দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম, হে স্বদেশ, ফের সেই কথা জানলাম। জানে না তো কেউ পৃথিবী উঠছে কেঁপে ধরেছে মিথ্যা সত্যের টুঁটি চেপে, কখনো কেউ কি ভূমিকম্পের আগে হাতে শাঁখ নেয়, হঠাৎ সবাই জাগে? যারা আজ এত মিথ্যার দায়ভাগী, আজকে তাদের ঘৃণার কামান দাগি। ইতিহাস, জানি নীরব সাক্ষী তুমি, আমরা চেয়েছি স্বাধীন স্বদেশভূমি, অনেকে বিরূপ, কানে দেয় হাত চাপা, তাতেই কি হয় আসল নকল মাপা? বিদ্রোহী মন! আজকে ক’রো না মানা, দেব প্রেম আর পাব কলসীর কণা, দেব, প্রাণ দেব মুক্তির কোলাহলে, জীন্ ডার্ক, যীশু, সোক্রোটিসের দলে। কুয়াশা কাটছে, কাটবে আজ কি কাল, ধুয়ে ধুয়ে যাবে কুৎসার জঞ্জাল, ততদিনে প্রাণ দেব শত্রুর হাতে মুক্তির ফুল ফুটবে সে সংঘাতে। ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ, আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ॥
লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে, কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায়? কতদিন তুষ্ট থাকবে আর অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে? মনের কথা ব্যক্ত করবে ক্ষীণ অস্পষ্ট কেঁউ-কেঁউ শব্দে? ক্ষুদিত পেটে ধুকে ধুকে চলবে কতদিন? ঝুলে পড়া তোমার জিভ, শ্বাসে প্রশ্বাসে ক্লান্তি টেনে কাঁপতে থাকবে কত কাল? মাথায় মৃদু চাপড় আর পিঠে হাতের স্পর্শে কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুধা আর গলার শিকলকে? কতক্ষণ নাড়তে থাকবে লেজ?
তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো, অস্বীকার করো বশ্যতাকে। চলো, শুকনো হাড়ের বদলে সন্ধান করি তাজা রক্তের, তৈরী হোক লাল আগুনে ঝল্সানো আমাদের খাদ্য। শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে॥
স্বচ্ছ রাত্রি এনেছে প্লাবন, উষ্ণ নিবিড় ধূলি দাপটের মরুচ্ছায়ায় ঘনায় নীল। ক্লান্ত বুকের হৃৎস্পন্দন ক্রমেই ধীর হয়ে আসে তাই শেষ সম্বল তোলো পাঁচিল। ক্ষণভঙ্গুর জীবনের এই নির্বিরোধ হতাশা নিয়েই নিত্য তোমার দাদন শোধ?
শ্রান্ত দেহ কি ভীরু বেদনার অন্ধকূপে ডুবে যেতে কাঁদে মুক্তি মায়ায় ইতস্তত কত শিখণ্ডী জন্ম নিয়েছে নূতন রূপে? দুঃস্বপ্নের প্রায়শ্চিত্ত চোরের মতো। মৃত ইতিহাস অশুচি ঘুচায় ফল্গু-স্নানে; গন্ধবিধুর রুধির তবুও জোয়ার আনে।
পথবিভ্রম হয়েছে এবার, আসন্ন মেঘ। চলে ক্যারাভান ধূসর আঁধারে অন্ধগতি, সরীসৃপের পথ চলা শুরু প্রমত্ত বেগ জীবন্ত প্রাণ, বিবর্ণ চোখে অসম্মতি। অরণ্য মাঝে দাবদাহ কিছু যায় না রেখে। মনকে বাঁচাও বিপন্ন এই মৃত্যু থেকে।
সঙ্গীবিহনি দুর্জয় এই পরিভ্রমণ রক্তনেশায় এনেছে কেবলই সুখাস্বাদ, এইবারে কর মেরুদুর্গম পরিখা খনন বাইরে চলুক অযথা অধীর মুক্তিবাদ। দুর্গম পথে যাত্রী সওয়ার ভ্রান্তিবিহীন ফুরিয়ে এসেছে তন্দ্রানিঝুম ঘুমন্ত দিন।
পালাবে বন্ধু? পিছনে তোমার ঘুমন্ত ঝড় পথ নির্জন, রাত্রি বিছানো অন্ধকারে। চলো, আরো দূরে। ক্ষুদিত মরণ নিরন্তর, পুরনো পৃথিবী জেগেছে আবার মৃত্যুপারে, অহেতুক তাই হয়নি তোমার পরিখা খনন, থেমে আসে আজ বিড়ম্বনায় শ্রান্ত চরণ।
মরণের আজ সর্পিল গতি বক্রবধির— পিছনে ঝটিকা, সামনে মৃত্যু রক্তলোলুপ। বারুদের ধূম কালো ছায়া আনে, —তিক্ত রুধির ; পৃথিবী এখনো নির্জন নয়— জ্বলন্ত ধূপ। নৈঃশব্দ্যের তীরে তীরে আজ প্রতীক্ষাতে সহস্র প্রাণ বসে আছে ঘিরে অস্ত্র হাতে।।
অভুক্ত শ্বাপদচক্ষু নিঃস্পন্দ আঁধারে জ্বলে রাত্রিদিন। হে বন্ধু, পশ্চাতে ফেলি অন্ধ হিমগিরি অনন্ত বার্ধক্য তব ফেলুক নিঃশ্বাস; রক্তলিপ্ত যৌবনের অন্তিম পিপাসা নিষ্ঠুর গর্জনে আজ অরণ্য ধোঁয়ায় উঠুক প্রজ্বলি’। সপ্তরথী শোনে নাকো পৃথিবীর শৈশব ক্রন্দন, দেখে নাই নির্বাকের অশ্রুহীন জ্বালা। দ্বিধাহীন চণ্ডালের নির্লিপ্ত আদেশে। আদিম কুক্কুর চাহে ধরণীর বস্ত্র কেড়ে নিতে। উল্লাসে লেলিহজিহ্বা লুব্ধ হায়েনারা তবু কেন কঠিন ইস্পাত? জরাগ্রস্ত সভ্যতার হৃদপিণ্ড জর্জর, ক্ষুৎপিপাসা চক্ষু মেলে মরণের উপসর্গ যেন। স্বপ্নলব্ধ উদ্যমের অদৃশ্য জোয়ারে সংঘবদ্ধ বল্মীকের দল।
নেমে এসো— হে ফাল্গুনী, বৈশাখের খরতপ্ত তেজে ক্লান্ত দু’বাহু তব লৌহময় হোক বয়ে যাক শোণিতের মন্দাকিনী স্রোত; মুমূর্ষু পৃথিবী উষ্ণ, নিত্য তৃষাতুরা, নির্বাপিত আগ্নেয় পর্বত ফিরে চায় অনর্গল বিলুপ্ত আতপ। আজ কেন সূবর্ণ শৃঙ্খলে বাঁধা তব রিক্ত বজ্রপাণি, তুষারের তলে সুপ্ত অবসন্ন প্রাণ? তুমি শুধু নহ সব্যসাচী, বিস্মৃতির অন্ধকার পারে ধূসর গৈরিক নিত্য প্রান্তহীন বেলাভুমি 'পরে আত্মভোলা, তুমি ধনঞ্জয়॥
নগরে ও গ্রামে জমেছে ভিড় ভগ্ননীড়,— ক্ষুদিত জনতা আজ নিবিড়। সমুদ্রে জাগে না বাড়বানল, কী উচ্ছল, তীরসন্ধানী ব্যাকুল জল। কখনো হিংস্র নিবিড় শোকে; দাঁতে ও নখে— জাগে প্রতিজ্ঞা অন্ধ চোখে। তবু সমুদ্র সীমানা রাখে, দুর্বিপাকে দিগন্তব্যাপী প্লাবন ঢাকে। আসন্ন ঝড়ো অরণ্যময় যে বিস্ময় ছড়াবে, তার কি অযথা ক্ষয়? দেশে ও বিদেশে লাগে জোয়ার, ঘোড়সোয়ার চিনে নেবে দৃঢ় লোহার, যে পথে নিত্য সূর্যোদয় আনে প্রলয়, সেই সীমান্তে বাতাস বয়; তাই প্রতীক্ষা— ঘনায় দিন স্বপ্নহীন॥
বেজে উঠলো কি সময়ের ঘড়ি? এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি, আমরা সবাই যে যার প্রহরী উঠুক ডাক।
উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে— ভীরুরা থাক।
মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি, চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি রুখবে কে আর এ অগ্রগতি, সাধ্য কার?
রুটি দেবে নাকো? দেবে না অন্ন? এ লড়াইয়ে তুমি নও প্রসন্ন? চোখ-রাঙানিকে করি না গণ্য ধারি না ধার।
খ্যাতির মুখেতে পদাঘাত করি, গড়ি, আমরা যে বিদ্রোহ গড়ি, ছিঁড়ি দু’হাতের শৃঙ্খলদড়ি, মৃত্যুপণ।
দিক থেকে দিকে বিদ্রোহ ছোটে, বসে থাকবার বেলা নেই মোটে, রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে পূর্বকোণ।
ছিঁড়ি, গোলামির দলিলকে ছিঁড়ি, বেপরোয়াদের দলে গিয়ে ভিড়ি খুঁজি কোনখানে স্বর্গের সিঁড়ি, কোথায় প্রাণ!
দেখব, ওপারে আজো আছে কারা, খসাব আঘাতে আকাশের তারা, সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া, ছড়াব দান। জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান॥
অনেক গড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হল, ব্যর্থ বহু উদ্যম আমার, নদীতে জেলেরা ব্যর্থ, তাঁতী ঘরে, নিঃশব্দ কামার, অর্ধেক প্রাসাদ তৈরী, বন্ধ ছাদ-পেটানোর গান, চাষীর লাঙল ব্যর্থ, মাঠে নেই পরিপূর্ণ ধান। যতবার গড়ে তুলি, ততবার চকিত বন্যায়। উদ্যত সৃষ্টিকে ভাঙে পৃথিবীতে অবাধ অন্যায়। বার বার ব্যর্থ, তাই আজ মনে এসেছে বিদ্রোহ, নির্বিঘ্নে গড়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে; ছিন্নভিন্ন মোহ। আজকে ভাঙার স্বপ্ন, —অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙার, বিপদ ধ্বংসেই মুক্তি, অন্য পথ দেখি নাকো আর। তাইতো তন্দ্রাকে ভাঙি, ভাঙি জীর্ণ সংস্কারের খিল, রুদ্ধ বন্দীকক্ষ ভেঙে মেলে দিই আকাশের নীল। নির্বিঘ্নে সৃষ্টিকে চাও? তবে ভাঙো বিঘ্নের বেদীকে, উদ্দাম ভাঙার অস্ত্র ছুঁড়ে দাও চারিদিকে॥
হে সাথী, আজকে স্বপ্নের দিন গোনা ব্যর্থ নয় তো, বিপুল সম্ভাবনা দিকে দিকে উদ্যাপন করছে লগ্ন, পৃথিবী সূর্য-তপস্যাতেই মগ্ন।
আজকে সামনে নিরুচ্চারিত প্রশ্ন, মনের কোমল মহল ঘিরে কবোষ্ণ ক্রমশ সফল নেপথ্যে লাঞ্ছনা, ক্রমশ পুষ্ট মিলিত উন্মাদনা।
স্বপ্নের বীজ বপন করেছি সদ্য, বিদ্যুৎবেগে ফসল সংঘবদ্ধ। হে সাথী, ফসলে শুনেছো প্রাণের গান? দুরন্ত হাওয়া ছড়ায় ঐকতান।
বন্ধু, আজকে দোদুল্যমান পৃথ্বী আমরা গঠন করব নতুন ভিত্তি; তারই সুত্রপাতকে করেছি সাধন হে সাথী, আজকে রক্তিম অভিবাদন॥
কত যুগ, কত বর্ষান্তের শেষে জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী : আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে বজ্রের কানাকানি। সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে শান্তি পালাল আজ। দিন ও রাত্রি হল অস্থির কাজ, আর শুধু কাজ! জনসিংহের ক্ষুদ্ধ নখর হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর ওঠে তার গর্জন— প্রতিশোধ, প্রতিশোধ!
হাজার হাজার শহীদ ও বীর স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন। ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধ : কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্ঝন্; প্রশ্ন নয়কো পারা না পারার, অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার দ্বার ভাঙা আজ পণ; এতদিন ধ’রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্ঝন্।
ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়, ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে আজো রোমাঞ্চকর; ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায় কে আছে আজকে ওদের ফিরায় কে ভাবে ওদের পর? ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়! নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে ওদের ফিরাব কবে? কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে কোটি মানুষের দুর্বার চাপে শৃঙ্খল গত হবে? কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে কোটি জনতার জোয়ারের জলে ভেসে যাবে কারাগার। কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার? মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি; ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে, বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে গোপনে করেছে ঋণী। মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি! হে খাতক নির্বোধ, রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ! শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো, শোনো স্বদেশের ভাই, রক্তের বিনিময় হয় হোক আমরা ওদের চাই॥
আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায় কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায় ভরে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়, জানে না কেউ। উদ্যমহীন মূঢ় কারায় পুরনো বুলির মাছি তাড়ায় যারা, তারা নিয়ে ঘোরে পাড়ায় স্মৃতির ফেউ॥
কারা যেন আজ দু’হাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল, মিছিলে আমারা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল। দুঃখ-যুগের ধারায় ধারায় যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায় তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাড়ায় হৃদয়বিল। তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল॥
কে যেন ক্ষুব্ধ ভোমরার চাকে ছুঁড়েছে ঢিল, তাই তো দগ্ধ, ভগ্ন, পুরনো পথ বাতিল। আশ্বিন থেকে বৈশাখে যারা হাওয়ার মতন ছুটে দিশেহারা, হাতের স্পর্শে কাজ হয় সারা, কাঁপে নিখিল তারা এল আজ দুর্বারগতি চলে মিছিল॥
আজকে হালকা হাওয়ায় উড়ুক একক চিল জনতরঙ্গে আমরা ক্ষিপ্ত ঢেউ ফেনিল। উধাও আলোর নিচে সমারোহ, মিলিত প্রাণের একী বিদ্রোহ! ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ, কী গতিশীল! সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল॥
একটি কথায় ব্যক্ত চেতনা : আকাশে নীল, দৃষ্টি সেখানে তাইতো পদধ্বনিতে মিল। সামনে মৃত্যুকবলিত দ্বার, থাক অরণ্য, থাক না পাহাড়, ব্যর্থ নোঙর, নদী হব পার, খুঁটি শিথিল। আমরা এসেছি মিছিলে, গর্জে ওঠে মিছিল॥
একুশে নভেম্বর : ১৯৪৬ আবার এবার দুর্বার সেই একুশে নভেম্বর— আকাশের কোণে বিদ্যুৎ হেনে তুলে দিয়ে গেল মুত্যুকাঁপানো ঝড়। আবার এদেশে মাঠে, ময়দানে সুদূর গ্রামেও জনতার প্রাণে হাসানাবাদের ইঙ্গিত হানে প্রত্যাঘাতের স্বপ্ন ভয়ঙ্কর। আবার এসেছে অবাধ্য এক একুশে নভেম্বর।। পিছনে রয়েছে একটি বছর, একটি পুরনো সাল, ধর্মঘট আর চরম আঘাতে উদ্দাম, উত্তাল; বার বার জিতে, জানি অবশেষে একবার গেছি হেরে— বিদেশী! তোদের যাদুদণ্ডকে এবার নেবই কেড়ে। শোন্ রে বিদেশী, শোন্ আবার এসেছে লড়াই জেতার চরম শুভক্ষণ! আমরা সবাই অসভ্য, বুনো— বৃথা রক্তের শোধ নেব দুনো একপা পিছিয়ে দু’পা এগোনোর আমরা করেছি পণ, ঠ’কে শিখলাম— তাই তুলে ধরি দুর্জয় গর্জন। আহ্বান আসে অনেক দূরের, হায়দ্রাবাদ আর ত্রিবাঙ্কুরের; আজ প্রয়োজন একটি সুরের একটি কঠোর স্বর : “দেশী কুকুর! আবার এসেছে একুশে নভেম্বর।”
ডাক ওঠে, ডাক ওঠে— আবার কঠোর বহু হরতালে আসে মিল্লাত, বিপ্লবী ডালে এখানে সেখানে রক্তের ফুল ফোটে। এ নভেম্বরে আবারো তো ডাক ওঠে—
আমাদের নেই মৃত্যু এবং আমাদের নেই ক্ষয়, অনেক রক্ত বৃথাই দিলুম তবু বাঁচবার শপথ নিলুম কেটে গেছে আজ রক্তদানের ভয়। ল’ড়ে মরি তাই আমরা অমর, আমরাই অক্ষয়॥
আবার এসেছে তেরোই ফেব্রুয়ারী, দাঁতে দাঁত চেপে হাতে হাত চেপে উদ্যত সারি সারি , কিছু না হলেও আবার আমরা রক্ত দিতে তো পারি? পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে ফেব্রুয়ারি। এ নভেম্বরে সংকেত পাই তারি।।
আর এক যুদ্ধ শেষ, পৃথিবীতে তবু কিছু জিজ্ঞাসা উন্মুখ। উদ্দাম ঢাকের শব্দে সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়? বিজয়ী বিশ্বের চোখ মুদে আসে, নামে এক ক্লান্তির জড়তা। রক্তাক্ত প্রান্তর তার অদৃশ্য দুহাতে নাড়া দেয় পৃথিবীকে, সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়? তুষারখচিত মাঠে, ট্রেঞ্চে, শূন্যে, অরণ্যে, পর্বতে অস্থির বাতাস ঘোরে দুর্বোধ্য ধাঁধায়, ভাঙা কামানের মুখে ধ্বংসস্তূপে উৎকীর্ণ জিজ্ঞাসা : কোথায় সে প্রশ্নের উত্তর?
দিগ্বিজয়ী দুঃশাসন! বহু দীর্ঘ দীর্ঘতর দিন তুমি আছ দৃঢ় সিংহাসনে সমাসীন, হাতে হিসেবের খাতা উন্মুখর এই পৃথিবী আজ তার শোধ করো ঋণ। অনেক নিয়েছ রক্ত, দিয়েছ অনেক অত্যাচার, আজ হোক তোমার বিচার। তুমি ভাব, তুমি শুধু নিতে পার প্রাণ, তোমার সহায় আছে নিষ্ঠুর কামান; জানো নাকি আমাদেরও উষ্ণ বুক, রক্ত গাঢ় লাল, পেছনে রয়েছে বিশ্ব, ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকাল, স্পীডোমিটারের মতো আমাদের হৃৎপিণ্ড উদ্দাম, প্রাণে গতিবেগ আনে, ছেয়ে ফেলে জনপদ-গ্রাম, বুঝেছি সবাই আমরা আমাদের কী দুঃখ নিঃসীম, দেখো ঘরে ঘরে আজ জেগে ওঠে এক এক ভীম। তবুও যে তুমি আজো সিংহাসনে আছ সে কেবল আমাদের বিরাট ক্ষমায়।
এখানে অরণ্য স্তব্ধ, প্রতীক্ষা-উৎকীর্ণ চারিদিক, গঙ্গায় প্লাবন নেই, হিমালয় ধৈর্যের প্রতীক; এ সুযোগে খুলে দাও ক্রূর শাসনের প্রদর্শনী, আমরা প্রহর শুধু গনি।
পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ, বন্ধ সৈনিকের রক্ত ঢালা ; ভেবেছ তোমার জয়, তোমার প্রাপ্য এ জয়মালা; জানো না এখানে যুদ্ধ—শুরু দিনবদলের পালা॥
তোমরা এসেছ, বিপ্লবী বীর! অবাক অভ্যুদয়। যদিও রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে সারা কলকাতাময়। তবু দেখ আজ রক্তে রক্তে সাড়া— আমরা এসেছি উদ্দাম ভয়হারা। আমরা এসেছি চারিদিক থেকে, ভুলতে কখনো পারি! একসূত্রে যে বাঁধা হয়ে গেছে কবে কোন্ যুগে নাড়ী। আমরা যে বারে বারে তোমাদের কথা পৌঁছে দিয়েছি এদেশের দ্বারে দ্বারে, মিছিলে মিছিলে সভায় সভায় উদাত্ত আহ্বানে, তোমাদের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছি জনতার উত্থানে, উদ্দাম ধ্বনি মুখরিত পথে ঘাটে, পার্কের মোড়ে, ঘরে, ময়দানে, মাঠে মুক্তির দাবি করেছি তীব্রতর সারা কলকাতা শ্লোগানেই থরো থরো। এই সেই কলকাতা! একদিন যার ভয়ে দুরু দুরু বৃটিশ নোয়াত মাথা। মনে পড়ে চব্বিশে? সেদিন দুপুরে সারা কলকাতা হারিয়ে ফেলেছে দিশে; হাজার হাজার জনসাধারণ ধেয়ে চলে সম্মুখে পরিষদ-গেটে হাজির সকলে, শেষ প্রতিজ্ঞা বুকে গর্জে উঠল হাজার হাজার ভাই : রক্তের বিনিময়ে হয় হোক, আমরা ওদের চাই। সফল! সফল! সেদিনের কলকাতা— হেঁট হয়েছিল অত্যাচারী ও দাম্ভিকদের মাথা। জানি বিকৃত আজকের কলকাতা বৃটিশ এখন এখানে জনত্রাতা!
গৃহযুদ্ধের ঝড় বয়ে গেছে— ডেকেছে এখানে কালো রক্তের বান; সেদিনের কলকাতা এ আঘাতে ভেঙে চুরে খান্খান্। তোমারা এসেছ বীরের মতন, আমরা চোরের মতো।
তোমরা এসেছ, ভেঙেছ অন্ধকার— তোমরা এসেছ, ভয় করি নাকো আর। পায়ের স্পর্শে মেঘ কেটে যাবে, উজ্জ্বল রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়বে বহুদুর— বহুদূর তোমরা এসেছ, জেনো এইবার নির্ভয় কলকাতা— অত্যাচারের হাত থেকে জানি তোমরা মুক্তিদাতা। তোমরা এসেছ, শিহরণ ঘাসে ঘাসে : পাখির কাকলি উদ্দাম উচ্ছ্বাসে, মর্মরধ্বনি তরুপল্লবে শাখায় শাখায় লাগে : হঠাৎ মৌন মহাসমুদ্র জাগে অস্থির হাওয়া অরণ্য পর্বতে, গুঞ্জন ওঠে তোমরা যাও যে-পথে।
আজ তোমাদের মুক্তিসভায় তোমদের সম্মুখে, শপথ নিলাম আমরা হাজার মুখে : যতদিন আছে আমাদের প্রাণ, আমাদের সম্মান, আমরা রুখব গৃহযুদ্ধের কালো রক্তের বান। অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, বুঝি আরো দিতে হবে এগিয়ে চলার প্রত্যেক উৎসবে। তবুও আজকে ভরসা, যেহেতু তোমরা রয়েছ পাশে, তোমরা রয়েছ এদেশের নিঃশ্বাসে।
তোমাদের পথ যদিও কুয়াশাময়, উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো ও কিছু নয়। তোমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয় দুর্বার, পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার। আবার জ্বালাব বাতি, হাজার সেলাম তাই নাও আজ, শেষযুদ্ধের সাথী॥
সীমান্তে আজ আমি প্রহরী। অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক'রে আজ এখানে এসে থমকে দাড়িয়েছি— স্বদেশের সীমানায়।
দূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী, স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে : —ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও।
আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক, হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল, রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ, আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি।
আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ, স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ, চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠি কিছুতেই বুঝি না কী ক'রে এড়াব তাকে?
কী ক’রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক? যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি, চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া, প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল, গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক, রাত্রে চাঁদ ওঠে : আমার চোখে ঘুম নেই।
তোমাকে ভেবেছি কতদিন, কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে, কত গোলা ফাটার মুহূর্তে। কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে তোমার আর তোমাদের ভাবনায়। তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে, ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব। আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্র। জানি না আজো, আছ কি নেই, দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে জানি না তাও।
তবু লিখছি তোমাকে আজ লিখছি আত্মম্ভর আশায় ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে। জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক'রে নেই মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে; জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে, মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার। তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে সে তোমার হৃদয়। যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে; পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায় আর সামনে নয়, এবার পেছনে ফেরার পালা।
পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক, এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে। প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক’রে পেলাম কী? উত্তর তার— তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়, ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব, ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র; আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।
আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার॥
বিগত শেষ-সংশয়; স্বপ্ন ক্রমে ছিন্ন, আচ্ছাদন উন্মোচন করেছে যত ঘৃণ্য, শঙ্কাকুল শিল্পীপ্রাণ, শঙ্কাকুল কৃষ্টি, দুর্দিনের অন্ধকারে ক্রমশ খোলে দৃষ্টি। হত্যা চলে শিল্পীদের, শিল্প আক্রান্ত, দেশকে যারা অস্ত্র হানে, তারা তো নয় ভ্রান্ত। বিদেশী-চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদ্-বৃন্তে সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে। শিল্পীদের রক্তস্রোতে এসেছে চৈতন্য গুপ্তঘাতী শত্রুদের করি না আজ গণ্য। ভুলেছে যারা সভ্য-পথ,সম্মুখীন যুদ্ধ, তাদের আজ মিলিত মুঠি করুক শ্বাসরুদ্ধ, শহীদ-খুন আগুন জ্বালে, শপথ অক্ষুণ : এদেশ অতি শীঘ্র হবে বিদেশী-চর শূন্য। বাঁচাবো দেশ, আমার দেশ, হানবো প্রতিপক্ষ, এ জনতার অন্ধ চোখে আনবো দৃঢ় লক্ষ্য। বাইরে নয় ঘরেও আজ মৃত্যু ঢালে বৈরী, এদেশে-জন বাহিনী তাই নিমেষে হয় তৈরী॥
ভারতবর্ষে পাথরের গুরুভার : এহেন অবস্থাকেই পাষাণ বলো, প্রস্তরীভুত দেশের নীরবতার একফোঁটা নেই অশ্রুও সম্বলও।
অহল্যা হল এই দেশ কোন্ পাপে ক্ষুধার কান্না কঠিন পাথরে ঢাকা, কোনো সাড়া নেই আগুনের উত্তাপে এ নৈঃশব্দ্য ভেঙেছে কালের চাকা।
ভারতবর্ষ! কার প্রতীক্ষা করো, কান পেতে কার শুনছ পদধ্বনি? বিদ্রোহে হবে পাথরেরা থরোথরো, কবে দেখা দেবে লক্ষ প্রাণের খনি?
ভারতী, তোমার অহল্যারূপ চিনি রামের প্রতীক্ষাতেই কাটাও কাল, যদি তুমি পায়ে বাজাও ও-কিঙ্কিনী, তবে জানি বেঁচে উঠবেই কঙ্কাল।
কত বসন্ত গিয়েছে অহল্যা গো, জীবনে ব্যর্থ তুমি তবু বার বার, দ্বারে বসন্ত, একবার শুধু জাগো দু’হাতে সরাও পাষাণের গুরুভার।
অহল্যা-দেশ, তোমার মুখের ভাষা অনুচ্চারিত, তবু অধৈর্যে ভরা; পাষাণ ছদ্মবেশকে ছেঁড়ার আশা ক্রমশ তোমার হৃদয় পাগল করা।
ভারতবর্ষ, তন্দ্রা ক্রমশ ক্ষয় অহল্যা! আজ শাপমোচনের দিন; তুষার-জনতা বুঝি জাগ্রত হয়— গা-ঝাড়া দেবার প্রস্তাব দ্বিধাহীন।
অহল্যা, আজ কাঁপে কী পাসাণকায়! রোমাঞ্চ লাগে পাথরের প্রত্যঙ্গে; রামের পদস্পর্শ কি লাগে গায়? অহল্যা, জেনো আমরা তোমার সঙ্গে॥
নরম ঘুমের ঘোর ভাঙল? দেখ চেয়ে অরাজক রাজ্য : ধ্বংস সমুখে কাঁপে নিত্য এখনো বিপদ অগ্রাহ্য? পৃথিবী, এ পুরাতন পৃথিবী দেখ আজ অবশেষে নিঃস্ব, স্বপ্ন-অলস যত ছায়ারা একে একে সকলি অদৃশ্য।
রুক্ষ মরুর দুঃস্বপ্ন হৃদয় আজকে শ্বাসরুদ্ধ, একলা গহন পথে চলতে জীবন সহসা বিক্ষুব্ধ।
জীবন ললিত নয় আজকে ঘুচেছে সকল নিরাপত্তা, বিফল স্রোতের পিছুটানকে শরণ করেছে ভীরু সত্তা।
তবু আজ রক্তের নিদ্রা, তবু ভীরু স্বপ্নের সখ্য : সহসা চমক লাগে চিত্তে দুর্জয় হল প্রতিপক্ষ।
নিরুপায় ছিঁড়ে গেল দ্বৈধ নির্জনে মুখ তোলে অঙ্কুর, বুঝে নিল উদ্যোগী আত্মা জীবন আজকে ক্ষণভঙ্গুর।
দলিত হৃদয় দেখে স্বপ্ন নতুন, নতুনতর বিশ্ব, তাই আজ স্বপ্নের ছায়ারা একে একে সকলি অদৃশ্য॥
এ আকাশ, এ দিগন্ত, এই মাঠ, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি, সহস্র বছর ধ’রে একে আমি জানি পরিপাটি, জানি, এ আমার দেশ অজস্র ঐতিহ্য দিয়ে ঘেরা, এখানে আমার রক্তে বেঁচে আছে পূর্বপুরুষেরা। যদিও দলিত দেশ, তবু মুক্তি কথা কয় কানে, যুগ যুগ আমরা যে বেঁচে থাকি পতনে উত্থানে! যে চাষী কেটেছে ধান, এ মাটিতে নিয়েছে কবর, এখনো আমার মধ্যে ভেসে আসে তাদের খবর। অদৃশ্য তাদের স্বপ্নে সমাচ্ছন্ন এদেশের ধূলি, মাটিতে তাদের স্পর্শ, তাদের কেমন ক’রে ভুলি? আমার সম্মুখে ক্ষেত এ প্রান্তরে উদয়াস্ত খাঁটি, ভালবাসি এ দিগন্ত, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি। এখানে রক্তের দাগ রেখে গেছে চেঙ্গিস, তৈমুর, সে চিহ্নও মুছে দিল কত উচ্চৈঃশ্রবাদের খুর। কত যুদ্ধ হয়ে গেছে, কত রাজ্য হয়েছে উজাড়, উর্বর করেছে মাটি কত দিগ্বিজয়ীর হাড়। তবুও অজেয় এই শতাব্দীগ্রথিত হিন্দুস্থান, এরই মধ্যে আমাদের বিকশিত স্বপ্নের সন্ধান। আজন্ম দেখেছি আমি অদ্ভুত নতুন এক চোখে, আমার বিশাল দেশ আসমুদ্র ভারতবর্ষকে। এ ধুলোয় প্রতিরোধ, এ হাওয়ায় ঘূর্ণিত চাবুক, এখানে নিশ্চিহ্ন হল কত শত গর্বোদ্ধত বুক। এ মাটির জন্যে প্রাণ দিয়েছি তো কত যুগ ধ’রে রেখেছি মাটির মান কতবার কত যুদ্ধ ক’রে। আজকে যখন এই দিক্প্রান্তে ওঠে রক্তঝড়, কোমল মাটিতে রাখে শত্রু তার পায়ের স্বাক্ষর, তখন চীৎকার ক’রে রক্ত ব’লে ওঠে ‘ধিক্ ধিক্, এখনো দিল না দেখা দেহে দেহে নির্ভয় সৈনিক! দাসত্বের ছদ্মবেশ দীর্ণ ক’রে উন্মোচিত হোক একবার বিশ্বরূপ— হে উদ্দাম, হে অধিনায়ক।’ এদিকে উৎকর্ণ দিন, মণিপুর, কাঁপে মণিপুর চৈত্রের হাওয়ায় ক্লান্ত, উৎকণ্ঠায় অস্থির দুপুর— কবে দেখা দেবে, কবে প্রতীক্ষিত সেই শুভক্ষণ ছড়াবে ঐশ্বর্য পথে জনতার দুরন্ত যৌবন? দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে অতর্কিতে শত্রু তার পদচিহ্ন রাখে— এখনো শত্রু কে ক্ষমা? শত্রু কি করেছে ক্ষমা বিধ্বস্ত বাংলাকে? আজকের এ মুহূর্তে অবসন্ন শ্মশানস্তব্ধতা, কেন তাই মনে মনে আমি প্রশ্ন করি সেই কথা। তুমি কি ক্ষুধিত বন্ধু? তুমি কি ব্যাধিতে জরোজরো? তা হোক , তবুও তুমি আর এক মৃত্যুকে রোধ করো। বসন্ত লাগুক আজ আন্দোলিত প্রাণের শাখায়, আজকে আসুক বেগ এ নিশ্চল রথের চাকায়, এ মাটি উত্তপ্ত হোক, এ দিগন্তে আসুক বৈশাখ, ক্ষুধার আগুনে আজ শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। শত্রুরা নিয়েছে আজ দ্বিতীয় মৃত্যুর ছদ্মবেশ, তবু কেন নিরুত্তর প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা দেশ? এদেশে কৃষক আছে, এদেশে মজুর আছে জানি, এদেশে বিপ্লবী আছে, জনরাজ্যে মুক্তির সন্ধানী। দাসত্বের ধূলো ঝেড়ে তারা আজ আহ্বান পাঠাক, ঘোষণা করুক তারা এ মাটিতে আসন্ন বৈশাখ। তাই এ অবরুদ্ধ স্বপ্নহীন নিবিড় বাতাসে শব্দ হয়, মনে হয় রাত্রিশেষে ওরা যেন আসে। ওরা আসে, কান পেতে আমি তার পদধ্বনি শুনি, মৃত্যুকে নিহত ক’রে ওরা আসে উজ্জ্বল আরুণি; পৃথিবী ও ইতিহাস কাঁপে আজ অসহ্য আবেগে, ওদের পায়ের স্পর্শে মাটিতে সোনার ধান, রঙ লাগে মেঘে। এ আকাশ চন্দ্রাতপ, সূর্য আজ ওদের পতাকা, মুক্তির প্রচ্ছদপটে ওদের কাহিনী আজ ঢাকা, আগন্তুক ইতিহাসে ওরা আজ প্রথম অধ্যায়, ওরা আজ পলিমাটি অবিরাম রক্তের বন্যায়; ওদের দু’চোখে আজ বিকশিত আমার কামনা, অভিনন্দন গাছে, পথের দু’পাশে অভ্যর্থনা। ওদের পতাকা ওড়ে গ্রামে গ্রামে নগরে বন্দরে, মুক্তির সংগ্রাম সেরে ওরা ফেরে স্বপ্নময় ঘরে॥
ভাঙন নেপথ্য পৃথিবীতে : অদৃশ্য কালের শত্রু প্রচ্ছন্ন জোয়ারে, অনেক বিপন্ন জীব ক্ষয়িষ্ণু খোঁয়াড়ে উন্মুখ নিঃশেষে কেড়ে নিতে, দুর্গম বিষণ্ণ শেষ শীতে।
বীভৎস প্রাণের কোষে কোষে নিঃশব্দে ধ্বংসের বীজ নির্দিষ্ট আয়ুতে;— পশেছে আঁধার রাত্রে— প্রত্যেক স্নায়ুতে; গোপনে নক্ষত্র গেছে খসে আরক্তিম আদিম প্রদোষে।
দিনের নীলাভ শেষ আলো জানাল আসন্ন রাত্রি দুর্লক্ষ্য সংকেতে অনেক কাস্তের শব্দ নিঃস্ব ধানক্ষেতে সেই রাত্রে হাওয়ায় মিলাল : দিক্প্রান্তে সূর্য চমকাল॥
এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা, সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে পথ নেই, তবু এখানে যে পথ হাঁটা।
জোড়া দীঘি, তার পাড়েতে তালের সারি দূরে বাঁশঝাড়ে আত্মদানের সাড়া, পচা জল আর মশার অহংকারী নীরব এখানে অমর কিষাণপাড়া।
এ গ্রামের পাশে মজা নদী বারো মাস বর্ষায় আজ বিদ্রোহ বুঝি করে, গোয়ালে পাঠায় ইশারা সবুজ ঘাস এ গ্রাম নতুন সবুজ ঘাগরা পরে।
রাত্রি এখানে স্বাগত সান্ধ্য শাঁখে কিষাণকে ঘরে পাঠায় যে আল-পথ; বুড়ো বটতলা পরস্পরকে ডাকে সন্ধ্যা সেখানে জড়ো করে জনমত।
দুর্ভিক্ষের আঁচল জড়ানো গায়ে এ গ্রামের লোক আজো সব কাজ করে, কৃষক-বধূরা ঢেঁকিকে নাচায় পায়ে প্রতি সন্ধ্যায় দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে।
রাত্রি হলেই দাওয়ার অন্ধকারে ঠাকুমা গল্প শোনায় যে নাতনীকে, কেমন ক'রে সে আকালেতে গতবারে, চলে গেল লোক দিশাহারা দিকে দিকে।
এখানে সকাল ঘোষিত পাখির গানে কামার, কুমোর, তাঁতী তার কাজে জোটে, সারাটা দুপুর ক্ষেতের চাষীরা কানে একটানা আর বিচিত্র ধ্বনি ওঠে।
হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে, ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনোমতে, সবুজ ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে॥
অনিশ্চিত পৃথিবীতে অরণ্যের ফুল রচে গেল ভুল; তারা তো জানত যারা পরম ঈশ্বর তাদের বিভিন্ন নয় স্তর, অনন্তর তারাই তাদের সৃষ্টিতে অনর্থক পৃথক দৃষ্টিতে একই কারুকার্যে নিয়মিত উত্তপ্ত গলিত ধাতুদের পরিচয় দিত। শেষ অধ্যায় এল অকস্মাৎ। তখন প্রমত্ত প্রতিঘাত শ্রেয় মেনে নিল ইতিহাস, অকল্পেয় পরিহাস সুদূর দিগন্তকোণে সকরুণ বিলাল নিঃশ্বাস।
যেখানে হিমের রাজ্য ছিল, যেখানে প্রচ্ছন্ন ছিল পশুর মিছিলও সেখানেও ধানের মঞ্জরী প্রাণের উত্তাপে ফোটে, বিচ্ছিন্ন শর্বরী : সূর্য-সহচরী! তাই নিত্যবুভুক্ষিত মন চিরন্তন লোভের নিষ্ঠুর হাত বাড়াল চৌদিকে পৃথিবীকে একাগ্রতায় নিলো লিখে। সহসা প্রকম্পিত সুষুপ্ত সত্তায় কঠিন আঘাত লাগে সুনিরাপত্তায়। ব্যর্থ হল গুপ্ত পরিপাক, বিফল চীৎকার তোলে বুভুক্ষার কাক; —পৃথিবী বিস্ময়ে হতবাক।
আকাশের খাপছাড়া ক্রন্দন নাই আর আষাঢ়ের খেলনা। নিত্য যে পাণ্ডুর জড়তা সথীহারা পথিকের সঞ্চয়।
রক্তের বুকভরা নিঃশ্বাস, আঁধারের বুকফাটা চীৎকার— এই নিয়ে মেতে আছি আমরা কাজ নেই হিসাবের খাতাতে।
মিলাল দিনের কোনো ছায়াতে পিপাসায় আর কূল পাই না; হারানো স্মৃতির মৃদু গন্ধে প্রাণ কভু হয় নাকো চঞ্চল।
মাঝে মাঝে অনাহূত আহ্বান আনে কই আলেয়ার বিত্ত? শহরের জমকালো খবরে হাজিরা খাতাটা থাকে শূন্য।
আনমনে জানা পথ চলতে পাই নাকো মাদকের গন্ধ! রাত্রিদিনের দাবা চালেতে আমাদের মন কেন উষ্ণ?
শ্মশানঘাটেতে ব’সে কখনো দেখি নাই মরীচিকা সহসা, তাই বুঝি চিরকাল আঁধারে আমরাই দেখি শুধু স্বপ্ন!
বার বার কায়াহীন ছায়ারে ধরেছিনু বাহুপাশে জড়িয়ে, তাই আজ গৈরিক মাটিতে রঙিন বসন করি শুদ্ধ॥
বিষণ্ণ রাত, প্রসন্ন দিন আনো আজ মরণের অন্ধ অনিদ্রায়, সে অন্ধতায় সূর্যের আলো হানো, শ্বেত স্বপ্নের ঘোরে যে মৃতপ্রায়।
নিভৃত-জীবন পরিচর্যায় কাটে যে দিনের, আজ সেখানে প্রবল দ্বন্দ্ব। নিরন্ন প্রেম ফেরে নির্জন হাটে, অচল চরণ ললাটের নির্বন্ধ?
জীবন মরণে প্রাণের গভীরে দোলা কাল রাতে ছিল নিশীথ কুসুমগন্ধী; আজ সূর্যের আলোয় পথকে ভোলা মনে হয় ভীরু মনের দুরভিসন্ধি॥
অনেক স্তব্ধ দিনের এপারে চকিত চতুর্দিক, আজো বেঁচে আছি, মৃত্যুতাড়িত আজো বেঁচে আছি ঠিক। দুলে ওঠে দিন : শপথমুখর কিষান-শ্রমিকপাড়া, হাজারে হাজারে মাঠে বন্দরে আজকে দিয়েছে সাড়া। জ্বালে আলো আজ, আমাদের হাড়ে জমা হয় বিদ্যুৎ, নিহত দিনের দীর্ঘ শাখায় ফোটে বসন্তদূত। মূঢ় ইতিহাস; চল্লিশ কোটি সৈন্যের সেনাপতি। সংহত দিন, রুখবে কে এই একত্রীভূত গতি? জানি আমাদের অনেক যুগের সঞ্চিত স্বপ্নেরা দ্রুত মুকুলিত তোমার দিন ও রাত্রি দিয়েই ঘেরা। তাই হে আদিম, ক্ষতবিক্ষত জীবনের বিস্ময়, ছড়াও প্লাবন, দুঃসহ দিন আর বিলম্ব নয়। সারা পৃথিবীর দুয়ারে মুক্তি, এখানে অন্ধকার, এখানে কবে আসন্ন হবে বৈতরণীর পার?
আমার মৃত্যুর পর কেটে গেল বৎসর বৎসর; ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির ব্যর্থ প্রচেষ্টাও আজ অগভীর, এখন পৃথিবী নয় অতিক্রান্ত প্রায়ান্ধ স্থবির : নিভেছে প্রধূম্রজ্বালা, নিরঙ্কুশ সূর্য অনশ্বর ; স্তব্ধতা নেমেছে রাত্রে থেমেছে নির্ভীক তীক্ষ্ণস্বর— অথবা নিরন্ন দিন, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা ; উদ্ধত বজ্রের ভয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর আনাগোনা, অনন্য মানবসত্তা ক্রমান্বয়ে স্বল্পপরিসর।
গলিত স্মৃতির বাষ্প সেদিনের পল্লব শাখায় বারম্বার প্রতারিত অস্ফুট কুয়াশা রচনায়; বিলুপ্ত বজ্রের ঢেউ নিশ্চিত মৃত্যুতে প্রতিহত। আমার অজ্ঞাত দিন নগণ্য উদার উপেক্ষাতে অগ্রগামী শূন্যতাকে লাঞ্চিত করেছে অবিরত তথাপি তা’ প্রস্ফুটিত মৃত্যুর অদৃশ্য দুই হাতে॥
চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন, হাঠাৎ ঘোষণা শুনেছি : আমার জীবনে শুভক্ষণ এসেছে ; তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি। রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজী। এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার, এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্য পার। এসেছে বন্যা, এসেছে মৃত্যু, পরে যুদ্ধের ঝড়, মন্বন্তর রেখে গেছে তার পথে পথে স্বাক্ষর, প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি এবার মুছে নেবে ইতিহাস— তবু উদ্দাম, মৃত্যু-আহত ফেলি নি দীর্ঘশ্বাস : নগর গ্রামের শ্মশানে শ্মশানে নিহিত অভিজ্ঞান : বহু মৃত্যুর মুখোমুখি দৃঢ় করেছি জয়ের ধ্যান। তাই তো এখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি, মনে হয় শুধু তোমারই মধ্যে আমরা যে বেঁচে আছি— তোমাকে পেয়েছি অনেক মৃত্যু-উত্তরণের শেষে, তোমাকে গড়ব প্রাচীর, ধ্বংস-বিকীর্ণ এই দেশে। দিক্দিগন্তে প্রসারিত হাতে তুমি যে পাঠালে ডাক, তাইতো আজকে গ্রামে ও নগরে স্পন্দিত লাখে লাখ॥
আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ, আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের। হাতাশায় স্তব্ধ বাক্য; ভাষা চাই আমরা নির্বাক, পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা ভেঙে যাবে রুদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা, আমাদেরই দুঃখসুখে ব্যক্ত হবে প্রত্যেক রচনা। পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হবে সব কথা।
আমি দিব্য চোখে দেখি অনাগত সে রবীন্দ্রনাথ দস্যুতায় দৃপ্তকণ্ঠ (বিগত দিনের) ধৈর্যের বাঁধন যার ভাঙে দুঃশাসনের আঘাত, যন্ত্রণায় রুদ্ধবাক্, যে যন্ত্রণা সহায়হীনের। বিগত দুর্ভিক্ষে যার উত্তেজিত তিক্ত তীব্র ভাষা মৃত্যুতে ব্যথিত আর লোভের বিরুদ্ধে খরধার, ধ্বংসের প্রান্তরে বসে আনে দৃঢ় অনাহত আশা; তাঁর জন্ম অনিবার্য, তাঁকে ফিরে পাবই আবার।
রবীন্দ্রনাথের সেই ভুলে যাওয়া বাণী অকস্মাৎ করে কানাকানি ; ‘দামামা ঐ বাজে, দিন বদলের পালা এ ঝড়ো যুগের মাঝে’।
নিষ্কম্প গাছের পাতা, রুদ্ধশ্বাস অগ্নিগর্ভ দিন, বিষ্ফারিত দৃষ্টি মেলে এ আকাশ, গতিরুদ্ধ রায়ু ; আবিশ্ব জিজ্ঞাসা এক চোখে মুখে ছড়ায় রঙিন সংশয় স্পন্দিত স্বপ্ন, ভীত আশা উচ্চারণহীন মেলে না উত্তর কোনো, সমস্যায় উত্তেজিত স্নায়ু। ইতিহাস মোড় ফেরে পদতলে বিধ্বস্ত বার্লিন , পশ্চিম সীমান্তে শান্তি, দীর্ঘ হয় পৃথিবীর আয়ু, দিকে দিকে জয়ধ্বনি, কাঁপে দিন রক্তাক্ত আভায়। রাম-রাবণের যুদ্ধে বিক্ষত এ ভারতজটায়ু মৃতপ্রায়, যুদ্ধাহত, পীড়নে-দুর্ভিক্ষে মৌনমূক। পূর্বাঞ্চল দীপ্ত ক’রে বিশ্বজন-সমৃদ্ধ সভায় রবীন্দ্রনাথের বাণী তার দাবি ঘোষণা করুক। এবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে কণ্ঠে গণ-সংগীতের সুর;
জনতার পাশে পাশে উজ্জ্বল পতাকা নিয়ে হাতে চলুক নিন্দাকে ঠেলে গ্লানি মুছে আঘাতে আঘাতে। যদিও সে অনাগত, তবু যেন শুনি তার ডাক। আমাদেরই মাঝে তাকে জন্ম দাও পঁচিশে বৈশাখ॥
অনেক উল্কার স্রোত বয়েছিল হঠাৎ প্রত্যুষে, বিনিদ্র তারার বে পল্লবিত মেঘ ছুঁয়েছিল রশ্মিটুকু প্রথম আবেগে! অকস্মাৎ কম্পমান অশরীরী দিন, রক্তের বাসরঘরে বিবর্ণ মৃত্যুর বীজ ছড়াল আসন্ন রাজপথে। তবু স্বপ্ন নয় : গোধূলীর প্রত্যহ ছায়ায় গোপন স্বাক্ষর সৃষ্টি কক্ষচ্যুত গ্রহ-উপবনে ; দিগন্তের নিশ্চল আভাস। ভস্মীভূত শ্মশানক্রন্দনে, রক্তিম আকাশচিহ্ন সবেগে প্রস্থান করে যূথ ব্যঞ্জনায়।
নিষিদ্ধ কল্পনাগুলি বন্ধ্যা তবু অলক্ষ্যে প্রসব করে অব্যক্ত যন্ত্রণা, প্রথম যৌবন তার রক্তময় রিক্ত জয়টীকা স্তম্ভিত জীবন হ’তে নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন ক’রে দিল। তারপর : প্রান্তিক যাত্রায় অতৃপ্ত রাত্রির স্বাদ, বাসর শয্যায় অসম্বৃত দীর্ঘশ্বাস বিস্মরণী সুরাপানে নিত্য নিমজ্জিত স্বগত জাহ্নবীজলে। তৃষ্ণার্ত কঙ্কাল অতীত অমৃত পানে দৃষ্টি হানে কত। সর্বগ্রাসী প্রলুব্ধ চিতার অপবাদে সভয়ে সন্ধান করে ইতিবৃত্ত দগ্ধপ্রায় মনে। প্রেতাত্মার প্রতিবিম্ব বার্ধক্যের প্রকম্পনে লীন, অনুর্বর জীবনের সূর্যোদয় : ভস্মশেষ চিতা। কুজ্ঝটিকা মূর্ছা গেল আলোক-সম্পাতে, বাসনা-উদ্গ্রীব চিন্তা উন্মুখ ধ্বংসের আর্তনাদে।
সরীসৃপ বন্যা যেন জড়তার স্থির প্রতিবাদ, মানবিক অভিযানে নিশ্চিন্ত উষ্ণীষ! প্রচ্ছন্ন অগ্ন্যুৎপাতে সংজ্ঞাহীন মেরুদণ্ড-দিন নিতান্ত ভঙ্গুর, তাই উদ্যত সৃষ্টির ত্রাসে কাঁপে। পণ্যভারে জর্জরিত পাথেয় সংগ্রাম, চকিত হরিণদৃষ্টি অভুক্ত মনের পুষ্টিকর : অনাসক্ত চৈতন্যের অস্থায়ী প্রয়াণ। অথবা দৈবাৎ কোন নৈর্ব্যক্তিক আশার নিঃশ্বাস নগণ্য অঙ্গারতলে খুঁজেছে অন্তিম। রুদ্ধশ্বাস বসন্তের আদিম প্রকাশ, বিপ্রলব্ধ জনতার কুটিল বিষাক্ত প্রতিবাদে প্রত্যহ লাঞ্ছিত স্বপ্ন, স্পর্ধিত আঘাত! সুষুপ্ত প্রকোষ্ঠতলে তন্দ্রাহীন দ্বৈতাচারী নর নিজেরে বিনষ্ট করে উৎসারিত ধূমে, অদ্ভুত ব্যাধির হিমছায়া দীর্ণ করে নির্যাতিত শুদ্ধ কল্পনাকে ; সদ্যমৃত-পৃথিবীর মানুষের মতো প্রত্যেক মানবমনে একই উত্তাপ অবসাদে। তবুও শার্দূল-মন অন্ধকারে সন্ধ্যার মিছিলে প্রথম বিস্ময়দৃষ্টি মেলে ধরে বিষাক্ত বিশ্বাসে।
বহ্নিমান তপ্তশিখা উন্মেষিত প্রথম স্পর্ধায়- বিষকন্যা পৃথিবীর চক্রান্তে বিহ্বল উপস্থিত প্রহরী সভ্যতা। ধূসর অগ্নির পিণ্ড : উত্তাপবিহীন স্তিমিত মত্ততাগুলি স্তব্ধ নীহারিকা, মৃত্তিকার দাত্রী অবশেষে॥
আজকে হঠাৎ সাত-সমুদ্র তের-নদী পার হতে সাধ জাগে মনে, হায় তবু যদি পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ প্রস্রবণের মতো এসে যেত হঠাৎ আজ— তাহলে না হয় আকাশবিহার হত সফল, টুকরো মেঘেরা যেতে যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল। আর আমি বুঝি দৈত্যদলনে সাগর পার হতাম; যেখানে দানবের দায়ে সব আঁধার। মত্ত যেখানে দৈত্যে দৈত্যে বিবাদ ভারি : হানাহানি নিয়ে সুন্দরী এক রাজকুমারী (রাজকন্যার লোভ নেই, —লোভ অলঙ্কারে, দৈত্যেরা শুধু বিবস্ত্রা ক’রে চায় তাহারে।)
আমি একজন লুপ্তগর্ব রাজার তনয় এত অন্যায় সহ্য করব কোনোমতে নয়— তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন, যেখানে ঝল্সে উঠবে আমার অসির কিরণ। ভাঙাচোরা এক তলোয়ার আছে, (নয় দু’ধারী) তাও হ’ত তবে পক্ষীরাজেরই অভাব ভারি। তাই ভাবি আজ, তবে আমি খুঁজে নেব কৌপীন নেব কয়েকটা বেছে জানা জানা বুলি সৌখিন॥
আজ মনে হয় বসন্ত আমার জীবনে এসেছিল উত্তর মহাসাগরের কূলে আমার স্বপ্নের ফুলে তারা কথা কয়েছিল অস্পষ্ট পুরনো ভাষায় অস্ফুট স্বপ্নের ফুল অসহ্য সূর্যের তাপে অনিবার্য ঝরেছিল মরেছিল নিষ্ঠুর প্রগল্ভ হতাশায়।
হঠাৎ চমকে ওঠে হাওয়া সেদিন আর নেই— নেই আর সূর্য-বিকিরণ আমার জীবনে তাই ব্যর্থ হল বাসন্তীমরণ!
শুনি নি স্বপ্নের ডাক : থেকেছি আশ্চর্য নির্বাক বিন্যস্ত করেছি প্রাণ বুভুক্ষার হাতে।
সহসা একদিন আমার দরজায় নেমে এল নিঃশব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা। সেইদিন বসন্তের পাখি উড়ে গেল যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত ।
আজ মনে হয় হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুরে, কী ক’রে সম্ভব হল আমার রক্তকে ভালবাসা! সূর্যের কুয়াশা এখনো কাটে নি ঘোচে নি অকাল দুর্ভাবনা। মুহূর্তের সোনা এখনো সভয়ে ক্ষয় হয়, এরই মধ্যে হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর কঠিন কাস্তেতে দেয় সুর, অন্যমনে এ কী দুর্ঘটনা— হেমন্তেই বসন্তের প্রস্তাব রটনা॥
নীল সমুদ্রের ইশারা— অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর ছোট ছোট দ্বীপ, আর সূর্যময় দিনের স্তব্ধতা; নিঃশব্দ দিনের সেই ভীরু অন্তঃশীল মত্ততাময় পদক্ষেপ : এ সবের ম্লান আধিপত্য বুঝি আর জীবনের উপর কালের ব্যবচ্ছেদ-ভ্রষ্ট নয়। তাই রক্তাক্ত পৃথিবীর ডাকঘর থেকে ডাক এল— সভ্যতার ডাক। নিষ্ঠুর ক্ষুধার্ত পরোয়ানা আমাকে চিহ্নিত ক’রে গেল। আমার একক পৃথিবী ভেসে গেল জনতার প্রবল জোয়ারে। মনের স্বচ্ছতার ওপর বিরক্তির শ্যাওলা গভীরতা রচনা করে, আর শঙ্কিত মনের অস্পষ্টতা ইতস্ততঃ ধাবমান। নির্ধারিত জীবনেও মাটির মাশুল পূর্ণতায় মূর্তি চায়; আমার নিষ্ফল প্রতিবাদ, আরো অনেকের বিরুদ্ধে বিবক্ষা তাই পরাহত হল। কোথায় সেই দূর সমুদ্রের ইশারা আর অন্ধকারের নির্বিরোধ ডাক! দিনের মুখে মৃত্যুর মুখোস। যে সব মুহূর্ত-পরমাণু গেঁথেছিল অস্থায়ী রচনা, সে সব মুহূর্ত আজ প্রাণের অস্পষ্ট প্রশাখায় অজ্ঞাত রক্তিম ফুল ফোটে॥
ভেঙ্গেছে সাম্রাজ্যস্বপ্ন, ছত্রপতি হয়েছে উধাও; শৃঙ্খল গড়ার দুর্গ ভূমিসাৎ বহু শতাব্দীর। ‘সাথী, আজ দৃঢ় হাতে হাতিয়ার নাও’— রোমের প্রত্যেক পথে ওঠে ডাক ক্রমশঃ অস্থির। উদ্ধত ক্ষমতালোভী দস্যুতার ব্যর্থ পরাক্রম মুক্তির উত্তপ্ত স্পর্শে প্রকম্পিত যুগ যুগ অন্ধকার রোম। হাজার বছর ধ’রে দাসত্ব বেঁধেছে বাসা রোমের দেউলে, দিয়েছে অনেক রক্ত রোমের শ্রমিক— তাদের শক্তির হাওয়া মুক্তির দুয়ার দিল খুলে, আজকে রক্তাক্ত পথ; উদ্ভাসিত দিক। শিল্পী আর মজুরের বহু পরিশ্রম একদিন গড়েছিল রোম, তারা আজ একে একে ভেঙে দেয় রোমের সে সৌন্দর্য সম্ভার, ভগ্নস্তূপে ভবিষ্যৎ মুক্তির প্রচার।
রোমের বিপ্লবী হৃৎস্পন্দনে ধ্বনিত মুক্তির সশস্ত্র ফৌজ আসে অগণিত, দু’চোখে সংহার স্বপ্ন, বুকে তীব্র ঘৃণা, শত্রুকে বিধ্বস্ত করা যেতে পারে কিনা রাইফেলের মুখে এই সংক্ষিপ্ত জিজ্ঞাসা। যদিও উদ্বেগ মনে, তবু দীপ্ত আশা— পথে পথে জনতার রক্তাক্ত উত্থান, বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে ডেকে ওঠে বান।
ভেঙে পড়ে দস্যুতার, পশুতার প্রথম প্রাসাদ বিক্ষুব্ধ অগ্ন্যুৎপাতে উচ্চারিত শোষণের বিরুদ্ধে জেহাদ। যে উদ্ধত একদিন দেশে দেশে দিয়েছে শৃঙ্খল আবিসিনিয়ার চোখে আজ তার সে দম্ভ নিষ্ফল।
এদিকে ত্বরিত সূর্য রোমের আকাশে যদিও কুয়াশাঢাকা আকাশের নীল, তবুও বিপ্লবী জানে, সোভিয়েট পাশে॥
পাখি সব করে রব, রাত্রি শেষ : ঘোষণা চৌদিকে, ভোরের কাকলি শুনি; অন্ধকার হয়ে আসে ফিকে, আমার ঘরেও রুদ্ধ অন্ধকার, ষ্পস্ট নয় আলো, পাখিরা ভোরের বার্তা অকস্মাৎ আমাকে শোনালো। স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি, অন্ধকারে খাড়া করি কান— পাখিদের মাতামাতি, শুনি মুখরিত ঐকতান; আজ এই রাত্রিশেষে বাইরে পাখির কলরবে রুদ্ধ ঘরে ব’সে ভাবি, হয়তো কিছু বা শুরু হবে, হয়তো এখনি কোনো মুক্তিদূত দুরন্ত রাখাল, মুক্তির অবাধ মাঠে নিয়ে যাবে জনতার পাল; স্বপ্নের কুসুমকলি হয়তো বা ফুটেছে কাননে, আমি কি খবর রাখি? আমি বদ্ধ থাকি গৃহকোণে, নির্বাসিত মন চিরকাল অন্ধকারে বাসা, তাইতো মুক্তির স্বপ্ন আমাদের নিতান্ত দুরাশা।
জন-পাখিদের কণ্ঠে তবুও আলোর অভ্যর্থনা. দিকে দিকে প্রতিদিন অবিশ্রান্ত শুধু যায় শোনা; এরা তো নগণ্য জানি, তুচ্ছ ব’লে ক’রে থাকি ঘৃণা, আলোর খবর এরা কি ক’রে যে পায় তা জানি না।
এদের মিলিত সুরে কেন যেন বুক ওঠে দুলে, অকস্মাৎ পূর্বদিকে মনের জানালা দিই খুলে : হঠাৎ বন্দর ছাড়া বাঁশি বুঝি বাজায় জাহাজ, চকিতে আমার মনে বিদ্যুৎ বিদীর্ণ হয় আজ।
অদূরে হঠাৎ বাজে কারখানার পাঞ্চজন্যধ্বনি, দেখি দলে দলে লোক ঘুম ভেঙে ছুটেছে তখনি, মনে হয়, যদি বাজে মুক্তি-কারখানার তীব্র শাঁখ তবে কি হবে না জমা সেখানে জনতা লাখে লাখ? জন-পাখিদের গানে মুখরিত হবে কি আকাশ? —ভাবে নির্বাসিত মন, চিরকাল অন্ধকারে বাস।
পখিদের মাতামাতি : বুঝি মুক্তি নয় অসম্ভব, যদিও ওঠে নি সূর্য, তবু আজ শুনি জনরব॥
এখানে সূর্য ছড়ায় অকৃপণ দু’হাতে তীব্র সোনার মতন মদ, যে সোনার মদ পান ক’রে ধান ক্ষেত দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ।
ভারতী! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে রৌদ্র তোমায় পরায় সোনার হার, সূর্য তোমার শুকায় সবুজ চুল প্রেয়সী, তোমার কত না অহংকার।
সারাটা বছর সূর্য এখানে বাঁধা রোদে ঝলসায় মৌন পাহাড় কোনো, অবাধ রোদ্রে তীব্র দহন ভরা রৌদ্রে জ্বলুক তোমার আমার মনও।
বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রের ভোজে মুঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা, প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে, কী মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা ।
রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে।
পথিক-বিরল রাজপথে সূর্যের প্রতিনিধি হাঁকে আসন্ন কলরব, মধ্যাহ্নের কঠোর ধ্যানের শেষে জানি আছে এক নির্ভয় উৎসব।
তাইতো এখানে সূর্য তাড়ায় রাত প্রেয়সী, তুমি কি মেঘভয়ে আজ ভীত? কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়, এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত।
সূর্য, তোমায় আজকে এখানে ডাকি— দুর্বল মন, দুর্বলতর কায়া, আমি যে পুরনো অচল দীঘির জল আমার এ বুকে জাগাও প্রতিচ্ছায়া॥
দেওয়ালী (ভূপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়-কে) তোর সেই ইংরেজীতে দেওয়ালীর শুভেচ্ছা কামনা পেয়েছি, তবুও আমি নিরুৎসাহে আজ অন্যমনা, আমার নেইকো সুখ, দীপান্বিতা লাগে নিরুৎসব, রক্তের কুয়াশা চোখে, স্বপ্নে দেখি শব আর শব। এখানে শুয়েই আমি কানে শুনি আর্তনাদ খালি, মুমূর্ষু কলকাতা কাঁদে, কাঁদে ঢাকা, কাঁদে নোয়াখালী, সভ্যতাকে পিষে ফেলে সাম্রাজ্য ছড়ায় বর্বরতা : এমন দুঃসহ দিনে ব্যর্থ লাগে শুভেচ্ছার কথা; তবু তোর রঙচঙে সুমধুর চিঠির জবাবে কিছু আজ বলা চাই, নইলে যে প্রাণের অভাবে পৃথিবী শুকিয়ে যাবে, ভেসে যাবে রক্তের প্লাবনে। যদিও সর্বদা তোর শুভ আমি চাই মনে মনে, তবুও নতুন ক’রে আজ চাই তোর শান্তিসুখ, মনের আঁধারে তোর শত শত প্রদীপ জ্বলুক, এ দুর্যোগ কেটে যাবে রাত আর কতক্ষণ থাকে? আবার সবাই মিলবে প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে, আমার ঐশ্বর্য নেই, নেই রঙ, নেই রোশনাই— শুধু মাত্র ছন্দ আছে তাই দিয়ে শুভেচ্ছা পাঠাই॥ |