শ্রবণ নমুনা
অলকানন্দা সুবৃতা [শ্রবণ নমুনা]

                   ১৭২৯
      রাগ : নির্ঝরিণী (নজরুল-সৃষ্ট),
            তাল:ত্রিতাল।     
  

 রুম্‌ ঝুম্‌ রুম ঝুম্‌ কে বাজায় জল-ঝুম্‌ঝুমি।
 চমকিয়া জাগে ঘুমন্ত বনভূমি

            দুরন্ত অরণ্যা গিরি-নির্ঝরিণী
              রঙ্গে সঙ্গে ল'য়ে বনের হরিণী,
 
শাখায় শাখায় ঘুম ভাঙায় ভীরু মুকুলের কপোল চুমি'

 কুহু-কুহু কুহরে পাহাড়ি কুহু পিয়াল-ডালে,
 
পল্লব-বীণা বাজায় ঝিরিঝিরি সমীরণ তা'রি তালে তালে।

              সেই জল-ছলছল সুরে জাগিয়া
              সাড়া দেয় বন-পারে বাঁশি রাখালিয়া',
 
পল্লীর প্রান্তর ওঠে শিহরি' বলে
'চঞ্চলা কে গো তুমি'॥  
                

ভাবসন্ধান : নব রাগমালিকা গীতিনাট্যের প্রথম গান। গীতিনাট্যের কারণে এই গানের শুরুতেই রয়েছে- নির্ঝরিণী তথা ঝর্‌নাধারার ধ্বনি মাধুর্যে উদ্বেলিত তীর-ধনুক হাতে বন-কিশোরের গেয়ে উঠা গান। রাগ সৃষ্টির প্রেরণায় নজরুল সৃষ্টি করেছিলেন 'নির্ঝরিণী'। তিনি এই রাগের নামটিই অপূর্ব কৌশলে ব্যবহার করেছেন এর বাণী অংশে। তাই রাগ-নির্দেশনা হিসেবেই গীতিনাট্যের শুরুর দুটি পংক্তিতে উল্লেখ করেছেন-

'নিবিড় অরণ্য মাঝে বয়ে যায় ঝর্ণাধারা। অবিচ্ছিন্ন ঝর ঝর সুরের প্রবাহে পাখির পালক বাঁধা তীর-ধনুক হাতে গেয়ে উঠে ঝর্ণা তীরে বনের কিশোরঃ'

এই বর্ণনাটুকু এই গানের ভূমিকা হিসেবেও গ্রহণ করা যায়। এই ভূমিকার পরেই 'বন-কিশোর'-এর গানে উদ্ভাসিত হয় ঝর্‌নার ধ্বনি ও রূপসৌন্দর্যে বর্ণাঢ্য হয়ে। এ গানের সুরকে বাদ দিলেও, শুধু বাণী হয়ে উঠে এক অনির্বচনীয় নান্দনিক অভিব্যক্তি। বনকিশোরের এই গানে আমরা পাই অরণ্য-নির্ঝরের ধ্বনিচিত্র। যা মনের গভীর তলে দর্শন ও শ্রবণের এক নান্দনিক চিত্র মেলে ধরে। যে শুধু দেখার নয়, শুধু শোনার নয়। শধুই অনুভবের।

গানটি শুরু হয়েছে উচ্ছল ঝর্‌নার চলমান মধুর ধ্বনির মোহিত ধ্বনি সৌন্দর্যের কথা। কবি কল্পনায় তা জল-ঝুমঝুমী। গানটির প্রথম পংক্তির 'রুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ রুম্ ঝুম্', অনুপ্রাসের ধ্বনি-প্রবহমানতার ধ্বনিমাধুর্যে অলঙ্কৃত হয়ে উঠে। অবিরাম জল-ঝুমঝুমীর শব্দে ঘুমন্ত অরণ্য জেগে উঠে। বনের হরিণী রঙের খেলায় মেতে উঠে, পুষ্পকোড়ক বর্ণিল দল মেলে দেয়, বনকোকিলের কুহু ধ্বনিতে ভরে উঠে, গাছের পাতার শব্দও হয়ে উঠে ঝিরি ঝিরি বাতাসের সাথে মিশে বীণার মধুরধ্বনি। সব মিলিয়ে অরণ্য হয়ে উঠে ধ্বনি ও দৃশ্যের মোহনীয় আবেশে নান্দনিক। এই আবেশে অরণ্যকে উদ্বেলিত করে রাখালিয়াকে। তার বাঁশির সুরে লাগে জল-ঝুমঝুমীর ছোঁয়া, পল্লীপ্রান্তর আবেশিত হয়, রোমাঞ্চিত হয়।

১. প্রকাশ ও গ্রন্থভুক্তি :

২. রেকর্ড সূত্র: পাওয়া যায় নাই।

৩. রচনাকাল: ১৯৪০ বঙ্গাব্দের ১৩ই জানুয়ারি, সন্ধ্যা ৭.০৫টায় কোলকাতা বেতার থেকে 'নব রাগমালিকা' নামক একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। ধারণা করা হয়, এই অনুষ্ঠানের জন্য নজরুল ইসলাম এই গানটি রচনা করেছিলেন। এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪১ বৎসর।

৪. প্রাসঙ্গিক পাঠ:  

  • ১৯৪০খ্রিষ্টাব্দের ১৩, জানুয়ারি মাসে  বেতারে (নবরাগমালিকা-অনুষ্ঠানে) এই গানটি প্রচারিত হয়। শিল্পী ছিলেন-গীতা মিত্র।
  • নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ (নজরুল ইন্সটিটিউট, মাঘ,১৪১৮। ফেব্রুয়ারি,২০১২) নামক গ্রন্থের ১৭২৯সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা:৫১৫। -গানটির ৯ম লাইনে একটি পাঠভেদ উল্লেখ করা আছে,--
    'বউ কথা কও কোকিল পাপিয়া' পঙক্তিটি অতিরিক্ত আছে।

৫. সুরকার: কাজী নজরুল ইসলাম।

৬. স্বরলিপিকার:

  • জগৎ ঘটক। [বরাগ (নজরুল ইনস্টিটিউট, সেপ্টেম্বর ২০০৫) -এর ৫ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ১১-১২]।
  • কাজী অনিরুদ্ধ। [সুনির্বাচিত নজরুল গীতির স্বরলিপি, চতুর্থ খণ্ড, (সাহিত্যম্‌, আশ্বিন ১৩৮৫। সেপ্টেম্বর ১৯৭৮) -এর ৭৫ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা: ১৬০-১৬১]।

৭. সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাবলী: গানটির গতি চঞ্চল, বেতার জগতের প্রকাশিত রাগ পরিচিতির সাথেই এই নিরদেশ পাওয়া যায়। গানটি ত্রিতালে নিবদ্ধ। কিন্তু চতুর্মাত্রিক এই তালের চলনের ভিতরে ত্রিমাত্রিক চলনের সাথে ভিতরে ১ মাত্রার ধাক্কায় চটুল ছন্দ ফুটে উঠে।  রুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ রুম্ ঝুম্ এই ছন্দে চলতে চলতে পঞ্চম থেকে তারার ষড়্‌জে মীড় দিয়ে ছন্দকে চতুর্মাত্রিকে পৌঁছে দেয়। এই মীড়কে আশ্রয় করে কে ধ্বনিটি হয়ে উঠে উৎসুক্যবাচক। যার ফলে বাণী ও সুরে মহামিলন ঘটে। ছন্দের এই খেলা, স্বরের উল্লম্ফন এবং বাণীর আবেদনে স্বরের এরূপ পরিবর্তন গানটির পুরো অংশ জুড়ে রয়েছে। সেই সাথে রাগরূপের সাথে সমন্বিত হয়ে কোমল ধৈবতে স্থিতি লাভ করে 'বাজায়'। তারপরে 'জল্ ঝুমঝুমি'-তে সেই চটুল চলেন ফিরে আসে। এক্ষেত্রে মগ ম ঋ স। স্বর-ছন্দবিন্যাস মধুর বিরাম এনে দেয়। এই গানের বাণী, সুর ও ছন্দের অপূর্ব লীলা খুঁজে পাওয়া যায়- শেষ অব্দ। শুধু রাগের বিচারে নয়, গানের সামগ্রিক রূপের বিচারে এই গানটি নজরুলের সঙ্গীতসৃষ্টি এবং ভাবনার একটি নতুন দিক আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে উঠে।

রাগ:  নির্ঝরিণী
তাল :
ত্রিতাল।
গ্রহস্বর :
সা।