বিষয়:
নজরুল সঙ্গীত।
গান সংখ্যা :
১৪৯৩.
শিরোনাম:
দোলন-চাঁপা বনে দোলে
দোল্-পূর্ণিমা-রাতে চাঁদের সাথে।
পাঠ ও পাঠভেদ:
দোলন-চাঁপা বনে দোলে দোল্-পূর্ণিমা-রাতে চাঁদের সাথে।
(শ্যাম) পল্লব-কোলে যেন দোলে রাধা
লতার দোলনাতে॥
(যেন)
দেব-কুমারীর শুভ্র হাসি
ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি'
আরতির মৃদু জ্যোতি প্রদীপ-কলি দোলে যেন দেউল-আঙিনাতে॥
বন-দেবীর ওকি রূপালী
ঝুম্কা চৈতি সমীরণে দোলে,
রাতের সলাজ আঁখি-তারা যেন তিমির-আঁচলে।
ও যেন মুঠিভরা চন্দন-গন্ধ
দোলে রে গোপিনীর গোপন আনন্দ,
ও কি রে চুরি করা শ্যামের নূপুর, চন্দ্রা-যামিনীর মোহন হাতে॥
ফিরে আসিল না আর বনের কিশোর
ঘরে ফিরিল না আর বনের কিশোরী
মাধুরী চাঁদের বুকে কৃষ্ণ লেখা হয়ে
দেখা দেয় আজো সেই কিশোরের ছায়া।
কাঁদে চাঁদ সেই বিরহীরে বুকে ধরি
আনন্দে কলঙ্কী নাম করিল বরণ।
বনের কিশোরী চন্দ্রা সেই চাঁদ পানে
চাহিয়া বনের বুকে বিসরিয়া তনু
ধরিল দোলনচম্পা রূপ এ ধরায়
জনম লভিয়া পুন হেরিতে কিশোর।
আজো দোল পূর্ণিমার রাতে বিকশিয়া
ঝরে যায় বিরহের প্রখর বৈশাখে
বারে বারে জন্ম লভে মরে বারে বারে
তবু তার প্রেমের সে অনন্ত পিপাসা
মিটিল না মিটিবে না বুঝি কোন কালে
অনন্ত এ বিরহের রাস মঞ্চে তার
অচ্ছেদ্য মিলন লীলা চলে অনিবার॥
গানটির সাথে রাগের আরোহ-অবরোহ, বাদী, সম্বাদী উল্লেখের সাথে সাথে রাগের প্রকৃতি বর্ণিত হয়েছে, এই ভাবে-
'ইহাতে হাম্বীর, কামোদ ও নট রূপ মাঝে মাঝে উঁকি দেয়, কিন্তু ইহার গতি অত্যন্ত দোলনশীল বলিয়া ঐসব রাগের আভাস দিয়াই ছুটিয়া পালাইয়া যায়।
আরোহণে পূর্ববর্তী সুরকে ধরিয়া 'ঝুলনা' বা দোলাই ইহার প্রধান বিশেষণ, দক্ষিণ সমীরণে দোলনচাঁপার দোলনের সঙ্গে ইহার গতির সামঞ্জস্য হইতে ইহার নাম দোলনচাঁপা হইয়াছে। তীব্র মধ্যম ও গা মা না ধা-র চাঁপা ফুলের সুরভির তীব্রতা ও মাধুর্য ফুটিয়া উঠে।'
[তথ্যসূত্র:নজরুল
যখন বেতারে। আসাদুল হক (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী।
মার্চ ১৯৯৯)। পৃষ্ঠা: ১২৪।]
দোলনচাঁপা সকল আনন্দের এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের তরঙ্গ। দোলন-চাঁপা রাগের অপরূপ দোল- যা হাম্বীর, কামোদ ও নট-এর রূপকে ভাগিয়ে দিয়ে আপন মহিমায় দুলে উঠে আপন মহিমায়। এই দোলনের আনন্দই এই গানের মূল সৌন্দর্য।
গানের স্থায়ীতে দোলনের আনন্দকে কবি দেখাতে চেয়েছেন- যেনো, দোল্-পূর্ণিমারাতে চাঁদের সাথে দোলন-চাঁপা ফুল দোল খায়। দোল-পূর্ণিমায় শ্যামের সাথে রাধা যেমন দোলনায় দোলে, তেমনি দোলন-চাঁপাও সবুজ-পাতার কোলে লতার দোলনাতে দোলে।
দেব-কুমারীর নির্মল হাসিই যেন দোলন-চাঁপা ফুল হয়ে পৃথিবীতে এসে দোলা খায়। যেন পূজার আরতি-প্রদীপের মৃদু জ্যোতি ফুলের কলির মতো মন্দিরের আঙিনাতে দোলে।
কবি দোলন-চাঁপার রূপে মুগ্ধ। তিনি ভাবেন বনদেবীর কানের দুলই যেনো চৈতালি চাদনী রাতে রূপালী ঝুমকা হয়ে দুলছে, যেন রাতের গোপন আনন্দের সলাজ আঁখিতারা অন্ধকারের আবরণের ভিতর দিয়ে আনন্দতরঙ্গে দুলছে।
দোলন চাঁপায় যেনো একমুঠি চন্দনের গন্ধের মতো, যা গোপিনীর গোপন আনন্দে দোলে। চন্দ্রশোভিত রাত্রিতে যেন মন চুরি করা শ্যামের নূপুর ধ্বনির ছন্দ, গোপিনীকে আন্দোলিত করে।
