানের সূত্রে। এই সূত্রে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে রেকর্ডের গানের প্রচার ও প্রসারের পথ খুলে গিয়েছিল তিনটি  রেকর্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এই কোম্পানিগুলো হলো-

রেকর্ডের গান জনপ্রিয় হয়ে উঠার সাথে সাথে নতুন নতুন গানের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল। সঙ্গীতপ্রেমিকদের কাছে ঘরে বসে চলচ্চিত্রের গানের রেকর্ডের পাশাপাশি, নানা ধরনের গান শোনার আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠেছিল। ফলে রেকর্ড কোম্পানিগুলো নতুন নতুন গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীর সন্ধান করা শুরু করে। এই সূত্রে এই সময় থেকে নতুন নতুন গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে রেকর্ডের মাধ্যমে। এই সূত্রে বাংলা গানের নতুন নতুন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল। রেকর্ডের গানের আগে চিরাচরিত কীত্র্তন, ভক্তিমূলক গান, টপ্পা অঙ্গের গান প্রচলিত ছিল। সে সব শুনতে হতো আসরে বসে। সমগ্র বঙ্গদেশের সঙ্গীতপ্রেমিকদের ৯৯ ভাগ মানুষের পক্ষে গুণীশিল্পদের গান আসরে বসে শোনার সৌভাগ্য হতো না। এমন কি তাঁরা বাংলা গানের বিচিত্র রূপের সংস্পর্শে আসার সুযোগই পায় নি। রেকর্ডের গানের মাধ্যমে- গুণী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পদের গান, বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগান, চলচ্চিত্রের গান, সেকালের আধুনিক গান রেকর্ডের বদৌলতে ঘরের ভিতরে চলে এলো। এ কথা সত্য আর্থিক ক্ষমতার বিচারে পয়সা খরচ করে সকলের কলের গান শোনার সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু ধনী লোকের বৈঠকখানায় জড় হয়ে,আশপাশের অনেকেরই সে গান শোনার সৌভাগ্য হতো। এই ধারায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রসার ঘটেছিল।

            [দেখুন: সেকালের রেকর্ডে ধৃত রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিকা]

সূত্র: