বিষয়: রবীন্দ্রসঙ্গীত।
গান সংখ্যা :
শিরোনাম: নয়ান
ভাসিল জলে
পাঠ ও পাঠভেদ:
নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বশী।
গোষ্ঠে যবে নামে সন্ধ্যা শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি
তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বালো সন্ধ্যাদীপখানি।
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাতে
স্মিতহাস্যে নাহি চল লজ্জিত বাসরশয্যাতে অর্ধরাতে।
উষার উদয়-সম অনবগুণ্ঠিতা তুমি অকুণ্ঠিতা॥
সুরসভাতলে যবে নৃত্য করো পুলকে উল্লসি
হে বিলোল হিল্লোল উর্বশী,
ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল,
শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল,
তোমার মদির গন্ধ অন্ধ বায়ু বহে চারি ভিতে,
মধুমত্ত ভৃঙ্গ-সম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধ চিতে উদ্দাম গীতে।
নূপুর গুঞ্জরি চলো আকুল-অঞ্চলা বিদ্যুতচঞ্চলা॥
পাণ্ডুলিপির পাঠ:
পাঠভেদ:
গীতবিতানের গ্রন্থ পরিচয় অংশে এই গানটি সম্পর্কে উল্লেখ আছে —
"...'নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধু' — 'উর্বশী' (২৩ অগ্রহায়ণ ১৩০২) কবিতার সংক্ষেপীকৃত ও পরিবর্তিত গীতরূপ। কবির জীবনকালে 'শাপমোচন'এর শেষ অভিনয় শান্তিনিকেতনে, ১৩৪৮ পৌষে। তদুদ্দেশে ১৩৪৭ অগ্রহায়ণে রচিত গানের পাঠ শ্রীশান্তিদেব ঘোষের সৌজন্যে পাওয়া গিয়াছে, এবং সম্প্রতি প্রথম স্তবকটি শ্রীশান্তিদেব ঘোষ গ্রামোফোন রেকর্ডেও গাহিয়াছেন।"
উল্লেখ্য, গীতবিতানে এই গানের দুটি স্তবক রয়েছে। কিন্তু স্বরবিতানে স্বরবিতান দ্বিষষ্টিতম খণ্ডে (চৈত্র ১৪১৩) স্বরলিপি পাওয়া যায় শুধু প্রথম স্তবকের।
ভাবসন্ধান:
এই গানটির 'উর্বশী' হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে, স্বর্গের নর্তকী। রবীন্দ্রনাথ চিত্রা কাব্যের 'উর্বশী' শিরোনামের কবিতার উর্বশী চরিত্রকে দেখেছেন পৌরাণিক 'উর্বশী'র মতো করে নয়। তিনি এ বিষয়ে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যয়কে লিখিত একটি পত্রে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এই ভাবে-,
"উর্বশী যে কী, কোনো ইংরেজি তাত্ত্বিক শব্দ দিয়ে তার সংজ্ঞা নির্দেশ করতে চাই নে, কাব্যের মধ্যেই তার অর্থ আছে। এক হিসেবে সৌন্দর্যমাত্রই অ্যাব্সট্র্যাক্ট্—সে তো বস্তু নয়, সে একটা প্রেরণা যা আমাদের অন্তরে রসসঞ্চার করে। নারীর মধ্যে সৌন্দর্যের যে প্রকাশ উর্বশী তারই প্রতীক। সে সৌন্দর্য আপনাতেই আপনার চরম লক্ষ্য— সেইজন্য কোনো কর্তব্য যদি তার পথে এসে পড়ে তবে সে কর্তব্য বিপর্যস্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে কেবল অ্যাব্স্ট্র্যাক্ট সৌন্দর্যের টান আছে তা নয়, কিন্তু যেহেতু নারীরূপকে অবলম্বন করে এই সৌন্দর্য সেইজন্য তার সঙ্গে স্বভাবত নারীর মোহও আছে। শেলি যাকে ইন্টেলেক্চুয়াল বিউটি বলেছেন, উর্বশীর সঙ্গে তাকেই অবিকল মেলাতে গিয়ে যদি ধাঁধা লাগে তবে সেজন্যে আমি দায়ী নই। গোড়ার লাইনে আমি যার অবতারণা করেছি সে ফুলও নয়, প্রজাপতিও নয়, চাঁদ ও নয়, গানের সুরও নয়— সে নিছক নারী— মাতা কন্যা বা গৃহিণী সে নয়— যে নারী সাংসারিক সম্বন্ধের অতীত, মোহিনী, সেই।
মনে রাখতে হবে উর্বশী কে। সে ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী নয়, বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী নয়, সে স্বর্গের নর্তকী, দেবলোকের অমৃতপানসভার সখী।
দেবতার ভোগ নারীর মাংস নিয়ে নয়, নারীর সৌন্দর্য নিয়ে। হোক-না সে দেহের সৌন্দর্য, কিন্তু সেই তো সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা। সৃষ্টিতে এই রূপসৌন্দর্যের চরমতা মানবেরই রূপে। সেই মানবরূপের চরমতাই স্বর্গীয়। উর্বশীতে সেই দেহসৌন্দর্য ঐকান্তিক হয়েছে, অমরাবতীর উপযুক্ত হয়েছে। সে যেন চিরযৌবনের পাত্রে রূপের অমৃত; তার সঙ্গে কল্যাণ মিশ্রিত নেই। সে অবিমিশ্র মাধুর্য।
কামনার সঙ্গে লালসার পার্থক্য আছে। কামনায় দেহকে আশ্রয় করেও ভাবের প্রাধান্য, লালসায় বস্তুর প্রাধান্য। রসবোধের সঙ্গে পেটুকতার যে তফাত এতেও সেই তফাত। ভোজনরসিক যে, ভোজ্যকে অবলম্বন করে এমন কিছু যে আস্বাদন করে যাতে তার রুচির উৎকর্ষ সপ্রমাণ করে। পেটুক যে, তার ভোগের আদর্শ পরিমাণগত, রসগত নয়। সৌন্দর্যের যে আদর্শ নারীতে পরিপূর্ণতা পেয়েছে যদিও তা দেহ থেকে বিশ্লিষ্ট নয়, তবুও তা অনির্বচনীয়। উর্বশীতে সেই অনির্বচনীয়তা দেহ ধারণ করেছে, সুতরাং তা অ্যাব্সট্র্যাক্ট্ নয়।
মানুষ সত্যযুগ এবং স্বর্গ কল্পনা করেছে। প্রতিদিনের সংসারে অসমাপ্তভাবে খণ্ডভাবে যে পূর্ণতার সে আভাস পায়, সে যে অ্যাব্সট্র্যাক্ট্ভাবে কেবলমাত্র তার ধ্যানেই আছে, কোনোখানেই তা বিষয়ীকৃত হয় নি, এ কথা মানতে তার ভালো লাগে না। তাই তার পুরাণে স্বর্গলোকের অবতারণা। যা আমাদের ভাবে রয়েছে অ্যাব্সট্র্যাক্ট্ স্বর্গে তাই পেয়েছে রূপ। যেমন, যে কল্যাণের পূর্ণ আদর্শ সংসার প্রত্যহ দেখতে পাই নে, অথচ যা আছে আমাদের ভাবে, সত্যযুগে মানুষের মধ্যে তাই ছিল বাস্তবরূপে এই কথা মনে করে তৃপ্তি পাই। তেমনি এই কথা মনে করে আমাদের তৃপ্তি যে, নারীরূপের যে অনিন্দনীয় পূর্ণতা আমাদের মন খোঁজে তা অবাস্তব নয়, স্বর্গে তার প্রকাশ উর্বশী-মেনকা-তিলোত্তমায়। সেই বিগ্রহিণী নারীমূর্তির বিস্ময় ও আনন্দ উর্বশী কবিতায় বলা হয়েছে।
অন্তত পৌরাণিক কল্পনায় এই উর্বশী একদিন সত্য ছিল, যেমন সত্য তুমি আমি। তখন মর্তলোকেও তার আনাগোনা ঘটত, মানুষের সঙ্গেও তার সম্বন্ধ ছিল; সে সম্বন্ধ অ্যাব্সট্র্যাক্ট্ নয়, বাস্তব। যথা পুরুরবার সঙ্গে তার সম্বন্ধ। কিন্তু কোথায় গেল সেদিনকার সেই উর্বশী। আজ তার ভাঙাচোরা পরিচয় ছড়িয়ে আছে অনেক মোহিনীর মধ্যে, কিন্তু সেই পূর্ণতার প্রতিমা কোথায় গেল!
ফিরিবে না, ফিরিবে না, অন্ত গেছে সে গৌরবশশী!
একটা কথা মনে রেখো। উর্বশীকে মনে করে যে সৌন্দর্যের কল্পনা কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে, লক্ষ্মীকে অবলম্বন করলে সে আদর্শ অন্যরকম হত; হয়তো তাতে শ্রেয়স্তত্ত্বের উচুসুর লাগত। কিন্তু রসিক লোকে কাব্যের বিচার এমন করে করে না। উর্বশী উর্বশীই, তাকে যদি নীতি-উপদেশের খাতিরে লক্ষ্মী করে গড়তুম তা হলে ধিক্কারের যোগ্য হতুম।
[সূত্র: রবিরশ্মি, প্রথম খণ্ড চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কলেজস্ট্রিট সংস্করণ, ১৪১৯। পৃষ্ঠা: ৩৭৫-৩৭৬ ]
গ্রন্থ:
- কাব্যগ্রন্থাবলী [আদি ব্রাহ্মসমাজ প্রেস, ১৩০৩।
- গীতবিতান -এর নাট্যগীতি (শাপমোচন গীতি আলেখ্য) পর্যায়ের ১১৪ সংখ্যক গান।
- (আদি ব্রাহ্মসমাজ যন্ত্র, ফাল্গুন ১৩০২ বঙ্গাব্দ)। শিরোনাম: উর্বশী। শুধু প্রথম স্তবক সুর সংযোজিত। পৃষ্ঠা: ৯৫][নমুনা]
রবীন্দ্ররচনাবলী (চরতুর্থ খণ্ড)। বিশ্বভারতী। আশ্বিন ১৩৭২। শিরোনাম: উর্বশী। পৃষ্ঠা: ৮২-৮৪
স্বরলিপিকার: প্রফুল্লকুমার দাস [ শান্তিদেব ঘোষ-এর গ্রামোফোন রেকর্ডে গাওয়া গান অনুসারে]
সুর ও তাল:
স্বরবিতান দ্বিষষ্টিতম (৬২) খণ্ডে (চৈত্র ১৪১৩) গৃহীত গানটির স্বরলিপিতে রাগ-তালের উল্লেখ নেই। উক্ত স্বরলিপিটি ৪।৪ মাত্রা কাহারবা তালে নিবদ্ধ।
রাগ: মিশ্র কানাড়া। তাল: কাহারবা। [রবীন্দ্রসংগীত : রাগ-সুর নির্দেশিকা। সুধীর চন্দ। (প্যাপিরাস, ডিসেম্বর, ২০০৬)] পৃষ্ঠা: ৬১
রাগ: কাফি। তাল: কাহারবা [রাগরাগিণীর এলাকায় রবীন্দ্রসংগীত। প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমী, জুলাই ২০০১। পৃষ্ঠা: ১০৭]
গ্রহস্বর: সা