রেকর্ড সূত্র: ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে 'সেনোলা' রেকর্ড কোম্পানী থেকে এই গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। গানটির রেকর্ড নম্বর Q.S-456 শিল্পী: গীতা মিত্র।
বেতার: ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি বেতারে
'নব-রাগমালিকা' অনুষ্ঠানে এই গানটি প্রচারিত হয়। শিল্পী ছিলেন গীতা মিত্র।
রাগ-দোলনচাঁপা (নজরুল-সৃষ্ট)। তাল: ত্রিতাল। চরিত্র: চন্দ্রা।
(উল্লেখ্য; ১৬ জানুয়ারি, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ সংখ্যার বেতার জগতে নজরুল রাগটির সুর
বিশ্লেষণ করেছেন।)
পত্রিকা: ভারতবর্ষ, ফাগুন, ১৩৪৭ (স্বরলিপি-সহ)।
স্বরলিপি করেছেন জগৎ ঘটক। দোলনচাঁপা-ত্রিতালী।
(পাদটীকা:
"রাগটি কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত। আদি কয়েকটি রাগ রাগিণীর মিশ্রণ ফলে কত যে
নতুন রাগের সৃষ্টি এতাবৎকাল হয়ে এসেছে এবং হতে পারে, এই রাগটি তাহার অন্যতম
দৃষ্টান্ত। এমনি করেই ভারতের সঙ্গীত সম্পদ চিরদিন বৃদ্ধি পেয়ে এসেছে, ইহার
পিছনে থাকা দরকার কৃষ্টি ও প্রতিভা"।)
বি.দ্র.: বিস্তারিত তথ্যের জন্য 'বেতারে নজরুল ও তাঁর গান' গ্রন্থ
দ্রেষ্টব্য।
[সূত্র: নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা, ব্রহ্মমোহন ঠাকুর
(নজরুল ইন্সটিটিউট। মে ২০০৯)। ১৪১৯ সংখ্যক গান।
পৃষ্ঠা: ৩৮৭-৩৮৮।]
প্রকাশের কালানুক্রম: ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি বেতারে 'নব-রাগমালিকা' অনুষ্ঠানে এই গানটি প্রচারিত হয়। শিল্পী ছিলেন গীতা মিত্র। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে 'সেনোলা' রেকর্ড কোম্পানী থেকে এই গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৪১ সালে ভারতবর্ষ (১৩৪৭) সংখ্যায় গানটি স্বরলিপি-সহ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত সুনির্বাচিত নজরুল গীতির স্বরলিপি -র চতুর্থ খণ্ড (সাহিত্যম) -গ্রন্থে গানটি গৃহিত হয়েছিল। ২০০০ সালে জানুয়ারি মাসে একশো গানের নজরুল স্বরলিপি, প্রথম খণ্ড (হরফ প্রকাশনী) -গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ২০১১ সালে জুলাই মাসে শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি (হরফ প্রকাশনী) -গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ২০১২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইনস্টিটিউট) -গ্রন্থে গানটি গৃহিত হয়েছিল। ২০০৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসে নবরাগ (নজরুল ইনস্টিটিউট) -গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
খ). সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাবলী:
সুরকার : কাজী নজরুল ইসলাম।
স্বরলিপিকার:
জগৎ ঘটক। [নবরাগ (নজরুল ইনস্টিটিউট। সেপ্টেম্বর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ)]
জগৎ ঘটক। [নবরাগ (হরফ প্রকাশনী। কবির ৭৩তম জন্মদিন, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)]
কাজী অনিরুদ্ধ। [সুনির্বাচিত নজরুল গীতির স্বরলিপি, চতুর্থ খণ্ড (সাহিত্যম্। সেপ্টেম্বর ১৯৭৮)]
নিতাই ঘটক। [শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি (হরফ প্রকাশনী। Deluxe Edition : July 2011)]